মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ভবনের মুখ্য সমন্বয়ক; কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির উত্তরণের সন্ধিকালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে তার বিস্তার ও বৈচিত্র আমাদের বিস্মিত করে। সমসাময়িক নথি ছাড়াও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী’ বইতে স্বল্পপরিসরে এইসময়ের শান্তিনিকেতনের বিদ্যাচর্চার মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায়। বোলপুরের ভুবনডাঙার রুখুপ্রান্তরে সেসময় যে বিপুল বিদ্যা-আয়োজন মহোৎসব সম্পন্ন হয়েছিল তা বিস্ময়কর বইকী! প্রায় সমকালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও সূচিত হয়েছিল নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক পঠন-পাঠনের এক নতুন অধ্যায়। ব্রিটিশ যুগে পূর্বভারতের প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এইসময়ের আগে পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অন্যতর ইতিহাস। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রটির আমূল সংস্কার হয়। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা ও আদর্শ, বলাই বাহুল্য, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ঔপনিবেশিক যুগে দেশজ ছাঁদের বিকল্প একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের নিরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা হিসেবে ১৩০৮ সালের (১৯০১) ৭ পৌষ সূচনা হয়েছিল শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের। এইখানে একটু সংক্ষিপ্ত সালতামামির প্রয়োজন। ১৩২৫ বা ১৯১৮ সালের পৌষ-উৎসবের সময় বিশ্বভারতীর প্রতীকী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়, আর ১৩২৮ বা ১৯২১ সালের ৮ পৌষ কবি বিশ্বভারতীকে ‘সর্বসাধারণের’ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। বিশ্বভারতীর ইতিহাসের এই দুটি ঐতিহাসিক তারিখের মধ্যে আছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। ১৩২৬ সালের ১৮ আষাঢ় (৩ জুলাই, ১৯১৯) বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক ‘কার্যারম্ভ’ সূচিত হয়, এবং সেই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংস্থিতি (constitution)-ও প্রকাশিত হয়। সুতরাং ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে বিশ্বভারতীর সূচনা পর্যন্ত সময়কালের মাঝে বয়ে গেছে প্রায় দুটি দশক। এরই মধ্যে নোবেল পুরস্কারের সৌজন্যে আক্ষরিক অর্থেই কবি বিশ্বকবি হয়ে উঠেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত মানবতাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে, সেও এই সময়েরই ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্বে ভারত জগৎসভাকে কীভাবে তার ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ মন্ত্রে শুশ্রূষা জোগাবে সেই ভাবনাটিও লগ্ন হয়ে যায় কবির ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার ভাবনায়। ১১ অক্টোবর ১৯১৬ তারিখে আমেরিকা থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই লিখেছিলেন, “শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুল্তে হবে— ঐখানে সর্ব্বজাতিক মনুষ্যত্বচর্চ্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে— স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আস্চে— ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে— ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে…।” কবির এই সঙ্কল্পই বছর দুয়েকের মধ্যে ‘বিশ্বভারতী’ হিসেবে রূপলাভ করে।
কেমন ছিল সেই ‘বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা’ তার পরিচয় নানাভাবে পাওয়া যেতে পারে। একশো বছরের এপার থেকে সেইসময়ের উদ্দীপনা বুঝতে চাইলে তার অন্যতর প্রকৃষ্ট উপায় হতে পারে অঙ্কুরদশার বিশ্বভারতীর বিদ্যাসমবায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা। বস্তুতই সে-এক সমীহ-জাগানিয়া ইতিহাস। সামষ্টিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে সমত্ব ও মমত্ব চেতনা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ ‘সমবায়’ শব্দটির উপর জোর দিতেন। বিশ্বভারতীর দিগন্তহীন বিদ্যাচর্চার অভীপ্সা ও আয়োজন বোঝাতে কবি ‘বিদ্যাসমবায়’ শব্দটিই বেছে নিয়েছিলেন। ‘শান্তিনিকেতন পত্রিকা’র ১৩২৬ (১৯১৯) সালের আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় ‘বিদ্যাসমবায়’ নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমাদের দেশে বিদ্যাসমবায়ের একটি বড়ো ক্ষেত্র চাই, যেখানে বিদ্যার আদান প্রদান ও তুলনা হইবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রাখিয়া বিচার করিতে হইবে।” এই লেখাটির পাশাপাশি সমসাময়িক (‘শান্তিনিকেতিন পত্রিকা’, বৈশাখ ১৩২৬) আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ নজর করলে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তাহার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা।” সোজাকথায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বটে কিন্তু নতুন নতুন গবেষণা এবং গোটা বিশ্বের মানবসম্পদকে মানবহিতায় তা দান করা হল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ— এমনই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীর সূচনা পর্বেই সেই কাজটি শুরু হয়েছিল। বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতেরা উচ্চাঙ্গের গবেষণাকর্মে ব্রতী হয়েছিলেন সেই তাগিদেই। শুধু গবেষণাকর্মেই নয়, বিদ্যা-আয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্রে; বিশেষ করে তার পঠন-পাঠনের মানচিত্রে প্রতিফলিত হয় সেই তাগিদ। পঠন-পাঠনের এই মানচিত্রকে একভাবে বলা যেতে পারে সিলেবাস। সিলেবাস প্রতিষ্ঠানের বিদ্যাচর্চার দর্পণের মতো। সূচনাপর্বের সিলেবাসে কবির অভীপ্সিত বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। কেমন ছিল সেই পঠন-পাঠনের ধারা?
প্রভাতকুমারের প্রাগুক্ত বইটির বিবরণ ও অন্যান্য নথি থেকে জানা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য পড়াচ্ছেন। ব্রাউনিঙের দুরূহ কাব্যপাঠ ও ব্যাখ্যা করছেন কবি এমন উল্লেখ করেছেন প্রভাতকুমার। ওদিকে ইংরেজি সাহিত্যের ডালি সাজিয়ে বসেছেন অ্যান্ড্রুজ সাহেব। পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী পড়াচ্ছেন হিন্দু ও বৌদ্ধদর্শন। অধিকন্তু বিধুশেখর ও পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন পড়াচ্ছেন সংস্কৃত সাহিত্য ও ব্যাকরণ। ক্ষিতিমোহনের আগ্রহের আরেকটি ক্ষেত্র ভারতের মধ্যযুগের মরমিয়া ধর্ম ও দর্শন। ভারতীয় ভক্তিবাদী ধারার গবেষণার এই ক্ষেত্রটিই কালে ক্ষিতিমোহনের পাণ্ডিত্যের বিশেষ অভিজ্ঞান হয়ে উঠবে। তবে শুধু এই আশ্রম-শিক্ষকেরাই নন; বৌদ্ধদর্শন পড়াতে সিংহল থেকে শান্তিনিকেতন এসেছিলেন এক মহাস্থবির। মৈথিলী পণ্ডিত কপিলেশ্বর মিশ্র পড়াতেন পাণিনি। বিদ্যালয় পর্যায়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের ভিত পাকা না হলে কলেজ পর্যায়ে পাণিনি পড়ানো দুঃসাধ্য। অতএব বিশ্বভারতীর কলেজ পর্যায়ের সিলেবাসের প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিদ্যালয় পর্যায়েও। স্কুল পর্যায়ে তখন ‘ধরানো হল’ লঘুকৌমুদী। শুধু যে সাহিত্য বা দর্শন তা-ই নয়, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ আদিকুটিরে জীবতত্ত্ব সম্পর্কে ধারাবাহিক বক্তৃতা করে চলেছেন। নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে এইসব বক্তৃতা ও স্বল্পকালীন ক্লাসগুলিও ছিল তখন বিশ্বভারতীর শিক্ষাতন্ত্রে ওতপ্রোত ও পরিপূরক। গুজরাট থেকে জার্মান ভাষাভিজ্ঞ নরসিংভাই প্যাটেল কিছুদিন আশ্রমে জার্মান শেখানোর দায়িত্ব নেন। ওদিকে বোম্বাইয়ের পার্সি যুবক হিরজিভাই পেস্তোনজি মরিসওয়ালা শুরু করলেন ফরাসি শেখাতে। মাঝে কিছুদিন খোদ ফ্রান্স থেকে আসা পল রিশার পড়িয়েছিলেন ফরাসি ভাষা। শুধু ছাত্ররা নয়, সেইসব ক্লাসে তখন ভিড়ে যেতেন অধ্যাপক ও আশ্রমিকেরাও।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন
শান্তিনিকেতনে বিবিধ বিদ্যা-আয়োজনের এই খণ্ডচিত্রটি হল ১৯১৯ সালের। প্রভাতকুমার লিখেছেন, “এইরূপে ১৯১৯ সনে শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত ঘরোয়াভাবে ভাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ উপ্ত হইল।” হয়তো-বা এও এক সমাপতন যে, ১৯১৯ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাসহ ভারতীয় ভার্নাকুলার ল্যাঙ্গুয়েজগুলির উচ্চবিদ্যার পঠন-পাঠন শুরু হবে। সমাপতন এও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তখন শান্তিনিকেতনের মতোই ভারতীয় ভার্নাকুলারের পাশাপাশি সিংহলি ভাষাকেও অন্তর্গত করে নেবে। সেকথায় আসার আগে বিশ্বভারতীর সূচনাকালের দিনগুলিতে পঠন-পাঠনের চিত্রটি আরেকটু স্পষ্ট করে নেওয়া যাক।
সেইসময়ের আশ্রমের মুখপত্রতুল্য ‘শান্তিনিকেতন পত্রিকা’র মাঘ ১৩২৬ সংখ্যায় ‘১৮ই আষাঢ় হইতে ৭ই পৌষ, ১৩২৬ সাল’ পর্যন্ত যে ‘বিশ্বভারতীর ষাণ্মাসিক বিবরণ’ দেওয়া হয় তাতে জানা যায়, ছুটিছাটা বাদে কার্যারম্ভের পর থেকে মাস চারেকের মধ্যে বিশ্বভারতীতে অনেকগুলি বিষয় পঠন-পাঠনের জন্য গৃহীত হয়েছে। তালিকাটি অনেকটা এইরকম: ‘১। সংস্কৃত, দুই বিভাগ, (ক) সাহিত্য ও ব্যাকরণ (খ) তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র। ২। পালি, দুই বিভাগ, (ক) সাহিত্য ও ব্যাকরণ এবং (খ) দর্শন ও মনোবিজ্ঞান। ৩। ইংরাজী সাহিত্য। ৪।সিংহলী ভাষা। ৫। চিত্রকলা। ৬। সঙ্গীত।’ এরপর পত্রিকাটিতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে মন্তব্য করা হয়েছে, “সম্প্রতি যেরূপ ব্যবস্থা আছে, তাহাতে ছাত্র উপস্থিত হইলে যে-কোনো সময়ে প্রাকৃত, মারাঠী ও গুজরাটী পড়ান আরম্ভ করা যাইতে পারে।”
শুধু ভাষা ও তত্ত্বশিক্ষাই নয়, ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলা-সঙ্গীত ভবন। তাতে যুক্ত হয়েছেন নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ করের মতো শিল্পীরা, আর সঙ্গীতে পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী, নকুলেশ্বর মিশ্র প্রমুখ। শান্তিনিকেতনে যখন বিশ্বভারতীর ইতিহাসের এই জ্ঞানকাণ্ড রচিত হচ্ছে তখন তলে তলে প্রস্তুতি চলছে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড রচনার। ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সূচনা হবে বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ড শ্রীনিকেতনের। সে আর-এক ইতিহাস।
নন্দলাল বসু
আগেই বলা হয়েছে, নিয়মিত বক্তৃতা বা স্বল্পকালীন ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা সেই সূচনাপর্বের বিশ্বভারতীর অন্যতম ঐশ্বর্যের একটা দিক। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ ‘বিদ্যার উৎপাদন’। শুধু অধ্যয়ন ও অধ্যাপন কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হতে পারে না। বিদ্যার উৎপাদন হতে গেলে তাকে নিত্যজায়মান বা সদাজীবন্ত থাকতে হয়। সেইজন্যেই হয়তো নিয়মিত অধ্যাপকদের পাশাপাশি আজকালকার ‘ভিজিটিং ফেলো’র মতো ব্যবস্থা বিশ্বভারতীর সেই অঙ্কুরদশাতেই লক্ষ করা যায়। এক রথীন্দ্রনাথই কার্যত ওই চারমাসের মধ্যে জেনেটিক্স বিষয়ে ষোলোটি বক্তৃতা করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী তাঁকেও ছাড়িয়ে যান। তিনি ‘বেদান্তদর্শনের ভূমিকারূপে অন্যূন ২৫টি বক্তৃতা করেন।’ পরবর্তী একবছরে, অর্থাৎ ১৩২৬ সালের ৮ পৌষ থেকে ১৩২৭ সালের ৭ পৌষ (১৯১৯-১৯২০) সময়পর্বে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে যে-সব বক্তৃতা আয়োজিত হয় তার বিষয়বস্তুর ওজন দেখলে ঘোর কাটে না সহজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব পণ্ডিতেরা তখন বক্তৃতা করছেন ভুবনডাঙার প্রান্তরে! বক্তৃতার সঙ্গে সেকালের ‘পাওয়ার পয়েন্ট’; অর্থাৎ ম্যাজিক লণ্ঠনের ব্যবহারও করছেন কেউ কেউ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ‘রিলেটিভিটি’ নিয়ে বলছেন তো মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তিনটি পৃথক বক্তৃতায় বলছেন ভাষাতত্ত্বের নানাদিক নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক ডঃ তারপুরওয়ালাও তিনটি বক্তৃতা করছেন এইসময়েই। তার মধ্যে ২২ কার্তিক ১৩২৬ তারিখের বক্তৃতাটি বিশেষ কৌতূহল উদ্রেক করে আমাদের। সেই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘ইনস্ট্রাকশন অফ দ্য ইয়ং ইন দ্য লজ অফ সেক্স’। বোঝা যায়, ‘জ্ঞান যেথা মুক্ত’ কথাটা আশ্রমে কতটা সত্য হয়ে উঠেছিল বিশ্বভারতীর সূচনার সেই দিনগুলিতে। এমন নয় যে আশ্রম তখন ধনী হয়ে উঠেছে। দান-দাক্ষিণ্য আর সর্বোপরি আপন সীমিত সামর্থ্যেই চলছে বিদ্যা-আয়োজনের এই বিপুল কর্মকাণ্ড। শুধু ক্লাস বা বক্তৃতা নয়, ওই একবছর সময়ে আশ্রমের লাইব্রেরিতে নতুন বই কেনা হয়েছে ২১২৩খানা। শুধু লাইব্রেরিবাবদই খরচ হয়েছে একবছরে ৪৪১৫ টাকার বেশি। নব্বইটার উপর দেশি-বিদেশি সাময়িকপত্র যুক্ত হয়েছে সেবছর লাইব্রেরিতে। দেশ-বিদেশের অনেক দানশীল সুহৃদ ব্যক্তি তখন বিশ্বভারতীর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তা সত্য, কিন্তু মনে রাখতে হবে বিশ্বভারতীও তখন সে-সব দান গ্রহণের যোগ্য পাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। আর তা যে মূলত আশ্রমগুরুর সৌজন্যেই সম্ভব হয়েছিল তা বোধহয় বলবার অবকাশ রাখে না। সংগৃহীত, প্রাপ্ত ও ক্রীত বইপত্রগুলি থেকেও বোঝা যায়, বিশ্বভারতীর তত্ত্বগত অবধারণাকে কীভাবে তখন ‘বিশ্বত্ব’ ও ‘ভারতীয়ত্ব’-এর সম্মিলনে ‘বিদ্যাসমবায়’-এর ফলিত রূপে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছিল।
বিধুশেখর শাস্ত্রী
‘বিদ্যাসমবায়’-এর ধারণাটি যে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তথ্যের দাবিতে এও বলতে হয় যে ১৯১৯ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছিল অনুরূপ একটি বিদ্যাসমবায়ের ক্ষেত্র। তবে সেই ক্ষেত্রটি ছিল মূলত আধুনিক ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষার বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পঠন-পাঠনের সীমায় নিবদ্ধ। বস্তুত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘলালিত একটি আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ হয় ১৯১৯ সালেই। কোন প্রতিষ্ঠান কোন প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করেছে এই তর্ক তোলার জন্য আমরা প্রসঙ্গটি এখানে উত্থাপন করছি না। এই দুইয়ের মধ্যে মিলও যেমন আছে তেমনি অমিলও আছে কিছু সেইটি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় আধুনিক প্রাদেশিক ভাষাবিভাগ প্রবর্তনের আকাঙ্ক্ষা স্যর আশুতোষ দীর্ঘদিন নিজের মনে লালন করে চলেছিলেন। স্যাডলার কমিশন (১৯১৭)-এর সুপারিশ তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নে সহায়ক হয়েছিল তা অবশ্যস্বীকার্য। আশুতোষের এই প্রয়াসের মধ্যে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিদ্যাসম্মিলনের একটি দিক অবশ্যই ছিল। অধিকন্তু তারই সঙ্গে মিশে ছিল জাতিগঠনের একটি উচ্চারিত-অনুচ্চারিত প্রকল্প। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ১৯২৩ সালের সমাবর্তন ভাষণে এই দুটি দিকই খোলসা করেছিলেন আশুতোষ। বলেছিলেন, “…higher studies could be achieved only by assimilation of what is best in the West with what is best in the East, for revivification of all that is most vital in our national ideals.” সেইসঙ্গে ভারতীয় আধুনিক প্রাদেশিক ভাষাসাহিত্য বিভাগ খোলার ঘটনাটির গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, এটি হল, “a special feature of [Calcutta University] which should constitute its chief glory in the eyes of all patriotic and public spirited citizen.” স্যর আশুতোষের অন্যতম সহায়ক দীনেশচন্দ্র সেন তো স্পষ্ট করেই তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জাতিগঠন করিবার আদর্শ সমক্ষে রাখিয়া ইনি [আশুতোষ] বিশ্ববিদ্যালয়ের কাণ্ডার চালাইতেছেন।”
নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতির দেশ উপনিবেশিত ভারতকে একসুতোয় গাঁথার অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে্র পঠন-পাঠনে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন স্যর আশুতোষ। দৃশ্যত সালটা ১৯১৯। আর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে দেশ-বিদেশের ভাষাশিক্ষা, জ্ঞানচর্চা, কলা-সঙ্গীতচর্চার যে বিদ্যাসমবায় তৈরি হচ্ছে; সেখানে ‘বিশ্ব’ ও ‘ভারত’ মিলেমিশে হয়ে যাচ্ছে ‘বিশ্বভারতী’। বিশ্বভারতীর কার্যারম্ভের সেই সালটাও ১৯১৯। তবু খেয়াল করতে হয়, ‘বিশ্ব’ শব্দটিই এখানে অগ্রগামী। তাছাড়া ‘ভারতী’ শব্দে যেমন ‘ভারত’ অনুস্যূত আছে, তেমনি আছে সীমানাহীন সর্বকালীন সারস্বত-চর্চার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর!