Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাজ্য শাসক দলের সঙ্কট— গণতন্ত্রেরও নাভিশ্বাস

অশোক মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও মানবাধিকার কর্মী, সেস্টাস-এর সম্পাদক

 

 

 

 

বখরা নিয়ে ঝগড়াতে ভাই করব না দলবাজি!
বুলেট বোমা অগ্নিজারণ— সব কিছুতেই রাজি!!

পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, পতনশ্রী প্রকল্প এল বলে! চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান বিরোধীরা করেনি, করতে পারেনি। বামফ্রন্ট, বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সিপিআই (এম) দলই সেই অবসানের শুরুয়াতি কাজটা সেরে রেখেছিল। বিরোধী শক্তি, মূলত টিএমসি, আর কিছু ছোট বাম দল ও গ্রুপ তাতে হাত লাগিয়ে নাটকের শেষ দৃশ্যের সম্পাদনা করেছিল।

গত এগারো বছরে মমতা ব্যানার্জির শাসনকালের মেয়াদও পাঁচে পাঁচে বাড়ছে বলে মনে হচ্ছিল। একটা য-ফলা কোত্থেকে যেন ঢুকে পড়েছে। এখন যেটা বাড়ছে সেটা প্যাঁচে।

রাজনীতিতে অনেককালই সন্ন্যাস ধর্মের অভাব অনুভূত হচ্ছিল। সর্বস্ব দেওয়ার বদলে দেশসেবা এক সময় সামান্য দিয়ে যেটুকু করা যায় সেইদিকে গড়াল। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু হল, কিছুই না দিয়ে অনেক কিছু পাওয়ার রাজনীতি। তাতে স্বভাবতই ইংরেজি ‘পাওয়ার’-ও যুক্ত হতে থাকল। উপরকাঠামোয় ইংরেজি ‘পাওয়ার’ ভিতের স্তরে বাংলা পাওয়ার সুবিধা জোগান দিতে শুরু করল।

বামফ্রন্ট জমানায় ভিত আর উপরকাঠামো একেবারে ধ্রুপদী শিক্ষানুযায়ী এগোতে রইল। ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের ভিত পাকাপোক্ত হবে এ আর বেশি কথা কী? তবে সব কিছুর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা ছিল, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ছিল, উপর থেকে তলা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। মাত্রা বেঁধে দেওয়া ছিল। একটা অটোও পাঁচ মিনিট আগে বা পরে ছাড়তে পারত না।

সিদ্ধার্থশঙ্কর জমানায় রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়া মমতা ব্যানার্জির ধাত একেবারেই অন্যরকম (এই হাতেখড়ির কৃতিত্ব অবশ্য কমরেড প্রভাস ঘোষ ২০০৮ সালে জোট করার সময় ভুল করে তাঁর দলের হাতেই কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন!)। বিগত শতাব্দের উপান্তে উপবাসী কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে মমতার হাত শক্ত করেছিলেন তাঁরাই যাঁরা বামফ্রন্টের জমানায় রাজকীয় সুখের ইচ্ছানুযায়ী প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত বোধ করছিলেন। সেই বঞ্চনা বোধই তাঁর নতুন দলকে সেদিন বিজেপি-র নতুন বিছানো আঙিনায় বিচরণে প্ররোচনা যুগিয়েছিল। কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়া, রাজ্যে ক্রমবর্ধমান ভিআইপি হওয়া— এগুলো অঙ্কের হিসাবে নেহাত ফেলনা নয়। হিন্দি কবিতায় একেই বলা হয়েছে, “ছোটি ছোটি জল কে বুঁদে সাগর কি ভর দেতি হ্যাঁয়।” আজ কুঁয়ো আর পুকুর। লেগে থাকলে কাল পেতে পারবে আস্ত এক একখানা সাগর।

শৃঙ্খলার বদলে এখানে পাবেন নেত্রীবন্দনার শৃঙ্খল। রাস্তার ধারের একটা নলকূপের ভাঙা হাতলও সারাই হয় না তাঁর অনুপ্রেরণা না পেলে। বইমেলায় কবিতার সম্মেলন করতে হলেও সেই অনুপ্রেরণার ছিটে চাই। গণতন্ত্রহীন কেন্দ্রিকতা অবশ্যই আছে। সেই কেন্দ্রিকতায় পুজো দিয়ে কে কত পাবেন, তা মাত্রাহীন! টিল সিবিআই কাম্‌স।

সংসদীয় রাজনীতির একটা মজা আছে। সংসদে বা বিধানসভায় বিরোধীদের কমিয়ে দিলে বা শূন্য করে দিলে, শাসকের মনে হতে থাকে, আমরাই সব, আমাদেরই সব। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো ভদ্রলোকও এই রোগাভাস থেকে রেহাই পাননি। আর টিএমসি-র রাজনীতির মধ্যে আবার এই রোগাভাসেরই নিশ্চিন্ত সংবর্তন। বামপন্থীদের বিধানসভায় শূন্য করে দিয়েছি। ব্যস, ময়দান খোলা। বিজেপি একটা ক্রম-উদীয়মান ফ্যাক্টর বটে। তবে, কেন্দ্র আর রাজ্যের ক্ষমতার ভাগাভাগিতে রাজি করাতে পারলে তোমরা ওদিকে খাও, আমরা এদিকে— এরকম একটা অলিখিত বা নিরুচ্চার শির-সঙ্কেত পাঠানো কি একান্তই অসম্ভব? বোধহয় নয়। গণমাধ্যমগুলি প্রচারের বেলুনে যাই দেখাক, একটা সময় হেলিকপ্টার থেকে মাঠে নামতেই হয়। তখন শাহ, নাড্ডা, মোদিরা অনুভব করতে সক্ষম হন, তাঁদের সঙ্গে আনা তিনশোর চাইতে মাঠে জমে আসা সাইঁত্রিশ বেশ কম দেখায়! লোকসভা বিধানসভা থেকে কমতে কমতে পুরসভায় বিজেপিও এখন শূন্য। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিন অঙ্কের সংখ্যায় পৌঁছাতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

সুতরাং পুকুর থেকে সাগর এখন খোলা এবং অবাধ। আর এতেই গোল বাধছে।

অবিভক্ত আমলে পূর্ব বাংলায় এরকম গল্প শোনা যেত, নেমন্তন্নবাড়িতে যত খুশি খেয়ে আমন্ত্রিত অতিথির মৃত্যু ঘটেছে। কিংবা আরও সরেস: দুই ভাই দুপুরে দাওয়াত খেতে গিয়ে একজন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এল দেরি করে। তাও, খালের জলে চিৎসাঁতারে ভেসে ভেসে। বাবা জানতে চাইল, “তর দাদায় গ্যাল কই?” ভাই উত্তর দিল, “সাঁকোয় আটকাইয়া গ্যাসে! জল নামলে আইয়া পড়ব!!”

এরকম ভোজনেই ফুলে ফেঁপে উঠছে ভাদু শেখ আনারুল প্রমুখ। কিন্তু ভৌতবিজ্ঞানের পদার্থের ভরের মতোই অর্থশাস্ত্রেও সম্পদের পরিমাণের একটা নিত্যতা সূত্র আছে, মোট পরিমাণের সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটা নিয়ম আছে। সরকারি অর্থের আপনি যত অপচয়ই ঘটাতে চান না কেন, তারও সীমা আছে। মোট পরিমাণ যদি পঁয়ত্রিশ টাকা হয়, একজনই যদি বত্রিশ টাকা খেয়ে ফেলে, অন্য সতেরো জনকে তিন টাকার ভাগ নিয়েই খুশি হতে হয়। আসলে তখন তারা দুঃখ বোধ করে।

পৌনঃপুনিক অখুশি থেকে অসন্তোষের জন্ম হয়। অসন্তোষ এক সময় পরিণত হয় রাগে। এই সবই ঘটে কিন্তু স্বাভাবিক মানবমনের বুনিয়াদি নিয়মে। আর কে না জানে, রাগকে আমাদের প্রাচীন সনাতন শাস্ত্র ছয় রিপুর মধ্যে খুব খারাপ রিপু হিসাবে বর্ণনা করেছে। রাগ হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান নাকি লুপ্ত হয়। সত্যিই তাই। ভাদু শেখকে মেরে দিলে যে তিন টাকার হিতেও টান পড়বে, এটা তখন আর খেয়াল থাকে না। আবার ভাদুর লোকেরাও যে আমাদের মেরে দিতে পারে, সে কথাটাও মনে থাকে না। তুমি যদি টিএমসি হয়ে টিএমসির একজনকে মারতে পার, তাহলে নিহত টিএমসি-র দলবলও ঘাতক টিএমসি-র দলবলকে মেরে ফেলতে পারে। হিন্দি সিনেমায় এইসব এতবার দেখেও যদি মানুষের শিক্ষা না হয়, তাহলে কী আর করা যাবে!

বর্ধমানে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল অসম্মানের ভয়ে, সেই তুহিনা শেখ ছিল টিএমসি-র সক্রিয় সমর্থক পরিবারেরই কন্যা। যারা তাদের তিন বোনকে অসম্মান করবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল, এমনকি বাড়ির বাইরের দেওয়ালে তিন বোনের রূপক ছবি এঁকে ধর্ষণ ও হত্যা করে গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেবে বলে শাসিয়েছিল, তারাও তৃণমূল দলের টিকিটে জেতা পুরসভার কাউন্সিলার এবং তার শাগরেদপুঞ্জ।

মহেশতলায় যে ইঞ্জিনিয়ারকে তৃণমূল অফিসে তুলে নিয়ে গিয়ে তোলাবাজির অপ্রাপ্তির রাগে পেটানো হল, আর যারা পেটাল— সকলেই নীল সাদা ছবির অনুপ্রেরণার আওতাভুক্ত বলে জানা গেছে।

মালদায় যিনি বলছেন, আমের ব্যবসা করে “বড় বাড়ি” করে ফেলায় লোকের নজর পড়েছে, তিনি যদি পঞ্চায়েতের টিএমসি সদস্য না হতেন, তাহলে সমস্যা কম ছিল। কিন্তু আসলে সেই সুদৃশ্য সুবিশাল প্রাসাদের পেছনে যে (একের পিঠে কম পক্ষে আটটা শূন্য বসিয়ে) মূলধন লাগে আজকের বাজারে, সেটা ফজলি আম বেচে যে আসে না, আমআদমি মাত্রই তা বোঝে। এই ধন এল কোত্থেকে, বাংলা আর ইংরাজি পাওয়ার সমীকরণ থেকেই বোঝা যায়।

আর এই পাওয়া না-পাওয়ার সমস্যা থেকে সমীকরণে যেখানে ফাটল ধরছে, সেখানেই মূলোমূলি সংঘর্ষ বেধে যাচ্ছে।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা গিয়াসুদ্দিনের এত সাহস হল কী করে? সারা দিন ধরে দাপাদাপি করে গেলই বা কীভাবে? একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠন হলে ডেপুটেশন বা ধর্নার কর্মসুচিতে পনেরো মিনিট পর্যন্ত বসতে দেওয়া হয় না, পুলিশ এসে তুলে দেয় এবং ধরে নিয়ে যায়। টিএমসিপি বলেই তো হুল্লোরবাজি করতে পেরেছিল। এই কথা এখন অস্বীকার কী করে করা যাবে?

নদীয়ার হাঁসখালিতে দেখা গেল, এক তৃণমূল সমর্থক বাড়ির নাবালিকাকে আর এক তৃণমূল নেতার ছেলের দলবলই ধর্ষণ করে ভোর রাতে বাড়ির দরজায় ফেলে দিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে, পুলিশে যেন অভিযোগ না যায়। মেয়েটি মরে গেলে তারাই এসে মৃত্যুর ডাক্তারি নথি ছাড়াই, পুলিশি ময়না তদন্ত ছাড়াই— হাথরাসের যোগী কায়দায়— এক অব্যবহার্য শ্মশানে নিয়ে গিয়ে মৃতার লাশ দাহ করে আসছে।

এখন দিদি বলছেন, তাঁর নাকি “ফেস লস” হচ্ছে! পুলিশ তাদের কাজ করছে না বলে পুলিশমন্ত্রীর মুখে …. পড়ছে!

যদি এখনও বে-আইনি না হয়ে থাকে, তবে দেড় মিনিট হাহা হাহা হাহা করে অট্টহাসি হেসে নিই!!!!

আপনি যখন হাঁসখালির ধর্ষিতার সি-ভি নিয়ে বাণী দিচ্ছিলেন, আপনি কি ভেবেছেন, আপনার ফেস লস হয়নি? আপনি যে বামফ্রন্টের শাসনকালে কোথাও কোনও ধর্ষণকাণ্ড ঘটলে ছুটে যেতেন— সাংবাদিকবাহিনি সহ— আর ধর্ষিতার পাশে কিংবা তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে আগুন আগুন বাক্য উচ্চারণ করতেন, আর এখন ধর্ষণের কাণ্ড ঘটলেই ধর্ষিতার চরিত্রকে আপনার আক্রমণের লক্ষ্য করে ফেলেন, ওতে ফেস ফর্সা থাকে নাকি? ওতেও ডাবল ফেস লস হচ্ছে। সেদিন না বুঝলেও এখন রাজ্যবাসী বুঝতে পারছে, আপনার সেদিনের দৌড়ঝাঁপ কোনও মানবিক সহানুভূতি এবং রাজনৈতিক কর্তব্যবোধের তাড়না ছিল না, ছিল রাজনৈতিক ফসল তোলার ভোটমুখো কৌশল। আর তারপর মসনদে বসার সঙ্গে সঙ্গে সেই কৌশলের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

এখন বাঁচাতে হবে।

কাকে? ধর্ষিতাকে? তার পরিবারকে?

আরে না। দলের সহকর্মীদের। যতক্ষণ পারা যায়। তারাই ধর্ষণকারীদের মূল পুঙ্গব কিনা কে জানে! শাসকদলের সদস্য না হলে এইসব অপকর্ম করে আজকের দিনে পার পাওয়া মুশকিল। পুলিশও প্রথমেই সম্ভাব্য আসামির বায়োডাটা দেখে নেয়। তারপর তাদের ধরার অথবা ধরতে না পারার ভূমিকায় নামে। সেভাবে মামলা সাজায়। মুখ্যমন্ত্রীর মর্জিমাফিক কেস সাজাতে না চাইলে দময়ন্তী সেনের মতো বদলির কেস ঘটে। মনে আছে ম্যা’ম? বেশ অনেকদিন হয়ে গেল। সেই থেকেই আপনার ফেস লস হয়ে চলেছে।

হ্যাঁ, আমরা জানি, আপনি যখন বুঝতে পারেন, ধর্ষকদের বাঁচানো যাবে না, চটিতে কাদা এবং শাড়িতে দাগ লাগবে, আপনি পুলিশের উপর থেকে দড়িটা খানিক আলগা করে দেন। ধর্ষকরা ধরা পড়ে। বিচার হয়, সাজা হয়। কিন্তু প্রথম সাতদিন আপনার প্রতিক্রিয়াটা অমন হয় কেন? আমরা সেটারই সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে চাইছি।

বগটুইয়ের ঘটনার পর আমার একটা লেখায় আমি বলেছিলাম:

“আনারুল কেন পুলিশ পাঠায়নি”— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সফরকালে এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন খুঁজে পাননি। ফলত রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের বহু-নিধন কাণ্ডে স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ স্বরে তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে করেই হোক, যেখান থেকেই হোক, আনারুলকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর আদেশ বীরভূম পুলিশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। দুঘন্টার মধ্যেই তাকে পুলিশ খুঁজে পেয়েছে এবং গারদে পুরেছে।

আসলে সেদিন আরও দু-একটা প্রশ্ন ম্যাডামের করা দরকার ছিল, যথা, “আনারুল না বললে পুলিশ খবর পেয়েও নিজে থেকেই কেন ঘটনাস্থলে ছুটে যায়নি”, “পুলিশ সেদিনই কেন আনারুলকে গ্রেপ্তার করেনি”, ইত্যাদি। আর এই সব প্রশ্নেরই উত্তর সেদিন হয়তো অজানা ছিল রাজ্যমুখ্যের কাছে। আমাদের কাছেও। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার মতো অবস্থায় রাজ্য থাকলে তো প্রতি-ভাদু দহন কাণ্ড হত কিনা সন্দেহ! এমনকি ভাদু শেখও হয়তো কেয়ামতের ময়দানে না থেকে এখন কোনও জেলে ফরাস পেতে বিড়ি ফুঁকতেন!

যাই হোক, সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর আমরা পেয়ে গেলাম গতকাল। ম্যাডাম পেলেন কিনা সময় বলবে। আজ অবধি যে পাননি সেই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।

কীভাবে?

নিখিল ভারত তৃণমূল কংগ্রেস দলের বীরভূম জেলা সদর দপ্তরে জেলাশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারকে ডেকে এনে অনুব্রত মণ্ডলের বৈঠকের মনোরম নয়ননন্দন দৃশ্যটি অবলোকন করে।

এই ঘটনার কি কোনও নিন্দা বা সমালোচনা দিদি করেছেন?

না। এই লেখায় হাত দেওয়ার সময় পর্যন্ত দেননি। তাহলে তিনি আশা করেন কী করে, পুলিশ প্রশাসন স্বাধীনভাবে কাজ করবে? রং না দেখে অপরাধীদের ধরবে? ধরলে যদি কেষ্টদা বকে দেন তখন কী হবে?

পুলিশকে রাজ্য সরকার কীভাবে ব্যবহার করছে সেটা এই সুযোগে দেখে নেওয়া যাক।

কিছুদিন যাবত দেখা যাচ্ছে, টিএমসি আর বিজেপি ছাড়া কোনও দল বা সংগঠনকেই প্রায় পুলিশ কলকাতার বুকে বা অন্যান্য জেলায় মিটিং মিছিল প্রতিবাদসভা কিছুই করতে দিচ্ছে না, করতে গেলেই ডিএম অ্যাক্ট লাগিয়ে দিচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাঠিচার্জ ইত্যাদিও করে যাচ্ছে, ডিএম আইনের সুবাদে কমপক্ষে দশদিনের জেল হাজত আদায় করে নিচ্ছে। এই তৎপরতা পুলিশের কোত্থেকে জন্মাল? বহরমপুরে যে অনশন মঞ্চে আন্দোলনকারীদের বসতেই দেওয়া হল না— এসব কার নির্দেশে? সরকারি তরফে কি গোপনে এরকম ফরমান জারি করা হয়েছে? হয়ে থাকলে সেটা পাবলিকের এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির জানা থাকা দরকার। তখন তারা এই রাজ্যে তাদের কোনও মুদ্দাতে মিটিং মিছিল ধর্না করার কোথাও কোনও গণতান্ত্রিক অধিকার বিদ্যমান নেই— জেনেই কর্মসূচি নেবে, কিংবা নেবে না।

আর যদি রাজ্যের উপরমহলের তরফে এরকম নির্দেশনামা না থাকে, তাহলে পুলিশের এই অতিসক্রিয়তাকে সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে পরিষ্কার জানাতে হবে, স্বীকৃত সর্বমান্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের কোনও কর্মসূচিকে বানচাল করা চলবে না। আয়োজকরা টিএমসি বা বিজেপি-র না হলেও। সেই কাজটি করেছেন নাকি ম্যা’ম?

এই যে মাসখানেক আগে নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ কামালগাজিতে পথসভা করার সময় একদল যুবককে গ্রেপ্তার করল, সভা করতেই দিল না, ধৃত আন্দোলনকারীদের থানায় নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটাল, এবং পরেরদিন বারুইপুর আদালতে তোলার সময় তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, এগুলোর প্রত্যেকটাই দেশের এবং রাজ্যের ঘোষিত আইনের ভয়ঙ্কর বিরোধী। কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়াটা সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশিকার সরাসরি লঙ্ঘন এবং বেপরোয়া আদালত অবমাননা। রাষ্ট্রক্ষমতার কোনও একটা পর্যায়ের পশ্চাদ-মদতে রাজ্য পুলিশের ভাবখানা হচ্ছে, ওরকম আইন অনেক থাকে, আমরা মানছি না, কে কী করবে! রাজ্য পুলিশ এই মনোভাব কোথায় পেল, যদি না তাদের জানা থাকে যে বামপন্থী আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে যে কোনও আইন ভাঙলে রাজ্য সরকার এবং সরকারি দল খুশি হবে! কোনও পুলিশকর্মীর এতটকু অসুবিধায় পড়তে হবে না।

রাজ্য সরকার যে এইসব ঘটনা জেনেও পুলিশকে তাদের এই সব বে-আইনি অসভ্য কাজের জন্য এযাবত কোনও তিরস্কার করেনি, তারই একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ছিল আনিস হত্যাকাণ্ড। এক জেলার পুলিশ যদি দুপুর বারোটায় বামপন্থী কর্মীদের নিশ্চিন্তে কোমরে দড়ি পরাতে পারে, তাহলে অন্য জেলার পুলিশ রাত বারোটায় কারও বাড়িতে বিনা ওয়ারেন্টে বিনা সাক্ষী ঢুকে পড়তে পারে। ছাদে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতেও পারে। নির্যাতনের শিকার ছাদ থেকে পড়ে গেলে জলের ভাঙা পাইপও আবিষ্কার করতে অসুবিধা নেই। আবার এক জায়গার ভাঙা পাইপই আর এক জায়গায় টিভি বার্স্টের গল্পরূপ ধারণ করে। আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এই ধরনের ঘটনাসকল এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।

দিন ফুরিয়ে এলেই নাকি এরকম ঘটতে থাকে। স্কুলে নিয়োগের পরীক্ষা হচ্ছে না। যেটুকু নিয়োগ হচ্ছে ভয়ঙ্কর দুর্নীতিতে ভরা। মামলা না হলে এবং হাইকোর্ট থেকে রক্ষাকবচ না পেলে এই সব দুর্নীতির ঢাকনা খুলত নাকি দিদিভাই? তদন্তের নির্দেশ এলেই ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে স্টে নিতে হচ্ছে কেন? মাত্র কটা বছরে কী অবস্থা করে ফেলেছেন প্রশাসনের?

গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনুন। পুলিশকে গণতান্ত্রিক শাসনবিধি মেনে কাজ করতে বলুন। সমস্ত গণসংগঠনকে কাজ করতে দিন। বিরোধী সমালোচনা থেকে রাজ্যের বাস্তব ছবি দেখতে শিখুন। সংসদীয় মঞ্চে বামপন্থীরা আজ শূন্য হয়ে গেছে বলে মনে হলেও পশ্চিমবঙ্গে তারা মাটির কাছে এখনও অসংখ্য, অদম্য এবং সজীব। অসংসদীয় বামপন্থীদের একাংশের আদর্শগত সংগ্রামের জীবনপণ প্রচেষ্টাতেই প্রতাপান্বিত বিজেপি-র আগ্রাসন পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় আটকে দেওয়া গেছে। বিজেপি-কে যারা ঠেকাতে পারে, তারা আপনার স্বৈরশাসনকে রুখতে পারবে না ভেবে বসে থাকলে আপনি ভুল করবেন।

গণতন্ত্রে আপনার দল ফিরে এলে সেই দিনটা পেছোতেও পারে। নইলে গণতন্ত্র তার ফিরে আসার অন্য রাস্তা খুঁজে নেবেই। ফরাক্কায় গঙ্গানদীর বাঁধ পালানো পাড় ভাঙার মতো করে। বামপন্থীদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে উঠতে কটা দিন সময় লাগবে। তাদের এখনও রাজনীতির জটিল আবর্তের অনেক দুরূহ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং খুঁজে পাওয়া বাকি। দিল্লিতে জাহাঙ্গিরপুরীর ঘটনায় যে সঙ্কেত মিলেছে, সেটাই যে আগামী দিনে আরও বড় হয়ে দেখা দেবে না, কে বলতে পারে? সিপিআই (এম) যে বিজেপি-কে ডেকে এনে টিএমসি শাসন উৎখাতের রণকৌশল থেকে সরে আসছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই যে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ এক অঙ্কের-এর দিকে দ্রুত ধাবমান, এগুলোও লক্ষণ যে বামপন্থীরা অচিরেই সঠিক রণকৌশল খুঁজে নেবে। অনেক ভুল করতে করতেই।