টিন, লোহা, রামরাজ্য বিক্রি আছে
তোমরা বুঝি রামরাজ্যের স্বপ্ন বেচতে এসেছ?
বোসো… বোসো… কী ভাগ্যি আমাদের…
শুনলাম গুহক চণ্ডালের ঘরে আজ প্রাতরাশও করেছ?
বেশ… বেশ…
তোমার রামরাজ্যে কোনও রহিম থাকবে না তো?
বেটি বাঁচাওয়ের নামে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলবে?
বলো কী, পাতাল প্রবেশও দেখতে পাব?
আরেব্বাস !
এ কি কম কথা নাকি যে
যখন পৃথিবীটা হুড়ুম দুড়ুম করে এগিয়ে যাচ্ছে,
আমরা তখন টাইমমেশিনে চড়ে সোওওজা রামরাজ্যে পৌঁছে যাব…
একটা কথা বলি তোমাদের চুপিচুপি?
আমি না তোমাদের চিনে ফেলেছি।
না না, আর কাউকে এখনও বলিনি…
তোমরা তো সেই লবকুশ।
যারা জন্মের পর বাপের মুখ দেখেনি।
আর একটু সেয়ানা হয়েই মায়ের অপমান ভুলে,
রাজ্যলোভে পায়ে পায়ে অযোধ্যায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দ্যাখো সেই অযোধ্যা এবারও তো উদ্ধার করেই ফেলেছ।
শুধু রামরাজ্যটা বাকি…
শোনো কুলাঙ্গার,
আবারও বলছি
আমি চিনি তোমাদের।
আর তাই আমি চাই না এখানে কোনও রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক।
আমি চাই শম্বুকেরও থাক সংবিধান পাঠের অধিকার।
কী করে ভুলি বলো তো,
তোমাদের পাওয়ার পর স্বয়ং রামচন্দ্রকেই একদিন সরযূ নদীতে ডুবে মরতে হয়েছিল…
জেগে আছি। জেগে থাকতে হয়
খবরগুলো ফিরে ফিরে আসে।
একেকজন করে চলে যায়।
আর আমার শার্সিতে
উৎকণ্ঠা এসে ধাক্কা দেয়।
তুমি তো ভালো নেই…
তোমাকে ওরা বৃদ্ধ ভেবে
দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চাইছে।
ওঃ! কী অসম্ভব ভয় ওদের
তোমাকে নিয়ে।
কী করেছিলে তুমি?
গর্জন করেছিলে।
অন্যায়কে অন্যায়ই বলেছিলে।
নিয়মভঙ্গ করে,
বোবা ঠোঁটে কথা জুগিয়েছিলে।
তুমি জানতে না,
মারাত্মক অপরাধ এসব? এ দেশে?
একমাত্র ‘জো হুজুর’ বলার স্বাধীনতা
আমরা সাতচল্লিশ সালে পেয়েছিলাম ।
তুমি মানতে পারোনি তা।
ভালোবাসার কয়েক হাত জমি
তুমি বানাতে চেয়েছিলে,
অপমানিত বিধ্বস্ত নুয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য।
তাই তোমার ক্লান্ত বলিরেখাকেও,
ওরা ভয় পেয়েছে।
কিন্তু ওরা বুঝতে পারছে না,
শেকলের দাগ যত গাঢ় হয়ে বসবে তোমার শরীরে,
যত কালশিটে জমবে তোমার
ওই সব বিদ্যুৎ ছোঁয়া আঙুলে,
তত ‘তুমি’ জেগে উঠবে আমাদের বুকে।
একদিন ওরা দেখবে,
জনৈকের ভিড়ে,
সান্ত্রীর পোশাকে,
দিনমজুর বেশে,
ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম ছেড়ে,
ক্রোধে ঘৃণায় গনগনে কয়েকটা মানুষ,
একটু একটু করে ভারভারা রাও বনে যাচ্ছে।
ছড়িয়ে পড়ছে মানচিত্র জুড়ে…
ঘিরে ফেলেছে ক্ষমতার বলয়…
মুখোশ ধরে টান মারছে…
জানি, ওরা তোমার চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলবে।
উৎকণ্ঠা পেরিয়ে একদিন,
সেই ভয়ানক খবরটা ডাকবাক্সে এসে ঢুকবেই।
মৃত্যু মাত্রই বেদনার।
কিন্তু কোনও কোনও মৃত্যু
এমনও হয় যেদিন,
গুটি কয়েক মানুষ মনে মনে ‘তুমি’ হয়ে ওঠার দুঃসাহস দেখায়।
ফাঁকা পেট আর সোজা শিরদাঁড়া নিয়ে
ভুখ্ হরতালে বসে।
তোমার আগুন থেকে পাঁজর জ্বালিয়ে নেয়।
আর শৃগালের চোখে চোখ রেখে বলে,
– শেয়াল কখনও প্রকৃত
জঙ্গলেরই রাজা হতে পারে না।
মানুষের জঙ্গল তো দূর অস্ত্ …
যে হাতগুলোকে ছেড়ে এসেছিলে
কেন মনে হল কিছু না জেনেই পথে নেমেছি?
জানতাম আগেই অস্ত্রহীনের ওপর অস্ত্র প্রয়োগে পটু তুমি।
একটা মেয়েকেও যদি লকাপে পাও, সুযোগ ছাড়বে না।
একবারও মনে পড়বে না কোনও
ভাই
বোন
সন্তান
কিংবা মায়ের মুখ…
রাষ্ট্র তো আমারও!
তাকে দেখব বলেই আজ আমি মিছিলের কয়েক পা…
কিন্তু তোমার আর আমার দেশ…
এক হয়েও এক না।
চারদিক বন্ধ করে যাদের দিকে আজ টিয়ার শেল ছুড়লে…
জলকামান হানলে…
চোখ ফুটো করে দিলে…
তারা তোমার ঘর থেকেই আজ পথে বেরিয়েছিল।
হতভাগ্য পিতা, তুমি আজ সন্তানকে চিনতে পারলে না।
সিগারেটের ছ্যাঁকায় যার চামড়া পোড়ালে,
একদিন সে তোমাকে ভাই ডেকেছিল।
অনেকখানি তলিয়ে গেছ।
তবু আরও আরও গভীরে যাও।
শুনেছি ডুবে যেতে যেতে সব স্মৃতি ভেসে ওঠে।
কিন্তু সত্যিই যদি তুমি তখন ওদের চিনতে পারো?
যদি ঘেন্নায় নিজের মুখটাকে ছুড়ে ফেলতে চাও?
তোমায় ঘরে ফেরার রাস্তা কে বলে দেবে তখন?
তোমার পাড়াটাকে ওরা নির্বাসন দিয়েছে।
তুমি বরং তখন সেই দুঃখী মানুষটা সেজো,
যার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে না কোথাও…
খোকা তোর ভয় করছে না তো?
প্রিয় বিভীষণ,
এত সৎকার পেরিয়ে,
চৌকাঠে চৌকাঠে অপেক্ষাকে পার করতে করতে,
পৌঁছতে পেরেছ আজ অযোধ্যার তোরণে?
পথে পড়েনি তো কোনও মৃত্যু?
কোনও দাবি?
নিরন্ন কৃষকের একরোখা জেদ?
কিংবা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ভরা নো-ম্যান্স ল্যান্ডের জনবসতি?
এ দেশে প্রশ্ন নিষিদ্ধ, জানি।
কিন্তু আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারি না,
গুজরাট
কাশ্মীর
আসাম
উত্তরপ্রদেশ
বাবরি
কার্ফু
সেনা টহল
আরও… আরও… সব দৃশ্য…
হায় রে রামরাজ্য…
এ পোড়া নাকে
কেবল সীতার চামড়া পোড়া গন্ধ আসে।
অন্ধকার থেকে দুঃসাহসী প্রশ্ন ছুটে আসে,
কে পুড়ছে ওখানে?
কাকে তোমরা পুড়িয়ে দিলে…
আমার সন্তানেরা নিখোঁজ।
একদিন অরণ্য থেকে,
পাহাড় থেকে,
নদী পেরিয়ে,
নেমে আসবে ওরা।
আগুনখেকো…
পুড়িয়ে দেবে সব তোষণনামা।
বাছা আমার, যজ্ঞ শেষ কর্।
প্রস্তুত হ।
আজ থেকে কোনও মেঘনাদ,
বালি,
অন্যায় যুদ্ধে আর মরবে না।
দাঁড়িয়ে আছি নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের দ্বার আগলে।
অষ্টাদশ পুরাণ সাক্ষী
লক্ষ্মণের সঙ্গে আজ এক মায়ের যুদ্ধ হবে…
কাল হরতাল, কাল চাক্কা বনধ্
তোমার লাঠির ঘায়ে যেখানে রক্ত ঝরল আজ,
দেশ জেগে উঠল ঠিক সেখানে সেখানেই।
মুখ থুবড়ে পড়া নিঃশ্বাসে, কিছুটা ধুলো উড়ে গেল।
হাহাকার করে উঠল মাটি।
রক্তাক্ত সন্তানকে বুকে চেপে মাটি চিৎকার করে উঠল।
মাইনে মাইনে মাইল পেরোল।
বিস্ফোরণ…
উর্দি উড়ে গেল।
উড়ে গেল কুর্নিশ আর গোলামি।
ছিটকে পড়ল মান্যবর নেতার ঘিলু হাত তিনেক দূরে।
আমাদের রক্তের গন্ধে তোমাদের তৃপ্তি জেগেছিল,
আর তোমাদের চামড়া পোড়া গন্ধে
ভাঙা পাঁজর ভরে শ্বাস নিচ্ছে মাটি।
ভোরের কাগজে তোমাদের মৃত পড়ে থাকতে দেখে,
একটুও বিষণ্ণতা আসবে না আমার আর কোনওদিন।
দেশ আজ কানে কানে বলে গেছে,
মৃত সন্তান কোলে আর কোনও মা স্ট্যাচু হয়ে বসবে না গলির মোড়ে।
কিন্তু সন্তানের রক্তের ঋণ,
এভাবেই শুধে যেতে হবে তোমাদের, আগামীতে…
আরও…
অযুত কাল ধরে…