Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ পথেই বোমা ফেলে, এ পথেই ‘ক্রমমুক্তি’ হবে: রাশিয়া বনাম ইউক্রেন

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 



সাহিত্য গবেষক, দাবা প্রশিক্ষক

 

 

 

 

–যাই হোক, আমি আবার আসব। সামনের ইতিহাসে অনেক স্তালিন আসবে। স্তালিন যেমন আসবে তেমনি জানবি হিটলার, তোজো, চার্চিল, রুজভেল্ট, ট্রুম্যান, টিটো সব ফের আসবে। তবে সবই ডামি। আসলি মাল আর হবে না।
–কী হবে তাহলে?
–তোর মতো উটকো কতগুলো ভোঁদড় জলঘোলা করবে। আবার কী হবে?

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু বহুদূরে বসে যুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়তো সহজ। পূর্ব ইউরোপের রণক্ষেত্রের দক্ষিণে অন্য একটা মহাদেশের ‘নিরপেক্ষ’ (ভারতরাষ্ট্র আপাতত যা অবস্থান নিয়েছে) একটি দেশে বসে যুদ্ধরত দেশদুটির ত্রুটিবিচ্যুতি ও ঔচিত্য নিয়ে প্রবন্ধ নামানো হয়তো সহজ। কিন্তু বোঝা সহজ নয় একটিই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর— যুদ্ধ কেন হয়? এক দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত বাসনায় বন্দুক-কামান নিয়ে অন্য দেশের মানুষ মারতে চলে যায় না। রাষ্ট্রনেতারা ঠিক করে দেয় যুদ্ধের যুক্তি, যুদ্ধের কৌশল ও যুদ্ধের দিন। তারাই ঠিক করে যে, যুদ্ধের সপক্ষে সম্মতি আদায় করতে কী কী জুজু সামনে রাখবে। তারাই ঠিক করে যে দেশকে আক্রমণ করবে তার কোন কোন ‘অপরাধ’কে ক্ষমার অযোগ্য দাগিয়ে দেওয়া যায়। বিবদমান রাষ্ট্রনেতারা নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতার পাশে অন্য রাষ্ট্রনেতাদের চায়। কারা বন্ধুরাষ্ট্র, কারা শত্রুপক্ষের তা বুঝে নেয় ও বুঝিয়ে দেয় শাসিত নাগরিকদের। সংবাদমাধ্যমও বেছে নেয় কোনও না কোনও পক্ষ। বিনিয়োগ-পুঁজির যুগে কোন রাষ্ট্র কোন কোন সংবাদমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে, তা দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায় কার হয়ে তারা কথা বলবে। ‘আক্রান্ত’ আর ‘আক্রমণকারী’ এই দুই পক্ষের অবস্থান সমর্থন করতে তাবৎ বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। অধিক শক্তিশালী দেশ আর্থ-সামরিক ভারে তুলনায় কম শক্তিশালী দেশকে আক্রমণের অজুহাত হিসেবে বেছে নেয়— সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লুকোনো পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে শান্তি আনার যুদ্ধ। সম্প্রতি এই তালিকায় জুড়ে গেছে বিনাৎসিকরণ (denazification)। নাৎসি-জমানার বর্বরতার পরে সভ্যসমাজের কাছে ‘নাৎসি’ একটি ঘৃণ্য শব্দ। নাৎসিদের পর্যুদস্ত করে বার্লিন দখলের পরে রেড আর্মি যখন কাস্তে-হাতুড়ি শোভিত লাল পতাকা উড়িয়েছিল, তখন মানবসভ্যতাকে বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিল তারা। ফলে, বিনাৎসিকরণ শব্দটায় যেকোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের খুশি হওয়াই উচিত! পুতিন এই ধারালো শব্দাস্ত্রের ব্যবহারে ইউক্রেনকে সভ্যজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চেয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ যেন লালসৈন্যের ৮০ বছর আগের সেই মরণপণ যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু, সমীকরণ এত সরল নয়। রাশিয়া সোভিয়েত নয়; যে সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শগত আর্থ-রাজনীতিকে ঘিরে নির্মিত হয়েছিল। সোভিয়েতের শেষ কয়েক দশকে সংশোধনবাদের রমরমা তো ছিল বটেই, রাশিয়া রাষ্ট্রের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকাও অজানা নয়। পুতিন বলশেভিকদের ঘৃণা করে এবং লেনিন-ট্রটস্কি-স্তালিনদের সব চিহ্ন মুছে ফেলায় বিশ্বাসী। আর, ইউক্রেন একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে, নাগরিকেরা অত্যাচারিত— এই যুক্তিতে অন্য দেশ যুদ্ধবিমান-ট্যাঙ্ক-সেনা ঢুকিয়ে দিলে তাকে ‘আক্রমণ’ বলে। নেহাত ‘যুদ্ধকামী বদ্দা’ হতে না চাইলে কোনও রাষ্ট্র প্রতিবেশী দেশের দুটি ভূখণ্ডকে ‘স্বাধীন দোনেৎস্ক গণপ্রজাতন্ত্র ও লুগানস্ক গণপ্রজাতন্ত্র তৈরির অনুমতি দিলুম’ বলে স্বঘোষিত মুক্তিদাতা সাজে না!

***

 

মানুষ যদি কোনওদিন নিজের ঘুমন্ত মুখ দেখতে পেত, তাহলে পৃথিবীর সব যুদ্ধ থেমে যেত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার (১৯৯১) আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ব্লক ও আমেরিকান ব্লক এই দুই মহাশক্তিধর ঠান্ডা যুদ্ধ চালিয়েছে এবং নিজেদের পক্ষে-বিপক্ষে বহু রাষ্ট্রকে জড়ো করেছে। সোভিয়েত ভাঙার পরে বিভিন্ন জাতিসত্তা নিজেদের আত্মমর্যাদা বুঝে নিয়ে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ১৯৪৯ সালে উত্তর আতলান্তিক সন্ধি সংস্থা (NATO) যখন গঠিত হয়, তখন ১২টি মাত্র দেশ এর সদস্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ’৯০ দশকের মাঝামাঝি, সোভিয়েত টুকরো হয়ে যাওয়ার পরে ন্যাটো রাজনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টায় ইউরোপের অনেকগুলি দেশকে সদস্যপদ দিয়েছে। ২০০৪ সালে একদা সাবেক সোভিয়েত ব্লকে থাকা সাতটি রাষ্ট্রকে ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আমেরিকান ব্লকের দাপট বাড়ে পূর্ব ইউরোপে এবং রাশিয়ার মুঠো আলগা হয়। এই দেশগুলিকে ন্যাটোর অধীনে আনা জর্জ বুশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সাফল্য, যা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্লককে ফায়দা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। অন্যদিকে এই ছোট ছোট সাতটি রাষ্ট্র যে দারুণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুশীলনের জন্যে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা নয়। ন্যাটো কোনও শান্তিরক্ষার কবচ নয় বা প্রতিরোধের কুণ্ডল নয়। যুদ্ধোন্মাদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমরসঙ্গী। বুশ খোলাখুলি বলে যে, “এই দেশগুলো নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই জানে যে, আফগানিস্তান ও ইরাকে আমাদের আক্রমণ কতটা যুক্তিযুক্ত। ন্যাটো তৈরির সময় এই দেশগুলি একটি সাম্রাজ্যের দাস ছিল। বুলগেরিয়া আফগানিস্তান অভিযানের সময় জ্বালানি দিয়েছে ও চারশো সেনা পাঠিয়েছে। এস্তোনিয়া ও লাতভিয়ার সামরিক প্রযুক্তিবিদেরা ইরাকে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করেছে। রোমানিয়া ও স্লোভেনিয়ান সৈন্যরা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে। এবং লিথুয়ানিয়া ও স্লোভাকিয়ার সৈন্যরা ইরাকে আমাদের সমরসঙ্গী।”[1] ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো ও উত্তর ম্যাসিডোনিয়া সাবেক যুগোস্লোভিয়ার অংশ ছিল, তারাও ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৯-২০২০ সালের মধ্যে। অন্যদিকে রাশিয়া সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরেও ছোট ছোট যে দেশগুলি একদা তাদের সঙ্গে জুড়ে ছিল তাদের ‘মতাদর্শের বাঁধনে’ বেঁধে রাখতে চায়।[2] প্রাচ্যের খনিজ তেলসমৃদ্ধ দেশগুলিতে যুক্তরাষ্ট্র যতবার সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ করতে ধেয়ে গেছে, রাশিয়াও ধেয়ে গেছে। গত দেড় দশক ধরে এই দুই শক্তিধর দেশের সমান্তরালে আরেকটি দেশ পাল্লা দিয়েছে। চিন। যুক্তরাষ্ট্রীয় শিবির ও ন্যাটোর সদাবিবদমান অবস্থানের নিভৃতে গোকুলে বাড়ার মতোই চিন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিয়েছে। ‘বিশেষ শাসনভুক্ত অঞ্চল (SAR)’ বাড়িয়ে নেওয়ার নামে আশেপাশের দ্বীপপুঞ্জ নিজদখলে আনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ায় ইউক্রেন আক্রমণ এমন সময়ে যখন অতিমারির থাবার ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি এবং সকল রাষ্ট্রই অর্থনৈতিকভাবে কম-বেশি অস্থিরতার সম্মুখীন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি দেশে নতুন জাতীয় সুরক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যাতে ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণে সুবিধে হয়। ২০০৮ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদন জানিয়েছিল। ২০১৬ সালে ন্যাটো কম্প্রিহেনসিভ অ্যাসিস্ট্যান্স প্যাকেজ ঘোষণা করে ইউক্রেনের জন্যে। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত হওয়া থেকে আটকাতে সদাসচেষ্ট পুতিনের শেষ মরিয়া চেষ্টা ২৪শে ফেব্রুয়ারির এই আক্রমণ। আর, ইউক্রেন যদি একবার ন্যাটোর সদস্য হয়ে যায়, তাহলে রাশিয়া ইউক্রেনকে যে কোনও দোহাই পেড়ে আক্রমণ করলেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমরসঙ্গী জোট পাল্টা আক্রমণ করবে। এবং, রাশিয়ার পশ্চিমসীমান্তে নিঃশ্বাস ফেলবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ইউক্রেনকে ‘আজ-নয়-কাল’ বলে ঘোরালেও একদা কেজিবি-প্রধান পুতিনের নিশ্চিন্তির অবকাশ নেই, “All right. It doesn’t happen tomorrow, and then it will happen the day after tomorrow. What does it change from the historical perspective?”[3] পুতিন কয়েকটি যুক্তি সাজাল ইউক্রেন আক্রমণের প্রস্তুতিতে— শাসকের সবসময়ই শাসিতের সম্মতি প্রয়োজন হয়—

  1. রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি চরম অপমান ও অবজ্ঞা করা হচ্ছে ইউক্রেনে। দেশের সর্বত্র রুশভাষাভাষী মানুষকে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে সরকারি নীতিতে।
  2. ইউক্রেনের সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাক্‌স্বাধীনতা, জনক্ষোভ ও গণতান্ত্রিক বিরোধিতাকে পিষে মারা হচ্ছে।
  3. জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতালাভের পরে গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তি খুন হয়ে গেছে। বিরোধী শিবিরের সকলকে হেনস্থা করা হচ্ছে। ওডেসাতে প্রতিবাদকারীদের অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয়েছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
  4. অর্থনীতির চরম সঙ্কটাবস্থা চলছে। ১৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় কাজের সন্ধানে দেশ ছেড়েছে। ক্রেমচুং ইস্পাত কারখানায় তালা লেগেছে। সোভিয়েতের তৈরি গ্যাস পরিবহন ব্যবস্থার অতিজঘন্য অবস্থা। দারিদ্র, বেকারত্ব দেশের সর্বত্র।
  5. জাতীয় দুর্নীতিরোধী সংস্থা থেকে উচ্চ দুর্নিতীরোধী ন্যায়ালয় সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলনে চলছে।
  6. ক্রিমিয়া দ্বীপের অধিবাসীরা স্বেচ্ছায় রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও কিয়েভ প্রশাসন সেখানে অন্তর্ঘাতী চক্রান্ত চালাচ্ছে মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে; পরিকাঠামোগত ব্যবস্থার ওপরে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ নামিয়ে আনছে। পশ্চিমী গুপ্তসংস্থাগুলি এতে মদত যোগাচ্ছে। ডনবাসেও সামরিক দমনপীড়ন চলছে।
  7. কিয়েভ প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি দেশগুলির সহায়তায় গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে তারা। সোভিয়েত আমলে তৈরি অনেক উন্নত সমরাস্ত্র ইউক্রেনের আছে, তবুও তারা পরমাণু অস্ত্র ও অন্যান্য ভয়ঙ্কর অস্ত্র বানাচ্ছে। ন্যাটোর প্রত্যক্ষ মদত আছে। সমগ্র ইউরোপ ও মানবসভ্যতার কাছে ভয়ের ইঙ্গিত এগুলি।

পুতিনের এমন আশঙ্কাগুলির সঙ্গে একদা আমেরিকার ইরাক আক্রমণ বা সিরিয়ায় যৌথ আক্রমণ বা আফগানিস্তানে ন্যাটোর আক্রমণের আগের আশঙ্কাগুলির দারুণ মিল! গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিচারক সেজে অন্য দেশের সঙ্কটমুক্তিতে ‘ঝাঁপিয়ে’ পড়া। পরমাণু অস্ত্রে মানবসভ্যতা সঙ্কটে পড়বে এমন আশঙ্কায় ‘ভীত’ হয়ে পৃথিবীরক্ষার ভার স্বীয়কাঁধে তুলে নেওয়া। অন্য দেশের বাক-স্বাধীনতা, দমনপীড়নে ব্যথিত হয়ে এবং অপশাসনে চিন্তিত হয়ে নিপীড়িত জনগণকে ‘বাঁচাতে’ ছুটে যাওয়া। পুতিন রুশ মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্মতি পেয়ে গেছে। রুশ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠও সম্মতি দিয়ে দিয়েছে।[4] বিশ্বের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। পুতিনের জনদরদী মুখ আর প্রতিবেশীদরদী ভাষণ তাকে ‘ভ্লাদিমির লেনিনের নয়া অবতার’ বানিয়ে দিয়েছে। পুতিন নিশ্চিত জানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধে নামবে না। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি আমদানির। ইউরোপে শক্তি সরবরাহের ১৩ শতাংশ মাত্র নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে আসে। খনিজ তেল থেকে আসে ৩২ শতাংশ ও জৈবজ্বালানি থেকে আসে ১৮ শতাংশ। আর, সমগ্র ইউরোপের মোট ব্যবহৃত শক্তির ২৫ শতাংশ আসে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস তুলনামূলক সস্তাদরে সরবরাহ করে রাশিয়া। ২০২১ সালে রাশিয়া ১০০ বিলিয়ন মূল্যের তেল ও গ্যাস সরবরাহ করেছে ইউরোপে। ফিনল্যান্ড ৯৮ শতাংশ, গ্রিস ৭৬ শতাংশ, জার্মানি ৩৬ শতাংশ, ইতালি ২৭ শতাংশ, ফ্রান্স ১৪ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলির বেশ কয়েক শতাংশ জ্বালানি রাশিয়া থেকেই আসে। বহু হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নর্ডস্ট্রিম-২ পাইপলাইন তৈরি হয়েছে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস আমদানির জন্যে। ইউক্রেন আক্রমণের ‘শাস্তি’ হিসেবে আপাতত পাইপলাইনের কাজ স্থগিত, কিন্তু রুশ-জার্মান উভয়েই জানে যে, স্থগিত রাখা বেশিদিন চলবে না। এছাড়াও অর্থনৈতিক ভারসাম্যে রাশিয়ার বড় সহায়ক চিন। চিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরোধী। যুদ্ধবাজ পুতিন ‘সঠিক’ সময় বেছে নিয়েছে আক্রমণের জন্যে। আর, এই আক্রমণ বিপ্লব করার জন্যে বা ইউক্রেনের জনগণকে বাঁচানোর জন্যে নয়।

***

 

We want those who seized and continue to hold power in Kiev to immediately stop hostilities. Otherwise, the responsibility for the possible continuation of the bloodshed will lie entirely on the conscience of Ukraine’s ruling regime.

As I announce the decisions taken today, I remain confident in the support of Russia’s citizens and the country’s patriotic forces.

পুতিনকে সঙ্কটাপন্ন বিশ্বের ত্রাতা বলে ভেবেছে অনেক তাত্ত্বিক। এদের মধ্যে অনেকেরই সোভিয়েত-হ্যাল কাটেনি। সোভিয়েত ভাঙার আগে পর্যন্ত সংশোধনবাদী ও জবরদস্তি-শাসনচাপানো সোভিয়েতের সমর্থক ছিল এরা। রাশিয়া ও চিন যে বাজার-সমাজতন্ত্রকে সাম্যবাদী মতাদর্শের নামে চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে এদের অচলা ভক্তি। তাই যুদ্ধবাজ পুতিনের বিরুদ্ধতা করছে না। অথবা, পুতিনের বিরোধিতায় ‘কিন্তু’ ‘তবু’ লাগিয়ে পুরনো দেয়াললিখনের ‘পিতৃভূমি সোভিয়েত আক্রান্ত’ সেপিয়া ছবি তুলে ধরতে চাইছে। না, পুতিন আক্রান্ত নয়। রাশিয়াও আর সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমি বা আদর্শভূমি নেই; ক্রুশ্চেভের জমানা থেকেই নেই। আর, পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রবাদী দল, কমিউনিজমের ঘোষিত বিরোধী।

সাম্প্রতিক ভাষণে লেনিনপ্রণীত নীতির সমালোচনা করেছে পুতিন। লেনিনের সোভিয়েতনীতি সনাতন রুশদের বঞ্চিত করেছিল। স্তালিন পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে ভূখণ্ড ছেঁটে ইউক্রেনকে বড় করেছিলেন। ক্রুশ্চেভ রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়া কেটে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে জুড়ে দিয়েছিলেন।[5] লেনিন ও স্তালিনের জাতিসত্তার আত্মমর্যাদার প্রশ্ন, যা সোভিয়েতের ভিত্তি ছিল, তা আসলে রুশদের আত্মমর্যাদায় আঘাত ছিল। সোভিয়েতের ইউক্রেন আসলে ‘ভ্লাদিমির লেনিনের ইউক্রেন’ ছিল। ডনবাসকে ইউক্রেনে গুঁজে দেওয়া লেনিনের সোভিয়েত নীতির ভুল, যা এখন রাশিয়ার শিরঃপীড়ার কারণ। “When it comes to the historical destiny of Russia and its people, Lenin’s principles of state development were not just a mistake; they were worse than a mistake.”[6] পুতিনের কাছে জাতিসত্তার প্রশ্ন একটা ‘রোগ’ মাত্র, যা পুরনো রুশ সাম্রাজ্য ও রুশ আত্মমর্যাদাকে আঘাত করে। পুতিনের মূল রাগ বলশেভিকদের ওপরে, ফলে ‘বিসাম্যকরণ (decommunization)’ তার কাছে অত্যন্ত জরুরি আশু কর্তব্য। পুতিন ইউক্রেনের দক্ষিণপন্থার ‘ভয়াবহতা’ বোঝাতে দুটো শব্দ ব্যবহার করেছে— নয়া-নাৎসিবাদ ও রুশাতঙ্ক (Russophobia)। এবং সাম্যবাদের নীতি যে অবাস্তব কল্পবিলাস তা বুঝিয়েছে। পুতিনের সাম্যবাদাতঙ্ক ও বলশেভিকাতঙ্ক নতুন না। ২০১৬ সালে লেনিনকে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়ে পুতিন বলেছিল, “একটা হেরো দেশ জার্মানির হাতে রাশিয়ার একটা অংশ তুলে দেওয়ার মতো মূর্খামির ঘটনা ইতিহাসে বিরল। জারকে নিষ্ঠুরভাবে উৎখাত করে পরবর্তীতে জাতিসত্তার অধিকারকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাশিয়ারাষ্ট্রে টাইমবোমা রেখে দিয়েছিলেন লেনিন।”[7] বরিস ইয়েৎস্লিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুতিনও ৭ নভেম্বরের গুরুত্ব কমানোর সরকারি বন্দোবস্ত করে। ২০১৭ সালে পুতিনের জিগরি তথা মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ বলে, “কী হবে অক্টোবর বিপ্লবের একশো বছর উদ্‌যাপন করে?” ইয়েৎস্লিনের সুযোগ্য উত্তরাধিকার পুতিন সনাতন রুশ সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্খাতেই বলেছিল, “Russia did not begin either in 1917, or in 1991. We have a single, uninterrupted history spanning over a thousand years.”[8] নবারুণ হারবার্টে লিখেছিলেন, “রাশিয়ায় বরিস ইয়েৎস্লিন জব্বর ভূতের জলসা বসিয়েছে,” আর, সেই ভূতের জলসার ভিত হচ্ছে সাম্যবাদ-বিরোধী মতাদর্শে রুশ রাষ্ট্রবাদকে পুনর্নিমাণ করার। পুতিনের বিরুদ্ধে রাশিয়ায় গত এক দশকে যে বিক্ষোভ হয়েছে, ইয়েৎস্লিনের শাসনেও তা হয়েছে। বরিস ইয়েৎস্লিন ১৯৮০-র দশকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান থেকে জনতোষী সাম্যবাদবিরোধী নেতায় রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ দশকের শুরুতে। সোভিয়েত ভাঙনের পরে ক্রেমলিনের শাসনভার তারই হাতে ছিল। কিন্তু, ১৯৯৩-এর এপ্রিল-অক্টোবরে জনরোষ ও প্রতিবাদী মুখেদের শায়েস্তা করতে গিয়ে ইয়েৎস্লিনের স্বৈরতান্ত্রিক মুখ প্রকাশ্যে চলে আসে। নিজেরই মন্ত্রিসভার সদস্য (খাসবুলাৎভ ও রুৎস্কোই) ও আইনপ্রণেতাদের গ্রেপ্তার করে এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় ইয়েৎস্লিন। ১৯৯৯ সালে চেয়ারে বসিয়ে যায় ভ্লাদিমির পুতিনকে— রাশিয়ার বিসাম্যকরণ করা এবং রাষ্ট্রবাদী-জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনমুখী নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন রাশিয়ার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ। এর সঙ্গে লেনিন-পরিকল্পিত সোভিয়েতের কোনও সম্পর্ক নেই। একটি যুদ্ধবাজ জোট যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোর বিরুদ্ধে অপর যুদ্ধবাজ রাশিয়ার (এবং শক্তিধর বন্ধুরাষ্ট্রের) ভারসাম্যের লড়াই। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে শান্তিবৈঠকের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফার শান্তিবৈঠক শুরুর আগে ফের খারকিভ ও কিয়েভে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে রুশ সেনা। অন্যদিকে কিয়েভ শহর ‘দখল’ হয়ে যেতে যেতেও ‘লড়াই’ করে যাচ্ছে; কারণ, ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও রসদের জোগান দিয়ে যাচ্ছে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি। হয়তো এই যুদ্ধের সন্ধিসমাপ্তির সময়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির ভারসাম্যে বদল আসবে। হয়তো ইউক্রেনের যে ভূখণ্ডগুলি পুতিন আপাতত দখল করেছে, সেগুলি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেবে। সনাতন রুশ সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে আত্মতৃপ্তি হবে পুতিনের। আরও অনেক সম্ভাবনাই থেকে যায় যুদ্ধের ফল নিয়ে, বিতর্ক-দ্বিমত-বিশ্লেষণ। কিন্তু, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে যুদ্ধবাজ রাশিয়া আক্রমণকারী এবং দখলদার হয়ে ইউক্রেনে ঢুকেছে— এটুকু বলতে যেন দ্বিধার অবকাশ না থাকে।


[1] Ricks, Thomas. 7 Former Communist Countries Join NATO. The Washington Post, March 2004.
[2] পুতিন যুদ্ধশুরুর আগে ভাষণে বলেছে, “ইউক্রেন শুধু একটি প্রতিবেশী দেশ না। ইউক্রেন আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
[3] Address by the President of the Russian Federation. The Kremlin, Moscow. 21st February, 2022.
[4] রাশিয়ার অভ্যন্তরে, মস্কোয় যুদ্ধবিরোধী মিছিল হচ্ছে। গ্যারি কাসপারভ, ইয়ান নেপোমনিয়াশি, আব্দ্রেই এপিসেঙ্কোর মতো দাবাড়ুরা যুদ্ধবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ইউক্রেন আক্রমণের পক্ষে। আনাতোলি কারপভ, সেত্তগেই কারিয়াকিনের মতো দাবাড়ুরা আক্রমণের পক্ষে সায় দিয়েছে।
[5] পুতিনের ভাষণ। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২।
[6] তদেব।
[7] Vladimir Putin accuses Lenin of placing a ‘time bomb’ under Russia. The Guardian. 25 January, 2016.
[8] Lipman, Masha. Why Putin won’t Be Marking the Hundredth anniversary Of The Bolshevik Revolution. The New Yorker. November 3, 2017.

 

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২