প্রবুদ্ধ বাগচী
–ম্যাডাম, ব্যালান্সটা নিয়ে যান!
ওষুধের দোকানের কাউন্টারের ওপার থেকে নয়, কথাটা এল পাশের দিক থেকে। অপাবৃতা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। কাউন্টারের এপারেই নিতান্ত সাধারণ চেহারার এক যুবক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কাউন্টারের ওপারের লোকটার হাতে বিল আর কিছু খুচরো টাকা। পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছিল অপাবৃতা। আট টাকা মতন ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু ফেরতের কথা ভুলেই গিয়েছিল ও। অন্য কোনও একটা চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকলে যা হয় আর কী!
ওই অচেনা যুবকটি একটু হেসে বলল, ম্যাডাম বোধহয় একটু আনমনা ছিলেন।
অপাবৃতা আবার দেখল ছেলেটিকে। হাল্কা খয়েরি রঙের বুশ শার্ট আর ফেডেড জিন্স। মুখটা খুব ক্লিনশেভড নয়। সিঁড়ি দিয়ে একধাপ উঠে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে অপাবৃতা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস!
কাউন্টারের ওপারে ওষুধের দোকানের লোকটা বিল আর খুচরো টাকাগুলো ফেরত দিতে দিতে বলল, পরেরবার থেকে এই ওষুধ কিনতে কিন্তু প্রেসক্রিপশনের জেরক্স লাগবে। এখন খুব কড়াকড়ি। এবারের মতো দিয়ে দিলাম।
ওগুলো ব্যাগে ভরে রাস্তায় নেমে এল অপাবৃতা। ট্যাক্সি না পেলেও একটা মিনিবাস ধরলেও পার্ক স্ট্রিট পৌঁছাতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। সুপ্রতীক ওখানে আসবে তিনটে নাগাদ। বাসস্টপে দাঁড়াতেই একটা ফাঁকা মিনিবাস। ফলে তিনটে বাজার মিনিট দশেক আগেই মিউজিক ওয়ার্ল্ডের সামনে এসে গেল অপাবৃতা। আগে গিয়ে রেস্টুরেন্টে একটা সিট দখল করে বসবে কি বসবে না ভাবতে ভাবতেই একটা মেসেজ এসে গেল মোবাইলে। সুপ্রতীক। মিনিট পনেরো দেরি হবে আসতে। তেমন কিছু না ভেবে মিউজিক ওয়ার্ল্ডের ভেতরে ঢুকে গেল অপাবৃতা।
মিনিট দশেক এদিক ওদিক ঘুরে নতুন একটা গানের অ্যালবাম কিনল অপাবৃতা। বেরিয়ে আসার মুখে ভারী কাচের দরজা ঠেলে যখন বাইরে আসছে, মনে হল কেউ যেন ওকে বেরিয়ে আসতে দেখেই ঝট করে কোথাও সরে গেল! কে হতে পারে? ভুল দেখল কি? ফুটপাথে দাঁড়িয়ে একবার এদিকে ওদিকে তাকাল— কই তেমন কোনও পরিচিত মুখ চোখে পড়ল না। তবে কি মনের ভুল? মনের মধ্যে অন্য চিন্তার জট পাকিয়ে থাকলে এইরকম ভুল হয় নাকি? আবার একবার চারদিকে তাকাল ও। এই ভরদুপুরের পার্ক স্ট্রিটে লোকজন গাড়ির ভিড়ে কাউকে খুঁজে বার করা যায় নাকি? নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগল অপাবৃতার। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল, সুপ্রতীকের আসার সময় হয়ে গেছে। চেনা রেস্টুরেন্টে কোণের দিকে একটা টেবিলে বসল অপাবৃতা।
সুপ্রতীক বলল, নতুন করে কিছু ভাবলে নাকি?
অপাবৃতা একটা কাটলেটের টুকরো মুখে পুরে আলতো করে মাথা নাড়ল।
সুপ্রতীক বলল, রাকেশ কি আবার বাইরে গেছে? পরশু দিন ফোনে বলছিলে না!
আবার আলতো করে মাথা নাড়ল অপাবৃতা। তারপর আস্তে করে বলল, বেঙ্গালুরু। সাতদিনের ট্যুর।
এখানে কাচ ও এসির ঘেরাটোপে সিগারেট ধরানো যায় না। কিছুটা উসখুস করলেও শেষ পর্যন্ত আর ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে সিগারেট ধরানোর ইচ্ছেটা নিবারণ করল সুপ্রতীক। অপাবৃতার সঙ্গটা খুব দরকার। অথবা উল্টোটাও সত্যি। অপাবৃতাকে এখানে আসবার অনুরোধ করেছে সুপ্রতীকই। তাছাড়া দরকারটা অপাবৃতার দিক থেকেও জরুরি।
সুপ্রতীক একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, সাতদিন মানে কি সত্যিই সাতদিন, নাকি এবারেও আবার বেড়ে যাবে?
অপাবৃতা ম্লান মুখে হাসল। বলল, সেটা কি আমার হাতে? তুমি তো সবটাই জানো!
সুপ্রতীক মাথা নাড়ল। সত্যি এটা আগাম জানা মুশকিল। ও প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলল, ঠান্ডা কিছু নেব?
অপাবৃতা কাচের বাইরে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। মনের মধ্যে সেই পুরনো খচখচানিটা একবার যেন উঁকি দিয়ে গেল। লোকটাকে কি ভুল দেখল? সুপ্রতীকের কথাটা প্রথমে খেয়াল করতে পারেনি। আবার প্রশ্ন করতেই বলল, না। থাক।
আবার শুরুর কথায় ফিরল সুপ্রতীক। নতুন কিছু ভাবলে?
অপাবৃতা বলল, ভাবতে পারছি না, তাই তো তোমায় ডাকলাম!
সুপ্রতীক বলল, দ্যাখো, তোমার সঙ্গে রাকেশের পরিচয়ের আগে থেকেই আমি তোমায় চিনি। আমার মনে হয়েছিল রাকেশ ইজ নট ইওর প্রপার চয়েস। কিন্তু তুমি কি অ্যাবসলিউটলি ডিভোর্সের কথা ভাববে? মানে, আই মিন ভাবতে পারবে? একটু থেমে বলল, আমি জানি বৃতা এগুলো নিয়ে অ্যাভারেজ বাঙালি মেয়েদের ট্যাবু থাকে স্টিগমা থাকে, কিন্তু…
–কিন্তু? অপাবৃতা সুপ্রতীকের মুখের দিকে তাকাল।
বলল, জানতে চাইছ, সেই কিন্তুটায় আমি কতটা কাভার্ড? তাই তো?
–ধরে নাও তাই। সুপ্রতীক বলে।
অপাবৃতা বলল, আমার কোনও ট্যাবু নেই। হয়তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমারও একসময় ছিল… বাট… এখন নেই।
–দেন? সুপ্রতীক জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট অ্যাবাউট আওয়ার নেক্সট অ্যাকশন?
অপাবৃতা বলল, তার আগে আমায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবে? অন্তত সন্ধানটা তো দাও।
–কেন?
–ফিলিং ট্রাবল। এভরি মোমেন্ট। রাতে ঘুম হচ্ছে না। আজই ওষুধ কিনলাম বাট এরপর আর তাও পাব না। দোকান থেকে বলল শিডিউলড ড্রাগ আর প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেবে না।
সুপ্রতীক বলল, ওটা নিয়ে ঘাবড়িও না। আমি ব্যবস্থা করে দেব।
–তাহলে কোনটা নিয়ে ঘাবড়াব? পালটা প্রশ্ন করে অপাবৃতা।
–অ্যাবাউট লিগ্যাল ব্যাটল। আই থিঙ্ক ইটস টু টাফ টু ক্র্যাক দি নাট! খানিকটা যেন নিজের মনেই সুপ্রতীক বলল কথাটা।
–কেন?
–আমি কিছুটা খবর নিয়েছি। এটা ক্লিয়ার যে রাকেশের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগটা ও অ্যাডমিট করবে না। কারণ, ওর এই ট্যুরে যাওয়াটা ওর অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট। অন্য জায়গায় গিয়ে ও কী করছে, কারা ওর সঙ্গে যাচ্ছে এটা ওর কম্পানির ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। প্লাস কলকাতার বাইরে ওর অ্যাক্টিভিটি আমরা, আই মিন তুমি প্রমাণ করবে কী করে? এটা ওর অ্যাডভান্টেজ পয়েন্ট!
–আমি কিছু বুঝছি না সুপ্রতীক। সিমপ্লি আই ওয়ান্ট টু মেক আওয়ার রিলেশন টারমিনেটেড!
–দ্যাটস ফাইন, বাট আল্টিমেটলি ইটস অ্যা লিগ্যাল ইসু। এবং তুমি যদি অভিযোগ করো তাহলে সেগুলো তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে! তোমার কাছে ডকুমেন্টারি এভিডেন্স কী আছে?
–সুপ্রতীক, ইউ আর টকিং নেগেটিভ… এইজন্য আমি তোমায় ডেকে এনেছি কি?
–সারটেনলি নট, বাট যুদ্ধেরও কিন্তু একটা স্ট্র্যাটেজি থাকে, একটা গেমপ্ল্যান থাকে। ওগুলো ওয়ার্ক আউট না করলে যুদ্ধে নামা যায় না।
অপাবৃতা চুপ করে রইল। বাইরে বিকেল হচ্ছে। প্লেটের একপাশে ঠান্ডা আধ-খাওয়া কাটলেট। আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। অপাবৃতা-র মনে হল ওর একটু একা থাকা দরকার। বলল, চলো উঠি। এরপর বাসে ওঠা মুশকিল হয়ে যাবে।
ভারী কাচের দরজা ঠেলে রাস্তা পেরিয়ে ওরা যখন অক্সফোর্ড বুকশপের সামনে এসে দাঁড়াল অপাবৃতা হঠাৎ দেখতে পেল সেই লোকটাকে। হাল্কা খয়েরি রঙের বুশ শার্ট আর ফেডেড জিন্স। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা ফুটপাথের দোকান থেকে নিচু হয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়াতে কি?
২.
অফিসে ফিরে প্রথমেই দুটো মেসেজ করল বিকাশ। এটা ওর পেশাগত দায়। লিখল, ম্যাডাম এক স্ট্রিপ ঘুমের ওষুধ কিনেছেন। তারপরে মিনিবাসে করে পার্ক স্ট্রিটে। সেখানে একজনের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে কিছুক্ষণ ছিলেন। ঘণ্টা খানেক পরে সেখান থেকে বেরিয়ে আবার মিনিবাস ধরে বাড়ি ফিরেছেন।
ওদিক থেকে প্রশ্ন এল। গুড। বাট সঙ্গে কে ছিল?
বিকাশ জানাল, একজন যুবক। হ্যান্ডসাম। পরিচয় জানতে পারিনি।
উত্তর এল, ওকে। ক্যারি অন। তিনদিন পর আরও রিপোর্ট চাই। মোর ডিটেলস।
বিকাশ বুঝতে পারল সামনের তিনদিন খুব ঝামেলা আছে। পরিশ্রমও কম নয়। কিছু অ্যাডভান্স চাইতে হবে ম্যানেজারের কাছ থেকে। ওদের এই ‘গ্লোবাল ওয়াচ এজেন্সি’-তে এই নিয়মটা খুব ভালো। নিজের কাজের প্রয়োজনটা বোঝাতে পারলে দরকারমতন টাকা পাওয়া যায়। পরে কেস মিটে গেলে বিল করে সব পার্টির থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। অবশ্য ওদের এজেন্সিতে যেসব কেস আজকাল আসছে তার তুলনায় এটা অনেক সোজাসাপটা কেস। আজকাল পুলিশের থেকে লোকে এইসব এজেন্সির ওপর অনেক বিষয় বেশি ডিপেন্ড করছে। তবে বিকাশের হাতের কেসটা নেহাতই নজরদারি কেস। পার্টি চাইছে তার ম্যাডামকে তার অনুপস্থিতিতে দিন দশেক ফলো করতে। যদিও শুনতে সোজা হলেও বিকাশ জানে কাজটা ঠিক ততটা সহজ নয়। অনেক ফ্যাকড়া আছে।
এই যেমন আগামীকাল সকাল থেকে ওকে নজর রাখতে হবে ম্যাডামের লেক গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে। এইসব ক্ষেত্রে আবার অন্যের নজরে পড়ে গেলেই ঝামেলা। আজকাল সব হাউসিং-এই সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তাদের কিছু মালকড়ি দিয়ে হাত করতে হয়। ওরা অনেক খবরও বার করে দেয়। তবে সব লোক তো আর সমান হয় না, কেউ কেউ বেগড়বাই করে। আশেপাশে ঘেঁষতে গেলেই নানা প্রশ্ন করে, এতে কাজের অসুবিধে হয়। দু একবার হুমকি-টুমকিও পেয়েছে বিকাশ। তখন আবার সব নতুন করে ম্যানেজ করতে হয়। বছর খানেক আগে সল্টলেকের একটা হাউসিং-এ এইরকম একটা বেয়াড়া সমস্যা হয়েছিল। আর সল্টলেক জায়গাটা ফাঁকা বলে হাউসিং-এর আশেপাশে দোকানপাট কম, ফলে চট করে ভিড়ে মিশে থাকা যায় না।
অবশ্য এই কেসটায় সেইসব সমস্যা নেই। লেক গার্ডেনসের এই হাউসিংটার সিকিউরিটি গার্ডগুলো কোনও কারণে বাসিন্দাদের ওপর খুব প্রসন্ন নয়। ফলে অনেক খবর এর মধ্যেই বের করে ফেলতে পেরেছে বিকাশ। আর হাউসিংটার সামনে সারবাধা দোকানপাট, ফলে নিজেকে আড়াল করা খুব একটা কঠিন নয়। গত সপ্তাহে ম্যাডামের বেরোনোর দুটো খবর আগেই জেনে গিয়েছিল বিকাশ। সে ওই সিকিউরিটি গার্ডেরই সূত্রে। ম্যাডামের নামে একটা পার্সেল আসার কথা ছিল, ম্যাডাম ছেলেটাকে বলে গিয়েছিলেন ওটা নিয়ে নিতে। ব্যস তার মানে বিকাশ জেনে গেল কোন সময়টা ম্যাডাম বেরোবেন। ও তৈরি ছিল। সেদিন ম্যাডামকে ফলো করে ও গিয়েছিল গড়িয়ার দিকে। মনে হয় ওটা ওর কোনও বন্ধু বা বান্ধবীর বাড়ি। বাড়ির ঠিকানা টুকে রেখেছে ডাইরিতে। ওই ছোট্ট পকেট ডাইরিটায় অনেক খবর, ফোন নম্বর লিখে রাখতে হয়। এটাই ওদের পেশার দস্তুর। অবশ্য এই ম্যাডামের কেসটা কিছুটা এখন বুঝে গেছে বিকাশ। ফ্ল্যাটবাড়ির ভিতরের বাসিন্দাদের খবর পাশের ফ্ল্যাট না জানলেও কাজের লোক, রান্নার লোক, সিকিউরিটি এরা জানে। এরা সব সোর্স, শুধু সঠিক সময়ে সঠিক খবরটা বার করে নিতে হয়।
ম্যাডামের হাজব্যান্ড প্রায়ই অফিসের ট্যুরে যান, আর ম্যাডাম এটা কোনওভাবে জেনে গেছেন যে বেশিরভাগ সময় ওর সঙ্গে যান কোনও একজন মহিলা কলিগ। একই হোটেলে ওঠেন। দিন সাত-দশের কাজ সেরে আবার ফিরে আসা। এখন এই গল্পটা ছড়িয়ে যেতে চাইছে ফলে ওদের নিজেদের সম্পর্কের ভেতর টানাপোড়েন। সম্ভবত ম্যাডাম চাইছেন ওর হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স করে দিতে। কিন্তু হাজব্যান্ডটা হারামি কম নয়, ডিভোর্সে মনে হয় রাজি নয়। উলটে নিজের বউ ওর অনুপস্থিতিতে কোথায় যাচ্ছে কার সঙ্গে দেখা করে, এইসব খবর জোগাড় করার জন্য কন্ট্রাক্ট দিয়েছে ওদের এজেন্সিকে। সেইজন্যই বিকাশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নজর রাখার। এখন মালটা কলকাতার বাইরে। দিন সাত-আট বাদে ফিরবে। কিন্তু বিকাশের এখন প্রতিদিনের কাজ হল সারাদিনের ভাইটাল খবর ওই হাজব্যান্ডটাকে জানানো। আফটার অল তিনি তো এই খবরগুলো পাওয়ার জন্যই কোম্পনিকে পেমেন্ট করছেন!
চাকরি করে বটে তবে মাঝেমাঝে এইসব উঁচুমহলের কেচ্ছা ঘাঁটতে আর ইচ্ছে করে না বিকাশের। এই নিয়ে পনেরো বছর হল। যেন অনেক সময়। দিনে দিনে এগুলো বেড়েই চলেছে। ওদের কেউই সারা বছর ফাঁকা থাকে না। বিকাশ যেটা বুঝতে পারে না নিজেদের মধ্যে না পোষায় কোর্টে গিয়ে ডিভোর্স নিয়ে নিলেই তো হয়! তা না করে একে ওর পেছনে লাগানো তাকে আরেকজনের জন্য বহাল করা! ঘেন্না ধরে গেল পনেরো বছর ধরে এইসব কাজ করে করে!
আজ সকাল থেকে লেক গার্ডেনসের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একেবারে বোর হয়ে যাচ্ছিল বিকাশ। ম্যাডাম কি আজ বেরোবেন না? আজ পুরনো সিকিউরিটি ছেলেটার জায়গায় একটা নতুন লোক এসেছে। একে বিকাশ চেনে না। চট করে আলাপ করে কাজ হাসিল করা মুশকিল। ম্যাডামের রান্নার লোকটা বেরিয়ে গেল বারোটা নাগাদ। বিকাশ যেটুকু খবর পেল আজ ম্যাডাম ঘরেই আছেন। টিভি দেখছেন, ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছেন। মাঝে মাঝে দু একটা ফোন করছেন। উল্টোদিকের রাস্তায় একটা ভুট্টাওয়ালার ঠেলাগাড়ি, তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিকাশ। একবার ভাবল, ম্যাডামকে ফোন করলে কেমন হয়! তারপরেই সতর্ক হয়ে গেল— এইসব কী ভাবছে ও? ফোন করলেই তো ম্যাডাম সব জেনে যাবেন আর তখন কি পার্টি ওদের এজেন্সিকে বিল মেটাবে? বিকাশের চাকরি থাকবে আর? সেই সঙ্গে বদনাম। অগত্যা চুপ করে দাঁড়িয়ে নজর রাখা। মাঝেমাঝে জায়গা পরিবর্তন করে অন্যের দৃষ্টি এড়ানো। দুপুরের পর আশেপাশের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে একটু সমস্যায় পড়ল বিকাশ। অন্যদিন চেনা সিকিউরিটির ছেলেটার গুমটি ঘরটায় একটা টুলে বসে থাকে, আজ সে গুড়ে বালি। হাউসিং-এর মেনগেটের কাছাকাছি একটা মন্দিরমতো আছে, তার সঙ্গে একটু খোলা জায়গা, পাশেই একটা নাটমন্দির, বোধহয় দুগগাপুজো হয়। নাটমন্দিরে ওঠার দু তিনটে ধাপ সিঁড়ি, ওখানে বসলে মেনগেটটা দেখা যাওয়া সম্ভব।
হ্যাঁ, ঠিকই তাই। এখানটা দুপুরবেলা খুব নিরিবিলি। সিঁড়ির ধাপে বসে একটা সিগারেট ধরাল বিকাশ।
৩.
কাল সুপ্রতীক একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছে। আজ বিকেলে একবার কনফার্ম করতে হবে। ডাক্তারের চেম্বার সেরেই উকিলের কাছে যেতে চেয়েছিল অপাবৃতা, কিন্তু এই ব্যাপারে সুপ্রতীক ঠিক কথা দিতে পারেনি। হয়তো ওর অন্য কোনও কাজ আছে। তবু অপাবৃতা ঠিক করল আজ বিকেলে দুজনকেই একবার করে ফোন করবে। দুপুরে একটু গড়িয়ে নিয়ে ফোন করতে গিয়ে দেখল মোবাইলে ব্যালান্স শেষ। সুতরাং একবার বেরোতেই হবে। ফোন দুটো করা খুবই দরকারি। গেটের পাশেই মোবাইল রিচার্জের দোকান। বাইরে পরার একটা চুড়িদার গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল অপাবৃতা।
হাউসিং-এর উল্টোদিকের নাটমন্দিরের সিড়িতে বসে বিকাশ দেখল ম্যাডাম গেট দিয়ে বেরোচ্ছেন। তারপর ডানদিকে ঘুরে প্রায় ওরই সামনে দিয়ে মোবাইলের দোকানটায় ঢুকে গেলেন। বিকাশ সন্তর্পণে পিছু নিয়ে দোকানের দরজার সামনে দাঁড়াল। এইসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু পেশাগত ঝুঁকি নিতেই হয়। দরজা ঠেলে ঢোকার আগে একটু বুঝে নিতে হবে ম্যাডাম এখন হঠাৎ এখানে কেন? ও কান খাড়া করল। ম্যাডাম মোবাইলে ব্যালান্স ভরলেন। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। দোকানের লোকটা বা ম্যাডাম কারও কাছেই খুচরো নেই। সেটা নিয়েই ম্যাডাম বলছেন, কী করি বলুন তো? এখন তো কোনও দোকান খোলা নেই। খুচরো করি কোথা থেকে! দোকানিও খুব বিনীতভাবে বলছে, সত্যি ম্যাডাম আমার কাছে খুচরো একদম নেই! থাকলে দেব না কেন?
দরজা ঠেলে বিকাশ ভিতরে ঢুকল। ওর কাছে খুচরো আছে। ও একটা রিচার্জ করাল, না করালেও চলত। কিন্তু খুচরো পেয়ে ম্যাডাম আর দোকানির সমস্যাটা মিটে গেল। ম্যাডাম ওকে খেয়াল করেননি সেটা ও বুঝতে পারল কারণ খুচরো হাতে পেয়েই ম্যাডাম ফোন করতে আরম্ভ করেছেন। তার মানে খুব আর্জেন্ট। বিকাশের রিচার্জ হতে একটু দেরি হচ্ছে। ম্যাডাম বলছেন কালকের কোনও প্রোগ্রামের কথা। কাল বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় উনি টাটা সেন্টারের সামনে থাকবেন বলছেন। এটা কথা শুনে বোঝা গেল। এরপর দোকানির থেকে একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে দুটো ফোন নম্বর নোট করলেন। আড়চোখে তাকিয়ে নম্বর দুটো খুব দ্রুত মগজে গেঁথে নিল বিকাশ। এটাও পেশাগত দক্ষতা। এরপর বাজিয়ে দেখতে হবে নম্বর দুটো। ফোনটা করেই দ্রুত ম্যাডাম বেরিয়ে গেলেন দোকান থেকে। যাক, নিশ্চিন্ত।
বিকাশ ধীরেসুস্থে বেরোল। মনে হচ্ছে আজ আর ম্যাডাম বাইরে বেরোবেন না। তবু বিকাশের তো ডিউটি এখনও শেষ হয়নি। ম্যাডাম না বেরোন, ওর কাছে কেউ আসছেন কিনা সে খবরটাও তো দরকারি। এবং রাতে সবটাই জানাতে হবে ওকে। এইজন্যই ওকে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে। তার আগে এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে আঁচ পড়ছে। সামনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল বিকাশ। চায়ের অর্ডার দিয়ে হাউসিং-এর গেটের দিকে চোখ রেখে প্রথম নম্বরটায় ফোন করল।
–এটা সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ তথাগত সেনের চেম্বার। একজন মহিলা ফোন ধরলেন। রিনরিনে গলা।
বিকাশ জানতে চাইল, কাল কি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে?
ওপার থেকে সাড়া এল, না। যদি কেউ বাতিল করেন তবে হতে পারে।
বিকাশ বলল, একটা ইনফরমেশন পেতে পারি?
–বলুন।
–কাল কি মিসেস অপাবৃতা সেনগুপ্ত নামের কারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে?
–একটু ধরুন, ডাইরি দেখে বলতে হবে।
….
–হ্যাঁ, সন্ধে ছটায়। তিন নম্বরে নাম আছে।
–থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
এবার দ্বিতীয় নম্বরটা। সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আউট অফ রিচ। আরও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল। একই কথা শোনাচ্ছে। তার মানে কিছু একটা গোলমাল আছে। যাকগে চা এসে গেছে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বিকাশ ঠিক করে ফেলল, আগামীকাল পাঁচটার মধ্যে ওকে পৌঁছতে হবে টাটা সেন্টারের সামনে আর তার আগে চিনে আসতে হবে ডাঃ সেনের চেম্বারটা।
৪.
ডাক্তারের চেম্বারটা বেশ একটা পুরনো বাড়ির একতলায়। চওড়া গাড়িবারান্দা তারপর লম্বা করিডরে অনেকগুলো চেয়ার বসানো। একদম শেষের ঘরটায় ডাঃ সেন বসেন। ছটা বাজার মিনিট কুড়ি আগে বিকাশ একবার ঘুরে গেল বারান্দায়। না, ম্যাডামরা এখনও আসেননি। তার আগে সাড়ে পাঁচটা অবধি টাটা সেন্টারের পেছনের দিকের একটা দোকানের সামনে থেকে নজর রাখতে হয়েছিল। ও জায়গাটা ছেড়ে চলে আসা অবধি ম্যাডাম আসেননি। তবে কালকের ইনফরমেশন ঠিক হলে ওরা এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। মনে মনে একটা হিসেব কষে বাড়িটার উল্টোদিকে একটা সিগারেটের দোকানে দাড়াতেই ট্যাক্সি এসে থামল গেটে। ম্যাডাম নামলেন, সঙ্গে ওই আগেরদিন দেখা বন্ধুটি। দুজনে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন। বিকাশকে কারও নজর করার কথা নয়, তাছাড়া ওর কথা ওদের দুজনের কেউই জানে না। কিন্তু বিকাশ খেয়াল করল ওরা যে ট্যাক্সিটা থেকে নামলেন সেটা গেটটা থেকে একটু আগে গিয়ে সাইড করে দাঁড়াল। ওঁরা কি ট্যাক্সিটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন নাকি নতুন প্যাসেঞ্জারের ধান্দায় ও ওখানে দাঁড়াল? জানা দরকার।
বিকাশের ডাইরি বলছে ডাক্তার দেখিয়ে আজ ওদের উকিলের কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু উকিলের ফোন বন্ধ থাকায় বিষয়টা যে পুরোটা ওর জানা হয়নি এটা গতকাল রাতেই রাকেশকে জানিয়ে দিয়েছে ও। রাকেশস্যার বলেছেন, ক্যারি অন। লেগে তো ও আছেই, হাল ছাড়লে হবে না।
তবু কাল যখন কথাটা রাকেশস্যার বলল ওর খুব বিরক্ত লেগেছিল। লোকটা যেন কেমন! নইলে কেউ নিজে শহরের বাইরে গিয়ে নিজের বউয়ের পেছনে নজরদারির জন্য লোক লাগায়! বিকাশের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি বলে এই রাকেশ লোকটাও খুব সুবিধের নয়। হয়তো ওর নিজেরও কোনও গোলমাল আছে। ঠিক সুবিধের লোক নয়। ওর অফিসের ঠিকানা ফোন নম্বর সবই আছে— ইচ্ছে করলে সে খবর বের করে আনা যায়! কিন্তু এজেন্সির মাইনে করা লোক হিসেবে এই বাড়তি ঝামেলা পুইয়ে ওর তো সত্যি কোনও লাভ নেই। বিকাশ ভাবনাটার রাশ টানল। আবার মনের মধ্যে একটা আবছা খচখচানি— এই টিকটিকিগিরি করাটাই ওর পেশা ভাবলে কেমন যেন খারাপ লাগে। সমস্ত পেশারই তো একটা এথিক্স থাকা দরকার। উথলে পড়া ভাবনাগুলোকে আবার আবর্জনায় ফেলে দিতে চাইল বিকাশ। সময় নষ্ট করা যাবে না। ট্যাক্সিটাকে একবার বাজিয়ে দেখতেই হবে।
বিকাশ জানলা দিয়ে মুখ গলিয়ে ড্রাইভারটাকে দেখতে পেল না। হয়তো আশেপাশেই আছে কোথাও। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল হাতে একটা জলের বোতল ভরে লোকটা গাড়ির দিকেই আসছে। বিকাশ বলল, যাবেন নাকি?
–না, দাদা ভাড়া আছে।
–কই ভাড়া আছে? বাজে কথা বলছ কেন?
–না। একজন স্যার আর ম্যাডাম আমায় ওয়েটিং-এ রেখে ডাক্তারের কাছে গেছেন। এখান থেকে ওঁরা অন্য কোথাও যাবেন।
–কোথায় যাবেন জানো?
–না, সে আমায় বলেননি। তবে ওঁরা নিজেদের মধ্যে দেশপ্রিয় পার্কের কথা বলছিলেন, আমি ঠিকঠাক জানি না, যেখানে যেতে বলবেন যাব।
–তাহলে তুমি যাবে না!
–সরি দাদা, ভাড়া বুক করা আছে… কী করে যাই বলুন?
ঠিক আছে। বিকাশ ট্যাক্সির পাশ থেকে পিছিয়ে আসে। এখানে দাঁড়ানোটা নিরাপদ নয়। যে কোনও সময়ে ম্যাডামরা বেরিয়ে আসতে পারেন। বিকাশ মনে মনে খুব দ্রুত ভেবে নেয় দুটো কাজ ওকে এখনই করতে হবে। অন্য একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে ফলো করতে হবে এরা বেরোনো মাত্র। অথবা আরেকবার ফোন করে দেখতে হবে উকিলের চেম্বারে। দ্বিতীয় কাজটাই আগে করল বিকাশ। কুক কুক কুক…… কিছুক্ষণ অপেক্ষা। তিনবারের বার রিং বাজল। একজন পুরুষকণ্ঠ বলল, কাকে চাই?
বিকাশ বলল, আমি কি মিঃ পাকড়াশির সঙ্গে কথা বলছি?
–না, ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘোষ বলছি। কী দরকার জানতে পারি?
–আজ সন্ধেবেলা কি স্যারের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়? খুব দরকার…
ওপারের কণ্ঠ বলল, আজ খুব চাপ, আপনি কাল করুন।
বিকাশ বলে, আসলে আমার আজই দরকার! আর্জেন্ট। কেসের ডেট হঠাৎ চেঞ্জ হয়েছে… বুঝতেই পারছেন নিরুপায় হয়ে…
–একটু ধরে থাকুন, ওপাশ থেকে পুরুষকণ্ঠ বলল, আমি স্যারের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি।
–বেশ। তবে যাতে হয় তারই চেষ্টা করবেন কিন্তু।
দু এক মিনিটের নীরবতা। তারপর ওপাশ থেকে সাড়া এল, আজ খুব টাফ। একজনের সাতটায়, পরেরজন সাড়ে সাতটায়। দ্বিতীয়জনের একটু দেরি হতে পারে জানিয়েছেন— ওই ফাঁকটুকুতে যদি…
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ওতে হয়ে যাবে। আর একটা জিনিস জানতে পারি কি?
–কী? বলুন।
–মানে, আজকে সাতটায় আর সাড়ে সাতটায় কাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? পার্টির নাম বলা যাবে কি?
–না, আমরা পার্টির নাম অন্য কাউকে বলি না।
–ও হ্যাঁ ঠিকই। আসলে অপাবৃতা সেনগুপ্ত বলে একজনের আজ যাওয়ার কথা। ভদ্রমহিলা আমার বিশেষ পরিচিত। ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্টটা কটায় জানতে পারলেই হত। আসলে ওঁর থেকেই এই নম্বরটা আমি পেয়েছি।
–দেখছি। হ্যাঁ, ওনারই সাড়ে সাতটায় আছে, দশ পনেরো মিনিট দেরি হতে পারে জানিয়েছেন। আপনাকে ওই ফাঁকটাতেই দিচ্ছি। আপনি টাইমলি চলে আসবেন। এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, আমার নাম পবিত্র ঘোষ।
৫.
বিকাশ ঠিক করে নিল ঠিক এখনই ওকে কী কী করতে হবে। গলির মুখে বড় রাস্তায় একটা ট্যাক্সি ধরে সেটায় বসে ওয়েট করতে হবে। ওদের ট্যাক্সি এই রাস্তা দিয়ে বেরোলেই তার পিছু নিতে হবে। এছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। উকিলের চেম্বার অবধি তো ফলো করে যাওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। কী বিষয়ে কথা হল সেটাও জানতে হবে কোনওভাবে। পবিত্র লোকটাকে হাতে রাখা দরকার। যদিও আবার সেই অসোয়াস্তির অনুভূতিটা একটু একটু মাথা তুলতে চাইছে। অন্যের অজ্ঞাতে তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখা ব্যাপারটাই যেন কেমন। কোনও অপরাধী-টপরাধী হলে পুলিশ এই কাজ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে যার ওপর এই নজরদারি চলছে তিনি একজন ভদ্রমহিলা আর যার নির্দেশে চলছে তিনিও আপাতভাবে একজন ভদ্রলোক। আসলে বোধহয় দুজনেই পরস্পরকে সন্দেহ করেন, সেটা নিয়ে নিজেদের সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। তবে রাকেশস্যার যখন ওদের এজেন্সিতে যোগাযোগ করেছেন তখন সন্দেহটা হয়তো ওরই বেশি। না হলে পয়সা খরচ করে নিজের বউয়ের ওপর কেউ গোয়েন্দাগিরি করে!
কিন্তু আগের দিন যার সঙ্গে ম্যাডাম রেস্টুরেন্টে এসেছিলেন বা আজকে যার সঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছেন তাঁর সঙ্গে ম্যাডামের সম্পর্কটাই বা কীরকম? বিকাশ ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে মনে হল, ধুস, এইসব নিয়ে ভেবে কী লাভ! যে যার সঙ্গে লটঘট করে করুক ওর কী আসে যায়। ওর বউ রুমার এইসব করার সাহসও নেই, ক্ষমতাও নেই। আবার ওরও এত রোজগার নয় যে পয়সা খরচ করে নিজের বউয়ের পেছনে এজেন্সির লোক লাগাবে। এগুলো নিজেদের সম্পর্কের ব্যাপার। ওর তো তাই মনে হয়। কার ঘর ভাঙল কার ঘর পুড়ল এইসব নিয়ে ওর নিজের জীবনে কী এসে যায়! আপাতত বড় রাস্তার মোড়ে দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে একটাকে যে করে হোক রাজি করাতে হবে!
একটা ট্যাক্সি যথারীতি যেতে গররাজি হলেও অন্যটা রাজি হয়েছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারটার সঙ্গে কিছুটা আলাপ জমানো গেছে। ফুটপাথ ঘেঁষে চায়ের দোকানটায় দুজনে চা খেয়ে যখন সবে উঠতে যাচ্ছে দেখা গেল গলি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ম্যাডামদের ট্যাক্সিটা। ৫৭৫৮। নম্বরটা মনে রেখে দিয়েছিল বিকাশ। বড় রাস্তায় পড়ে বাঁদিকে ঘোরামাত্র বিকাশ ট্যাক্সি নিয়ে ওদের পিছু নিল।
দেশপ্রিয় পার্কের একটু আগে রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানের আগে উল্টোদিকের একটা রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে ম্যাডামদের ট্যাক্সিটা ডানদিকের একটা বাড়ির সামনে থামল। এটা একটা ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক। বড় গ্লোসাইনে নাম লেখা আছে। মনে হচ্ছে ওঁরা এই বাড়িতেই ঢুকবেন। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিকাশ অপেক্ষা করছিল উল্টোদিকের ফুটপাথে। তিনতলা বাড়িটায় ওপরের দুটো তলায় আলো জ্বলছে। নিচের ডায়গনস্টিক সেন্টারের মূল দরজাটা বন্ধ তবে ভিতরের আলো জ্বলছে। হয়তো কেউ আছে। অনেক সময় ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কাজ হয়।
ম্যাডামরা ঢুকে যাওয়ার মিনিট কয়েক পরে বিকাশ এসে দাঁড়াল বাড়িটার সামনে। হ্যাঁ, এই বাড়িটাই। বাড়িটার গায়ে উকিলের নাম লেখা আছে। চেম্বার সম্ভবত দোতলায়। ডায়গনস্টিক ক্লিনিকের মূল দরজাটার পাশ দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। বিকাশ উঠতে আরম্ভ করল।
একটা বারান্দার শেষে উকিলবাবুর চেম্বার। সোজা দেখা যাচ্ছে। একটু এগিয়ে বিকাশ দেখল পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে ম্যাডাম আর ওঁর ওই সঙ্গী ভদ্রলোকটি বসে আছে। মিঃ পাকড়াশিকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। তাঁর চেয়ারটা বোধহয় ঘোরানো, দেওয়ালে আড়াল হয়ে গেছে। বিকাশ এদিকে ওদিকে তাকাল। কই আর কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না! সেই পবিত্র ঘোষ ভদ্রলোকটি কোথায় গেলেন? অবশ্য কথামতো বিকাশেরই আগে আসার কথা ছিল। এখন আর ওকে পাকড়াশির সঙ্গে দেখা করতে দেবে কিনা কে জানে! যা হয় হোক, বিকাশ সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চেম্বারের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল, এমনভাবে যাতে ঘরের লোকরা ওকে কোনওভাবেই দেখতে না পায়, অথচ ও ঘরের কথাবার্তাগুলো শুনতে পায়। ওগুলো শোনা ওর ভীষণ দরকার। যদি এর মধ্যে সেই ঘোষ ভদ্রলোকটি এসে পড়ে তাহলে যা হোক একটা কিছুভাবে ম্যানেজ করতে হবে। আপাতত ঘরের ভিতরে কান পাতল বিকাশ। সুবিধে এই যে ম্যাডামরা স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও মিঃ পাকড়াশির গলাটা বেশ চড়া।
চেয়ার টানার শব্দে সতর্ক হয়ে গেল বিকাশ। বোধহয় ম্যাডামরা এইবার বেরোবেন। কথাবার্তা অনেকটাই শুনে নিতে পেরেছে বিকাশ এবং এখনও সেই পবিত্র ঘোষ মশাইয়ের কোনও পাত্তা নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বারান্দায় কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় বিকাশ। ম্যাডামরা এইবার বেরোতে পারেন। ওঁরা বেরোলে বিকাশ কী করবে? মুহূর্তের মধ্যে একটা আইডিয়া মাথায় এসে যায় বিকাশের। কিছুক্ষণের মধ্যে ও একটু দূর থেকে দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখে পর্দা ঠেলে ম্যাডাম আর সঙ্গী ভদ্রলোক বেরিয়ে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ অন্য মেজাজে গম্ভীর মুখে বিকাশ হাঁটতে আরম্ভ করে উকিলের চেম্বারের দিকে। অনুমান ছিল এইভাবে ঢুকলে ওঁদের দুজন ওকে আলাদা করে খেয়াল করবে না তাছাড়া ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। সেই কথায় কিছুটা উত্তেজনার আঁচ আছে, এইসব সময়ে মানুষ ছোটখাটো বিষয় খেয়াল করতে ভুলে যায়। তবু ওঁদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার চোখাচোখি হল। বিকাশ সেটা উপেক্ষা করল। অপাবৃতার একবার মনে হল, লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে! দেখেছে কি সত্যি? নাকি মনের ভুল। ওটা ভাবার থেকে অন্য প্রসঙ্গ মাথার মধ্যে ভার হয়ে আছে মিঃ পাকড়াশির সঙ্গে কথা বলার পর। সেগুলোই আবার দখল নিয়ে নিল চিন্তার আর আলোচনার।
বিকাশ ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ঘরের ভিতরে। মিঃ পাকড়াশি একগোছা কাগজ দেখছেন টেবিলে বসে। ভদ্রলোকের মাথায় অল্প টাক, চুলে পাক ধরলেও বেশ দশাসই চেহারা।
–স্যার, আসতে পারি?
মিঃ পাকড়াশি মুখ তুলে তাকালেন, কে আপনি? কোথা থেকে আসছেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল?
–আজ্ঞে।
–কটায়?
–ঘোষবাবু দিয়েছিলেন, সাড়ে সাতটায়। আমার একটু দেরি হয়ে গেছে… সরি স্যার…
–ঘোষকে ডাকুন।
–আজ্ঞে উনি নেই। আমি এসে থেকেই খুঁজছি। দেখতে পাচ্ছি না। তাই সরাসরিই ঢুকে পড়লাম— মাপ করবেন।
পাকড়াশি ভুরু কোঁচকালেন। প্রশস্ত ললাটে ছড়িয়ে গেল কুঞ্চন। তারপর নিজের মনেই হেসে উঠে বললেন, ওহো, ওকে পাবেন কোথায়? আমিই তো ওকে একটা কাজে পাঠিয়েছি! তা আপনার ব্যাপারটা কী? শর্টে বলুন। এবার আমি উঠব।
বিকাশ বলে, আচ্ছা একটু আগে যারা আপনার সঙ্গে কথা বলে গেলেন ওদের কেসটা কি একটু জানা যাবে?
–মানে? অন্যের কেস হিস্ট্রি আপনাকে বলতে যাব কেন? কে আপনি? এখনই চেম্বার থেকে বার করে দেব।
–রাগবেন না স্যার! একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। আমি ওদের কোনও ক্ষতি করতে চাই না।
–ক্ষতি? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ক্ষতি? বিয়ের দু বছরের মধ্যে মেয়েটার হাজব্যান্ড প্রতিমাসে দুমাসে অফিসের মহিলা সেক্রেটারি নিয়ে ট্যুরে যায়, একই হোটেলে ওঠে… আমায় চেনে না, সেকশন ৪৯৮ আর ৪৯৭ একসঙ্গে দিয়ে দেব… জেলের ঘানি টানাব আমি ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে! ফাজলামি! বিয়ে করা বউ থাকতে…
–রেগে যাবেন না স্যার, একটু শুনুন!
–বলুন আপনার কী বলার আছে? বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন মিঃ পাকড়াশি।
সুযোগ পেয়ে বিকাশ ওর পুরো বৃত্তান্ত খুলে বলল। পাকড়াশি সব শুনলেন। তারপর বললেন, বটে! রাস্কেলটার সাহস তো বড় কম নয়! দাঁড়ান আমি দেখছি। আপনার ফোন নাম্বারটা আমায় দিয়ে যান তো। আর শুনুন, এখন আমার এইসব আর ভালো লাগছে না। সারাদিন কেসের পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে এবার একটু পরিষ্কার হব। তার আগে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন…
–বলুন স্যার, আমারও আর ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে আর ম্যাডামকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে এটা আমারও মনে হয়েছিল। আমায় স্যার প্রতিদিন রাতে রাকেশস্যারকে সারাদিনে ম্যাডামের গতিবিধি সব রিপোর্ট করতে হয়!
–শুনুন, পরশুদিন বেলা বারোটায় আলিপুর কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনে আমার চেম্বারে আসবেন। আমি সুপ্রতীককেও বলে দিচ্ছি। ওখানেই বাকি কথা হবে। পাকড়াশি একটু থামলেন। তারপর বললেন, তবে শুনুন মশাই, এখন ভালো সেজে কাল আবার পিছলে যাবেন না! পেছন দিকে তাকান, ওখানে সিসিটিভি বসিয়ে রেখেছি। আমার কাছে এসেছিলেন পরে যদি ডিনাই করেন… হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব আর জেলে ওই জানোয়ারটার পাশে আপনারও একটা ঘর বুকিং হয়ে যাবে, বুঝেছেন?
–না স্যার, ওমনি হবে না।
–বেশ যা হবে কাল দেখা যাবে। এখন আসুন তো মশাই… যত্ত সব!
ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিকাশ।
৬.
ঠিক সন্ধে সাতটা নাগাদ অপাবৃতার ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজল। অপাবৃতা ভেতরেই ছিল। আই হোলে চোখ রেখে একটু অবাক হল। ঠিক চেনা মুখ নয়। আধখানা দরজা ফাঁক করে বলল, কে? কাকে চাই?
–আপনার কাছেই এসেছি ম্যাডাম।
–কিন্তু…
–না, আপনি আমায় চিনবেন না।
–হ্যাঁ, তবু কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে। ঠিক মনে করতে পারছি না।
বিকাশ মনে করে দেখল অন্তত তিনটে ক্ষেত্রে ম্যাডাম ওকে দেখেছিলেন কিন্তু ওর পরিচয় বা উদ্দেশ্য জানা সম্ভব ছিল না। আর এখন বোধহয় সেগুলো ওর পক্ষে মনে করাও সম্ভব নয়। কিন্তু বিকাশ জানত ম্যাডামের বাড়িতে ও খুব সহজে ঢুকতে পারবে না। অচেনা কাউকে একজন মহিলা তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে নাই দিতে পারেন। ওর অনুমান মিথ্যে নয়। দরজাটা আধখোলা রেখেই অপাবৃতা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমার সঙ্গে আপনার কী দরকার থাকতে পারে বুঝতে পারছি না, আমি তো আপনাকে চিনিই না!
এমন একটা প্রশ্নের জন্য বিকাশ তৈরি ছিল। তাই একটুও না ভেবে ও বলল, মিঃ পাকড়াশি আমায় পাঠিয়েছেন। কাল আপনি ওর চেম্বারে গিয়েছিলেন তো?
–ওহ আচ্ছা আসুন। দরজা পুরোপুরি খুলে গেল এইবার। কী ব্যাপার বলুন তো? সামনের সোফাটার দিকে ইঙ্গিত করে ম্যাডাম বলল, বসুন।
বিকাশ বসতে বসতে বলল, একগ্লাস জল হবে?
অপাবৃতা পাশের ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল বার করে গ্লাসে ঢালতে যাচ্ছিল। বিকাশ বলল, ঠিক আছে বোতলেই হবে, গ্লাস আর লাগবে না।
ঘণ্টাখানেক বাদে ম্যাডামের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিল বিকাশ। সারাদিন গরমের পর এখন বেশ হাওয়া ছেড়েছে। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় রাস্তার বাতিগুলোকে কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছে। লেক গার্ডেনসের অভিজাত পাড়ার রাস্তায় অনবরত জোরালো হেডলাইট জ্বেলে গাড়ির যাওয়া আসা। মোড়ের রোলের দোকানে জমাট হয়ে আসা ভিড়। উলটো দিকেই আবর্জনাভর্তি ভ্যাট। কাল সকালের আগে যা পরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু বিকাশের আজ এইভাবে হাঁটতে ভালো লাগছে। হাল্কা। দখিনা বাতাসের মধ্যে যেন একটা প্রাণজুড়োনো আবদার। পনেরো বছরের চাকরিজীবনে এইরকমের কোনও ভূমিকা যে ওকে নিতে হবে ও কোনওদিন ভাবেনি। এজেন্সি থেকে যা কাজ দিয়েছে যন্ত্রের মতন পালন করে গেছে। ন্যায় অন্যায় বিচারের ভার ওর ওপর ছিল না, ও নিজেও এইসব নিয়ে ভাবেনি। এই পেশায় যে এটা নিয়ে ভাবতে নেই এটা ওদের প্রথমেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন ওদের ম্যানেজার ঘোষসাহেব ছিলেন জাঁদরেল ট্রেনার। পুলিশে তিরিশ বছর কাজ করেছেন। বছর দুয়েক হল ঘোষসাহেব গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর শেখানো নির্দেশ থেকে কেউ কোনওদিন এতটুকু নড়চড় করেনি। বিকাশও নয়। কিন্তু এই কেসটায়… সব হিসেব কেমন যেন গুলিয়ে গেল। জীবন কি এইরকমই? আগাম জানতে দেয় না, কে কোথায় কেমনভাবে পালটে যাবে!
অপাবৃতা ম্যাডামকে আজকেই বলতে গেলে সামনাসামনি দেখল বিকাশ। প্রায় মুখোমুখিই বলা চলে। অনেকক্ষণ কথাও হল। যাই হোক বিকাশের মনে হয়েছে ম্যাডামের মুখে একটা নিষ্পাপ সারল্য আছে। ওষুধের দোকানে যেদিন প্রথম ম্যাডামকে ফলো করা আরম্ভ করেছিল সেদিন পাশ থেকে দেখলেও এই সৌন্দর্যটা ওর চোখ এড়ায়নি। কিন্তু পেশাদার মানুষের কি কোনও ব্যক্তিগত ভালো লাগা না-লাগা থাকতে পারে? রাকেশস্যারের অফিসে ওর আর যাওয়ার দরকার হয়নি ঠিকই কিন্তু নিজের সূত্রে খবর নিয়ে জেনেছে গণ্ডগোলটা সেখানেই। অফিসের অনেকেই এটা জানে। তাহলে?
এই ‘তাহলে’টাই বোধহয় বিকাশকে পথ ভুলিয়ে দিল, এলোমেলো করে দিল ওর গতানুগতিক চলার রাস্তা। প্রতি রাতে বেঙ্গালুরুতে ফোন করে ম্যাডামের গতিবিধির খবর দিতে খুব অসহায় আর অপরাধী লাগছিল নিজেকে। ঠিক এই মুহূর্তে সেই অসহায়তা আর তেমন টের পাচ্ছে না বিকাশ। বরং যেন একটা মুক্তির হাওয়া। এই তঞ্চকতার জীবন থেকে ম্যাডাম মুক্তি চান, বিকাশও এখন তাই চাইছে। ম্যাডাম একটা নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন এইবার। পাকড়াশি স্যার বলেছেন, বিকাশের স্টেটমেন্ট খুব কাজে আসবে। হ্যাঁ উকিলবাবু যা বলেছেন বিকাশ সেটা অক্ষরে অক্ষরে মানতে চায়। বিকাশ চায় ম্যাডাম সুখে থাকুন শান্তিতে থাকুন। একটা সুন্দর জীবন। এইরকম নজরদারির আড়ালে সেই জীবন লুকিয়ে আছে, বিকাশ জানে।
রাস্তার মোড়ে বাস ধরার যাত্রীদের জটলা। ওকেও এবার বাড়ি ফিরতে হবে প্রতিদিনের মতন। তবু আজকের দিনটা অন্যরকম। সব জানাজানি হলে এজেন্সি ওকে আর চাকরিতে রাখবে বলে মনে হয় না। না রাখুক। বিকাশ ওর এতদিনের এই লাইনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আর একটা কাজ জুটিয়ে নিতে কি পারবে না! এটা নিয়ে বিকাশ আজ ভাবতে চাইছে না একটুও। বরং ম্যাডামের খুশি হওয়া বিস্মিত মুখটা মনে করে ওর বেশ ভালো লাগছে। কেমন যেন একটা অন্য ধরনের অনুভূতি।
বুকের কাছে মোবাইল বাজছে। পকেট থেকে বার করে মোবাইলটা হাতে নিল বিকাশ। স্ক্রিনের দিকে তাকাল। কার ফোন? রাকেশস্যার। … উঁহু, এই ফোনটা ও আজ কিছুতেই ধরবে না!