Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রথম চিঠি

প্রথম চিঠি -- সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

দৃশ্য ১

ড্রয়িং রুম। সন্ধেবেলা। ঘড়িতে ঠিক সাতটা। টিভিতে খবরের সময়। সংবাদপাঠিকা লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির খবর পড়ছেন— এখনকার বিশেষ বিশেষ খবর হল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছেন যে, লকডাউনের মেয়াদ আগামী ১৭ মে পর্যন্ত বাড়ানো হল…। খবর পড়া চলতে চলতে থাকে, তবে তার আওয়াজ আস্তে আস্তে মিউট হয়ে যায়।

 

দৃশ্য ২

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসে খবর শুনছিলেন। ভদ্রলোকের নাম অমিত মৈত্র। বয়স ৫০-এর মতো। চোখমুখের ভঙ্গিমা থেকে বোঝা যায় তিনি খবরের বয়ানে বেশ বিরক্ত হয়েছেন। খানিকটা স্বগতোক্তি করে বলেন—

অমিত: ডিজগাস্টিং। আর কতদিন এমন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে কে জানে!

তারপর কণ্ঠস্বরে খানিক পরিবর্তন এনে ব্যস্ততার সুরে বলেন—

অমিত: কই গো, চা হল?

 

দৃশ্য ৩

রান্নাঘরের দৃশ্য। গ্যাস জ্বলছে। ওপরে চায়ের প্যানে টগবগ করে জল ফুটছে।

এক মহিলার কেবল হাত নাড়া দেখা যায়। নব ঘুরিয়ে গ্যাস স্টোভটা বন্ধ করেন। গরম জলে চা-পাতা ঢালেন। ট্রে-তে কাপ বসিয়ে লিকার ঢেলে দুধ দিয়ে হালকা হাতে চামচ নাড়েন।

মহিলার নাম তনিমা মৈত্র। বয়স ৪৫+।

 

দৃশ্য ৪

ড্রয়িং রুম থেকে অমিত তাড়া দেন। একটু চড়া স্বরে বলেন—

অমিত: কী হল তনু? সন্ধেবেলার চা কি শেষে মাঝরাতে পাব?

 

দৃশ্য ৫

তনিমা: আরে বাবা, হয়ে গেছে! একটু ধৈর্য্য ধরো। একা হাতে সবদিক সামলানো… [খানিকটা বিরক্তি ঝরে পড়ে তনিমার কণ্ঠে]

 

দৃশ্য ৬

তনিমা রান্নাঘর থেকে ট্রে হাতে ড্রয়িং রুমে আসে। [ঢোকা পর্যন্ত]

 

দৃশ্য ৭

ঘরে ঢুকে ট্রে-টা টেবিলে রাখে। তারপর একটু ঝাঁঝালো স্বরে বলে—

তনিমা: লকডাউন হয়েছে বলে কি ঘরের ভেতরেও নড়াচড়া করতে নেই? বাপ-ছেলে দুজনেই কুঁড়ের বাদশা আর শাহজাদা হয়েছে! দেখছ এক হাতে সব করতে হচ্ছে! একটু উঠে নিয়ে এলে ক্ষতি কী?

 

দৃশ্য ৮

অমিত চায়ের কাপে একটা দীর্ঘ, আয়েসি চুমুক দেয়। তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে বলে—

অমিত: ওহ! দারুণ। বুঝলে তনু, ওপরওয়ালা অনেক ভেবেচিন্তেই তোমাকে আমার ঘরে পাঠিয়েছেন ঘরণী করে। না হলে…

 

দৃশ্য ৯

তনিমা [চায়ের কাপ হাতে]: থাক! এই ভরসন্ধেয় আর আদিখ্যেতা করতে হবে না! [একটু বিরক্তি] শান্তিলতা যে কবে আসবে! আর পারি না বাপু! একা হাতে সব কিছু সামলানো যায়! একটু খোঁজ নিলে পারতে! ও বাড়ির মঞ্জু তো দিনে একবার করে কাজে আসছে…

 

দৃশ্য ১০

অমিত [হাসতে হাসতে]: দেবী! সে গুড়ে বালি। এইমাত্র খবরে বলল— লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হল সংক্রমণের আশঙ্কার কারণে…

 

দৃশ্য ১১

তনিমা [হতাশ ও বিরক্ত সুরে]: আবার! তার মানে তোমার আদরের বোন শান্তিলতা দেবীর কাজে না আসার অজুহাত বেড়ে গেল। তখনই বলেছিলাম, লেখাপড়া শিখিও না। কাজের লোকেদের পেটে অক্ষরের জল পড়লেই বিগড়ে যায়। দাবিদাওয়া, অধিকার— এসব শব্দ শিখে যায়। এই তো, নতুন মাস পড়ল। মাইনের টাকা রেডি রেখো। এল বলে মাসকাবারি তোলা নিতে…

 

দৃশ্য ১২

অমিত: আহা! এভাবে বলছ কেন তনু? এমন একটা অবস্থার মধ্যে যে আমাদের পড়তে হবে, তা কি আগেভাগে আঁচ করতে পেরেছিলাম কেউ? শান্তির বর, শৈলেন, নিশ্চয়ই কারখানার কাজ খুইয়ে ঘরে বসে আছে। এখন তো সবারই পুঁজি ভেঙে খাওয়া। সবাইকেই একটু মানিয়ে চলতে হবে। তা তোমার গুণধর পুত্রটিকে তো অনেকক্ষণ দেখছি না। তিনি গেলেন কোথায়?

 

দৃশ্য ১৩

তনিমা [রাগত কণ্ঠে]: কথার কী ছিরি! এ সময়ে— আমার পুত্র! এখন তো আমরা সবাই প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাসী মানুষের জীবন কাটাচ্ছি। যাবে আর কোথায় এই লকডাউনের মধ্যে! নিজের ঘরেই আছে। বাকযন্ত্র হাতে নিয়ে বিশ্বপরিক্রমা করছে। ওদের এত কী কথা থাকে বুঝি না বাপু! [কথায় ও শরীরে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে]

 

দৃশ্য ১৪

অমিত হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর হাসির দমক থামিয়ে উচ্চকণ্ঠে একটু আবেগমাখা প্রশংসার সুরে বলে—

অমিত: তনু! তোমার জবাব নেই। এই কথাগুলো আমি রেকর্ড করে রেখেছি। এটা হল কোটেশন অফ দ্য ডে! ভেরি ওয়েল সেইড! দারুণ বলেছ— বাকযন্ত্র হাতে নিয়ে বিশ্বপরিক্রমা! লকডাউনের মধ্যেও এমন রসিক মনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমাকে স্যালুট!

 

দৃশ্য ১৫

অমিতের ছেলে অরণ্যের ঘর। বেশ এলোমেলো। খাটের ওপর সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। ক্যামেরা এসব ছবি থেকে সরে এসে মূল চরিত্র অরণ্যের ওপর জুম করে।

অরণ্য মৈত্র। বয়স ২২+। পরনে একটা গেঞ্জি। তার ওপরে বুকের কাছে লেখা— Life is a journey। কালো রং। সঙ্গে বারমুডা। মাথার চুল এলোমেলো। মুখে খোঁচা খোঁচা না-কামানো দাড়ি। কানে ফোন ধরে ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে কথা বলছে হেঁটে হেঁটে। হাত নেড়ে নেড়ে। হঠাৎ একটা সোফায় বসে পড়ে। কথা চলতে থাকে…

অরণ্য: এই মন্টি, শোন না… লকডাউনের মধ্যে একটা মিউজিক ভিডিও বানালে কেমন হয়?… আরে না না, বাইরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই… দেখছিস না লোকজন কেমন ক্ষেপে উঠেছে… আরে ইউটিউবে ঋকদের ভিডিওটা দেখেছিস? … শোন না, সিলেকশনটা ভাইটাল। এটা নিয়ে তুই ভাব… ভাইব্রান্ট কিছু ভাববি… ঠিক আছে… সবাই আলাদা আলাদা শুট করবে… না না, আমি প্রবীর আঙ্কেলকে বলব, খুব ভালো এডিট করে… আমি স্বর্ণালী আর দীক্ষার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি… গেট প্রিপেয়ারড ইয়ার… দেখিস মালটা যেন হ্যাটা না হয়… বাই!

ফোন নামিয়ে খুশিতে গুনগুন করে সুর ভাঁজে।

 

দৃশ্য ১৬

রান্নাঘর। তনিমা সিঙ্কে কাপডিশ ধুচ্ছে। বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলে…

তনিমা (বিরক্তি সহকারে): নাও! এখন ঠেলা সামলাও! এই তো নতুন মাস পড়ার সময় হল। আজকালের মধ্যে মহারানি এসে হাজির হবেন তার এ মাসের নজরানা নিতে। হাড়মাস এক করে উদয়াস্ত খেটে মরছি আমি! আর…

হঠাৎ ডোরবেল বেজে ওঠে দুবার। আওয়াজ শোনা যায়। তনিমা খুব অবাক হয়। কাপড় দিয়ে কাপডিশগুলো মুছতে মুছতে বলে…

তনিমা: ডোরবেল বাজছে! এই লকডাউনের মধ্যে!! শান্তিলতা? কথা ভাবতে না ভাবতেই এসে হাজির! এখনও তো মাস শেষ হতে দুদিন বাকি!… বাপ্পা, এই বাপ্পা! দরজাটা খুলে দেখ তো কে এল?

 

দৃশ্য ১৭

অরণ্যর ঘর। অরণ্য ওরফে বাপ্পা খাটে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে। মোবাইলে ব্যস্ত। মায়ের কথা কানে যেতে সজাগ হয়। দরজা খোলার জন্য বিছানা ছেড়ে ওঠে। দরজা খুলতে এগোয়…

অরণ্য: দাঁড়াও আসছি… লকডাউনের মধ্যে এত রাতে আবার কে এল!

 

দৃশ্য ১৮

অরণ্য দরজা খোলে। কাউকে দেখতে পায় না। অবাক হয়।

অরণ্য: কই, কাউকে দেখছি না তো! মা, তুমি নিশ্চয়ই ভুল শুনেছ…

দরজা বন্ধ করতে যায়। আর করতে গিয়ে থমকে যায়। পায়ের সামনে একটা খাম পড়ে আছে। অরণ্য খামটা তুলতে নিচু হয়। খামটা তোলে, একনজর দেখে, বলে—

অরণ্য: একটা খাম! স্ট্রেঞ্জ! বেল বাজিয়ে খাম রেখে গেল কে! লকডাউনের বাজারে কত কিছুই যে হচ্ছে…

 

দৃশ্য ১৯

অরণ্য খামটা নিয়ে ভেতরে ঢোকে। মায়ের উদ্দেশ্যে একটু চেঁচিয়ে বলে—

অরণ্য: মা, একটা খাম! বোধহয় কেউ রেখে গেছে। এই এখানে রাখলাম। মন্টি ইজ ওয়েটিং ফর মি ওভার ফোন।

প্যাসেজের একটা ছোট টেবিলের ওপর খামটা রেখে অরণ্য নিজের ঘরের দিকে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যায়। তনিমা ফ্রেমে ঢোকে, একটা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে। রান্নাঘর থেকে এসেছে। টেবিল থেকে খামটা হাতে নেয়। চোখেমুখে বিস্ময়। অভিব্যক্তিতে দ্বিধার ভাব স্পষ্ট। ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে বলে—

তনিমা: খাম! কে রেখে গেল? হাউজিং-এর নোটিস? না কেউ ঠাট্টা করে রেখে গেল? দেখি তো…

খামটা খুলতে ভেতর থেকে একটা চিঠি বের হয়।

 

দৃশ্য ২০

ড্রয়িং রুম। অমিত সোফাতেই বসে আছে। জিজ্ঞাসু চোখমুখ।

অমিত: কে এল তনু? কিসের খাম?

 

দৃশ্য ২১

তনিমা চিঠিটা হাতে নিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে ঢোকে।

তনিমা: কেউ আসেনি… একটা চিঠি…

 

দৃশ্য ২২

অমিত চোখ থেকে চশমাটা খুলে ডানহাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলে—

অমিত: চিঠি! ইন্টারেস্টিং! পড়ো দেখি খুলে। এ তো দেখি সোশাল ডিসট্যান্সিং-এর নয়া তরিকা… [নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে]

 

দৃশ্য ২৩

তনিমা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে চিঠির ভাঁজ খুলে সামনে ধরে…

তনিমা: অক্ষরের ছাঁদ দেখে তো মনে হচ্ছে কোনও বাচ্চার লেখা। চিন্টু নয় তো? এখানে আসতে পারছে না বলে মজা করে চিঠি পাঠাল? ‘দাদা ও বৌদি’! নাঃ! চিন্টু তো দাদা-বৌদি বলবে না। ‘তোমরা আমার প্রণাম নিও। কেমন আছ সকলে? আমরা সকলে মোটামুটি ভালো আছি…’

 

দৃশ্য ২৪

ক্যামেরা তনিমার হাতের চিঠিটার ওপরে এসে স্থির হয়। চিঠির ভেতরে এ বাড়ির পরিচারিকা শান্তিলতার মুখ ভেসে ওঠে। বাকি চিঠিটা সেই পাঠ করে…

শান্তিলতা: বৌদি, আমার কথা ভাবছিলে তো? ভাবছিলে, কবে আবার শান্তিলতা আসবে এ-মাসের মাইনে নিতে? না গো বৌদি, এ মাসে আর তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমি আর বিল্টুর বাবা মিলে ঠিক করেছি এ মাসের মাইনে আমি নেব না। কাজ করলাম না, মাইনে নেব কী করে! অধম্ম হবে না! আর সমস্যা তো এখন ঘরে ঘরে। খামোখা তোমাদের ওপর চাপ বাড়ালে চলবে কেন! বরং এতদিনের মতো সুখদুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নিই সকলে। আর তো কটা দিন। লকডাউন কাটলেই তোমাদের শান্তিলতা আবার হাজির হয়ে যাবে। ভালো থেকো। বাইরে বেরোলে মুখে মুখোশ এঁটে নিও কিন্তু। বাপ্পাবাবা কেমন আছে?— ইতি শান্তিলতা।

 

দৃশ্য ২৫

তনিমার মুখ। চিঠি হাতে। বিমূঢ়। আনমনেই পাতা ওল্টায়। আরেকটু লেখা দেখতে পায়…

তনিমা: পুনঃ। অক্ষর চেনার পর এই হল আমার প্রথম চিঠি বৌদি। নিজের হাতে লেখা চিঠি। ভুল হলে মাফ করে দিও। হাতে এখন অঢেল সময়। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে এটা লিখে ফেললাম। মঞ্জুকে দিয়ে পাঠালাম…

 


*এই চিত্রনাট্য পড়ে কেউ চিত্ররূপায়ণে আগ্রহী হলে অবশ্যই চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।