Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নৃত্যজগতের নক্ষত্রপতন

বিরজু মহারাজ | কত্থকশিল্পী

ললিতা ঘোষ

 



নৃত্যশিল্পী, নৃত্যে ডক্টরেট

 

 

 

 

চলে গেলেন লখনৌ ঘরানার কত্থক নৃত্যের সাধক তথা প্রবাদ-প্রতিম পণ্ডিত নৃত্যগুরু বিরজু মহারাজ। বয়স হয়েছিল ৮৩। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের মৃত্যুতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের জগতে একটা বর্ণময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।

মহারাজজির জন্ম ১৯৩৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি লখনৌতে। কালকা-বৃন্দাদিন ঘরানার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন অচ্ছুন মহারাজের পুত্র-শিষ্য। তাঁর দুই প্রখ্যাত কাকা শম্ভু মহারাজ এবং লচ্ছু মহারাজ। যদিও নৃত্য তাঁর ভিত্তিপ্রস্তর ছিল, তবুও ভারতীয় সঙ্গীতের ওপর তাঁর দখলদারি বিন্দুমাত্র কম ছিল না। গুরুজি সব ধরনের তালবাদ্য বাদনেও ছিলেন তুখোড়। নানান ধরনের কলা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কবিতা লিখতেন, ছবিও আঁকতেন।

নয়াদিল্লিতে কলাশ্রম নামে নিজের আঙ্গিক প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি নৃত্যশিক্ষাকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন। বেশ কিছু হিন্দি চলচ্চিত্রে নৃত্য নির্দেশনা করেছিলেন তিনি। ২৮ বছর বয়সে তিনি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া কালিদাস সম্মান এবং ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মবিভূষণও পেয়েছিলেন। বিশ্বরূপম চলচ্চিত্রে নৃত্য নির্দেশনার জন্য জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

পণ্ডিত বিরজু মহারাজ ছিলেন অসামান্য দক্ষ কথক। জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন নাচকে। সেই দক্ষতা প্রদর্শনে ছিলেন অনন্য বিরজু মহারাজ।

কলকাতায় পণ্ডিত বিরজু মহারাজের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে সংবাদ প্রতিদিনের পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করার সৌভাগ্য ঘটেছিল আমার। সেই অসামান্য অভিজ্ঞতা এবং তারপরে তাঁর কিছু অনুষ্ঠান দেখা জানা বোঝার বুঝদারি থেকে বলতে পারি তিনি প্রয়াণের আগে অবধি ছিলেন সজীব, চিরনতুন এবং অসামান্য জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, যার চুম্বকীয় ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে দর্শক, শিক্ষার্থী ছুটে আসে পতঙ্গের মত। যার টানে সেদিন পদাতিকের সেই আয়তদীর্ঘ ঘরটি তো বটেই, অন্যান্য অনুষ্ঠানক্ষেত্রেও প্রবেশের সুযোগ থাকত না।

সেদিন কলকাতায় প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত বিরজু মহারাজের কাছে কত্থক নৃত্যের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্যে ভিড় উপচে গিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। ছিলেন কচিকাচা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক আট থেকে আশি পর্যন্ত শিক্ষার্থী। প্রশিক্ষণ শিবিরের সব থেকে বড় আকর্ষণ ছিল দীক্ষিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কত্থক শিখতে আসা, কত্থকের নাম ছাড়া আর কিছুই না জানা খুদে শিক্ষার্থীদের জন্যে গুরুজির প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া। যারা বাস্তবিক নাচে তেমন সড়গড় নয়, তাদের শেখানোর জন্যে যে কৌশল তিনি অবলম্বন করেছিলেন, সেটা আজও আমি ভুলতে পারিনি। এটা আমার মত নৃত্যাঙ্গনার কাছে অসামান্য শিক্ষা ছিল। আমি বুঝলাম মহারাজজি কীভাবে নাচ শেখাবার সময় নাচের সঙ্গে জীবনের নানান রংরূপগন্ধকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে পারেন অতি অনায়াসে, সুচতুর দক্ষতায়, পরম্পরার অসামান্য জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে। তাঁর প্রশিক্ষণে জীবনের সঙ্গে নাচের কোনও পার্থক্য থাকে না। আদিতে যেভাবে নাচের উৎপত্তি সেইভাবেই প্রতিটি শাখা থেকে তিনি নাচের সুষমাকে শুষে নিয়ে জারিত করতে পারেন শিক্ষার্থীর মধ্যে। বিশেষ করে জীবনের চলনের সঙ্গে নাচের চলনের অভেদ সম্পর্ক, পাখি ওড়ার সঙ্গে নৃত্যাঙ্গনাদের ওড়ার ভঙ্গি করতে শেখান অনায়াস দক্ষতায়।

গুরুজি অনন্য, গুরুজির অসামান্য কিছু নৃত্য অনুষ্ঠান আগামী দিনের শিক্ষার্থী, নৃত্যশিল্পীদের কাছে শিক্ষার ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলবে। তিনি রেখে গেলেন এক ঝাঁক প্রশিক্ষিত শিল্পী যাঁরা তাঁর ঘরানাকে নতুন করে বয়ে নিয়ে যাবেন নতুন নতুন উদ্যমে।