Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চুপ, প্রহসন চলছে

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 



লেখক প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর

 

 

 

 

প্রহসনকে আদতে একটি শিল্প হিসেবে দেখলে এমন শিরোনামের মাধ্যমে তাকে অপমান করা হয়। আমি অবশ্য আমজনতার বক্তব্যে সময়ে সময়ে উঠে আসা ব্যঙ্গার্থে ‘প্রহসন’ শব্দটি ব্যবহারের যে প্রচলন আছে, এই শিরোনামে সেই অর্থকেই বোঝাতে চেয়েছি। সাধারণ অর্থে একে তামাশাও বলতে পারেন। আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দগুলি ইদানীংকালে যে কার্যত এক বিরাট প্রহসন বা তামাশাতে পরিণত হয়েছে, সে বোধ করি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দু-চার কথা সেই নিয়েই বলতে চাইব।

হুজুগ বড় সর্বনেশে জিনিস। গত কয়েক বছরে আমাদের প্রশাসন এবং প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের চালচলন-আচার-আচরণ ইত্যাদি সবকিছুই এমন ভয়ানক রকমে হুজুগ-সর্বস্ব হয়ে পড়েছে যে, তার ঠেলা সামলাতে গিয়ে আমজনতার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। রাতারাতি নোটবন্দির ঘোষণাই হোক, অথবা চারঘন্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন জারির সিদ্ধান্তই হোক, মোদি-শাহের সরকার যে পুরোদস্তুর শোম্যানশিপে বিশ্বাসী, সে কথা আর দেশবাসীকে আলাদা করে বলে দিতে হবে না। পদে পদে, দিনে দিনে আমরা নতুন একেকটি অবতারে সরকারকে অবতীর্ণ হতে দেখেছি। প্রশাসন চালানোর যে পদ্ধতি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসৃত হচ্ছে, তা একেকসময়ে বোধ করি বলিউডের চিত্রনাট্যকেও হার মানাতে সক্ষম। আমাদের দেশ এখন লার্জার দ্যান লাইফের আবহে গা ভাসিয়েছে। এখানে জন্ম থেকে মৃত্যু, আদালতের রায় থেকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সবকিছুই ঘটে যায় হঠাৎ। দেশবাসীকে যেন দশ-বৎসর ব্যাপী এক ট্যুইস্ট নৃত্যের উৎসবে সরকার মাতিয়ে রাখতে আগ্রহী। এই নৃত্যের অন্যতম উপাদান হল ‘দেশ’প্রেম, এবং তারই সঙ্গে উগ্রের চেয়েও উগ্রতর এক জাতীয়তাবাদ। সেখানে দেশের প্রতি ভালোবাসা শেখানো হয় না। দেশের নামে মানুষকে হত্যা করতে শেখানো হয়। দেশের নামে গোষ্ঠীবিদ্বেষকে চাগিয়ে তোলা হয়। এক অসম্ভব অস্থির, নেশাগ্রস্ত, বদমেজাজি পরিবেশের অবতারণা ঘটানো হয়। সেখানে দুজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তই অন্তিম ও সর্বোত্তম বলে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক প্রজাতন্ত্রের অনুষ্ঠানেও তার অন্যথা হল না।

শুরু থেকেই শুরু করা যাক চলুন। প্রহসনের প্রথম সূচনা ২০-২১ জানুয়ারি, ২০২২। সেনা আধিকারিকদের তরফে জানা গেল অমর জওয়ান জ্যোতির পবিত্র পূতাগ্নিশিখাটিকে নিভিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিতর্ক এড়াতে একেবারে শেষ মুহূর্তে মোদি সরকারের তরফে এই সিদ্ধান্তকে প্রকাশ করা হয়। যদিও শেষ অবধি বিতর্ক-বিক্ষোভ কোনও কিছুকেই এড়ানো গেল না। সরকারের তরফে তখন তড়িঘড়ি বিবৃতি দিয়ে জানানো হল, ‘অমর জওয়ান’কে নির্বাপিত করা হচ্ছে না। বরং শিখাটিকে আদতে নবনির্মিত ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালের অন্য আরেকটি পূতাগ্নিশিখার সঙ্গে ‘সসম্মানে’ মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একের বিপরীতে দুইটি পবিত্র শিখাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে জ্বালিয়ে রাখতে কি মহামান্য সরকারের এতটাই সমস্যা হচ্ছিল? নাকি জ্বালানির দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, গৃহস্থকে ছাপিয়ে তা সরকারি হেঁশেলে গিয়েও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে?

চমকের এখানেই শেষ হল না। ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল ও অমর জওয়ান জ্যোতির এই শিখা-টানাটানির হট্টগোলের মধ্যেই খবর এসে পৌঁছল, সরকারের তরফে অমর জওয়ান জ্যোতির কাছে ইন্ডিয়া গেটের সম্মুখে বিশালাকৃতি এক নেতাজি-মূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে যতদিন অবধি সেই মূর্তি তৈরি না হয়, ততদিন পর্যন্ত হলোগ্রাফিক ইমেজের মাধ্যমে নেতাজির আলোক-মূর্তি সেই স্থানকে আলোকিত করবে। এভাবে কেউ যদি পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে আসে, তাহলে সেই উত্তর যে কতখানি দায়সারাভাবে লেখা হয়েছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞের দরকার পড়ে না। শেষমেশ কিনা নেতাজিকে ধার করে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’র ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রচেষ্টা। সময়ে সময়ে বড় লজ্জাবোধ হয়, এই দেশের নাগরিক হিসেবে। মাথা হেঁট করে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়।

১৯৭১ সাল, তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অবসানের পর ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেই সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালে এই জ্যোতির উদ্বোধন হয়। সেই থেকে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই জ্যোতি প্রজ্বলিত ছিল। প্রসঙ্গত, বর্তমানে আমরা বাংলাদেশেরও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে সেদেশের প্রাণপুরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীও উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক তার গভীরতাকে উপলব্ধি করতে, অনুভব করতে— যেটুকুও বা অন্তত ইতিহাস জানা প্রয়োজন আমাদের মহামান্য সরকারের বোদ্ধাদের, সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের অথবা নেতৃবৃন্দের, সেইটুকুও ইতিহাসের জ্ঞান বা পাঠ রয়েছে বলে মনে হয় না আমার। কাজেই ঠিক এই বছরেই হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে উঠে চুপিসাড়ে অমর জওয়ান জ্যোতিকে নির্বাপিত করার পিছনে মহামান্য মোদি-শাহ অথবা তাঁদের পরামর্শদাতাদের মগজে যে ঠিক কোন বুদ্ধি বা সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা কাজ করেছে, তা আমাদের বোধের বাইরে।

প্রহসনের এখানেই শেষ নয়। এরপরে আরও নৌটঙ্কি দেখা বাকি ছিল আমাদের।

অমর জওয়ান জ্যোতি বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই সেনাবাহিনির তরফে জানিয়ে দেওয়া হল, বিটিং দ্য রিট্রিটের অনুষ্ঠানে ‘অ্যাবাইড উইদ মি’ নাম্নী ক্রিশ্চিয়ান যে প্রার্থনাসঙ্গীতটিকে ১৯৫০ সাল থেকে আজ অবধি বাজিয়ে আসা হয়েছে, এবারের অনুষ্ঠানে সেটি আর শোনা যাবে না। মাপ করবেন পাঠকবন্ধুরা, ‘অ্যাবাইড উইদ মি’কে ‘ক্রিশ্চিয়ান প্রার্থনাসঙ্গীত’ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে আমার লজ্জায়, দুঃখে, অসহায়তায় মাথা হেঁট হয়ে আসছে। নির্বাক আস্ফালন ভিন্ন আমাদের বোধ করি একেকটা সময়ে, আর কিছুই করবার থাকে না। ‘সায়লেন্ট নাইট, হোলি নাইট’ গানটি শিক্ষিত সভ্য মানুষমাত্রের কাছেই প্রথমে সঙ্গীত, তারও পরে প্রার্থনাসঙ্গীত। ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ বা এমন একেকটি গান, প্রথমে সঙ্গীত, প্রথমে সুন্দর— তারও পরে সে ব্রহ্মসঙ্গীত অথবা প্রার্থনাসঙ্গীত। সঙ্গীতের কোনও প্রাথমিক শ্রেণিবিভাগ হয় না। ‘অ্যাবাইড উইদ মি’ তেমনই এক কালজয়ী সুরের সৃষ্টি। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির অন্যতম প্রিয় গান ছিল এটি। সবরমতী আশ্রমে বিভিন্ন ভজনের পাশাপাশি এই গানটিও নিয়মিত গাওয়া হত। কার প্রিয় গান, অথবা কার দ্বারা রচিত এই গান— এসব ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ প্রশ্নকে বাদ দিয়েও বলছি, এই গানের যে মিষ্টতা এবং যে স্বাভাবিক সারল্য— তাকে বাদ দিয়ে পরে ‘ভারতীয়’ প্রভাব বাড়াতে ‘ভারতীয়’ ভাষার গানকে ঢোকানোর সিদ্ধান্ত একই সঙ্গে রুচিহীনতা ও গা-জোয়ারি একমাত্রিক উগ্র জাতীয়তাবোধ জাগরিত করার এক জঘন্য প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। বহুত্ববাদ শব্দটি আজ মোদি-শাহের ভারতবর্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়েছে।

নৌটঙ্কির শেষ দফা বাকি ছিল প্রজাতন্ত্রের অনুষ্ঠানের দিন। মাথায় উত্তরাখণ্ডের টুপি, গলায় মণিপুরের চাদর জড়িয়ে রাজবেশে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন আমাদের প্রধানসেবক মহোদয়। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক মাধ্যমে আবেগ-গদগদ গলায় ঘোষণা করে দিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের উদযাপনের সময়েও আলাদা করে আমাদের রাজ্যের কথা স্মরণে রেখেছেন। নিন্দুকেরা সরবে জানিয়ে দিল, প্রধানমন্ত্রীবাহাদুর বোধ করি এও স্মরণে রেখেছেন যে, দুটি রাজ্যেই আসন্ন নির্বাচন। প্রজাতন্ত্রের অনুষ্ঠানে এমন পোশাকবিধির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে নির্বাচনী আইনের গেরোয় পড়তে হবে না হয়তো, কিন্তু এমন নির্লজ্জভাবে ভোটমুখী প্রজাতন্ত্র উদযাপন যে কারও চোখে লাগতে বাধ্য। সাধে কি আর প্রহসন চলছে বলেছি! উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে স্মরণে রেখেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত কল্যাণ সিংকে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করা হল। ভুললে চলবে না, এই কল্যাণ সিংয়ের আমলেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারই কি পুরষ্কার পেলেন কল্যাণ অথবা উত্তরপ্রদেশে তাঁর অনুগামী অনুচরেরা সবাই?

এই সবকিছুর পাশাপাশি নব্বই-ঊর্ধ্ব সর্বজনশ্রদ্ধেয় সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে, তাঁর জীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সামান্য পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়ার মতো অপমান; অথবা ২০২১তে পদ্মশ্রী ঘোষণার পরেও মৃত্যুর মাত্র পাঁচদিন আগে ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি মৃত্যুশয্যায় শায়িত কিংবদন্তী শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের হাতে অবশেষে সত্যি সত্যি করেই পদ্মশ্রী সম্মান ও মানপত্র তুলে দেওয়া— এসব ছোটখাটো নৌটঙ্কি তো হামেশাই জারি রয়েছে।

মধ্যে মধ্যে আর কিছু না হোক (তুলনা না করেই বলছি)— ইদানীং যেন বড্ড বেশি করেই আমাদের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। তিনি চা বিক্রি করেননি। এতরকম ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর (পড়ুন ‘মোদী’)’-এর মতো করে, নানাবিধ যেন ‘গো-অ্যাজ-ইউ-লাইক’ ইভেন্টের অনুপ্রেরণায় নানা বেশে নানা ছদ্মবেশেও, মাথায় পালক লাগিয়ে অথবা গলায় গামছা জড়িয়ে— তিনি বোধ করি কোনওদিনও আমাদের সুমুখে এসে উপস্থিত হননি। তৎসত্ত্বেও কোনও এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেই মানুষটিকে সম্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, “এবারে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমাদের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শিক্ষিত রাষ্ট্রপ্রধানকে— ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং!” ইতিহাসের পাতায় এমন শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধানের সত্যিই বড় একটা নজির নেই। যে কারণেই বোধহয় উইকিপিডিয়ার পাতায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পরিচয় লিখতে গিয়ে লেখা হয়েছে, “অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক”। এই সম্মানের গুরুত্ব নরেন্দ্রভাইয়ের পক্ষে বোঝা অসম্ভব…