Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নীলকণ্ঠের জীবন ও সাহিত্য

অজিত রায় | সাহিত্যিক

শুভম চক্রবর্তী

 




কবি ও সম্পাদক

 

 

 

অজিতদা নীলকণ্ঠ ছিলেন। আমরা বুঝতে পারিনি। এক কবি আমায় রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেন ধরার আগে বলেছিলেন—“ওসব ওর ভান”। আমি মৃদু হেসেছিলাম। অজিতদাকে সে কথা বলায় তিনিও  মৃদু হেসেছিলেন। আমরা জানতাম অক্ষমের ঈর্ষা যতটা প্রবল, ততটা আর কিছুই নয়। একদিন অজিতদা মার খেয়েছিলেন, তার পরেরদিনও অজিতদা মার খেয়েছিলেন আর তারপরের দিনও। কিন্তু সব মার শারীরিক নয় বলেই বেদনা আরও প্রবল। একদিন অজিতদার মুখে কেউ বেল্ট দিয়ে মেরেছিল, আর তারপরের দিন অণ্ডকোষে লাথি। এবং তারপরের দিন আবার বেল্ট দিয়ে মেরেছিল এবং আবার অণ্ডকোষে লাথি। এমনই ধারাবাহিক নির্যাতন সহ্য করার চওড়া কপাল ছিল তাঁর অথবা যাতনাভূমিও বলা যায়। স্ত্রীবিয়োগে তিনি তেমন দুখী হননি কারণ— “কষ্ট বা বেদনার স্মৃতিগুলো এত ক্রুর ও প্রখর যে এই নতুন যন্ত্রণাটা ছায়াও মেলে না” অজস্র বিষ খেতে খেতে তিনি অসামান্য অমৃত বমন করলেন। তিতির হয়ে তাই খুঁটে খাওয়া আর তাঁর জন্য কষ্ট পাওয়া ছাড়া আপাতত আমার কোনও কাজ নেই।

 

অজিত রায় সাহিত্যে আপাদমস্তক নিমজ্জিত ছিলেন। সাহিত্য তাঁর ‘অবসর বিনোদন’ ছিল না। তিনি বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক সময়ের একমাত্র ‘ফুলটাইম গদ্যকার’। অথচ লেখা পেশা হলে যে কী মারাত্মক ব্যাপার হয়। তা আমরা বছরবিয়ানো লেখাপত্তর পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছি। অজিত রায় তৎক্ষনাৎ কিছু করতেন না। ভাবনার ফল্গুস্রোত তাঁকে ভাসাত। তারপর ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে বেরিয়ে আসতো একটা ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘ঘামলাঘাট’ বা ‘নিরুজের রক্ততৃষা’। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে তেমনভাবে না লিখেও যাঁরা পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছেন অজিত রায় তাঁদের অন্যতম একজন। আটের দশকের মাঝামাঝি তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। আট ও পরবর্তী দশকগুলিতে  উপন্যাস, ছোটোগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ফিল্ম-স্ক্রিপ্ট, আত্মজীবনী, অনুবাদ, গবেষণাধর্মী রচনা, পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনা প্রভৃতি বহুবিধ সাহিত্যতাত্ত্বিক প্রকল্পে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তাঁর রচনার বহুমাত্রিক চরিত্র এবং স্বীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র স্বকীয়তা লক্ষ্য করেই বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায় নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেই লিখেছিলেন– “গদ্যে নতুন দিগন্ত দেখা দেবে, ভাবা যায়।” — যে কথা পরবর্তী কালে প্রমাণ হয়েছে। এই মুহূর্তে অজিত রায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের অন্যতম ব্যতিক্রমী ও অগ্রণী এক স্রষ্টা।

 

অজিত রায়ের প্রথম উপন্যাস ‘দোগলাচরিত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সেই উপন্যাসে  তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্যশৈলী ছিল অনেকাংশে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের রচনা দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু অচিরেই তিনি সেই প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন হয়তো টেক্সট থেকে প্রভাবের বিযুক্তিকরণের কাজেই কেটে যায় তাঁর চার বছর(১৯৮৮-৯২)। কিন্তু এই পর্বেই চলছিল নতুন গদ্যভাষা নির্মাণের প্রস্তুতি। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ উপন্যাসে আমরা তাঁর নতুন গদ্যভাষাকে প্রত্যক্ষ করব, যা ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ‘ যোজন ভাইরাস’ উপন্যাসে একটি তুরীয় বিন্দুকে স্পর্শ করবে। ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ এবং ‘যোজন ভাইরাস’ এই দুটি উপন্যাসের মাঝামাঝি আছে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘পাপরাৎজি’ যা আমার মতে ‘যোজন ভাইরাস’ এর বহুভাষিক টেক্সটের পূর্বে একটি পরীক্ষামূলক গদ্য-অভিজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসে ‘যোজন ভাইরাস’ নানাদিক থেকেই উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাস। আগাগোড়াই যৌনতার মনস্তাত্ত্বিক প্রস্থানকে কেন্দ্র ক’রে রচিত এই উপন্যাসের গদ্যভাষায় যে বহুপরত অনেকগুলি স্তর আছে যা পাঠককে বারবার পড়ে উপলব্ধি করতে হয়। বিবিধ  ডিসকোর্স থেকে যোজন ভাইরাসের  আলোচনা করার বিস্তৃত পরিসর আছে। কিঞ্চিৎ আলোকপাত করি।   অজিত রায়-এর যোজন ভাইরাসের উলটোপিঠ জোখিম কোরকাপ এবং জোখিম কোরকাপের উলটোপিঠ যোজন ভাইরাস। যুগপৎ নর ও নারীর যৌনতাকে অ্যাড্রেস করেই লেখা হয়েছে এই উপন্যাস দু’টি। তবে এই যৌনতা শুধু শারীরিক নয়, মনের নানান গ্রে শেড, যৌনতার সঙ্গে ক্ষমতা এবং সমাজমানুষের যূথ সেটাপটিকে আলতো ঠোক্কর মারার কাজ এখানে লক্ষনীয়। যৌনতার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বয়ানকে এখানে  নেড়েঘেঁটে দেখা হয়েছে। প্রচ্ছন্ন দৈহিক অধিকার বোধ, দৈনন্দিনের যৌন-বেপথু, শ্বাসপ্রশ্বাস এখানে একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছে যা মানব অস্তিত্বের, তার আনকনসাসের অন্ধকার দিকটিকেই অ্যাড্রেস করে। কমল ও রানির দৈনন্দিন, নুড়ি কুড়োনো ইত্যাদি হয়ে ওঠে তাদের আনকনসাসের আরতি এবং অরতি।  তাই অজস্র মজাদার কৃৎকৌশলের পরেও এই উপন্যাস দু’টির একটি তাত্ত্বিক প্রস্থান আমার কাছে স্পষ্ট। আদিম নরনারীর প্রবৃত্তি, তার রিরংসা অবদমনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আজ সভ্যভব্য। কিন্তু ভেতরে রিনরিন সেই আদিম টান। জাঁক দেরিদা তাঁর Animality সংক্রান্ত আলোচনায় মানুষের পোশাক সংক্রান্ত ব্যাপারটির সঙ্গে পশুর পোশাকহীনতার প্রস্তাবটি উত্থাপিত ক’রে মানুষের পশুত্বের দিকটিকে অ্যাড্রেস করেছেন। তেমনই রানি কমল বা কমল রানির ভিন্ন ভিন্ন তরিকার যৌন কারকিত, মনস্তাত্ত্বিক কসরত আসলে আদিম পাশবের পোশাকবদলু আয়োজন। এই উপন্যাস দু’টি পাঠের সময় হয়তো আমরা নিজেদের উপদ্রুত এবং  অ-প্রতর্কিত সেই এলাকাগুলিতে বেড়াতে যেতে পারব, এই বেড়ানোয় ভয় যেমন আছে তেমন স্যাডিস্টিক প্লেজারও আছে। ‘কমলের উপাংশুবাস’-এর মতোই যা রক্তাক্ত এবং উপাদেয়। পাঠক আপনারা অজিতের ‘তাঁইশ’ গল্পটির মধ্যেও যোজন ভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করবেন।  যৌনতার একটি অপ্রথানুগ তছনছ আপনারা পাবেন অজিতের বিভিন্ন লেখায়।কিন্তু যোজন ভাইরাস  ও জোখিম কোরকাপেই তাঁর    গদ্য থেমে থাকেনি। ‘পাতিনা ওয়েসিস’, ‘কারগিল হাসিলের দিনগুলি’, ‘ম্যাওড়া জোন’, ‘মায়ামঘর’,’পাগলনামা’, ‘ধানকাঠের তয়খানা’, ‘নভাক যামিনী’, ‘ঘামলাঘাট’, ‘হিরণ্যরেতাঃ’, ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ’সহ এ যাবৎ মোট ২৫টি উপন্যাসে তাঁর নিজস্ব গদ্যভাষার নির্মাণ ও  অবিনির্মাণ ক্রিয়াশীল।

অজিত রায়-এর ছোটোগল্প রচনার সূচনা আটের দশক থেকে হলেও কোনও অজ্ঞাত কারণে তাঁর কোনও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। হয়তো উপন্যাসে তাঁর অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠাই এর জন্য দায়ী। এই যুক্তি সমর্থিত হয় যখন দেখি তিনি ‘যোজন ভাইরাস’ উপন্যাসটির চোদ্দবার খসড়া করছেন বা একদশকের অধিক সময় ধরে পরিমার্জন করছেন ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ’ উপন্যাসটির। কিন্তু তবুও ছোটোগল্প রচনায় তাঁর নিষ্ঠার অভাব লক্ষণীয় নয়, গ্রন্থিত হয়নি, কিন্তু বিবিধ পত্রপত্রিকায় আমরা তাঁর ছোটোগল্প প্রকাশিত হতে দেখেছি। অজিত রায়ের প্রথম ছোটোগল্প সংকলন ‘বাছাই গল্প ‘ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। এই গ্রন্থে সংকলিত ন’টি ছোটোগল্প যথাক্রমে– ‘তাঁইশ’, ‘মায়ের শ্রাদ্ধ’, ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প’, ‘মাস্টর’, ‘অরন্তুদ’,’পরাভব’, ‘সন্ধিজীবক’,’একটি ‘গোরু’র গল্প’,  ‘কয়লা সোনা সোনাম্যাডাম ও কালাসোনা’। গল্পগুলির কাহিনি বিচিত্র। প্রত্যেকটি গল্পই প্রত্যেকটির থেকে আলাদা আবার প্রত্যেকটি গল্পেই উঁকি দেয় একজন ‘আউটসাইডার’ যে লেখকেরই ‘আদার সেলফ’ হয়ে ওঠে। কখনও-বা সচেতন এবড়োখেবড়ো বহুভাষিক টেক্সটই হয়ে ওঠে তাঁর ডায়াসপোরিক মনোভঙ্গির দ্যোতক। গ্রন্থিত গল্পের বাইরেও তাঁর অনেক গল্প বিবিধ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন ‘শিলাদিত্য’, ‘এবং’, ‘কৌরব’, ‘আজকাল’ সংবাদপত্রের ‘রবিবাসর’ বিভাগে, ‘গোধূলি মন’, ‘অনার্য সাহিত্য’, ‘সংবিত্তি’ ইত্যাদি। তাঁর ছোটোগল্পগুলিতে অনুধান্তিক জীবনচিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইউরোপীয় আধুনিকতার ডকট্রিনের ওপর বিতৃষ্ণায়, পূর্বপক্ষ অথবা বিকল্প প্রস্থান হিসেবেই লাতিন আমেরিকান কবি ফেদরিকো দ্য ওনিস পোস্টমর্ডানিটির প্রতর্কটিকে উত্থাপিত করেছিলেন। এখন যদি ছোটোগল্পের ঔপনিবেশিক সংজ্ঞায়নের নিরিখে উনিশ শতকীয় ধাঁচায় অজিত রায়ের ছোটোগল্প নিয়ে আলোচনা করতে চাই তবে তা একপ্রকার অসম্ভব। আসলে ভারতীয় উপমহাদেশ দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার কারণে চিন্তাচেতনাও সাম্রাজ্যবাদ আরোপিত আধুনিকতার ইউটোপিয়া থেকে মুক্ত নয়। জাঁক দেরিদার চিন্তাপ্রস্থানের সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদ তার উপনিবেশকে কীভাবে দেখে তার মৌল স্বরূপটিকে চিহ্নিতকরণের কাজ করেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থপ্রণেতা এডোয়ার্ড সাঈদ উত্তর ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি থেকে দেখেছেন ঔপনিবেশিক অসৈরনকে। আধিপত্যবাদীদের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক শোষণ যতটা প্রকাশ্য, কালচারাল হেজেমনি ততটাই অপ্রকাশ্য ফলত আরোপিত সাংস্কৃতিক প্রকল্পগুলিকে নানান ছুঁতোয় উপনিবেশের মনে ঢুকিয়ে “আমরা প্রভু, তোমার দাস”-এই ডকট্রিনটিকে খাড়া করতে অধিক বেগ পেতে হয় না এবং দীর্ঘকালীন ধারাবাহিক পরিকল্পনায় তা উপনিবেশনিবাসীর নির্জ্ঞানেও প্রবেশ করতে পারে। এভাবেই আমরা পাশ্চাত্যের কাছে “আদার”। এতটা গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হ’ল অজিত রায়ের মনোভঙ্গিগত অবস্থানকে অ্যাড্রেস করার জন্য। আধুনিকতার যে লক্ষণগুলিকে প্রকৃত ছোটোগল্পের নির্ণায়ক বলে চিহ্নিত করা হয় তা এই আলোচনার প্রতিপাদ্য নয়। কারণ অজিতের ছোটোগল্পের ভাবকল্প অধুনান্তিক। প্রাগাধুনিক কথকঠাকুর কথিত কথিকায় যেমন কথকের আনন্দ, বেদনা, সাংস্কৃতিক চেতনার স্বরায়ন ঘটত, অজিতের রচনাও তদনুরূপ অবস্থার সঙ্গে আংশিক তুলনীয়। অপরের মধ্যে ‘আমি’র অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া মনস্তত্ত্বনির্ভর। ভারতীয় অধ্যাত্মপরম্পরায় ইচ্ছাশক্তির মূল্য স্বীকৃত, যে যা হওয়ার প্রাণপণ ইচ্ছে করে সে তাই হয় তত্ত্বত এমনই বিশ্বাস করা হয়৷ অবচেতনের এই ক্ষমতাকে জোসেফ মার্ফি তাঁর ‘The Power of subconscious mind’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে স্থিত অজিতের ঘরানাও তাই সংকরায়িত এবং মাল্টিডায়ামেনশনাল। কান্টীয় euclidean ভাবনাবৃত্ত অথবা রাবীন্দ্রিক সদাপ্রসন্নবাদের কাঠামোয় তাঁর লেখার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। কোয়ান্টামের Epistemological ব্যাখায় দ্রষ্টাহীন দ্রষ্টব্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। Subjective Idealism-এর সর্বোচ্চস্তরে যে Solipsism, যেখানে গিয়ে সমূহ প্রতিপাদ্যই আমার চৈতন্যের প্রতিরূপ। যেমন উপনিষদে নুনের পুতুল সাগরে মেশার চিত্রকল্পে ‘আমিহীন’ একটি অবস্থাকে বিধৃত করা হয়, যেখানে আরাধ্য ও আরাধকের ভেদাভেদ নেই। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় একটি “আমি” সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে মনের ত্রিস্তরীয় গঠন স্বীকৃত। Id- Ego- Superego।  অজিতের মনোভঙ্গিতেও এই ত্রিবিধ প্রস্থান লক্ষনীয়। রীতিসচেতনতা তাঁর কনসাস স্তরে থেকেই হয়তো সাবকনসাস স্তরেও ছাপ ফেলেছে। অবশ্য ছাপ যে ফেলেছে তা তাঁর রচনারীতি থেকেই সুস্পষ্ট। অজিতের ডিকশন অটোরাইটিং পদ্ধতির হলেও প্রায় সব লেখাতেই যে বাকভঙ্গিসচেতন অভিযাত্রা পরিলক্ষিত হয় তা উপরিউক্ত মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে।কোয়ান্টাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে Eugene Wigner বলেছিলেন —  “It is not possible to formulate the laws of quantum theory in a fully consistent way without reference to consciousness.” অজিতের এই মনভূমি শ্রীঅরবিন্দ কথিত “বোধের নবাঞ্চল।” এখন এই বোধের নবাঞ্চল নির্মাণসূত্রের অনুসন্ধান করা যাক। ভাষাবিজ্ঞানী আব্রাহাম নোয়াম চমস্কি তাঁর ‘Syntactic Structure’ এবং ‘Current Issues Of Linguistic Theory’ গ্রন্থে ভাষার মনস্তত্ত্বপ্রধান চেতনাকে অ্যাড্রেস করেছেন। তাঁর মতে ভাষা কোনও জড় বস্তু নয়, প্রাণময় চেতনা। চমস্কির এই প্রতর্কটি অজিতের ভাষিক বাকভঙ্গির অপরতাকে বোঝার সহায়ক হবে বলে মনে হয়। বিশ্ববিখ্যাত Human  Geographer Yi Fu Tuan-এর অভিমত এখানে প্রণিধানযোগ্য — “There are the mutual influence of socio-geographical and physical geographical space and the narrative and the literary cultural discourse. The influence of place on literature exposes the  emotional attachment…”  অজিত রায় ভৌগোলিকভাবে ঝাড়খণ্ড রাজ্যভুক্ত ধানবাদের বাসিন্দা। বঙ্গভূমির থেকে বিবিক্ত ধানবাদের ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ট্যাবু ও টোটেমও পৃথক। এই “অপর” ভূমির কারণে অজিত রায়ের মানসে যুগপৎ “টোপোফিলিয়া” ও “টোপোফোবিয়া” ক্রিয়াশীল হয়েছে। “টোপোফোবিয়া” এই অর্থে যে বঙ্গভূমির ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক, নান্দনিক ঐতিহ্যের বিপ্রতীপ একটি ডিসকোর্স অজিতের মনোভঙ্গিকে করেছে ডায়াসপোরিক। আর “টোপোফিলিয়া” এই কারণে যে আনকোরা, অজানার মধ্যে ‘আমি’র স্বেচ্ছাবিকাশের স্বাধীনতা ও সুযোগ। এবং বায়োগ্রাফিক্যাল ক্রিটিসিজমের সাপেক্ষে এই দুই-এর দ্বান্দ্বিক নির্ণয় অনির্ণয় অনর্থক নয়, এমন মনে হয়।

 

অজিত রায়ের ছোটোগল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু যে কয়েকটি ছোটোগল্প তিনি লিখেছেন তা অনির্বচনীয় এবং বহুমাত্রিকতার দ্যোতক। অধ্যাপক তনুময় গোস্বামী অজিত রায়ের একমাত্র ছোটোগল্প সংকলন ‘বাছাই গল্প’র কথামুখ অংশে লিখেছেন —– “সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরন্তর উপন্যাস-চর্চার দরুন যদিও আজ ইনি ঔপন্যাসিক হিসেবেই সমধিক পরিখ্যাত, কিন্তু তারই পাশাপাশি মধ্যেমধ্যে তাঁর ছোটোগল্পের প্রোজ্জ্বল ছটাও আমাদের মাঝে প্রকীর্ণ হয়েছে। সেই গল্পগুলি নেহাত তাঁর গদ্যঝোরার অভ্রংলিহ চূড়া থেকে বিগলিত বিক্ষিপ্ত বাইপ্রোডাক্ট মাত্র নয়, অপিচ তাঁর গদ্যের ভিন্নতর গঠনবৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা, তথা তাঁর সাহিত্যগত উত্তরণের প্রতিটি ছাপছুপ বিধৃত আছে সেগুলিতে।”

‘বাছাই গল্প’ গ্রন্থে অজিত রায়ের ন’টি ছোটোগল্প সংকলিত হয়েছে। এটিই তাঁর প্রথম গল্প সংকলন । গ্রন্থভুক্ত হবার আগে গল্পগুলি ‘কৌরব’, ‘কারুবাসনা’, ‘শহর’-এর মতো অফবিট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।  বাছাই গল্পের প্রথম প্রকাশ অক্টোবর, ২০১৯। সংকলনে কোনও কালানুক্রমিক বিন্যাস অনুসৃত হয়নি। কিন্তু ন’টি ছোটোগল্পকে কালানুক্রম রক্ষা ক’রে সাজালে তার রূপটি হবে এমন —  ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প'(২০০৩), ‘তাঁইশ'(২০১৩), ‘পরাভব'(২০১৫), ‘সন্ধিজীবক'(২০১৫), ‘মায়ের শ্রাদ্ধ ‘ (২০১৬), ‘একটি ‘গোরু’র গল্প(২০১৬), ‘অরন্তুদ'(২০১৮), ‘মাস্টর’ ( ২০১৯), ‘কয়লা সোনা সোনাম্যাডাম ও কালাসোনা ‘(২০১৯)। উপরিউক্ত ন’টি ছোটোগল্পের বিষয় ভিন্ন ভিন্ন হলেও কখনও প্রকাশ্য, কখনও-বা অপ্রকাশ্য “আমি” উঁকি মারে। লেখকের স্বীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এই “আমি”-ই তাঁর সার্থকতার দ্যোতক। বৈচিত্র্যময় হলেও অজিতের ভাষা, বাকভঙ্গি সবই নিজস্বতায় ঋদ্ধ। জেমস জয়েসের মতো, কমলকুমার মজুমদারের মতো, সুবিমল মিশ্রের মতো অজিতও একটি মৌলিক স্বস্থানের নির্মাণ এবং বিনির্মাণ করেছেন।

‘বাছাই গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্পের নাম ‘তাঁইশ’। আক্ষরিক অর্থে, “ক্রুদ্ধ তিরস্কার বা শাসন।” একটি নিতান্ত আটপৌরে বাড়ির ভেতর থেকে দেখা দৃশ্যের মধ্যে দিয়েই গল্পটির সূচনা হয়েছে। তারপর একটার পর একটা জট খুলেছে। ফ্ল্যাট ন্যারেটিভ স্টাইলে কাহিনি এগিয়ে যায়নি। একইসঙ্গে এসেছে বিভিন্ন সময় ও স্পেশ। রিয়েলিটি ও ম্যাজিক রিয়েলিটির অদ্ভুত দোলাচল চলেছে গল্পের সমস্ত অংশ জুড়ে। তাঁইশ গল্পের কথক “বাবর।” সে একজন খুনি। দীর্ঘ অশান্তিময় দাম্পত্যের শেষে বাবর নিজের স্ত্রীকে খুন ক’রে উপাংশুবাস নিয়েছে। নির্জন, পুরোনো বাড়ির ঘনান্ধকার ঘরে বাবরের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে রানী নাম্নী নারীর কথা, উঠে এসেছে বন্ধু কমলের সঙ্গে কথোপকথন প্রসঙ্গে। দুই বন্ধুর কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। বাবরের উপাংশুবাসের ঠিকানাহীন গৃহে হঠাৎ নির্জনতা ভেঙে যখন কমল কলিং বেল বাজায় এবং তার কিছু পরেই যখন বলে “আজ আমার জন্মদিন”, তখন পাঠককে চমকে উঠতে হয়। তবে কী নির্জন উপাংশুবাসের স্মৃতিচারণে বাবরেরই আবার জন্ম হ’ল! যা কাম্য বাবরের চেতনায় তাই কি কমল অথবা যা কাম্য কমলের চেতনায় তাই কি বাবর? সারা গল্প জুড়ে সম্ভব অসম্ভবের টানাপোড়েন চলে। কমল কি তবে বাবরের অলটার ইগো?  এই ভাবনা মনস্তত্ত্ববিজ্ঞানসম্মত। একদেহধারী ব্যক্তির চৈতন্যে কখনও কখনও একাধিক চেতনার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। অনেক সময় একটি চেতনার অস্তিত্বের হদিস আরেকটি চেতনার কাছে থাকে না।মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় বিষয়টি “Dissociative Identity Disorder” নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত জানাই অজিত রায়ের ‘যোজন ভাইরাস’ উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন তাঁদের কাছে ‘রানী’, ‘কমল’, ‘বাবর’ চরিত্রত্রয় অপরিচিত নয়। বহুচর্চিত এই উপন্যাসটি নিয়ে এখানে আর কিছু বলছি না কিন্তু অজিতের প্রস্থান যেহেতু আত্মজৈবনিক, মূলগত প্রকরণ যেহেতু ‘আমি’র-ই নানামাত্রিক অনুসন্ধান, তাই আমার এই অভিমতের সমর্থন পাওয়া যাবে ‘যোজন ভাইরাস’ উপন্যাস ও ‘তাঁইশ’ ছোটোগল্পটি পাশাপাশি পাঠ করলে।’বাছাই গল্প’ গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্পের নাম ‘মায়ের শ্রাদ্ধ’। The Stranger উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই Albert  Camus  লিখেছিলেন — ‘ Maman Died Today. Or Yesterday Maybe, I Don’ts Know.” তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল, কারণ বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে মানবিক সম্পর্কের প্রতি যে সার্বিক অনাস্থা, অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ কাম্যুর এই মিথ হয়ে যাওয়া বাক্যটি। কিন্তু প্রাচ্যের ইতিহাসে শাক্তপদকর্তারা আছেন, আছে মা-ছেলের সম্পর্কের দ্যোতনায় পারমার্থিক সত্যানুসন্ধানী পরম্পরা। সেই প্রাচ্যেও বিশ্বায়ন, যন্ত্রসভ্যতা প্রভৃতি কারণে সম্পর্কের সংজ্ঞা কেমন বদলে গেছে। সেই বদলে যাওয়া নতুন সময়ের কথাই এই গল্পের উপজীব্য। বৃদ্ধা মা-এর বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলেও তা দুঃখজনক। কিন্তু বৃদ্ধার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যেন পিকনিকের মুড। মানবিক সম্পর্কের শেকড় আলগা হয়ে যাবার কথাই লেখক এখানে বলেছেন, তাঁর সহজাত হিউমারের আশ্রয় নিয়ে। কিন্তু পরিবর্তনশীল সময়ের কথা বলতে গিয়ে কোথাও অতীতচারী হাহুতাশ করেননি লেখক। ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প’-টি এই গ্রন্থের তৃতীয় গল্প। আলমোড়া এলাকার ‘নহেরখেত’ নামক একটি হিলস্টেশনের প্রেক্ষাপটে গল্পটি লিখিত। গল্পটির প্রধান চরিত্র পলান মাদোড় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু। আটচল্লিশ বছর বয়সী পলানের সঙ্গে লেখকের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে উদঘাটিত হয় পলানের জীবনের মর্মান্তিক এক একটি অধ্যায়। গল্পে “পলানের  বাবা-মা এসেছিল, পলানকে কাঁধে চড়িয়ে, একাত্তরে।” এই দৃশ্যটি দেশভাগপীড়িত মানুষের মনে মর্মান্তিক স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। এই দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায় অজিত রায়ের আত্মজৈবনিক গদ্যগ্রন্থ ‘জুভেনিলিয়া জুনূন’-এর একটি অংশ — “বাবার শীর্ণ কাঁধে দুটি সরু ঠ্যাঙ দুলিয়ে একটি ততোধিক শীর্ণ শিশু চলেছে দেশের বাড়ি, ভূলুই।”  এখানে শেষে পলান মাদোড়ের ঘরে ফেরার অনুচ্চারিত বেদনা লেখকের হয়ে ওঠে, পলান মাদোড় হয়ে ওঠে লেখকের আত্মপ্রতিকৃতি। পলানের পিছনে ফেলে আসা অতীত, সম্মুখে আশাহীন ভবিষ্যৎ। আত্মপরিচয়ের সংকট গল্পটিতে উচ্চারিত হয়েছে। খিদের কাছে দেশহীন মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ। বাংলা উপন্যাসের তিনটি চরিত্রের কথা আমার মনে পড়েছে, ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প ‘-টি পড়তে গিয়ে, প্রথমত, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘আসফাক’, দ্বিতীয়ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘হাড্ডি খিজির’, তৃতীয়ত, দেবেশ রায়ের ‘বাঘারু’। এই মনে পড়া কারণ পলান মাদোড়সহ উপরিউক্ত চারজনই ভূমিহীন, হতদরিদ্র, আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা শোষিত শ্রেণির। চারজনই সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার। কিন্তু অজিত রায়ের পলান মাদোড় কোথাও আলাদা হয়ে যায় তাঁর ডিকশনের কারণে৷ পলানের সংকট হয়ে যায় তাঁরই সংকট। সাম্প্রতিক অতীতে আত্মজৈবনিক ঘরানার লেখক হিসেবে যে দু’জন বহুচর্চিত। তার প্রথমজন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আর দ্বিতীয়জন, অজিত রায়। যে কোনও থিমই তাঁর রচনার উপজীব্য হোক শেষপর্যন্ত তা হয়ে ওঠে অজিতের আঁতের কথা। আমার মনে হয় বাংলায় আত্মজৈবনিক ঘরানার  সর্বোচ্চস্তরের গল্প ও উপন্যাসের রচয়িতা জীবনানন্দ দাশ। একইজীবনের  বহুবিধ বাঁককে তিনি যেমন নানান মাত্রায় দেখেছেন, অজিতের দেখাও তদনুরূপ। শুধুই গল্প বলে যাওয়া নয়, গল্প হয়ে ওঠার প্রণালীকে তিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করেন। বহুমাত্রিক সম্ভাবনার দরজা খোলা রাখেন পাঠকের সামনে। এই গ্রন্থের চতুর্থ গল্প ‘মাস্টর’। কাহিনি সংক্ষিপ্ত। নিম্নবর্গীয় এক নারীর তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের আকাঙখাই গল্পের বিষয়বস্তু। পড়তে পড়তে পাঠকের প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে’ গল্পটির কথা মনে হতে পারে। যা লক্ষনীয় তা এই গল্পের ভাষা। ভাষা এখানে উপরিতলে ভাসমান আলাদা কিছু নয়, নিম্নবর্গীয় জীবনসম্পৃক্ত ভাষা। ঝাড়খণ্ডী উপভাষার একটি বিশেষ মুড গল্পটিকে তাঁর অন্যান্য গল্পের মধ্যে আলাদা ক’রে  চেনায়।’অরন্তুদ’ এই গ্রন্থের পঞ্চম গল্প। প্রসঙ্গক্রমে বলি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়  নিজেকে ‘কলম পেষা মজুর’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। অজিত রায়ও স্বপ্ন দেখেন শ্রেণিহীন, সাম্যাবস্থার। হয়তো ইউটোপিয়া, কিন্তু সেই ইউটোপিয়াও স্বপ্নসন্ধানী কিছু মানুষের মনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে আছে। ‘টুন্ডি’ নামক স্থানে সাবঅলটার্ন প্রতারিত মানুষের জাগরণের কাহিনিই এই গল্পের উপজীব্য। কিন্তু কোনও একরৈখিক স্টোরিটেলিং নয়। গল্পের শেষে নায়ক “বুঢ়া সরেন” নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং উপলব্ধি করা যায় এই কাহিনি কোনও ব্যক্তি মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে না। প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বের জন্মান্তরবাদ ব্যাখ্যায় যেমন বীজ ছড়িয়ে পড়ার উপমা ব্যবহৃত হয়, তেমন বিপ্লবের বীজ ছড়িয়ে পড়ার কাহিনি ‘অরন্তুদ’। শুধু বিপ্লবের কথাই নয়, ঈশ্বর নামক ‘বিমূর্ত’ শক্তির কাছে মানুষের অসহায়তা দিয়ে গল্পের শেষ হয়েছে। ১.১.১১ তারিখে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘হিরণ্যরেতাঃ’-এর একটি অংশ ‘অরন্তুদ’ গল্পে অবিকল বিধৃত হয়েছে। অংশটি উদ্ধৃত করা হ’ল– “এ দেশে বামপন্থী আন্দোলন মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি দলিত সমাজকে বরাবর রীঢ়ার চোখে দেখে এসেছে। যে-কারণে আজ-অব্দি দলিত শ্রেণি, বিশেষত আদিবাসীরা কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে জুড়তে পারেনি। ফলে, ক্ষতি হয়েছে দুটো। একদিকে বামপন্থী রাজনীতি নিজস্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণসমর্থন খুইয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আন্দোলন বয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক খাতে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি যদি এই ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত, তাহলে এর চেহারা অন্যরকম হতে পারত। আরেকটা হয়ত তেলেঙ্গানা হতে পারত এই ঝাড়খণ্ড,— যা বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডকে সৃষ্টি করত।” একটি আইডিয়াই যেন ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে দেখা। আবার গল্পের শেষদিকের ‘বিমূর্ত’ ঈশ্বরের কাছে মানুষের অসহায়তার বর্ণনাটি অবিকল ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘নভাক যামিনী’ উপন্যাসের । এই মিলগুলিই বায়োগ্রাফিক্যাল ক্রিটিসিজমের সাপেক্ষে, “Narrotology”-এর নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখার সাপেক্ষে আমার অভিমতকে সমর্থন করে। আত্মজৈবনিক লেখার একটি সমস্যা তার পৌনঃপুনিকতা, যা পাঠকমনে বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। ‘বাছাই গল্প’ গ্রন্থের ষষ্ঠ গল্পের নাম ‘পরাভব’। কামতানাথের হিন্দী ভাষায় লেখা গল্প ‘শিকস্ত’কে অজিত রায় এই গল্পে বিনির্মিত করেছেন। গল্পের মূল চরিত্র অলখ মুর্মু। বিহার রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় এই গল্পের প্রেক্ষাপট। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে ভিন্ন ভিন্নভাবে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকাঠামো যে নিছক কথার কথা আসলে রাষ্ট্র যে দুর্বল, অসহায়-এর ওপর অধিকতর প্রবল এই সহজ সত্যই এখানে ফুটে উঠেছে। ‘সন্ধিজীবক’ এই গ্রন্থের সপ্তম গল্প। আমরা জানি ‘জীবক’ ছিলেন বুদ্ধদেবের চিকিৎসক। তাই এই গল্পটি পড়তে পড়তে আমার জাতকমালার ‘অশাতমন্ত্র’ গল্পটির কথা মনে পড়ছিল। দু’টি গল্পই কামুক নারীর সন্তানবধের গল্প। অশাতমন্ত্রে বধের উদ্যোগ নিলেও তা সম্ভব হয়নি, কিন্তু সন্ধিজীবকে তা সফল। গল্পটির মূল উপজীব্য নারীর যৌনতা, যা রাখঢাকহীন অথচ শৈল্পিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। ‘একটি ‘গোরু’র গল্প’  বাছাই গল্পের অষ্টম গল্প। যশভিখারি সাহিত্য উদ্যোক্তাদের প্রতি হিউমারাস কশাঘাত গল্পটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাহ্যিক উদ্যোগে লেখক হওয়া যায় না আন্তরিক উৎসাহ, শ্রম প্রয়োজন এটিই এই গল্পের মূল কথা। বিনয় মজুমদারের একটি প্রবন্ধ থেকে লেখক গল্পমধ্যবর্তী ক্যালকুলেশনের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ‘পরাভব’ এবং ‘একটি ‘গোরু’র গল্প’-এর কিছু অংশ যথাক্রমে কামতানাথ ও বিনয় মজুমদারের লেখা থেকে নেওয়া হলেও, তা লেখকের মুন্সীয়ানায় ‘ভিস্যুয়াল রিইন্টারপ্রেটেশান’ বলে মনে হয়। এই সংকলনের নবম এবং শেষ গল্প ‘কয়লা সোনা সোনা ম্যাডাম কালোসোনা’। বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কিছু কিছু উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বাহ্যিক পরিচয় ‘সৎ’ হলেও, তলায় তলায় তারা নানারকম দুষ্কর্মে, বিশেষত অসৎ উপায়ে অর্থপার্জন করে থাকে। এমনকি, তাদের যোগান দিতে তাদের সহধর্মিনীরাও পেছপা থাকে না। তেমনি এই গল্পটি। কেন্দ্রস্থান দেশের কয়লা-রাজধানী ঝরিয়া কোলফিল্ড। গল্পটি আঙ্গিকগত দিক থেকে অজিত রায়ের পূর্বোক্ত গল্পগুলির সঙ্গে বিশেষ খাপ খায় না, এবং অপেক্ষাকৃত সাদামাটা। কিন্তু চরিত্রগুলো অনেকটাই প্রাঞ্জল।

এই গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘তাঁইশ’-এর সূচনা হয় পোস্টকার্ডের ভেতরে থাকা দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে, অনুরূপভাবে তৃতীয় গল্প ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প’-তেও ফিরে আসে পোস্টকার্ডের মধ্যে থাকা দৃশ্যের  বর্ণনা। ইংরেজি ‘Narratology’ শব্দের বাংলা পরিভাষা ‘আখ্যানতত্ত্ব’। পূর্বে আত্মজৈবনিক প্রস্থানের প্রসঙ্গে যা বললাম তারই পুনরাবৃত্তি ক’রে বলা যায় অজিতের “আঁতের কথা”টি এক, তিনি শুধু ভিন্ন ভিন্ন ডিসকোর্স নির্মাণ করেছেন। একই দৃশ্যের অবতারণা ক’রে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি গ্রথিত করেছেন। M.BAL তাঁর ‘Narratology : Introduction To The Theory Of Narrative’ গ্রন্থে ওপরে উত্থাপিত প্রতর্কটিকে অ্যাড্রেস করেছেন — “A Fabula (story) Is A Series Of Logically And Chronologically

Releted Events That Are Caused Or Experienced By Actors.” M.Bal-এর অভিমত উত্থাপিত প্রসঙ্গটিকে সমর্থন করছে। রলাঁ বার্ত তাঁর ‘Image-Music-Text’ গ্রন্থের ‘লেখকের মৃত্যু’  প্রবন্ধে যে অভিমতটি প্রকাশ করেছেন তা সমালোচনা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে এক বৈপ্লবিক মতামত। সেই মতামত শিরোধার্য করেই বলা যায় এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনার আরও সুদীর্ঘ পরিসর থাকল, থাকল অজস্র সম্ভাবনা।