গৌতম দাস
চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক
অশিক্ষিত লোকজনের মাথায় ‘বিজ্ঞান’চর্চার নির্মম পেরেক ঠুকে সরস্বতীর পুজোমণ্ডপে তাদের উপদ্রব শেষ করে দেবেন, এমনই আদর্শ নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরে কিছু ‘যুক্তিবাদী’ অতিব্যস্ত। তাঁরা সময়সুযোগমতো সরকারি, অসরকারি আসর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন; তাঁদের আমরা সমীহ করি। তাঁদের হুঙ্কার এবং উপদেশ শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।[1] একই সঙ্গে চমৎকৃতও, কেননা দেখা যাচ্ছে, কোভিড ১৯-এর নামে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যে পাহাড়প্রমাণ অন্যায় এবং মিথ্যাচার সংঘটিত হচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়ে ক্ষমতাশালীদের যে আখ্যান এই অন্যায় এবং মিথ্যাচারকে ‘নিউ নরমাল’ আর ‘গ্রেট রিসেট’ বলে চালানোর চেষ্টা করছে, স্বঘোষিত যুক্তিবাদীরা তাদের সুরেই পোঁ ধরেছেন। এই চিৎকৃত আত্মরতি, নির্বোধ এবং বদ রসিকতা অনেক সময় কুৎসিত মনে হয়। তা অবশ্য বেদনার কথাই।
তাঁরা কথায় কথায় ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের’ হদিশ পান। অবশ্য তাঁদের অনেক আগে অমন তত্ত্বের হদিশ পেয়েছিল খোদ ‘সিআইএ’! সেকথা থাক, আপাতত যদি ধরেও নিই যে ষড়যন্ত্র বলে কিছুই ছিল না তাহলেও, এমন এমন প্রশ্ন গত কয়েক বছরে তৈরি হয়েছে যা সত্যিই ভাববার কথা। আর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে, বিশ্বসমাজে যে একটা অন্যায্য ছকের নির্মাণ হচ্ছে তা এতদিনে প্রায় স্পষ্ট। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল, গবেষণাপত্র এবং এমনকী, মূল ধারার পত্রপত্রিকাতেও অকাট্য যুক্তি এবং তথ্যের উপর নির্ভর করে, কোভিড ১৯-এর চলতি আখ্যানকে যাঁরা বারবার প্রশ্ন করছেন, সমালোচনা করছেন এবং তীব্র বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বক্তব্য থেকেও তা স্পষ্ট। আমরা বরং মূল ধারার সেইসব গবেষক, সমালোচক এবং লেখকদের কথাই এখানে তুলে ধরব। হয়তো তাতেই বোঝা যাবে, কোথায় কতটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি আর কাণ্ডজ্ঞানের ভার।
প্রথম কথা, চিনে অস্বাভাবিক রোগটি ধরা পড়ার মাত্র এক মাসের মধ্যে, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০, যখন ‘হু’ কোভিড ১৯-কে PHEIC (Public Health Emergency of International Concern) অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক আপৎকালীন স্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে ঘোষণা করে, তখন সারা পৃথিবীতে এই অসুখে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭১।[2] অথচ সারা পৃথিবীতে মরসুমি ফ্লুতে প্রতিবছর গড়ে ৩,৮৯,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।[3] অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩২ হাজার। তাহলে কোন বিচারে সেই সময় কোভিড ১৯ ছিল আন্তর্জাতিক মহাবিপদ?
দ্বিতীয় কথা, ‘হু’ বলেছিল, এতে মৃত্যুহার হবে ৩ থেকে ৪ শতাংশ।[4] তাদের অনুমান ছিল, ২০২০ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা হবে তিন মিলিয়ন। আসলে হয়েছে ১.৮ মিলিয়ন।[5][2] (অবশ্য এই সংখ্যাটিতেও কতটা জল মেশানো তা নিয়ে আজও কেউ নিঃসংশয় না।) ওদিকে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী, মহামারিবিদ এবং সংখ্যাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আয়োয়ানিডিস তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রে, যা আবার ‘হু’-র বুলেটিনে[6] ছাপা হয়েছে, প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন, কোভিডে মৃত্যুর হার অর্থাৎ IFR হচ্ছে সারা পৃথিবীর গড় হিসাবে ০.২৩ শতাংশ। কোনও কোনও দেশে সেটা ০.১ শতাংশ বা তার কমও হতে পারে। আমাদের দেশের বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদদের হিসাব অনুযায়ী, এই মৃত্যুহার ০.০৫ শতাংশ[7], যা মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার মৃত্যুহার (০.১ শতাংশ)[8]-এর অর্ধেক।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যা অতি মারক নয় সেই অসুখটিকে কেন অতিমারি ঘোষণা করা হল? (ইদানিং শোনা যাচ্ছে, কোভিড-এ মৃত্যুর সংখ্যা নাকি আরও বহুগুণ বেশি। অবশ্য ‘বহুগুণ’-এর হিসেব যেভাবে কষা হচ্ছে তা এত গোলমেলে আর অবান্তর যে, তা নিয়ে আলাদা নিবন্ধ দরকার। আপাতত আমরা সেই আলোচনায় যাব না।)
যাহোক, সংখ্যার সমর্থন ছাড়াই ‘হু’ যে অতিমারি ঘোষণা করে দিল তার কারণ, তারা নিজেরাই ২০০৯ সালে অতিমারির সংজ্ঞাটা বদলে দিয়েছিল। কোনও ‘অতি বাম’, ‘ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক’ নন, পিটার দোসি, যিনি মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ফার্মেসির গবেষক এবং ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের সহযোগী সম্পাদক, তিনি এই কথা জানিয়েছিলেন ২০১০ সালের একটি প্রবন্ধে। তাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, H1N1-কে অতিমারি ঘোষণা করার জন্যই, অতিমারির সংজ্ঞা ‘হু’ বদলে দিয়েছিল। কোনও ব্যাখ্যা না-দিয়ে ‘অতিমাত্রায় মৃত্যু’ এই শব্দবন্ধকে তারা ছেঁটে ফেলেছিল।[9] কিন্তু কাদের পরামর্শে তারা এই কাজ করেছিল? কিছু ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল একযোগে অনুসন্ধানে নেমেছিলেন। তদন্ত রিপোর্ট বেরিয়েছিল, ৪ জুন, ২০১০।[10] তাতে তাঁরা বলেছিলেন, ‘হু’-এর কর্তাদের এই সংজ্ঞা বদল নিয়ে যাঁরাই প্রশ্ন করেছেন এবং সমালোচনা করেছেন, তাঁদেরই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর সমর্থক বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু, তদন্তের ফলে বেরিয়ে এসেছে যে, যেসব বিজ্ঞানীরা ‘হু’-কে এই পরামর্শ দিয়েছে, তারা সকলেই সেইসব ফার্মা কোম্পানির পোষিত বিজ্ঞানী, যারা অতিমারির দোহাই দিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশকে বাধ্য করেছিল Tamiflu (Oseltsmivir) এবং Relenza (Zanamivir)— এইসব অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খরিদ করতে এবং ভ্যাকসিন-এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশকে ‘হু’ এই মর্মেই নিদান দিয়েছিল। তার এই তৎপরতায় এই ফার্মা কোম্পানিগুলি কয়েক বিলিয়ন ডলার পকেটস্থ করেছিল।[11]
এই ফার্মা কোম্পানিগুলি গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ‘হু’-র প্রধান অনুদানদাতা হিসেবে, তাকে দিকভ্রান্ত করেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর নির্দিষ্ট সংক্রামক অসুখগুলির উপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে, এবং ওষুধ ও ভ্যাকসিন নির্মাতাদের মদতে এবং প্ররোচনায় ‘হু’ একটি আদ্যোপান্ত দুর্নীতিপরায়ণ আন্তর্জাতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এই বৃহৎ ফার্মা কোম্পানির অনুমোদিত লোকেরাই সেখানে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। একথা বহুকাল আগেই আমাদের শুনিয়েছিলেন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের সহ-সম্পাদক ফিওনা গডলি (গত মাসেই অবসর নিয়েছেন), তার বিখ্যাত প্রবন্ধ WHO in crisis-এ।[12]
তাহলে, বিজ্ঞানচর্চার একচ্ছত্র উত্তরসাধকরা নিশ্চয়ই এবার বুঝবেন, প্রশ্ন এবং সমালোচনাকে কালিমালিপ্ত করা এবং হেয় করার মাধ্যমে তাকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টায় তাঁরা কাদের হাত ধরছেন। বিজ্ঞানচেতনার এই পরাকাষ্ঠা অবশ্য শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। বলা যায়, সারা পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্যকে যখন থেকে সীমাহীন মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে নির্মাণের জন্য ‘হু’-কে ব্যবহার করা শুরু হল, এবং জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি সেই বাণিজ্য প্রসারের একটি অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হল, তখন থেকেই। মনে পড়ছে? ২০০৬ সালে ভুয়ো ‘পিসিআর টেস্ট’-এর মাধ্যমে ‘হুপিং কফ’-কে মহামারি ঘোষণা করার চেষ্টা হয়েছিল? নিউইয়র্ক টাইমস-এ (২২/১/২০০৭) প্রকাশিত হয়েছিল, “Faith in Quick Test Leads to Epidemic That Wasn’t.”[13]
যুক্তিবাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা দরকার; কিন্তু যুক্তিবাদীরা একথা ভুলে যান কেন যে, যুক্তি কখনও একতরফা হয় না। ক্ষমতাবানের কাছে যে-যুক্তি অস্বস্তিকর তার কণ্ঠরোধ করে দিতে হবে, এও বা কেমন যুক্তি? কোনটা যুক্তি আর কোনটা না, তা কে স্থির করবে? তখন কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া আমাদের কে বাঁচাবে? তার ওপর ভর করে এখন দেখছি, প্রলাপবচনে ধূম্রজাল তৈরি করে পণ্ডিতম্মন্য যুক্তিবাদীরা ভাবছেন এবং প্রকারান্তরে বলছেনও যে, বিল গেটস সায়েবের কোনও কুকীর্তি নেই, তিনি বিজ্ঞানমুখী ব্যবসাদার।
বেশ, তা হতে দোষ নেই; কিন্তু একথা তো ঠিক যে, ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর, নিউইয়র্ক শহরে ইভেন্ট ২০১ অনুষ্ঠানের আয়োজন বিল গেটসের প্রতিষ্ঠান গেটস ফাউন্ডেশন, জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কর্তাব্যক্তিরাই করেছিলেন। উপরন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এবং ইভেন্ট ২০১-এর ওয়েবসাইটে ঘোষণা করা হয়েছিল,
Event 201 simulates an outbreak of a novel zoonotic coronavirus transmitted from bats to pigs to people that eventually becomes efficiently transmissible from person to person, leading to a severe pandemic. The pathogen and the disease it causes are modeled largely on SARS, but it is more transmissible in the community setting by people with mild symptoms.[14]
এখন প্রশ্ন, এই আয়োজক গণৎকাররা কীভাবে মহামারি আসার তিন মাস আগেই নির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন? এঁরা কি সব চিকিৎসক-গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিদ এবং ভাইরোলজিস্ট ছিলেন? নাকি এঁরা মানুষের ভূতভবিষ্যৎ নিয়ে বড্ড কাতর?
এঁরা ছিলেন মূলত বিগ ফার্মা ও ভ্যাকসিননির্মাতা কর্পোরেটদের প্রতিনিধি, বৃহৎ লগ্নিপুঁজি সংস্থা এবং আমেরিকার উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা। ছিলেন ‘সিআইএ’-র প্রাক্তন উপপ্রধান আরভিল হাইনস, ‘সিডিসি’-র পরামর্শদাতা হিসেবে প্রাক্তন মার্কিন অ্যাডমিরাল স্টেফান সি রেড, জনসন এন্ড জনসন কোম্পানির প্রতিনিধি অ্যাড্রিয়ান টমাস এবং ছিলেন চিনা ‘সিডিসি’-র এক বর্ণময় চরিত্র ডক্টর গাও।[15] এই ডক্টর গাও ওখানে একটি বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি এরকম খবর ছড়িয়ে যায় যে ভ্যাকসিননির্মাতারা এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে তাহলে আমরা কী করে তার বিরুদ্ধে প্রচার করব? ভিডিওটি এখনও ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে।[16] নিজের কানে শুনে যেকেউ সন্দেহ নিরসন করতে পারেন। এছাড়া মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, (পরি)কল্পিত মহামারির খবর কীভাবে একেবারে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে অ্যালগরিদম-এর মাধ্যমে ছেঁকে সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া মারফত ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এর বিরোধী বক্তব্যকে কীভাবে এবং কতটা প্রতিহত করা হবে এবং গুজব বলে সেগুলিকে দাগিয়ে দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কোনও ‘ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক’-এর কথা না, ন্যাশনাল হেরাল্ড (২ মে, ২০২০) পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল একটি নিবন্ধ, Why is Gates denying Event 201?[17]।
কোনও ‘সত্যসন্ধানী’ গেটস সায়েবের প্রতি অতি-সংবেদনশীল হয়ে থাকতে পারেন, তাহলেও কিছু কথা তাঁর শুনে রাখা দরকার। জৈব অস্ত্রের কথা তুলে বিল গেটসই বলেছিলেন, “ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলো গোলাবারুদ বোমাবন্দুক নিয়ে হবে না, হবে জীবাণু-অস্ত্র নিয়ে, সুতরাং সমস্ত দেশকেই যুদ্ধাস্ত্রের বদলে এখন ভ্যাকসিন কিনতে হবে।”[18] আমরা জানি, বৈশ্যসম্রাট হতে গেলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার। এই প্রজ্ঞা থেকেই ২০১০ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘গাভি’, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন। কোভিড ১৯ আসার আগে পর্যন্ত তিনি সেখানে বিনিয়োগ করেছেন ১০ বিলিয়ন ডলার। সংবাদমাধ্যমে মহামারির ‘সিমুলেশন’ দেখিয়ে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ৩০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হবে[19], সেই মৃত্যুর মহামিছিলে ভ্যাকসিন বিক্রি করে তিনি লাভ করবেন ২০০ বিলিয়ান ডলার।[20] ২০১৭ সালে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দাভোস সম্মেলনে তৈরি করেছিলেন CEPI (Coalition for Epidemic Preparedness innovations)। ‘হু’-র ওয়েবসাইটে গেলেই দেখবেন, অতিমারি আসার সঙ্গে সঙ্গেই, ডায়াগনোস্টিক কিট থেকে ওষুধপত্র এবং ভ্যাকসিনের বিক্রি-বাট্টা করার জন্য এই প্ল্যাটফর্ম কতখানি সক্রিয়। জানতে পারবেন, ওয়েলকাম ট্রাস্ট, গেটস ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশন কীভাবে সারা পৃথিবীর বৃহত্তম লগ্নিপুঁজির সামাজিক সংগঠন হিসেবে ‘হু’-কে নিয়ন্ত্রণ করছে[21] এবং এই প্ল্যাটফর্ম-এর মাধ্যমে ৮০টির বেশি ভ্যাকসিন কোম্পানিতে কারা কারা বিনিয়োগ করছে।
আরও একটি তথ্য দিলে সত্যসন্ধানীরা নিশ্চয়ই মর্মাহত হবেন না, কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও বাণিজ্যপ্রবর ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও বিশ্বখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানের জার্নালে প্রবন্ধ লিখছেন। ২০১৫ সালে, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত হল, “আগামীর মহামারি: এবোলার শিক্ষা”[22]। লেখক বিল গেটস। লিখলেন, “ভবিষ্যতে রোগীদের এমন একটি বিশেষ ‘আরএনএ’-নির্ভর উপাদান দেওয়া হবে যার ফলে একটি বিশেষ প্রোটিন বা অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। সম্পূর্ণ একটি নতুন ক্ষেত্র, তবে সম্ভাবনা অনেক। নিরাপদ চিকিৎসার ধরন থেকে খুব দ্রুত বিপুল আকারে উৎপাদন করা সম্ভব হবে।”[23] ততদিনে মডার্না কোম্পানিতে তিনি বিপুল বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। বিনিয়োগের ফসল তিনি ঘরে তুলবেন এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? ষড়যন্ত্রেরই বা কী আছে? তিনি তো ঘোষণা করেই ব্যবসার জাল ছড়িয়েছেন। ২০১৫ সালেই তিনি ‘টেড টক্’-এ বক্তৃতা দিয়ে করোনাভাইরাস-এর আগমনবার্তা জানিয়ে দিয়েছিলেন।[24] হ্যাঁ, করোনাভাইরাসেরই!
তারপর প্রায় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। সত্যান্বেষী এবং বিজ্ঞানের এই অতন্দ্র প্রহরীরা একবারও কি প্রশ্ন তুলেছিলেন?
এই বুদ্ধিজীবীরা আজকাল বলেন, মরণপণ ‘যুদ্ধ’ করেই ভাইরাসকে পরাজিত করতে হবে, আর তার জন্য পুলিশের হাত ধরতেই হবে। বলেন, একটু-আধটু কৌশলগত ভুলভ্রান্তি থাকলেও ভাইরাসের গতি আটকাতে গেলে লকডাউনের মতো কঠোর বিধি দরকার। তাতে নাকি পুঁজিপতিদের লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়।
তাহলে পুঁজিপতিদের যে মুখপত্র বা নিউজ চ্যানেল আছে সেগুলো কী বলছে দেখে নেওয়া যাক। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, সিএনবিসি চ্যানেলে প্রকাশিত খবর: সর্ববৃহৎ সাতটি টেক কোম্পানি ২০২০ সালে অতিরিক্ত আয় করেছে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার।[25] বাজারে অ্যাপেলের সম্পত্তির মূল্য বেড়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলার, আমাজনের ৭১০ বিলিয়ান, টেসলার ৫৮৪ বিলিয়ান, গেমিং ডিভাইসের মাইক্রোচিপ প্রস্তুতকর্তা এনভিডিয়ার ৩২৩ বিলিয়ান, মাইক্রোসফটের ৪৮০ বিলিয়ান, গুগলের মালিক অ্যালফাবেটের ২৬৮ বিলিয়ান এবং ফেসবুকের ১৯৩ বিলিয়ন ডলার।[26] এ ছাড়া আরও একটা ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে; সেকথাও পুঁজিবাদী পত্রিকা নিউজ উইক রাখঢাক না রেখেই জানিয়ে দিচ্ছে। উত্তর সম্পাদকীয়তে সেখানে লেখা হয়েছে ‘We are living through the greatest transfer of wealth from the middle class to the elites in history‘। তার মানে, “মধ্যবিত্তদের থেকে ধনকুবেরদের হাতে সম্পত্তির সর্ববৃহৎ হাত বদল হচ্ছে আমাদের সময়ে”।[27]
সেখানে লেখা হয়েছে,
মহামন্দা থেকে মহা সঙ্কোচন, অর্থনীতির ইতিহাসে নানান অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আমরা এখন এই লকডাউন-এর সময় দেখতে পেলাম নতুন একটি ঘটনা যাকে বলা যায় মহা সংযুক্তিকরণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির থেকে সম্পত্তির দ্রুত হাতবদল ঘটছে সেই ধনকুবের শ্রেণির হাতে যাদের হাতে রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অন্যান্য শক্তির উৎস। … লকডাউন নামক নতুন ব্যবস্থায় তারা তাদের ক্ষমতাকে সংহত করে আমজনতার ক্ষতির বিনিময়ে নিজেরা মুনাফার পাহাড় তৈরি করছে। কোভিড-এর আগে, গোটা আমেরিকার জিডিপির অর্ধেক এবং কর্মসংস্থানের অর্ধেক জোগাত ৩০ মিলিয়ান ক্ষুদ্র ব্যবসা। অপর অর্ধেকের দখল ছিল ২০,০০০ বৃহৎ কোম্পানির হাতে। অতিমারির সময়, (এই বৃহৎ কোম্পানিগুলি) ‘অপরিহার্য’ তকমা লাগিয়ে দিব্যি তাদের ব্যবসা চালিয়ে যায় কিন্তু শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে ছোট এবং মাঝারি ব্যবসাগুলিতে। এর সঙ্গে সরকারি কোষাগার থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পুঁজির বড় তরফরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পকেটস্থ করে। এর সামগ্রিক ফল হিসেবে কয়েক মাসের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ছোট ব্যবসাকে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় কার্যত খুন করা হয় এবং মাত্র সাতটি বৃহৎ টেক কোম্পানি ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার দখল করে নেয়।[28]
এর পরেও যুক্তিবাদীরা বলেন, ভ্যাকসিন ব্যবসায় মুনাফা এত কম আর এই ভ্যাকসিননির্মাতা কোম্পানিগুলো নাকি এত দুর্বল যে, গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই তাদের নেই। তাঁরা হিসেবও দেখান আর বলেন, কোম্পানিগুলোকে অত ক্ষমতাবান বলে দেখাটা একটা অবান্তর, উদ্ভট আবদার।
কিন্তু মুশকিল এই যে, বিশ্বজুড়ে ফার্মা কোম্পানিগুলোর মৌরসিপাট্টা ঠিক কেমন তা তারা ‘ফার্মাসিউটিক্যালস গ্লোবাল মার্কেট রিপোর্ট ২০২১’-তে নিজেরাই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে বলেছে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ফার্মা কোম্পানির বাজার ছিল ১২২৮.৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৫-এ তাদের কাঙ্খিত বার্ষিক বৃদ্ধির হার হবে ৮ শতাংশ, অর্থাৎ তাদের বাজারের আয়তন দাঁড়াবে ১৭০০.৯৭ বিলিয়ন ডলার।[29] তাহলে কাদেরকে আড়াল করছেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা? এখন তো দেখাই যাচ্ছে, ফাইজার-বায়ান টেক এবং মডার্না এই দুই ভ্যাকসিন দৈত্য একত্রিতভাবে প্রতি মিনিটে মুনাফা করছে ৬৫,০০০ ডলার অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৬ হাজার ডলার। সম্প্রতি (১৬-১৮ নভেম্বর, ২১) ফার্মা কোম্পানিগুলির ‘সিইও’দের যে শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, যাকে বলা হয় বিগ ফার্মা ডাভোস, তাদের রিপোর্ট থেকেই এই তথ্য।[30] তা সত্ত্বেও ‘যুক্তিবাদী’রা যেরকম বদরাগী শিক্ষকের মত ফার্মা কোম্পানির মুনাফার একটি ম্যাড়ম্যাড়ে রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেছেন, সেটা হাতে পেলে ফাইজার কোম্পানির ‘সিইও’ হয়তো টয়লেট পেপার হিসেবেই ছুড়ে ফেলে দেবেন। কারণ যেদিন তিনি তার ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন ৯৪ শতাংশ কার্যকরী বলে ঘোষণা করলেন, সেদিনই পূর্বপরিকল্পনামত নিজের কোম্পানির শেয়ার বেচে ৫.৬ মিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিয়েছেন।[31] সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, দিনটা ‘মানবতার জন্য স্মরণীয়’। তবে আমাদের ‘যুক্তিবাদী’দের বিজ্ঞানচর্চাও অনুরূপভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
এবার আসি ভ্যাকসিনের কুফলের কথায়। প্রথমেই বলি, আমেরিকায় ‘ভিএইআরএস’ বলে একটি ভ্যাকসিন-পরবর্তী মৃত্যু এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজরদারি ব্যবস্থা আছে। ভ্যাকসিন-পরবর্তী যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে তার মাত্র ২ শতাংশ এখানে নথিবদ্ধ হয়। তবু, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত, মৃত্যুর সংখ্যা ৬,৫৭৬ এবং মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সংখ্যাটা ৪৩,০৩৭। গত ৩০ বছরে ভ্যাকসিনের কারণে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় অর্ধেক সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে বিগত ১০ মাসে। যে কেউ একটু যাচাই করে নিতে পারেন।[32]
তেমনি Eudra Vigilance-ও ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সির অধীনস্থ একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নথিবদ্ধ করার প্রতিষ্ঠান। সেখানে দেখা যাচ্ছে এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন-পরবর্তী মৃত্যুর সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং সর্বমোট নথিভুক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সংখ্যা ৮ লাখের ওপর।[33] আমাদের দেশে সরকারিভাবে স্বীকৃত মৃত্যুর সংখ্যা ৯৪৬ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সংখ্যা ৪৯,৮১৯। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (৭/১/২২) জানাচ্ছে, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, অস্বচ্ছতা এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও আমলাদের অসহযোগিতার কারণে এই নথিবদ্ধ সংখ্যাগুলি অবিশ্বাস্যরকমভাবে কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলে দেওয়া হচ্ছে, মৃত্যু ভ্যাকসিনের জন্য ঘটেনি। অথচ এযাবত মাত্র ৮৯টি অর্থাৎ মাত্র ৯ শতাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করতে পেরেছে।[34] যে-যুক্তিবাদ নিয়ে বিজ্ঞানসাধকদের এত অভিমান তার সূত্রেই বলি, ভ্যাকসিন দেওয়ার পরপর মৃত্যুগুলো যদি ভ্যাকসিন-মৃত্যু নাও হয় তাহলে করোনা সংক্রমণের পরপর সব মৃত্যু কোভিড-মৃত্যু হয় কী প্রকারে? একটাকে কম করে দেখাতে পারলে আরেকটাকে তো বেশি করেও দেখানো যায়!
তাছাড়া, ভ্যাকসিন-জনিত মৃত্যুর সংখ্যা যদি কমও হয়, সেই মৃত্যুগুলি নিয়ে কৌতুক করা কি সভ্যতার পরিচয়? এই মৃত্যুগুলো কি এড়ানো যেত না? কোভিড তো সংক্রমণ-জনিত রোগ, সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে; কিন্তু ভ্যাকসিন তো সুস্থ মানুষকেই দেওয়া হয়। তাহলে সুস্থ মানুষের দেহে যে স্পাইক প্রোটিনগুলি তৈরির ব্যবস্থা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলো কী বলছে সে সম্পর্কে? হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ্রদের অত্যন্ত সম্মানীয় জার্নাল ‘দি সার্কুলেশন’-এ প্রকাশিত হয়েছে, স্পাইক প্রোটিন হার্টের পেশী এবং রক্তনালীতে গিয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, যার ফলে মায়োকার্ডাইটিস, পেরিকার্ডাইটিস, কার্ডিওমায়োপ্যাথি— এইরকম ভয়ঙ্কর পরিণাম দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু ভ্যাকসিন-গ্রাহকদের মধ্যে।[35] এবং লক্ষণীয়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং কমবয়সিরা। সুইডেনের পলিসি রিসার্চ জানাচ্ছে এই ভ্যাকসিনগুলো ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।[36] স্পাইক প্রোটিনগুলি যে কোনও কোনও মানুষের দেহে রক্তনালীর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে, সেটা আজ আর লুকোনো যাচ্ছে না।
আরও একটি বুনিয়াদি প্রশ্ন, এই জিনগত ভ্যাকসিনগুলি কি এর আগে কখনও মানবদেহে ব্যবহার করা হয়েছে? কেন হয়নি? গত দেড় দশক ধরে এগুলির গবেষণা চলা সত্ত্বেও সেগুলি কেন বাজারে আসেনি? কেন প্রাণীদেহে ট্রায়ালের সময় সমস্ত প্রাণী মারা গেছে? ‘এডিই’ বা অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট কাকে বলে? ‘এমআরএনএ’ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা কেন বারবার দেখা গেছে? জরুরি অবস্থার নাম করে কেন প্রাণীদেহে ট্রায়াল সম্পূর্ণ না-করে মানবদেহে এই জিনগত কোভিড ভ্যাকসিনের সরাসরি ট্রায়াল শুরু হয়েছিল? জিনগত ভ্যাকসিনগুলির বয়স মাত্র দশ মাস। এগুলির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মানবদেহে কী হতে পারে, সেটা না জেনেই কেন প্রসূতিদের দেহে এবং শিশুদের দেহে সেটা দেওয়া হচ্ছে? পরীক্ষামূলক ভ্যাক্সিন দিয়ে গণটিকাকরণ কি চিকিৎসার প্রাথমিক নীতিকে লঙ্ঘন করে না?
আরও গোড়ার প্রশ্নটা হল, এই ‘এমআরএনএ’ জাত-পদার্থগুলো কি ভ্যাকসিন? যদি তাই হত, তবে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেন সিডিসিকে ভ্যাকসিনের সংজ্ঞা বদলে দিতে হল?[37] আগে বলা হত, যাহাই সংক্রমণ থেকে ইমিউনিটি তৈরি করে, তাহাই ভ্যাকসিন। বদলে দেওয়া সংজ্ঞায় বলা হল, যাহা প্রতিরোধব্যবস্থাকে ‘উত্তেজিত’ করে তাহাই ভ্যাকসিন। অতি উত্তেজনায় ‘এডিই’র মত প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটতে পারে, আবার কম উত্তেজনায় প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি নাও হতে পারে। এই ভ্যাকসিনগুলোতে কিন্তু দুটো সম্ভাবনাই প্রকট। ভ্যাকসিনের সংজ্ঞা বদলে দেওয়ার প্রশ্নটিই তুলেছিলেন পিটার দোসি। বলেছিলেন, ভ্যাকসিন সংক্রমণ আটকাতে পারে না ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা যে কমাচ্ছে তার প্রমাণ কোথায়? কোন্ ‘এফিকেসি ট্রায়াল’-এ এগুলো লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল? কোথাও হয়নি।[38]
সত্যসন্ধানীদের আরেকটি আজগুবি ভাষণের নমুনা হল, ইজরায়েলে টিকা ব্যর্থ হবার গল্পটি নাকি একটি অত্যন্ত বাজে মিথ্যে প্রচার।
কিন্তু “Israel, widely vaccinated, suffers another covid-19 surge”, এই শিরোনামে খবরটা বেরিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে।[39] সেখানে লেখা ছিল, গোটা ইজরায়েলের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের প্রায় ৮০ শতাংশকে ডবল ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। অথচ কোভিডের নতুন দংশনে হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হচ্ছিলেন তাঁদের ৯০ শতাংশের ভ্যাকসিন নেওয়া ছিল। এই প্রেক্ষাপটে ডক্টর সিভান গাজিট-এর নেতৃত্বে যে সমীক্ষা সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে তার শিরোনাম ছিল, “Comparing SARS-CoV-2 natural immunity to vaccine induced immunity”[40]। এই সমীক্ষা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, টিকার্জিত প্রতিরোধের চেয়ে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ১৩ গুণ বেশি শক্তিশালী।[41] তাহলে ইজরায়েলের দুর্ঘটনা তো মিথ্যে প্রচার না।
অনেকে নিজের নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য ভ্যাকসিনের ‘এফিকেসি’ বা কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু তাঁরা একথা বলেন না যে, কোম্পানিগুলো যে-কার্যকারিতার কথা বলে তা হল, আপেক্ষিক হিসেব (রিলেটিভ)। যাঁরা ডাক্তারি পরিসংখ্যান নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা বলেন, সেই আপেক্ষিক সংখ্যাগুলোকে চরম সংখ্যায় (অ্যাবসলিউট) অনূদিত না-করলে কিছুই স্পষ্ট হয় না।[42] কেউ যদি বলে, অমুক ওষুধ দিয়ে আমি তমুক রোগের ঝুঁকি কমাচ্ছি তাহলে সবচেয়ে আগে বলতে হবে, তমুক রোগের প্রাথমিক ঝুঁকি কতটা, তারপর আসবে অমুক ওষুধ ব্যবহারের পর পরিবর্তিত ঝুঁকি কতটা দাঁড়াল, তারপর আসবে আপেক্ষিক আর চরম সংখ্যার হিসেব। গবেষকদের মতে, চরম সংখ্যাটা আপেক্ষিক সংখ্যার চেয়ে এত কম যে কোম্পানি সেগুলো দেখাতে চায় না। কোভিড ভ্যাকসিনের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে।
মূলত চারটি ভ্যাকসিনের যে ট্রায়াল চলছে, সেগুলোর বিজ্ঞাপিত ‘এফিকেসি’ ছিল এইরকম: ফাইজার-বায়নটেক ৯৫ শতাংশ, মডার্না ৯৪ শতাংশ, জনসন অ্যান্ড জনসন ৬৭ শতাংশ, আ্যসট্রা জেনেকা ৬৭ শতাংশ। কিন্তু এই হিসেব যে গোলমেলে সেটা আমাদের জানায় ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধ।[43] সেখানে দেখানো হয, কীভাবে আপেক্ষিক সংখ্যা ব্যবহার করে এফিকেসি মাত্রাকে বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা হয়েছে, এটাই RRR (Relative Risk Reduction)। যদি দস্তুরমতো চরম সংখ্যা ব্যবহার করা হত তাহলে ARR (Absolute Risk Reduction)-এর মাত্রাগুলো হত এইরকম— অ্যাসট্রা জেনেকা ১.৩ শতাংশ, মডার্না ১.২ শতাংশ, জনসন অ্যান্ড জনসন ১.২ শতাংশ, ফাইজার বায়নটেক ০.৮৪ শতাংশ। ব্যাপারটা এইরকম— ধরা যাক, ১০০ জন যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৪০ জনের কোভিড হয়েছে এবং ১০০ জন যারা ভ্যাকসিন নেননি তাদের মধ্যে ৬০ জনের কোভিড হয়েছে। যদি RRR হিসাব করা হয় তাহলে নেওয়া হবে, দুটি বিভাগে কোভিড হওয়ার অনুপাত অর্থাৎ ৪০/৬০ = ০.৬৬ মানে ৬৬ শতাংশ। যদি নিয়মমতো ARR হিসেব করা হয়, তাহলে দুই বিভাগের কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যার অনুপাত নয়, অন্তর নেওয়া হত। তার মানে ARR হত ৬০-৪০ = ২০ শতাংশ।
উপকারের পরিমাণ বেশি না-দেখালে লোকে প্রলুব্ধ হয় না, তাই রিলেটিভ বা আপেক্ষিক সংখ্যা দেখানো। নিচের উদাহরণে দেখব, কীভাবে ARR থেকে NNTV হিসেব করতে হয় এবং সেটা দিয়েই ‘এফেক্টিভনেস’ বা কার্যোপযোগিতা মাপা হয়। ‘এফিকেসি’ দেখা হয় সমীক্ষার অন্তর্গত সীমিত সংখ্যক লোকের মধ্যে। তার তাৎপর্য আছে; কিন্তু ‘এফেক্টিভনেস’ দেখা হয় প্রয়োগের পর বাস্তব সমাজের বৃহত্তর অংশে। তাই এটাই কার্যোপযোগিতা; তা মাপার মাপকাঠি হলো NNTV, পুরো কথাটা হল Number Needed To Vaccinate. অর্থাৎ একটি সংক্রমণ আটকাতে কতজনকে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কীভাবে হিসাব করা হয়?
ধরা যাক ১০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হল এবং ১০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হল না। দেখা গেল, প্রথম গোষ্ঠীতে সংক্রমিত হলেন ৪০ জন অর্থাৎ ৪০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় গোষ্ঠীতে সংক্রমিত হলেন ৬০ জন অর্থাৎ ৬০ শতাংশ।
এবার ARR (Absolute Risk Reduction ) দাঁড়াল, ৬০-৪০ = ২০ শতাংশ।
যেহেতু NNTV = 1/ARR,
অতএব NNTV দাঁড়াল ১০০/২০ = ৫।
এর মানে হচ্ছে, একটি সংক্রমণ আটকাতে অন্ততপক্ষে ৫ জনকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। আদর্শ পরিস্থিতিতে ‘এনএনটিভি’ হওয়া উচিত ১।
বিশ্বখ্যাত ‘ভ্যাকসিন’ জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী ফাইজার এবং মডার্না ভ্যাকসিনের যে কার্যকারিতা ইজরায়েল সহ অন্যান্য দেশে দেখা গেছে, তার ‘এনএনটিভি’ ২০০-৭০০, গড় ২৫৪। অর্থাৎ একটি সংক্রমণ আটকাতে হলে ২৫৪ জনকে ভ্যাকসিন দিতে হবে।[44] আর আমাদের দেশে যে কোভিশিল্ড দেওয়া হচ্ছে তার কার্যকারিতা কতখানি? Medical Journal Armed Forces India 77 (2021)-এ প্রকাশিত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, আংশিকভাবে টিকাযুক্ত লোকেদের ক্ষেত্রে ARR = 487 (দশ লক্ষে) এবং NNTV = 2051, সম্পূর্ণভাবে টিকাযুক্ত লোকের ক্ষেত্রে ARR = 486 (দশ লক্ষে) এবং NNTV = 2054[45]। তাহলে পাঠক এবার সহজেই অনুমান করতে পারবেন, যেসব কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আদৌ কোনও কাজের কাজ করতে পারে কিনা, আর পারলেও তা কতটা? এও বুঝতে পারবেন যে, সামান্যকে অসামান্য করে তোলা ব্যবসাদারদের বহু পুরনো কৌশল, আধুনিক ডাক্তারি আঙিনা তার প্রখর প্রমাণ।
আরও একটি মারাত্মক তথ্য ওই ভ্যাকসিন জার্নালের সংখ্যায় জানা গিয়েছিল। সেটা হচ্ছে রিস্ক বেনিফিট অনুপাত।[46] বিজ্ঞানসাধকরা নিশ্চয়ই জানবেন, ভ্যাকসিন বাজারজাত হওয়ার পরেও একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই রিস্ক বেনিফিট অনুপাত হিসাব করতে হয়। যদি দেখা যায় বেনিফিটের তুলনায় রিস্ক অর্থাৎ লাভের তুলনায় ক্ষতির অনুপাত বেশি, তৎক্ষণাৎ সেই ওষুধ বা ভ্যাকসিনের ব্যবহার বন্ধ করা হয়। জার্নালটিতে বলা হয়েছিল প্রতি ১ লক্ষ মানুষকে ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিন দিলে ৩টি মৃত্যু আটকানো যায়, কিন্তু ভ্যাকসিনের কারণে মৃত্যু হয় ২টি। অর্থাৎ রিস্ক বেনিফিট অনুপাত দাঁড়াল ২:৩। বাস্তব ক্ষেত্রে কোনও কোনও সময় এই অনুপাত এমনকি, ২:১ পর্যন্ত হতে পারে, লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা দ্বিগুণ হতে পারে।[47] গবেষকরা সমস্ত দেশের সরকারকে পুনর্বিবেচনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু, সমীক্ষার ফল বাণিজ্যিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতেই বলা হল, এই বক্তব্য ‘ভ্যাকসিন বিরোধী’।
গত আগস্ট মাসে, মহামারিবিদ্যার বিশ্বখ্যাত জার্নাল, ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ এপিডিমিওলজি’তে ভ্যাকসিন এবং সংক্রমণের সম্পর্ক নিয়ে একটি সমীক্ষার রিপোর্ট ছাপা হয়।[48] তাতে লেখা হয়েছিল যে সারা পৃথিবীর ৬৮টি দেশ এবং আমেরিকার ২৯৪৭টি কাউন্টির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, নতুন সংক্রমণের সঙ্গে ভ্যাকসিন দেওয়া বা না দেওয়ার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বরং কোথাও কোথাও দেখা গেছে ভ্যাকসিন-গ্রহীতাদের মধ্যে এই সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ইজরায়েলে ৬০ শতাংশের বেশি জনগণ ভ্যাকসিন দেওয়ার সত্ত্বেও সেখানে প্রতি ১০ লক্ষে কোভিড ১৯-এর সংখ্যা সর্বোচ্চ। আইসল্যান্ড এবং পর্তুগালের মত যেসব দেশে ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের সংখ্যা ৭৫ শতাংশের ওপর সেখানে প্রতি ১০ লক্ষে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি। তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভিয়েতনাম যেখানে টিকাকরণের হার ১০ শতাংশের নিচে সেখানে কোভিড ১৯ সংক্রমণের সংখ্যা প্রতি ১০ লক্ষে অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কাউন্টিতে ভ্যাকসিনেশনের হার ৯০ শতাংশের বেশি সেখানেই সবচেয়ে বেশি হারে সংক্রমণ বাড়ছে। সিডিসির রিপোর্ট উদ্ধৃত করে সেখানে দেখানো হয়েছে যে, ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার ০.০১ থেকে ৯ শতাংশ এবং সর্বমোট মৃত্যুর হার শূন্য থেকে ১৫.১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে সম্পূর্ণভাবে যারা টিকা নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে।
টিকাহীন এবং টিকাযুক্ত, জনগোষ্ঠীগুলোকে এইভাবে দুটি বৈরী সম্প্রদায়ে বিভক্ত করার সর্বনাশা চেষ্টা চলছে। এই বিভেদ এবং বৈষম্যের নীতিতে বিজ্ঞানসাধকরাও সায় দিচ্ছেন, ভ্যাকসিন-অনিচ্ছুকদের অবরুদ্ধ করা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে বলেই মত দিচ্ছেন। তাঁদের এই পরিণতি মর্মান্তিক। কর্পোরেট আশীর্বাদধন্য আইনবিশেষজ্ঞরাও তাই চান; তাঁরা এমনকি, মানবতাবাদের সংজ্ঞাও বদলে দিতে চান।[49] কিন্তু আমাদের অবস্থান কী হওয়া উচিত সেটা উপরোক্ত সমীক্ষার শেষ কয়েকটি লাইনে প্রতিফলিত হয়েছে।
সংক্ষেপে, জনমানুষকে যদি ভ্যাকসিনে উৎসাহিত করতেই হয়, তবে সেটা করতে হবে ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বজায় রেখে এবং নম্রতার সঙ্গে। জনগোষ্ঠীর কোনও অংশকে দাগিয়ে দেওয়ার পরিণাম সর্বনেশে হতে পারে। কোভিডবিধির নামে যা চলছে তাকে কাণ্ডজ্ঞান এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে এটাই বুঝে নিতে হবে যে, কোভিড ১৯-কে সঙ্গে নিয়েই আমাদের থাকতে হবে, ঠিক যেভাবে আমরা, ১৯১৮-র ফ্লু মহামারির পর প্রায় ১০০ বছর ধরে বেঁচেবর্তে আছি।[50]
লকডাউন না করে সুইডেনের কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে গিয়ে অনেকে বলেন, তাতে নাকি সুইডেনে “সংক্রমণ ও মৃত্যু হুহু করে বেড়ে গিয়েছিল এবং বছর খানেক পরে সংক্রমণ হার গিয়ে দাঁড়ায় সমতুল্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দশগুণ। … ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটগুলোর সমস্ত বিছানা ভর্তি হয়ে যায়।”[51]
এইসব আজগুবি তথ্যের উৎস কেউ জানে না বা জানলেও তা বলে না। এসব যাঁরা প্রচার করেন তাঁদের এই খেয়ালও থাকে না যে, তাঁরা সরাসরি সুইডেনের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের অপমান করছেন। তবু, এগুলো যে অনৃতভাষণ তা বোঝাবার জন্য ডেইলি মেইল (৮/১১/২০) পত্রিকার রিপোর্ট-এর একটি অংশ তুলে দিচ্ছি। রিপোর্টের শিরোনাম: How Sweden’s lockdown gamble paid off.[52] অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা প্ল্যাটফর্ম-এর সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সুইডেনে কোভিড ১৯-এর মৃত্যুহার প্রতি ১০ লাখে ১৫০০ যা ইউরোপের গড় কোভিড-এ মৃত্যুর হার (১৮০০)-এর থেকে কম। ব্রিটেন, বেলজিয়াম এবং ইটালিতে এই মৃত্যুর হার ২০০০-এর বেশি। একই সূত্র উদ্ধৃত করে তারা জানাচ্ছে যে, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এবং ব্রিটেনের সংক্রমণের হার ছিল যথাক্রমে ৮০০, ৭০০ এবং ৫০০ প্রতি ১০ লাখে। তুলনায় সুইডেনের সংক্রমণের হার ছিল সর্বনিম্ন, প্রতি ১০ লাখে মাত্র ১০০। ডেকান হেরাল্ড পত্রিকার রিপোর্টে (১/১০/২০) একই তথ্যের সমর্থন মিলছে।[53]
অযথা বিধিনিষেধ চাপিয়ে না-দিয়েও যে সমস্ত-স্তরের স্কুল-কলেজ নিরাপদে খুলে রাখা যায় এবং জনসমাজে কোনও বাড়তি বিপদ, কোনও বাড়তি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে না, একথা যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে বিশেষজ্ঞরা টেনে এনেছেন সুইডেনের দৃষ্টান্ত। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে ৬ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে Open Schools, Covid-19, and Child and Teacher Morbidity in Sweden।[54] সুইডেনের ৪ চিকিৎসক গবেষকের রিপোর্ট জানাচ্ছে, সেখানে—
১৬ বছরের নিচে বয়সীদের সংখ্যা প্রায় ১৯ লক্ষ। ২০১৯-এ অর্থাৎ প্রাক কোভিড বছরের শেষ চার মাসে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) এদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬৫। সংক্রমণ যখন শিখরে তখন চার মাসে (মার্চ থেকে জুন, ২০২০) মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬৯। এদের মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিল মাত্র ১৫ জন। এদের একজনও মারা যায়নি।
এরপরেও যদি মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে হয় যে, লকডাউনের পথে না-গেলে অনেক দেশেই ভয়ঙ্কর সংক্রমণ এবং মৃত্যু-মিছিল দেখা যেত, তাহলে বেলারুশের দিকে তাকাতে হয়। এই দেশও লকডাউন হতে দেয়নি। তাতেও নরক নেমে আসেনি; বরং সেখানে কোভিডে সর্বমোট সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে কম। তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে।[55]
লকডাউনে সমাজের সামগ্রিক ক্ষতি হয় না লাভ হয়, সংক্রমণ রোধে এর আদৌ কোনও ভূমিকা আছে কিনা, এটা বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক আয়োয়ানিডিস্ এবং জয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস পত্রিকায়। সমীক্ষকরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন—
লকডাউন এবং বিভিন্ন বিধিনিষেধের কার্যকারিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে এবং সমগ্র সমাজের ক্ষেত্রে, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে এর যে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে সেটা এক কথায় ব্যাপকতর।[56]
সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যটি করেছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জনৈক সংবাদ ভাষ্যকার। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, একটি নিবন্ধে তিনি লেখেন—
মার্কিন প্রশাসন এ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের দুটি বৃহৎ পরীক্ষা চালিয়েছে। প্রথমত তারা লকডাউন করে ভাইরাসের বিস্তার আটকাবার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত তারা লকডাউন শেষ করে অর্থনীতিকে আবার মুক্ত করেছে। প্রথমটি্র মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে, অর্থনীতিকে তালাবন্ধ করে অসুখের বিস্তার আটকানো যায় না এবং দ্বিতীয়টির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে, অর্থনীতি থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিলে দ্বিতীয় সংক্রমণের ঢেউ আসে না।[57]
আমাদের মনে হয়, বিজ্ঞান শুধু শুকনো তথ্যচর্চা না; বিজ্ঞানচর্চায় যদি প্রাণ না-থাকে, সে যদি প্রাণজীবন নিয়ে উদ্বেল না-হয় তাহলে তা কীসের বিজ্ঞান? পরিতাপ এই যে আজও যাঁরা প্রশ্নবাচীদের মধ্যে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁরা কাদের স্বার্থে কথা বলছেন? সত্যি যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা দিনের আলোয় আপনাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আপনাদের কলম দিয়ে তাদের কাজটুকু করিয়ে নিচ্ছে! আমাদের অনুরোধ, কর্পোরেট নির্দেশিত, রাষ্ট্রীয় আখ্যান এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে আপনারাও প্রশ্ন তুলুন। আসুন, আমরা একটা বিশাল দেশের সুস্থ নাগরিক হয়ে উঠি।
[1] ভট্টাচার্য, দেবাশিস। প্রসঙ্গ কোভিড ও ভ্যাকসিন: মাননীয় ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক, আপনাকে বলছি স্যার। গুরুচণ্ডা৯। ১৭ জানুয়ারি, ২০২২।
[2] The true death toll of COVID-19. WHO.
[3] Paget, John et al. Global mortality associated with seasonal influenza epidemics. PMC. 22 Oct 2019.
[4] Coronavirus disease 2019 (COVID-19), Situation Report – 46. WHO. 6 Mar 2020.
[5] Ioannidis, John P A. Infection fatality rate of COVID-19 inferred from seroprevalence data. WHO. 14 Oct 2020.
[6] পূর্বোক্ত।
[7] Karnataka’s Covid-19 infection fatality rate at 0.05%: Sero-survey. The Hindu Business Line. 4 Nov 2020
[8] দ্রষ্টব্য টীকা ৩।
[9] Doshi, Peter. The elusive definition of pandemic influenza.
[10] Cohen, Deborah and Carter, Philip. WHO and the pandemic flu “conspiracies”. BMJ. 4 June 2010.
[11] পূর্বোক্ত।
[12] Godlee, F. WHO in crisis. BMJ. 26 Nov 1994.
[13] Faith in Quick Test Leads to Epidemic That Wasn’t. NYT. 22 Jan 2007.
[14] The Event 201 Scenario. Event 201.
[15] Engdahl, F. William. Coronavirus, Vaccines and the Gates Foundation. Global Research. 24 July 2021.
[16] Event 201 Pandemic Exercise: Segment 1. Youtube.com. 4 Nov 2019.
[17] Haring, Norbert. Why is Gates denying Event 201? National Herald. 2 May 2020.
[18] MacAskill, Ewen. Bill Gates warns tens of millions could be killed by bio-terrorism. The Guardian. 18 Feb 2017.
[19] Loria, Kevin. Bill Gates thinks a coming disease could kill 30 million people within 6 months. Business Insider. 28 Apr 2018.
[20] Bill Gates making $200 billion from vaccines? Financial Express. 27 Sep 2020.
[21] Schwab, Tim. Covid-19, trust and Wellcome: how charity’s pharma investments overlap with its research efforts. BMJ. 3 Mar 2021.
[22] Gates, Bill. The Next Epidemic — Lessons from Ebola. NEJM. 9 Apr 2015.
[23] পূর্বোক্ত।
[24] Bill Gates Warned Us About Covid-19 in 2015, Now He is Predicting Two More Disasters. NEWS18.COM. 5 Feb 2021.
[25] Levy, Ari. Tech’s top seven companies added $3.4 trillion in value in 2020. CNBC. 31 Dec 2020.
[26] পূর্বোক্ত।
[27] Roth, Carol. We’re Living Through the Greatest Transfer of Wealth From the Middle Class to the Elites in History. Newsweek. 24 Oct 2021.
[28] পূর্বোক্ত।
[29] Global Pharmaceuticals Market Report 2021. Globe Newswire. 31 Mar 2021.
[30] Pfizer, BioNTech and Moderna making $1000 profit every second while world’s poorest countries remain largely unvaccinated. OXFAM International. 16 Nov 2021.
[31] Feuer, Will and Wells, Nick. Pfizer CEO sold $5.6 million of stock as company announced vaccine data that sent shares soaring. CNBC. 11 Nov 2020.
[32] Redshaw, Megan. Nearly 15,000 Deaths, More Than 700,000 Injuries Reported to VAERS Since December 2020 Rollout of Covid Vaccines in U.S. The Defender. 20 Sep 2021.
[33] COVID-19 pandemic. European Medicines Agency.
[34] Pulla, Priyanka. How covid-19 vaccines exposed India’s adverse events reporting system. BMJ. 7 Jan 2022.
[35] Gundry, Steven R. Observational Findings of PULS Cardiac Test Findings for Inflammatory Markers in Patients Receiving mRNA Vaccines. Circulation. 8 Nov 2021.
[36] Covid Vaccines and Cancer. Swiss Policy Research. 25 Sep 2021.
[37] Camero, Katie. Why did CDC change its definition for ‘vaccine’? Agency explains move as skeptics lurk. Miami Herald. 27 Sep 2021.
[38] Doshi, Peter. Will covid-19 vaccines save lives? Current trials aren’t designed to tell us. BMJ. 21 Oct 2020.
[39] Lieber, Dov. Israel, Widely Vaccinated, Suffers Another Covid-19 Surge. The Wall Street Journal. 12 Aug 2021.
[40] Gazit, Sivan et al. Comparing SARS-CoV-2 natural immunity to vaccine-induced immunity: reinfections versus breakthrough infections. MedRxiv, BMJ. 1 Nov 2021.
[41] পূর্বোক্ত।
[42] Schwartz, Lisa M., Woloshin, Steven., Welch, H. Gilbert. Risk Communication in Clinical Practice: Putting Cancer in Context. Journal of the National Cancer Institute Monographs No. 25, 1999.
[43] Olliaro, Piero., Torreele, Els., Vaillant, Michel. COVID-19 vaccine efficacy and effectiveness— the elephant (not) in the room. Lancet Microbe 2021. 20 April 2021.
[44] Walach, Harald et al. The Safety of COVID-19 Vaccinations— We Should Rethink the Policy. MDPI. 24 June 2021.
[45] Ghosh, Subhadeep et al. COVISHIELD (AZD 1222) VaccINe effectiveness among healthcare and frontline Workers of Indian Armed Forces: Interm results of VIN-WIN cohort study. MJAFI, Vol 77, Suppl 2, July 2021, p S264-S270.
[46] দ্রষ্টব্য, টীকা ৪৪।
[47] পূর্বোক্ত।
[48] Subramanian, S.V., Kumar, A. Increases in COVID-19 are unrelated to levels of vaccination across 68 countries and 2947 counties in the United States. Eur J Epidemiol 36, 1237–1240 (2021). 30 Sep 2021.
[49] King, Jeff., Ferraz, Octávio Luiz Motta., Jones, Andrew. Mandatory COVID-19 vaccination and human rights. The Lancet. 23 Dec 2021.
[50] দ্রষ্টব্য, টীকা ৪৮।
[51] দ্রষ্টব্য, টীকা ১।
[52] Boyd, Connor. How Sweden’s lockdown gamble paid off: Nation has suffered fewer coronavirus deaths than most of Europe and has a lower infection rate. Mail Online. 8 Nov 2021. Updated: 9 Nov 2021.
[53] No lockdowns, but Sweden seems to have controlled the Covid-19 pandemic. DH. 1 Oct 2020.
[54] Open Schools, Covid-19, and Child and Teacher Morbidity in Sweden. NEJM. 18 Feb 2021.
[55] Karath, Kata. Covid-19: How does Belarus have one of the lowest death rates in Europe? BMJ. 15 Sep 2020.
[56] Ioannidis, John P.A. et al. Assessing mandatory stay-at-home and business closure effects on the spread of COVID-19. ESCI. 5 Jan 2021.
[57] Luskin, Donald L. The Failed Experiment of Covid Lockdowns. WSJ. 1 Sep 2020.