অয়নেশ দাস
পূর্ব প্রকাশিতের পর
বন্দুকের নলই…
সে বেশ খানিক আগের কথা। আশির দশকের শেষার্ধ। তখন সকাল-সকাল ওঠার রেওয়াজ ছিল। বারান্দায় এসে দাঁড়ালে মাঝেমধ্যেই পাড়ার অরূপদাকে দেখতাম সামনের রাস্তা ধরে সাইকেলে চেপে আসতে। অরূপদার পিঠের স্ট্র্যাপে বাঁধা থাকত দোনলা পাখিমারা বন্দুক আর সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে নীচের দিকে মাথা করে দুলতে দুলতে ঝুলত সারস, বালিহাঁসের ভেজা ভেজা শবদেহ। সকালের অরূপদাকে দেখে এক অদ্ভুত সমীহ জেগে উঠত আমার মনে। বিকেলের ওর মুদির দোকানের ভিতর আনন্দবাজারের ঠোঙায় ডাল মাপতে থাকা নিরীহ মুখের অরূপদাকে দেখলে সেটা আর থাকত না। কিন্তু আমার যে সকালের অরূপদাকেই পছন্দ ছিল। তাই ওর দোকানে সচরাচর যেতে চাইতাম না; অরূপদার কাছে ডাল-দুধ-তেজপাতা চাইতে আমার কোথায় যেন বাধত।
একদিন অরূপদা বলেছিল— কী রে, আমার সঙ্গে যাবি?
সে ছিল আমার কাছে লটারির টিকিট পাওয়া। আজও মনে আছে এক শনিবারের কাকভোরে অরূপদার পিছনে ক্যারিয়ারে বসে, অরূপদার পিঠের স্ট্রাপে শক্ত করে বাঁধা বন্দুকের লোহা-লোহা, তেল-তেল গন্ধ বুকের মধ্যে নিয়ে পৌঁছলাম পুরনো রাজবাড়ির গড়ে। গড় মানে উঁচুনীচু মাটির ঢিপির মধ্যে মধ্যে ঝোপঝাড় আর বাঁশবন। বিঘাখানেক জমির ওপর যেন ছোট্ট এক আফ্রিকান ভেল্ড। সেটা পেরোলেই রাজাদের দীঘি। দীঘিতে তখন বকের ঝাঁক।
অরূপদা ফিসফিসিয়ে আমাকে বলল— এখানেই বোস, আওয়াজ করবি না।
আমি বললাম— তুমি একাই ঝিলের ধারে যাবে?
অরূপদা বলল— দূর বোকা, ওরা বুঝে যাবে না?
আমি অবাক হয়ে বললাম— এত দূর থেকে মারা যাবে?
অরূপদা হেসে বলল— এটার রেঞ্জ কত জানিস? আর তাছাড়া এই দানাটার টাইপ আলাদা। একে বলে হলো পয়েন্ট। বডির মধ্যে ফাটে। তাই মরার চান্স হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
সেই সময়ে আমাদের এলাকায় অরূপদাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোনও বাড়িতে বন্দুক রাখার কথা আমি অন্তত শুনিনি। বন্দুক-রাইফেল নিয়ে চর্চা তো দূরের কথা। অরূপদার ঠাকুর্দা ছিলেন ইংরেজ আমলের শিকারি। সেই সূত্রেই অরূপদার বন্দুকপ্রাপ্তি, প্রীতি ও চর্চা। সেই অরূপদাই যে কী করে মুদির দোকান দিল!
–আমার ভাণ্ডার শেষ, বুঝলি? বুড়ো হান্টারের কটা দানা এখনও আছে। সত্তর বচ্ছর আগের মাল। ইয়ার্কি না। রোজ নিয়ম করে রোদে দিই। তারই দুটো মাত্র নিয়ে এসেছি। নইলে তোকেও একবার ট্রাই করাতাম। যাক, এবার চুপ কর।
অরূপদা পা টিপে টিপে সামনের ঢিপিটার আড়াল নিল। পিছন থেকে বন্দুক হাতে অরূপদার এগিয়ে যাওয়াটা অবিকল যেন চাঁদের পাহাড়ের অলঙ্করণে মিশে যাচ্ছিল। যদিও অরূপদার পিঠে ব্যাগ ছিল না আর পায়ে ছিল পাজামা। তবুও নিমেষে ঠোঙা হাতে এক-দুই গ্রাম ডালের হিসেবে পর্যুদস্ত গোবেচারা দোকানদার থেকে ক্র্যাকশট দিয়েগো আলভারেজে বদলে গেল অরূপদা। আর পেছনে ঢিপির আড়াল থেকে কোনও এক শঙ্করের মতোই অগাধ বিস্ময় ও মুগ্ধতা চোখে মেখে সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম আমি।
অরূপদা টিপ করে ফায়ার করল। একটা দাম করে শব্দ। কুয়াশামাখা দীঘির পাড় জুড়ে সামান্য একটু ঝটপটানি। আবার বকগুলো শান্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন কিছুই হয়নি। অরূপদা কি মিস করল নাকি?
অরূপদা বলল— লেগেছে! যা কুড়িয়ে নিয়ে আয়।
এতখানি দূর থেকে, এত প্রত্যয়ের সাথে, এত নিখুঁতভাবে কোনও প্রাণ নিয়ে নেওয়া যায়; আমার ধন্দ কিছুতেই কাটছিল না।
আমি বললাম— কোনটা?
অরূপদা বলল— দৌড়ে যা। সব পালালে যেটা পড়ে থাকবে, সেটা।
আমি অবাক হয়ে বললাম— ওরা সব হেঁটে বেড়াচ্ছে যে!
অরূপদা হাসল— তুই দৌড়লেই পালাবে। যা দৌড় দে।
আমি দৌড় দিলাম; বকের ঝাঁকের দিকে চোখ রেখে। ধড়মড় করে ডানা ঝাপটে বকগুলো উড়ে পালাতে শুরু করল। আমি দৌড়তে দৌড়তেই দেখতে পেলাম একটা বেশ বড়সড় বক কিন্তু ওড়েনি। সোজাসুজি তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। তাহলে কি ওইটার গায়েই গুলি লেগেছে? আমি প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। বকটা হঠাৎ চেষ্টা করল দুই ডানা প্রাণপণ ঝাপটে অন্তত শেষবার উড়তে। মাথাটা প্রাণপণ আকাশের দিকে ওঠালেও শরীরটা উঠল না। কোথায় যেন পড়েছিলাম অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে জীবদেহের শরীরে এনডর্ফিন ক্ষরণ বেড়ে যায়। কী জানি! পাখিটা জল ঝাপটে কাদামাটিতে আছড়ে পড়ল। আমার ঠিক সামনে। পেটের কাছটার ধবধবে সাদা পালক রক্তে ভিজে লাল। পালকের আস্তরণ ভেদ করে ফাটা পেটটা বারবার অতিকায় অগ্নিকুণ্ডের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছিল। নিশ্চল দেহ থেকে বকের গলাটা নীচের দিকে গড়িয়ে এসে মাথাটাকে রেখেছিল ঠিক জলের গায়ে। বোধহয় আজৈবনিক জলজ অভিকর্ষণের টানে। আর ঠিক সেই সময়েই ওর চোখ আবার পড়ল আমার দিকে। অদ্ভুত এক অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি নিয়ে বকটা চোখ রাখল ঠিক আমার চোখে। সেই দৃষ্টিতে এনডর্ফিন জিতছিল না কি মরণযন্ত্রণা, আমি ঠাহর করতে পারলাম না। হঠাৎই এক প্রচণ্ড ভয়ে আমি উল্টোদিকে দৌড়তে শুরু করলাম। আমি দৌড়তেই থাকলাম।
অনন্ত দৌড়তে দৌড়তে, ঘামতে ঘামতে আমি শেষে একদিন ঢুকে পড়লাম এক দুঃস্বপ্নের ভিতরে। সেখানেও আমি দৌড়তে থাকলাম আর আমার দিকে বন্দুক তাক করে, শোলার টুপি পরে ঝোপের পিছনে হাসছিল অরূপদা। দিগ্বিজয়ী কনকুইজ়টেডোরের[1] মতো।
–দৌড়ে আর কতদূর পালাবি? এই দ্যাখ নতুন মডেল এটা, রেঞ্জ কত জানিস?
আমি প্রাণপণ দৌড়তে থাকলাম; শেষ শক্তি দিয়ে। কিন্তু কিছুতেই পাল্লার বাইরে যেতে পারছিলাম না। কারণ ততক্ষণে অরূপদার হাতে উঠে আসছিল আরও বেশি পাল্লার নতুন নতুন মডেল।
অরূপদা চিৎকার করছিল, মরবি, মরবি, এখনই মরবি! এটা যে হলো-পয়েন্ট দানা, রে!
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার শরীর ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে অফুরন্ত এনডর্ফিনে। চোখে নেমে আসছে নেশা-নেশা তন্দ্রা। তবু আমি বুঝতে পারছিলাম আমার শরীরে ক্রমশ ঢুকে আসছে গরম সীসার স্পর্শ। তারপর সেটা ব্যাঙের ছাতার মতো ক্রমশ ফুলতে থাকল। আমার পেটের মধ্যে, সাদা পালকের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা এক হিরোশিমা আকাশ-জোড়া বিস্ফোরণের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে আমি শেষবারের মতো শুনতে পেলাম অরূপদার হাসি—
–বুঝলি, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।
চেয়ারম্যানের আগেই বুঝেছিল সাদা ভাম্বি
ইতিহাসও চলতে চলতে হঠাৎ দৌড় শুরু করে। এমনি এমনি হয় না, ভালো রানিং শ্যু পেলে তবেই সে ছুট শুরু হয়। ইতিহাসের এরকমই এক রানিং শ্যু হল গানপাউডার। ১৫ শতাংশ চারকোল, ১০ শতাংশ সালফার আর ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট অর্থাৎ সল্টপিটারের এক বিস্ফোরক মিশ্রণ। আগুনের সংস্পর্শে এলে এই মিশ্রণ থেকে উদ্ভুত হয় ২১০০ ডিগ্রি থেকে ২৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যা প্রতি গ্রাম মিশ্রণ থেকে তৈরি করে ২৭৫ থেকে ৩৬০ ঘন সেমি গ্যাস; যার ফলে সৃষ্টি হয় বিস্ফোরণ। নবম শতাব্দীতে চিনে এর আবিষ্কার। সেখানেই প্রথম বন্দুক তৈরির চেষ্টা হয় বাঁশের নলে এর ব্যবহারে। মোঙ্গোলদের সঙ্গে যুদ্ধে এর কিছু খুচখাচ দুর্ঘটনাময় নিষ্ফল প্রয়োগের বাইরে আর বেশিদূর এগোতে পারেনি চিনেরা। ত্রয়োদশ শতকে হয় আরবদের অথবা মোঙ্গোলদের হাত ঘুরে সিল্ক রুট ধরে ইউরোপে পৌঁছয় গানপাউডার। মাও সেতুং-এর নিজের দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ফর্মুলা যে আসলে পৃথিবী দখলের ফর্মুলা, পৌঁছনোমাত্র সেটা ইউরোপীয়রা সার বুঝে নিয়েছিল মাও-এর জন্মের ছশো বছর আগেই।
ফর্মুলা হাতে আসার কিছুদিনের মধ্যেই তারা বানিয়ে ফেলবে কামান। ইউরোপ জুড়ে প্রত্যন্ত কাস্ল্গুলোর শক্ত পাথুরে দেওয়াল, যারা এতযুগ ধরে ছিল দুর্ভেদ্য; কামানের গোলায় মুহুর্মুহু কেঁপে উঠতে শুরু করবে তারা। ইউরোপ জুড়ে সামন্ততন্ত্রের ভিত নড়ে যেতে শুরু করবে। তারপর সময়ের দাবী মেনেই ইউরোপ বেরিয়ে পড়বে নতুন দুনিয়ার খোঁজে। ভারী কামানের প্রযুক্তি দ্রুত বদলে ফেলে তার হাতে উঠে আসবে এমন এক অপরাজেয় মারণাস্ত্র; হাতে হাতে বহনযোগ্য অথচ যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বের আড়াল থেকে একটি মাত্র আঙুলের সামান্য চাপেই যা নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে জাতির পর জাতি… প্রজাতির পর প্রজাতি… এক নিখুঁত লক্ষ্যে; এক তর্কাতীত মারণক্ষমতায়!
দ্রুতগামী কারাভেলে বোঝাই করে ‘নতুন দুনিয়া’র খোঁজে দলে দলে বেরিয়ে পড়ল ‘আরকেবাস’[2] হাতে নিয়ে ‘সাদা ভাম্বি’[3]-র দল। তাদের আটকানোর ক্ষমতা ছিল না কাদামাটির মানুষের কাদামাটির প্রযুক্তির।
আমাদের পিতৃপুরুষ সুখেই ছিল
গবাদিপশুর পালে আর বিবিধ ফসলে ভরে ছিল তাদের দেশ
আর ছিল কলাগাছের বন আর লবণের ধূ-ধূ জলাভূমিহঠাৎ একদিন তারা দেখল
ছুরির মতো চমকদার সাদা ডানায় ভর করে
মহাসাগরের গভীর থেকে উঠে আসছে এক নৌকা বিশালাকায়সাদা মানুষেরা উঠে এল জলের থেকে
অবোধ্য ছিল তাদের ভাষাআমাদের পিতৃপুরুষ ভয় পেয়ে গেল
তারা বলল— এরা হল ভাম্বি
মৃতদের দেশ থেকে ফিরে আসা প্রেতাত্মার দলতীরের ঝাঁক দিয়ে তারা ফিরিয়ে দিতে চাইল প্রেতাত্মাদের
কিন্তু বজ্রের আওয়াজ করে ভাম্বিরা আগুন ছুঁড়ে মারল
আমাদের পিতৃপুরুষ বেশিরভাগ মরল
কিছু গেল পালিয়েসেই সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত
সাদারা আমাদের যা দিয়েছে তা হল
যুদ্ধ, দুঃখ আর কান্নার স্তূপ[4]
সাতাশশো সেলসিয়াসের উত্তাপে ঝলসানো চিরস্থায়ী ঘা-এর মতো সেই কাদামাটির দুনিয়ার আষ্টেপৃষ্টে দেগে যেতে থাকল অন্তহীন জেনোসাইডের মানচিত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী। অনর্গল। ধ্বংস হল মায়া আর ইনকা সভ্যতা; নিশ্চিহ্ন হতে বসল অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার আদি বাসিন্দারা; পুরোপুরি উবে গেল তাসমানিয়ার আদি মানুষ; দাসব্যাবসার কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল সারা আফ্রিকা।
তবু কিছু বাকি থেকে গেল
কিন্তু কাদামাটির আফ্রিকার গভীরের দখল নিতে তখনও বাকি ছিল। তার জন্য ইউরোপকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ অবধি। বরং বলা ভালো অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেঞ্জামিন টাইলার হেনরির ‘মার্টিনি-হেনরি রাইফেল’ আর হিরাম ম্যাক্সিমের ‘ম্যাক্সিম মেশিনগান’-এর আবিষ্কার অবধি। বধ্য হল আফ্রিকা। বধ্য হল দুখী মহাদেশের কাদামাটির যাবতীয় সন্তান। পাল্লার বাইরে আর থাকল না কোনওকিছুই। হেনরি রাইফেলের আধুনিকতর সংস্করণ উইনচেস্টার রাইফেলের নলে বেঁধেই রাজা লিওপোল্ডকে কঙ্গো উপহার দিয়েছিল হেনরি মর্টন স্ট্যানলি। এবং সেই উইনচেস্টার হাতে থাকলে দুর্গম আফ্রিকার যাবতীয় বিপদের ভয়ও যে শঙ্করের মন থেকে উবে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
সাহস আনবার প্রাণপণ চেষ্টায় সে রাইফেল দুটির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে। একটা উইনচেস্টার, অপরটি ম্যানলিকার— দুটোরই ম্যাগাজিনে টোটা ভর্তি। এমন কোনো শরীরধারী জীব নেই, যে এই দুই শক্তিশালী অতি ভয়ানক মারণাস্ত্রকে উপেক্ষা করে, আজ রাত্রে অক্ষত দেহে তাঁবুতে ঢুকতে পারে।
–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ১৪৩
সূক্ষ্ম কলায় পরিণত হল দূর থেকে নিখুঁত লক্ষ্যে প্রাণ নিয়ে নেওয়ার বিদ্যা। একেকটি হৃদয়; একেকটি ট্রফি! ভাম্বি হয়ে উঠল শ্বেত ঈশ্বর। আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল শ্বেত ঈশ্বরের ওস্তাদ যাদু। কাদামাটির তামাম পৃথিবীর যে কোনও জাতির সবচেয়ে উন্নত অস্ত্রটি তাদের শ্বেতাঙ্গ ত্বক ছুঁতে পারার ঢের ঢের আগেই ইউরোপীয়রা সে বিপক্ষের লাবডুব হৃদয়টিকে ট্রফি বানিয়ে নিতে পারত। শেষ দুর্বলতাটুকুও শেষ হল যখন ফ্রেঞ্চম্যান পল ভিয়েই আবিষ্কার করলেন নাইট্রোগ্লিসারিন; যা কিনা কোনওরকম ধোঁয়া বা ছাই ছাড়াই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে— যার অর্থ— এই আবিষ্কারের পর থেকে গুলি ছোঁড়ার সময়টিতেও বন্দুকধারী বিপক্ষের চোখে অদৃশ্য থাকার চরম সুবিধাটুকুও হাসিল করতে পারল। আর এই নাইট্রোগ্লিসারিনে বলীয়ান, সেকেন্ডে এগারো রাউন্ড ফায়ারিং-এর ক্ষমতাসম্পন্ন মাক্সিম গানের দৌলতে পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হল মহারানির ব্রিটিশ সাম্রাজ্য— যে সাম্রাজ্যে কি না সূর্য এবং সভ্যতার আলো কখনওই অস্তমিত হয় না। সুসভ্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের গর্ব— সেকেন্ডে এগারোটি প্রাণ। আগেই উল্লেখ করেছি, খতমের লার্জ স্কেল ব্যবস্থাপনায় কিভাবে মাত্র পাঁচটি ম্যাক্সিমগানের হলকায় পুড়ে গিয়েছিল আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধায় সমৃদ্ধ এক কাদামাটির ভূখণ্ড— মাটাবেলল্যান্ড।
কিন্ত এতেও সন্তুষ্ট হওয়া গেল না। না, আরও কিছু একটু বাকি থেকে গেল। ১৮৯০-এর মধ্যেই রাইফেল প্রযুক্তির যাবতীয় বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। মাটিতে শুয়ে শুয়ে নিজের অস্তিত্বের কোনওরকম জানান না দিয়েই একজন ইউরোপীয় সৈন্য প্রত্যেক পনেরো সেকেন্ডে পনেরোটি বুলেট ফায়ার করতে পারত। তালে তাল রেখে কার্টিজের মানও যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। বিশেষ করে ট্রপিকাল জলবায়ুতে সেগুলি যথেষ্ট কার্যকর ছিল। কিন্তু তাও যেন একটু কিছু বাকি থেকে গেল। কিছু সমস্যা থেকেই গেল কাদামাটির অসভ্যদের নিয়ে। সে এক সমস্যা। অনেকসময়ই তাদের শরীরে এই বুলেটের আকাঙ্খিত ফল পাওয়া যেত না। সে এক আজব সমস্যা। এই অসভ্য কুৎসিত মানুষগুলোর কী অদ্ভুত জীবনীশক্তি। সে যেন কাদামাটির অন্তঃস্থল থেকে অফুরন্ত প্রাণশক্তির উৎসারণ। কখনও কখনও চার-পাঁচখানা গুলি হজম করেও তারা তাড়া করে আসত। রক্তাক্ত শরীরে; বিভীষিকার মতো।
একটু খুলেই বলা যাক। ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনি চালু করে লি-মেটফোর্ড রাইফেল। এই রাইফেলে ব্যবহার করা হত .৩০৩ বুলেট, যা মার্ক টু নামে পরিচিত ছিল। আগেকার রাইফেল যেমন মার্টিনি-হেনরি বা স্নাইডারে যে বুলেট ব্যবহৃত হত তার থেকে নতুন এই বুলেটগুলি অনেক বেশি হালকা ও অনেক বেশি পাল্লার। ছোট ক্যালিবারের, তাই অনেক বেশি দ্রুতবেগসম্পন্ন হলেও এই বুলেটের একটি অদ্ভুত ত্রুটি দেখা দিল। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে সার্জেন-মেজর জে বি হ্যামিল্টন লিখলেন—
দিস বুলেট ওয়জ় কমপ্লেইন্ড অব অ্যাজ় নট হ্যাভিং স্টপিং পাওয়ার— দ্যাট ইজ়়, ইট পাস্ড থ্রু দ্য লিম্বস্ অর বডি উইদাউট কজ়িং ইমিডিয়েট কোলাপ্স আনলেস সাম ভাইটাল পার্ট অর ইম্পর্ট্যান্ট বোন ওয়জ় স্ট্রাক। ইন ইউরোপিয়ান ওয়রফেয়ার দিস ওয়জ় অব কম্পারেটিভলি লিট্ল কনসিকোয়েন্স, অ্যাজ় সিভিলাইজ়ড ম্যান ইজ় মাচ মোর সাসেপ্টিব্ল দ্যান স্যাভেজেস। অ্যাজ় আ রুল হোয়েন আ ‘হোয়াইট ম্যান’ ইজ়় উন্ডেড হি হ্যাজ় হিজ় এনাফ, অ্যান্ড ইজ়় কোয়ায়েট রেডি টু ড্রপ আউট অব দ্য র্যাঙ্কস অ্যান্ড গো টু দ্য রিয়ার; বাট দ্য স্যাভেজ, লাইক দ্য টাইগার, ইজ়় নট সো ইম্প্রেশনেব্ল, অ্যান্ড উইল গো অন ফাইটিং ইভেন হোয়েন ডেস্পারেটলি উন্ডেড।
দ্রুত এরও জবাব লিখে ফেলল সভ্য দুনিয়া।
এক-দম জবাব— দমদম জবাব
জবাব তৈরি হচ্ছিল দমদমে। হ্যাঁ, এই দমদমে। ছেলেবেলা থেকেই একটিই কারণে দমদমের নাম শুনে এসেছি। কেজি ক্লাস থেকেই বোধহয় জেনেছিলাম দমদমে আছে কলকাতার বিমানবন্দরটি। বিমানবন্দরটি নিজের চোখে দেখবার ইচ্ছে বুকের মধ্যে বারবার ছটফট করে উঠত। এক আত্মীয়ের এয়ারপোর্টলাগোয়া বাড়ির ছাদ থেকে গোটা গোটা বিশাল বিমানগুলিকে ওঠানামা করতে দেখা যায়, এ কথা জেনে আমার যে কী প্রচণ্ড হিংসে হত! পরের দিকে সে টান চলে গিয়েছিল। কলেজে পড়ার সময় সম্পূর্ণ অন্য এক টানে চলে গিয়েছিলাম দমদম। মেট্রো থেকে নেমে নাগেরবাজার, তারপর যশোর রোড বরাবর এয়ারপোর্টের অটো ধরে এইচএমভি-র কারখানা। যাওয়ার সময় মল রোডের কোনায় এক মিনার দেখিয়ে অটোড্রাইভার চিনিয়েছিলেন ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি’। তখন জানতাম না, ব্রিটিশ যুগে এই ছিল ‘দমদম আর্সেনাল’। সেই আর্সেনালে ক্যাপ্টেন নেভিল বার্টি-ক্লের তত্ত্বাবধানে সেই অফুরন্ত প্রাণশক্তির জবাব তৈরি হল— দমদম বুলেট। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় পোস্টিং পাওয়া, ‘বিগ গেম’[5]-এ হাতপাকানো অফিসারদের অভিজ্ঞতা জড়ো হল ব্রিটিশ অস্ত্র-প্রযুক্তিবিদের নকশায়। দমদম আর্সেনালের লেদ মেশিনে নিকেল-ফিনিশ হয়ে সরকারিভাবে ‘মার্ক ফোর’ নাম নিয়ে তা পেটেন্ট পেল ১৮৯৭-এ।
এই অসাধারণ সাফল্যের আনন্দে ১৮৯৭-এর ফ্রিম্যান’স জার্নাল অ্যান্ড ডেইলি কমার্শিয়াল অ্যাডভ্যার্টাইজ়ার-এর লন্ডন করেসপন্ডেন্ট লিখে ফেললেন—
দ্য নিকেল প্লেট বুলেট হিদারটু ইউজ়ড উইথ দ্য লী-মেটফোর্ড রাইফেল ওয়েন্ট ক্লিন থ্রু দ্য বডি, অ্যান্ড আনলেস আ ভাইটাল পার্ট ওয়জ়় স্ট্রাক দ্য পার্সন ডিড নট ফিল দ্য ইনকনভেনিয়েন্স ফর সাম লিট্ল টাইম। দ্য ‘দমদম বুলেট’, অন দ্য আদার হ্যান্ড, স্টপ্স্ দ্য ম্যান ইনস্ট্যান্টলি, অ্যান্ড কজ়়েস সাচ আ উন্ড দ্যাট দ্য পার্সেন্টেজ অব ডেথস্ অ্যান্ড লাইফলং ইনজুরিস ইজ়় লার্জলি ইনক্রিজ়়ড। দ্যাট ইজ়় দ্য ওয়ে টু স্প্রেড সিভিলাইজ়়িং ইনফ্লুয়েন্সেস অ্যান্ড ইম্প্রেস দ্য হিলমেন উইদ আ রেসপেক্ট অ্যান্ড অ্যাডমায়ারেশন ফর দেয়ার ব্রিটিশ ফোজ়।
কাজের দিক থেকে তাকে ‘এক্সপান্ডিং বুলেট’-ও বলা যায়। টার্গেটের শরীরে প্রবেশ করলেই তার ‘হলো পয়েন্ট’ বা ‘সফট পয়েন্ট’ মাথা ফেটে ছড়িয়ে যায়। ফলে শরীরের ভিতরে বুলেটটির ব্যাস দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। একে বলে ‘মাশরুম এফেক্ট’। এই ফুলে ওঠার জন্য প্রচণ্ড গতিশক্তির বেশিরভাগটাই টার্গেটের শরীরে স্থানান্তরিত হয়; ফলে টার্গেটের শরীরে এক প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে ও তার শরীরে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে বীভৎস ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সেই ভয়ঙ্কর অভিঘাত অগ্রাহ্য করা অতিকায় মত্ত হাতির পক্ষেও অসম্ভব হয়ে ওঠে। কাদামাটির মানুষ তো নগণ্য। এই বিষয়ে আমার থেকে অনেক ভালো বর্ণনা দিয়েছিলেন উইনস্টন চার্চিল, সেই সময় ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর করেসপন্ডেন্ট—
দ্য পাওয়ার অব দ্য নিউ লী-মেটফোর্ড রাইফেল উইদ দ্য নিউ দমদম বুলেট— ইট ইজ় নাও কল্ড, দৌ নট অফিশিয়ালি, দ্য ‘এক-দম’[6] বুলেট— ইজ় ট্রিমেন্ডাস… অব দ্য বুলেট ইট মে বি সেইড, দ্যাট ইট্স্ স্টপিং পাওয়ার ইজ় অল দ্যাট কুড বি ডিজ়ায়ার্ড। দ্য দমদম বুলেট, দৌ নট এক্সপ্লোসিভ, ইজ়় এক্সপ্যানসিভ। দ্য অরিজিন্যাল লী-মেটফোর্ড বুলেট ওয়জ়় আ প্যালেট অব লেড কভার্ড বাই আ নিকেল কেস উইদ অ্যান ওপনিং অ্যাট দ্য বেস। ইন দ্য ইমপ্রুভ্ড বুলেট দিস আউটার কেস হ্যাজ়় বিন ড্রন ব্যাকওয়র্ড, মেকিং দ্য হোল ইন দ্য বেস আ লিট্ল স্মলার অ্যান্ড লিভিং দ্য লেড অ্যাট দ্য টিপ এক্সপোজ়়ড। দ্য রেজ়়াল্ট ইজ়় আ ওয়ান্ডারফুল অ্যান্ড ফ্রম দ্য টেকনিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ আ বিউটিফুল মেশিন। অন স্ট্রাইকিং আ বোন দিস কজ়েস দ্য বুলেট টু ‘সেট আপ’ অর স্প্রেড আউট, অ্যান্ড ইট দেন টিয়ার্স অ্যান্ড স্প্লিন্টার্স এভরিথিং বিফোর ইট, কজ়়িং উন্ডস হুইচ ইন দ্য বডি মাস্ট বি জেনারেলি মর্টাল অ্যান্ড ইন এনি লিম্ব নেসেসিটেট অ্যামপিউটেশন।
তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ইউরোপীয় রেটোরিকে ‘বিস্টলিয়ার দ্যান বিস্টস্’— অসভ্য কালো শয়তানদের জন্য এতদিনে তৈরি হল উপযুক্ত সুসভ্য ব্রিটিশ দাওয়াই। আর মারণাস্ত্রের ইতিহাসে চিরকালের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল দমদম আর্সেনাল। যদিও আমি জানতাম দমদমে শুধু উড়োজাহাজ ওঠানামা করে… বুলেটের মতো। অরূপদার সঙ্গে ছেলেবেলার সেই শিকারে যাওয়ার পর থেকে আমারও কোনওদিনই আর বন্দুক-টন্দুকে আগ্রহ জাগেনি। তাই এ সম্বন্ধে পড়াশোনারও কোনওরকম আগ্রহ জেগে ওঠেনি। শুধু অরূপদার হলো-পয়েন্ট দানা খাওয়া বুনো বকটার চোখদুটো আবছা ছবির মতো এখনও মাঝে-মাঝে ভেসে ভেসে আসে আমার স্বপ্নে… ঘোরে… নিদ্রাহীনতায়…। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো ফাটা পেটের হাঁ-উপচানো নাড়িভুড়ি বেয়ে নেমে আসা লাভাস্রোতে পুড়ে যায় নিরুপায় মস্তিষ্কের গভীরতম সুড়ঙ্গ। বকেরা তো অনেক… অনেকদূর উড়ে যেতে পারে। বেঁচে থাকলে একদিন সেটা হয়তো দমদমের আকাশেও উড়ে যেত।
হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন
টেক আপ দ্য হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন—
সেন্ট ফোর্থ দ্য বেস্ট ইয়ে ব্রীড—
গো বাইন্ড ইয়োর সনস্ টু একজ়াইল
টু সার্ভ ইয়োর ক্যাপটিভস’ নীড;
হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন। কাদামাটির অন্ধকার পৃথিবীতে সভ্যতার আলো ছড়িয়ে বেড়ানো। কী অসম্ভব কঠিন দায়িত্বই না পালন করতে হয়েছে রুইয়ার্ড কিপলিং-এর সাধের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে। কিপলিং-এর জন্ম এই ভারতে… উপনিবেশে; কিন্তু শেষ অবধি তো তিনি সাম্রাজ্যেরই প্রতিনিধি। সাম্রাজ্যের অংশ। ‘সাম্রাজ্যের কোকিল’। দিকে দিকে তখন পতপত করে উড়ছে সভ্যতার ইউনিয়ন জ্যাক। ভিক্টোরীয় সমাজ সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাদের রানি ভারতসম্রাজ্ঞী। তাদের সন্তানরা তখন লড়ছে মিশর, সিঙ্গাপুরের ফ্রন্টে। পুরুষেরা সমুদ্রের অন্যপারের কোম্পানিতে নিত্যনতুন বিনিয়োগ করছে। সকালে ঘুম ভেঙে ভিক্টোরীয় জেন্টলম্যান চিন ও ভারত থেকে আমদানি করা সুগন্ধি চায়ে চুমুক দিচ্ছে। প্রাচ্যের সিল্ক গায়ে জড়িয়ে ইয়ং লেডিরা হয়ে উঠছে ফ্যাশন-দুরস্ত। একদিকে এই যেমন ব্রিটেনের মধ্যেকার দৈনন্দিন জীবন; সমুদ্রের ওপারে আরও দূরগামী সে সাম্রাজ্য। রেখায় ও লেখায় ক্রমশ ভরে উঠছে মানচিত্রের ফাঁকা জায়গাগুলি। সভ্যতার আলোয় ভরে উঠছে মানচিত্রের অন্ধকার-অন্ধকার খোপ। সে আলোয় ভরা মশালের বেশিরভাগই তখন মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে হাতে, কাদামাটির পশ্চাৎপদ অন্ধকার মুছে এগিয়ে চলেছে। বয়ে নিয়ে চলেছে হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন! সাজানো ক্যালেন্ডারের মতো এক ছবি। যেন ভয়াল, ভয়ঙ্কর, আদিম, রাত্রির মতো অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে সভ্যতার মশাল হাতে কাদামাটির যাবতীয় অন্ধকার মুছে এগিয়ে চলেছেন মহামতি ডেভিড লিভিংস্টোন। চওড়া কাঁধে তাঁর ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’।
কাদামাটির মানচিত্রের ফাঁকা ফাঁকা জায়গাগুলো ছোট্টবেলা থেকেই প্রবল টানত আরও একজনকে। কিপলিং-এর মতোই এক উপনিবেশে… জ়ার অধিকৃত পোল্যান্ডে জন্ম তাঁর। জোসেফ কনরাড। যদিও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ পরিচয়েই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন কনরাড। ১৮৯০ সালে এক বেলজিয়ান কোম্পানির স্টিমারে লুআলাবার সেই পথটি ধরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কনরাডের; যেই পথটি ধরে কিছুকাল আগে লেডি অ্যালিসে ভেসেছিল হেনরি মর্টন স্ট্যানলি, আরও কিছুকাল পরে যেই পথটি ধরে স্টিমারে ভেসে সানকিনিতে পৌঁছবে শঙ্কর ও আলভারেজ। কঙ্গোর গভীরে এক অন্য সাম্রাজ্যের সন্ধান পেয়েছিলেন কনরাড। এক দশকের মধ্যেই তাঁর হাত থেকে বেরোল একটি নভেলা। বিংশ শতাব্দীর সেরা একশো ইংরেজি উপন্যাসের মধ্যে একটি— ‘হার্ট অব ডার্কনেস’। কিপলিং-এর দুনিয়ার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে গেল এই উপন্যাস। ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ দাঁড়িয়ে গেল ‘হোয়াইট ম্যান’স হরর’-এ।
হার্ট অব ডার্কনেস-এর আখ্যান বোনা হয়ে চলে কথক মার্লো ও মিঃ কার্টজ়কে কেন্দ্র করে। লিওপোল্ডের কঙ্গোর যে ‘ইনার স্টেশন’টি সবচেয়ে বেশি আইভরির যোগান দিত, মিঃ কার্টজ় হল সেই ‘ইনার স্টেশন’-এর সর্বময় কর্তা। সেখানকার শ্বেত ঈশ্বর। লোকে বলত, কাদামাটির কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ যদি মাটির তলাতেও আইভরি পুঁতে রাখত, গন্ধ শুঁকে ঠিক খুঁজে বার করে নিত কার্টজ়। সরকারের সঙ্গে হঠাৎই সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কার্টজে়র। ব্রিটিশার মার্লোর হাতে দায়িত্ব পড়ে তাকে খুঁজে বার করার। অনেক ঘটনাবহুল স্টিমারযাত্রার পর মার্লো অবশেষে খুঁজে পায় ইনার স্টেশন। ততদিনে কার্টজ় মৃত্যুপথযাত্রী। এই ইনার স্টেশনের যে বর্ণনা দেয় মার্লো তা পৃথিবীর সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধারণার শিরদাঁড়াটিকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। স্টিমার থেকেই ইনার স্টেশনটিকে দেখতে পায় মার্লো। কার্টজে়র বাংলো ও তার সামনের বেড়া ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দূর থেকে যেগুলোকে মার্লোর চোখে মনে হয়েছিল বেড়ার পোস্টে লাগানো অনেকগুলি নকশা করা স্তম্ভ, আসলে সেগুলি ছিলো কাদামাটির মানুষের শুকিয়ে যাওয়া কাটা মুণ্ড। যার প্রত্যেকটি, মার্লোর ভাষায়— ‘ব্ল্যাক, ড্রায়েড, সাঙ্কেন, উইদ ক্লোজ়ড আইলিডস— আ হেড দ্যাট সিমড্ টু স্লিপ অ্যাট দ্য টপ অব দ্য পোল, অ্যান্ড উইদ দ্য শ্রাঙ্কেন ড্রাই লিপস্ শোইং আ ন্যারো হোয়াইট লাইন অব দ্য টিথ।’
পরবর্তীকালে পোস্টমর্ডান, পোস্টকলোনিয়াল ও পোস্টস্ট্রাকচারাল যাবতীয় চর্চায়… নিৎশে, ইয়ুং আর ফ্রয়েডের যাবতীয় পাঠে চিরকালের জন্য কাঁটার মতো বিঁধে রইল মিঃ কার্টজ়। মার্লোর কাছে লিওপোল্ডের কঙ্গো ছিল— ‘দ্য হরর! দ্য হরর!’ ঠিক এই দুটি শব্দই মৃত্যুর ঠিক আগে শেষবারের মতো উচ্চারণ করেছিল মিঃ কার্টজ়। মার্লোর মস্তিষ্কে এই হরর দানা বেঁধে যায়—
দ্য কনকোয়েস্ট অব দ্য আর্থ, হুইচ মোস্টলি মিন্স্ দ্য টেকিং ইট অ্যাওয়ে ফ্রম দোজ় হু হ্যাভ আ ডিফরেন্ট কমপ্লেক্সন অর স্লাইটলি ফ্ল্যাটার নোজ়় দ্যান আওয়ারসেল্ভস্, ইজ়় নট আ প্রিটি থিং হোয়েন ইউ লুক ইনটু ইট টু মাচ…
কঙ্গোর গভীরে ঘটে চলা সেইসব অস্বস্তিকর ঔপনিবেশিক সত্য ইউরোপের দুই চোখে জলে মিশে থাকা বালির মতো বিঁধতে থাকে। সে চোখ প্রাণপণে জল বদলে নিতে চায়। বেলজিয়ান সাম্রাজ্যের ‘হরর’-এ যখন মার্লোর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তখন তার আঙুল তাজা হাওয়ার খোঁজে চলে যায় লাল রঙে দাগানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মানচিত্রের সেই সব অঞ্চলগুলিতে, যেখানে— ‘গুড টু সি অ্যাট এনিটাইম বিকজ় ওয়ান নোজ় দ্যাট সাম রিয়াল ওয়র্ক ইজ় ডান ইন দেয়ার।’ কেননা মার্লো জানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার হল— ‘বিয়ারার্স অব আ স্পার্ক ফ্রম দ্য সেক্রেড ফায়ার।’ মার্লোর চোখে সমস্ত ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ আসলে চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিল ব্রিটিশাররাই। মার্লোর কণ্ঠস্বর আসলে কনরাডেরই কণ্ঠস্বর। বেলজিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্য ছাড়িয়ে গেলেই তা আসলে কিপলিং-এরই কণ্ঠস্বর। কনরাড যতই আফ্রিকার মাটিতে বেলজিয়ান সাম্রাজ্যের চোখের ভিতর বালিময় অস্বস্তি নিয়ে নিজের কলম শানান না কেন, তার অন্তর্গত বিশ্বাস ছিল— ‘লিবার্টি… ক্যান ওনলি বি ফাউন্ড আন্ডার দ্য ব্রিটিশ ফ্ল্যাগ অল ওভার দ্য ওয়র্ল্ড।’ নিন্দুকেরা বলে যে জোহানেসবার্গের একটি সোনার খনিতে এক বড় অংশীদারের নাম ছিল জোসেফ কনরাড।
স্পেকটাকুলার ব্রিটিশ ওয়রফেয়ার
ব্ল্যাকউডের ম্যাগাজিনে ১৮৯৯ সালে তিন পর্বে ভাগ করে প্রকাশিত হয় ‘হার্ট অব ডার্কনেস’। আর তার ঠিক দু বছর আগেই পেটেন্ট পায় ‘দমদম বুলেট’ আর ঠিক পাঁচ মাস আগে দার্ভিশদের[7] ধ্বংস করে সুদানের ওমদুর্মান দখল করে সুসভ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাহিনি। সেই যুদ্ধের বর্ণনা আমি শুরু করার চেয়ে এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের কলম থেকেই নেওয়া শ্রেয়। তিনি আর কেউ নন, উইনস্টন চার্চিল।
নাথিং লাইক দ্য ব্যাট্ল অব ওমদুর্মান উইল এভার বি সিন আগেইন। ইট ওয়জ় দ্য লাস্ট লিঙ্ক ইন দ্য লং চেইন অব দোজ় স্পেকটাকুলার কনফ্লিক্টস্ হুজ় ভিভিড অ্যান্ড ম্যাজেস্টিক স্প্লেন্ডার হ্যাজ়় ডান সো মাচ টু ইনভেস্ট ওয়র উইদ গ্ল্যামার।
যুদ্ধের আগে কর্নড বিফ আর পানীয়ে মত্ত ব্রিটিশ সৈন্যদের দেখে চার্চিলের মনে, যুদ্ধ আদৌ হতে চলেছে কিনা, সেই নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। পরের দিন সত্যিই যুদ্ধ হয়েছিল। আফ্রিকার মাটিতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। একদিকে স্যর হারবার্ট কিচেনারের নেতৃত্বে আট হাজার সুসভ্য ব্রিটিশ সৈন্য; অন্যদিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে, সাদা পোশাকে আদ্যিকালের মাস্কেট আর তরোয়াল হাতে পঞ্চাশ হাজারের মতো কাদামাটির দার্ভিশ সেনা। চার্চিল শুরু করেন—
দ্য হোয়াইট ফ্ল্যাগস ওয়্যার নিয়ারলি ওভার দ্য ক্রেস্ট। ইন অ্যানাদার মিনিট দে উড বিকাম ভিজ়িবল টু দ্য ব্যাটারিজ়। ডিড দে রিয়ালাইজ় হোয়াট উড কাম টু মিট দেম? দে ওয়্যার ইন আ ডেন্স মাস, ২৮০০ ইয়ার্ডস ফ্রম দ্য থার্টি সেকেন্ড ফিল্ড ব্যাটারি অ্যান্ড দ্য গানবোটস। দ্য রেঞ্জেস ওয়্যার নোন। ইট ওয়জ় আ ম্যাটার অব মেশিনারি…
মেশিনগান আর রাইফেলের পাল্লার মধ্যে ছুটে আসতে শুরু করল হাজারে হাজারে দার্ভিশ। অকাতরে, বন্য উন্মাদের মতো। ‘বিস্টলিয়ার দ্যান দ্য বিস্ট’! চার্চিল বলে চলেন—
এইট হান্ড্রেড ইয়ার্ডস অ্যাওয়ে আ রাগেড লাইন অব মেন ওয়জ় কামিং অন ডেসপারেটলি ইন দ্য ফেস অব দ্য পিটিলেস ফায়ার, হোয়াইট ব্যানারস টসিং অ্যান্ড কোল্যাপসিং, হোয়াইট ফিগারস সাবসাইডিং ইন ডোজ়েনস্… দ্য ইনফ্যান্ট্রিমেন ফায়ারড স্টেডিলি অ্যান্ড স্টলিডলি, উইদাউট হারি অর এক্সাইটমেন্ট, ফর দ্য এনিমি ওয়্যার ফার অ্যাওয়ে…
রাইফেলগুলো প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠছিল। রিজার্ভ থেকে তাদের বারবার বদলে আনতে হচ্ছিল। ম্যাক্সিম গানের গুলির জ্যাকেট ফুরিয়ে আসছিল। আবার তা নতুন করে ভরতে হচ্ছিল। প্রতিটি ব্রিটিশ সৈন্যের ঠিক পাশের জায়গাটায় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠছিল খালি কার্তুজের স্তুপ। কাদামাটির সৈন্যরা তবু ছুটেই আসছিল। মুখোমুখি। নির্বোধ স্যাভেজের মতো। তাদের জানা ছিল না যে আধুনিক মারণাস্ত্রের পাল্লা নামক একটি জ্যামিতিক ভূখণ্ড পার করে এগিয়ে আসা তাদের পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না।
অ্যান্ড অল দ্য টাইম আউট অন দ্য প্লেইন অন দ্য আদার সাইড দ্য বুলেটস ওয়্যার শিয়ারিং থ্রু ফ্লেশ, স্ম্যাশিং অ্যান্ড স্প্লিন্টারিং বোন; ব্লাড স্পাউটেড ফ্রম টেরিব্ল উন্ডস্; ভ্যালিয়্যান্ট মেন ওয়্যার স্ট্রাগলিং অন থ্রু আ হেল অব হুইসলিং মেটাল, এক্সপ্লোডিং শেলস্ অ্যান্ড স্পার্টিং ডাস্ট— সাফারিং, ডেস্পেয়ারিং, ডাইং।
মনে হতে পারে বিজিত দার্ভিশদের প্রতি চার্চিলের কিছুটা সহানুভূতিই ছিল। আসলে তা নয়। বরং চার্চিলের ভয় ছিল, কাদামাটির এই নির্বোধ ‘স্যাভেজ’দের আটকানো না গেলে তারাই বিজয়ী হয়ে উঠতে পারে। চার্চিল নিশ্চিন্তই থাকতে পারতেন। ম্যাক্সিম গান আর লি-মেটফোর্ডের পাল্লা সম্পর্কে কোনও ধারণাই সাদা পোষাকের কালো দার্ভিশদের ছিল না। সে পাল্লা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে কখনওই সম্ভব ছিল না, কারণ এই প্রথম কোনও যুদ্ধে ভাণ্ডার উজাড় করে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘দমদম বুলেট’। এবং প্রথম ট্রায়ালে লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করেছিল দমদম আর্সেনাল।
পাঁচ ঘন্টার ওমদুর্মানের যুদ্ধে— আদৌ তাকে যদি যুদ্ধ বলা যায়— ধ্বংস হয়েছিল বারো হাজার ‘বর্বর’ দার্ভিশ সৈন্য। আহত হয়েছিল আরও ষোল হাজার। তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত বেঁচেছিল খুব কমই। এইভাবে শেষ হল ওমদুর্মানের যুদ্ধ; চার্চিল শেষ করেন— “দাস এন্ডেড দ্য ব্যাট্ল্ অব ওমদুর্মান— দ্য মোস্ট সিগন্যাল ট্রায়াম্ফ এভার গেইনড বাই দ্য সায়ান্স ওভার বারবারিয়ানস্।” কিছু পরে চার্চিল যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কাদামাটির শবদেহ স্তূপে স্তূপে নয়, একরের পর একর ভূখণ্ড জুড়ে ছড়িয়েছিল। হাজার হাজার কালো দেহ— অরূপদার শিকার করা বুনো, নির্বোধ বকটার সাদা পালকের মতো সাদা পোষাক ছিঁড়ে, শরীরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে নরকের মতো লাল, মার্ক ফোরের ‘মাশরুম এফেক্ট’-এ ছিন্নভিন্ন, দলাপাকানো মাংসপিণ্ড। চার্চিলের মন্তব্য ছিল— “দ্য টেরিব্ল মেশিনারি অব সায়েন্টিফিক ওয়র হ্যাড ডান ইটস ওয়র্ক।”
১৮৯৯-তে প্রকাশিত হয় কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ আর ঐ বছরেই হেগ কনভেনশনে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত করে ‘সিভিলাইজড ওয়রফেয়ার’-এ, অর্থাৎ ‘সভ্য’ দেশগুলির নিজেদের মধ্যেকার যুদ্ধে নিষিদ্ধ করা হয় দমদম বুলেটের মতো একটি অতিমাত্রায় নৃশংস মারণাস্ত্র। কিন্তু বন্য জানোয়ার এবং কাদামাটির অসভ্য নির্বোধ মানুষদের ওপর তার ব্যবহার বলবৎ রাখে সভ্যতার মশালবাহী ব্রিটিশ সরকার। শঙ্কর ও আলভারেজের উইনচেস্টার ও ম্যানলিকার রাইফেলদুটিতে দমদম বুলেট ব্যবহার হয়েছিল কিনা বিভূতিভূষণ আমাদের জানাননি।[8] কিন্তু সেই সময় জুড়ে আফ্রিকার খোপে খোপে তার ব্যবহার ছিল দুর্দান্ত।
কালাহারি পার করার পর ক্রুগার মাউন্টেনের যে এলাকা থেকে জমি জরিপ দল মুমূর্ষু শঙ্করকে উদ্ধার করেছিল তার থেকে খুব বেশি দূরে নয় উইটওয়াটার্সর্যান্ড-এর সোনার খনি অঞ্চল। আলভারেজের এসব আগে থেকেই চেনা অঞ্চল। শঙ্করদের অভিযানের তিন বছর আগেই সেই অঞ্চলে জ্বলে উঠেছিল এক বিদ্রোহের আগুন। বাধ্যতামূলক শ্রম ও অত্যধিক করের প্রতিবাদে বাম্বাথা কামানসিঞ্জার নেতৃত্বে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল কাদামাটির জ়ুলু যোদ্ধারা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, মানে আমাদের মহাত্মা গান্ধিজি তখন দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিপলিং-এর ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’-এর মশালের আলোয় তখন মোহমুগ্ধ গান্ধি। এই জ়ুলু বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সেনার হাতে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের নিয়ে সামিল হতে চাইলেন তিনি। ভারতীয়দের ওয়রফেয়ারে যথোপযুক্ত ট্রেনিং না থাকার ফলে ব্রিটিশ সরকার নাকচ করে দিয়েছিল সেই আবেদন। কিন্তু গান্ধির ভাগ্যে সামান্য হলেও শিকে ছিঁড়েছিল। নিহত ও আহত জ়ুলু শরীর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্ট্রেচার-বাহকের বড় দলের প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশ সরকারের। এই রকম একটি দলের (কর্পস অব ২১) নেতৃত্বেও ছিলেন গান্ধি।
উইটওয়াটার্সর্যান্ড-এর কিছুটা দূরে ১৯০৬-এর এক রাত্রে পাহাড়ঘেরা মোমে গর্জের উপত্যকায় রাতের বিশ্রামটুকু সারছিল জ়ুলু যোদ্ধাদের দল। রাতের অন্ধকারে সঙ্কীর্ণ গর্জের চারিদিক দিয়ে তাদের ঘিরে ফেলল কলোনেল ডানকান ম্যাকেঞ্জি-র নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনি। ভোরের আকাশ আলো হতেই চালু হয়ে গেল ম্যাক্সিম গানের অক্লান্ত বর্ষণ আর খালি কার্তুজের পাথরের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ার একঘেয়ে টুং-টাং শব্দ। আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের মধ্যে পড়ে জ়ুলুরা। তাদের একহাতে ধরা ছিল ‘আসেগাই’— জ়ুলুদের দুর্দান্ত বর্শা আর অন্য হাতে আত্মরক্ষার জন্য ছিল বিখ্যাত গরুর চামড়ার ঢাল। যেমন আমরা যে কোনও আফ্রিকার দামী ছবির বইতে দেখে থাকি। কিন্তু সেটা ছিল বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া। কাদামাটির পৃথিবীর জানা ছিল না যে ততদিনে ইউরোপ পেরিয়ে এসেছে আধুনিক শিল্পবিপ্লবের অনেকগুলি ধাপ। দমদম বুলেটের সামনে এসে দাঁড়াল গরুর চামড়ার ঢাল। যা হওয়ার তাই হল। এখানেও ‘দ্য টেরিব্ল মেশিনারি অব সায়েন্টিফিক ওয়র হ্যাড ডান ইটস ওয়র্ক।’ মোমে গর্জ জুড়ে পড়ে থাকল চার হাজার জ়ুলু মৃতদেহ। এক্সপান্ডিং মাশরুম এফেক্টে সেই সব কাদামাটির শীতল শবদেহ এমনভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাদের মাটি থেকে ছাড়িয়ে স্ট্রেচারে ওঠানো এক অমানুষিক পরিশ্রমসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়াল। নিঃসন্দেহে গান্ধিকে অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে হয়েছিল। এবং সে দিনের স্মৃতি তাঁকে ঘিরে রেখেছিল আরও অনেক দিন। অনেক পরে, ১৯২৭ সালে বাম্বাথা বিদ্রোহ দমন নিয়ে গান্ধি লেখেন— “নো ওয়র বাট আ ম্যান হান্ট।”
খুলে গেল রহস্যময় মোড়ক
সাদা ভাম্বিরা সারা আফ্রিকা দখল সম্পূর্ণ করল। পনেরশো শতকের আগে সাহারার নীচের আফ্রিকা তাদের দেখেনি। কাদামাটির মানুষের কাছে তারা ছিল এক রহস্যময় প্রজাতি। রহস্যময় তাদের ভাষা। রহস্যময় তাদের আগমন ও উপস্থিতি। অন্যদিকে সভ্যতার গমগমে আলো থেকে আফ্রিকার অন্ধকারতম কেন্দ্রে, ইনার স্টেশনে প্রবেশ করেছিল মার্লোর স্টিমার। ‘হার্ট অব ডার্কনেস’। মার্লো সেখানে আবিষ্কার করেছিল এক ভয়াল, হাড়-হিম অন্ধকার। সেই ভয়াল অন্ধকার নিজের গায়ে আশরীর জড়িয়ে মার্লোর জন্য অপেক্ষা করছিল সেই অন্ধকারের একচ্ছত্র রাজা মিঃ কার্টজ়।
এই কার্টজ়-এর সৃষ্টি নিয়ে অনেক জল্পনা পরবর্তীকালে হয়েছে। বেশিরভাগের মত ছিল কার্টজ় আসলে লিওন রোমের ছায়া। স্ট্যানলি পুল স্টেশনটির সর্বময় কর্তা ছিল রোম। ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা লিখেছেন যে রোমের বাংলোর চারপাশে বাঁশের খুঁটির ওপরে পাকা আর্টিস্টের হাতের ইনস্টলেশনের মতো টাঙানো থাকত কালো মানুষদের কেটে নেওয়া মাথা। রোম এইভাবেই তার বাংলো সাজিয়ে রাখতে ‘পছন্দ’ করত। কিন্তু এই ‘পছন্দ’ রোম পেয়েছিল কোথা থেকে? কেউ বলে যায়নি। বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ছবি উঠে এল আমার হাতে।
ছবিটা ১৮৭৮-এর। কাদামাটির কোজ়়া উপজাতির সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনির লড়াই চলেছিল অনেকগুলি পর্বে, অনেকদিন ধরে। শেষ সংঘাতটির ঠিক পরের ছবি এটি। খুঁটিতে খুঁটিতে লাগানো মানুষের শুকিয়ে যাওয়া মাথা— সাজিয়ে রাখা একেকটি ট্রফি। এরপরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল কোজ়়াদের যাবতীয় প্রতিরোধ। আমিও জানি না লিওন রোমের মাথায় সেই বীভৎস ভাবনার উৎসটা কী ছিল। কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস নাড়িয়ে দিয়েছিল একটা শ্রেণির ইউরোপের বিবেক। মূলত ব্রিটিশ সাংবাদিক ই ডি মোরেলের উদ্যোগে, লিওপোল্ডের কঙ্গোর বিভীষিকার প্রতিবাদ করে তৈরি হয়েছিল ‘কঙ্গো রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন আর্থার কোনান ডয়েল ও মার্ক টোয়েনের মতো ব্যক্তিত্ব। তাঁরাও কি এই ছবিটি কেউ দেখেছিলেন? জোসেফ কনরাড কি এই ছবিটি দেখেছিলেন? এ ছবি তো লিওপোল্ডের কঙ্গোর নয়, বা ভন ট্রোথার জার্মান সাউথ-ওয়েস্ট আফ্রিকাও নয়। এ তো দক্ষিণ আফ্রিকা। ভিক্টোরীয় সভ্যতার মশালে আলোকিত দক্ষিণ আফ্রিকা। এ ছবি কি দেখেছিলেন কিপলিং? যতবার দেখি, ছবিটি আমার মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় নিরন্তর বলে চলে— ‘দ্য হরর’— ‘দ্য হরর’। হার্ট অব ডার্কনেস-এ পৌঁছে মার্লো ধরেই নিয়েছিল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার— ‘দ্য হরর’ সেখানে আবহমান। কিন্তু মার্লো অথবা কনরাডের নিজের সেই অন্ধকারের উৎস সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন ছিল কি?
সে অনেক দিন আগের কথা। বুন্দেলখন্ডী বড়াদেওর মতো আফ্রিকার ঈশ্বর যখন তৈরি করেছিলেন তার যাবতীয় সৃষ্টি, তখন কাদামাটির বুকে দুটি জিনিস কেউ দেখেনি— অন্ধকার আর শীত। সারাদিন ধরে সূর্য দিত উজ্জ্বল আলো আর রাতের বেলা চাঁদের আলোয় এমনভাবে ভেসে যেত চরাচর যে সবকিছুই থাকত দিনের মতোই স্পষ্ট।
একদিন ঈশ্বর বাদুড়কে দিয়ে চাঁদের কাছে পাঠালেন এক রহস্যময় মোড়ক। ঈশ্বর বাদুড়কে বলেছিলেন— এর মধ্যে আছে অন্ধকার। কিন্তু তাড়াহুড়োতে, অন্ধকারের আসল মানেটা যে কী, সেটা বুঝিয়ে দিতে ভুলে গেলেন। অর্ধেকখানি জেনেই বাদুড় বেরিয়ে পড়ল চাঁদের খোঁজে। হালকা চালে উড়ে চলল বাদুড়। একসময় ক্লান্ত বাদুড় ক্ষুধার্ত হ’ল। তার কোনও তাড়া ছিল না। রাস্তার পাশে মোড়কটি রেখে বাদুড় গেল খাবারের সন্ধানে।
এই সময় সেখানে হাজির হ’ল এক রহস্যময় প্রাণীর দল। মোড়কটি চোখে পড়ল তাদের। লোভী চোখ নিয়ে সেটি খুলতে শুরু করল তারা। এমন সময় সেখানে ফিরে এল বাদুড়। প্রাণপণ চেষ্টা করল সেই রহস্যময় প্রাণীদের থামাতে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। শেষ সুতোর প্যাঁচটিও যে ততক্ষণে খুলে গিয়েছে। মোড়ক খুলে ততক্ষণে আকাশে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে অন্ধকার। আস্তে আস্তে কাদামাটির মহাদেশ ঢেকে গেল ভয়াল, হাড়-হিম অন্ধকারে। আলো আর কখনোই ফিরল না সেখানে।[9]
স্ট্যানলির লেডি অ্যালিস চলেছিল সেই অন্ধকার চিরে— থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট। জোসেফ কনরাডের স্টিমার পৌঁছেছিল সেই অন্ধকারের হৃৎপিণ্ডে— হার্ট অব ডার্কনেস। না, তারা কেউ নিজেদের প্রশ্ন করেনি, প্রশ্ন করেনি অন্যদের, এমনকি প্রশ্ন করেনি ১৫শ শতকের সমুদ্র টপকে রহস্যময় প্রাণীদের মতো হাজির হওয়া সাদা ভাম্বিদের— এত অন্ধকার কাদামাটির দুনিয়ায় এল কোথা থেকে! কে খুলেছিল সেই রহস্যময় মোড়কের সুতোর প্যাঁচ?
[ক্রমশ]
[1] কনকুইজ়টেডোর: স্প্যানিশ শব্দ। ষোড়শ শতক জুড়ে আমেরিকার বুকে, বিশেষ করে পেরু ও মেক্সিকোয় স্প্যানিশ কনকোয়েস্ট অর্থাৎ বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া প্রথম সারির নেতাদের বলা হত কনকুইজ়টেডোর।
[2] আরকেবাস: প্রথম যুগের ম্যাচলক প্রযুক্তির বন্দুক। ১৫শ শতকে স্পেনে তৈরি হয়। কাঁধের ওপর রেখে প্রচণ্ড ভারী এই বন্দুক চালাতে হত।
[3] ভাম্বি: আফ্রিকীয় লোকভাষায় এর মানে হল পিতৃপুরুষের অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। ইউরোপীয়দের গায়ের সাদা রঙের জন্য আফ্রিকীয়রা প্রথম দর্শনে তাদের সাদা ভাম্বি ভেবেছিল।
[4] পেন্ডে উপজাতিদের সঙ্গে পর্তুগীজদের প্রথম সাক্ষাতের, মুখে মুখে চলে আসা অভিজ্ঞতা পেন্ডেদের কাছ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করেন বিংশ শতকের এক আফ্রিকীয় ওরাল হিস্টোরিয়ান মুকুনজ়ো কিয়োকো।
[5] বিগ গেম: বড় জানোয়ারের শিকারকে বিগ গেম বলে। যেমন হাতি, গন্ডার, সিংহ বা বাঘ শিকার।
[6] এক-দম বুলেটের ফুটনোট নিজেই দিয়েছিলেন চার্চিল। এক-দম: হিন্দুস্তানি ফর অ্যাট ওয়ান্স।
[7] দার্ভিশরা হল ইসলামের একটি সুফি শাখা। সুদানের মোহম্মদ আহমদ আল-মাহদির অনুগামীদের দার্ভিশ বলে সম্বোধন করত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিরা।
[8] ‘চাঁদের পাহাড়’ সিনেমাটি স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বন্ধুদের কাছে থেকে শুনেছি, কীভাবে অনায়াসে সিনেমায় বিশালাকায় সিংহ, এমনকি আস্ত বুনিপ শিকার করেছে শঙ্কর; তাতে করে আমার ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, অন্তত সিনেমায় শঙ্করের উইনচেস্টারটিতে ‘দমদম বুলেট’-ই ব্যবহৃত হয়েছে।
[9] সিয়েরা লিওনের ‘কোনো’ মানুষদের উপকথা ‘অন্ধকারের আগমন’ থেকে নেওয়া।