Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মধুদার মতো মানুষ উপযুক্ত মর্যাদা পেলেন না

দীপঙ্কর দে

 



সমাজবিদ, প্রাবন্ধিক

 

 

 

মধুদার সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৫ সালের শেষ দিকে। বিশ্বেন্দু একদিন মধুদাকে নিয়ে আমাদের ইনস্টিটিউট এল। মনে আছে ছাত্রছাত্রীদের ডেকে বলেছিলাম ওঁর সঙ্গে সেলফি তুলে রাখ। যখন বুঝবি উনি কত বড় মাপের মানুষ তখন নিজেদের গর্ব হবে।

ওঁর প্রস্তাবে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানে (IBS Business School) দুদিনের একটা আলোচনাসভার আয়োজন করি সেবছরেই ডিসেম্বর মাসে। সেই সভায় প্রতিষ্ঠিত হয় Weavers’ Artisans & Performing Artists Guild (WAPAG)! কিছুদিন পর তা পঞ্জীকরণও করা হয়। মধুমঙ্গল মালাকার সভাপতি, বিশ্বেন্দু নন্দ সম্পাদক। পরবর্তীতে WAPAG ও IBS যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিল।

সেই থেকে মধুদার সঙ্গে আমাদের এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাঁর মাধ্যমে অনেক গুণীজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে— নেপাল সূত্রধর, নারায়ণ মাহাতো আরও কত মানুষ! আমার জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে মধুদার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর।

তাঁর শিল্প ভাবনা বা শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁর কাছ থেকেই আমি বাংলার কারিগরদের ‘নব শাখা’র কথা জানতে পারি। নব শাখা নয়টি শাখা নয়। প্রথমে সেটাই ভাবতাম। পরে জানলাম এই নবশাখারা হলেন হিন্দু ধর্মের নতুন শাখা। সেন আমলে যে সব কারিগর বৌদ্ধধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু হয়েছিলেন তাদেরকেই শূদ্রবর্ণের একটি নতুন শাখা বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কুম্ভকার, স্বর্ণকার, কর্মকার, তন্তুবায়, সূত্রধর ইত্যাদি কারিগর সম্প্রদায়ের মতো আর একটি কারিগর সম্প্রদায় মালাকার সম্প্রদায়। এতটুকু বুঝেছি মধুদা ছিলেন এই সম্প্রদায়ের একজন সেরা কারিগর যাঁকে আমরা উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারিনি।

মধুদা শুধু একজন স্বনামধন্য শিল্পী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। অল্পদিনেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। সে অনেক স্মৃতি। মনে পড়ছে একবার করবীর ডান হাতের আঙুল ভাঙল। দুজন অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখানো হল। ব্যথা কমে না। কী কারণে মধুদা ফোন করেছিলেন। বললাম এই কথা। শুনেই রায়গঞ্জ থেকে ছুটে এলেন। সঙ্গে কিছু লতাপাতা। করবীর হাতের সব ব্যান্ডেজ খুলে সেই হাড়জোড়া পাতা নিজে বেটে ভাঙা আঙুলে বেঁধে দিয়ে বললেন সাতদিনের মধ্যে সেরে যাবে। বাস্তবে সেটাই হয়েছিল। না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

শেষ যেদিন চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে দেখা করতে গেলাম হাত মুঠো করে বোঝালেন তিনি লড়বেন, ভয় নেই। না সত্যি সেদিন মনে হয়নি তিনি এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবেন!

ভালো লাগছে না। মেনে নিতে পারছি না মধুদার চলে যাওয়া। বড় অপরাধী লাগছে। এত বড় মাপের একজন মানুষকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি আমরা।

একবার মধুদার উদ্যোগে আমরা অনেকে গিয়েছিলাম রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আলোচনায় অংশ নিতে। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার পারম্পরিক কারিগর আর্থবাবস্থার একটা কোর্স চালু করতে। দিনের পর দিন আমাদের ঘরে বসে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। একটা পাঠ্যসূচি তৈরিও হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল WAPAG হয়তো নিজেই চালু করবে এমন একটি শিক্ষাক্রম। করা হয়নি। তাঁর স্বপ্নকে আমরা মর্যাদা দিতে পারিনি।

কেউ উৎসাহী হলে জানাবেন। খুঁজলে হয়তো আমার ল্যাপটপে এখনও পাওয়া যাবে সেই পাঠক্রমের খসড়া।