Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অশ্রুগঙ্গা

ডঃ মানিক শইকিয়া

 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ— বাসুদেব দাস

১৯৬০ সনে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার এবং কবি ডঃ মানিক শইকিয়ার জন্ম হয়। জগন্নাথ বরুয়া কলেজ থেকে অসমিয়া ভাষার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অসম সাহিত্যসভার সহকারী সম্পাদক (২০০৭-২০০৯), এবং সদৌ অসম কবি সম্মেলনের সভাপতি (২০১৩-২০১৫) ছিলেন। ‘পিতামহর শরশয্যা’ একমাত্র উপন্যাস। সম্প্রতি প্রকাশিত গল্প সঙ্কলন ‘সাক্ষী হ’বা সরযু’। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলন রয়েছে।

 

বিয়ের আগে একদিন যখন, বিস্তীর্ণ বনভূমির মধ্যে তোমার সঙ্গে একা দেখা হয়েছিল— সেই নীরব অপরাহ্নে তোমাকে আমার হৃদয় এবং শরীরের কাছে টেনে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম— সেদিনই তুমি প্রথম এবং শেষবারের জন্য অবতারণা করেছিলে আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের প্রসঙ্গ।

সঙ্গে সঙ্গে আমার শারীরিক উন্মাদনা শান্ত হয়ে এসেছিল; তীব্র ক্রোধে মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম মানসিক স্থিতি। তোমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম বলে তুমিও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলে, আমার শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের কথা। সেদিন, সেই মুহূর্তে তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম— বীথিকা, আমার জীবনের সর্বস্ব তোমাকে অর্পণ করব, আমার জীবনের কোনও কথাই তোমার অজানা থাকবে না, কেবল, কেবল এই আঙুলটার বিষয়ে  আমাকে একবারও  জিজ্ঞেস কোরো না। কোনওদিনই জিজ্ঞেস কোরো না। কখনও কোনওভাবে একথা উত্থাপন করলেই আমি আর আমি হয়ে থাকব না। কারণ, এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই আমার ভেতরে একটা দৈত্যদানবের জন্ম হয়ে একদিক থেকে সমস্ত কিছু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে  চায়। সেই সময় আমার খুব ভয় হয় বীথিকা, তোমার কথাও ভুলে যাব বলে মনে হয়। কিন্তু তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে তো আমাকেও ভুলে যাওয়া। সেইজন্যই তোমার কাছে আমার এই অনুরোধ। আশা করি চিরদিন মনে রাখবে।

আর তারপরে তোমার সান্নিধ্যের জন্য উন্মুখ আমার যুবক শরীরের সমস্ত উন্মাদনা ক্রমে ক্রমে স্তিমিত হয়ে এসেছিল। আমার আরক্ত-রক্তিম দুই চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তুমি খুলে ফেলা বল্কলরাজি পুনরায় পরতে শুরু করেছিলে। তোমার যুবতী শরীরের অপরূপ অঙ্গশোভা আমাকে আর তখন আকর্ষণ করতে পারছিল না। আমি যেন সত্যি সত্যিই একটি আলাদা মানুষ হয়ে পড়েছিলাম। আর আমরা— বহু যুগের পুরনো দুটি প্রস্তরমূর্তির মতো সেই বিস্তীর্ণ অরণ্যের মধ্যে অনেকক্ষণ একসঙ্গে বসে ছিলাম। ……

মৌন-মূক-নিথর হয়ে বসে থাকা সেই সময়টুকুতে আমার তোমার জন্য বড় দুঃখ হয়েছিল জানো, বীথিকা। তুমি যে কত আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলে। কতদিনের অন্তহীন অপেক্ষার পরে যে, আমরা সেই সময়টুকু নিজের করে পেয়েছিলাম। সেদিন তোমার কোমল মনে দুঃখ দেওয়ার জন্য আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।

তারপরে বহু দিন মাস বছর মহাকাল নিজের বুকে গ্রাস করে নিয়েছে।

আমরা যুগ্ম জীবন আরম্ভ করলাম। তুমি আমার ঔরসজাত সন্তান গর্ভে ধারণ করলে। ওদের জন্ম দিলে। লালনপালন করে বড় করলে।

এক পরিপূর্ণ গৃহস্থালির মধ্যে সময় দ্রুতগতিতে পার হয়ে যেতে লাগল।…….

আমি ভেবেছিলাম— বিয়ের পরে বহুদিন পর্যন্ত— বিশেষ করে আহার গ্রহণের সময় তুমি সতৃষ্ণ নয়নে আমার হাতের দিকে চেয়ে থাকতে। বুড়ো আঙুলটা না থাকার জন্য আমার অসুবিধার কথা লক্ষ‍ করে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে চাইত। এইসব সময়ে, আমি জানি বীথিকা, কিছুদিন কোনও না কোনও একটি অজুহাত দেখিয়ে আমার কাছ থেকে তুমি দূরে সরে গিয়েছিলে। আমি জানি, ভালো করেই জানি, তুমি সরে গিয়ে, গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে ফেলতে চাইছিলে। কিন্তু কী করবে বীথিকা, চোখের জলের ধর্মই যে সেরকমের, একবার মুছে ফেলার পরেও পুনরায় গড়িয়ে পড়তে চায়, অথচ, আমার কথা রাখতে গিয়েই তুমি কখনও এই বিষয়ে কোনও কথার অবতারণা করোনি। আমি জানি আমার প্রতি থাকা ভালোবাসার জন্যই, তোমার মনের মধ্যে মুহুর্মুহু বিরক্ত করতে থাকা এই মানসিক যন্ত্রণা চিরদিন বহন করেছ।

আমি দুঃখ পাব— এই কথা ভেবেই তুমি এতদিন এই মানসিক যন্ত্রণা তিল তিল করে সহ্য করেছ।

সত্যিই বীথিকা তোমাকে নিয়ে আমি সুখী। তোমার মতো, স্বামীর মন বুঝে আচরণ করা স্ত্রী কত জন্মের ভাগ্যে পাওয়া যায়।……

তুমি কখনও, মধ্যরাতের অন্ধকারে, আমার দুটি হাত তোমার সুন্দর সুগোল স্তন দুটি পেষণের সময় আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলের অভাব অনুভব করেছিলে কি বীথিকা?

আমি জানি এই কথা তুমি আমাকে বলতে পারো না। কিন্তু, তথাপি; এই মুহূর্তে আমার এইসব কথাই মনে পড়ছে। হয়তো কথাগুলি তোমাকে বলতে চাইছি বলেই এই ধরনের ভাবগুলি আমাকে বেশি বিরক্ত করছে। কারণ, জীবনের অন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বাদেই একান্ত নিজের মুহূর্তগুলিতেও আমার এই বিকলাঙ্গতা তোমার মতো সরল, তোমার মতো নির্দোষ একজন মানুষকে কীভাবে তিল তিল করে অশান্তি দিয়েছিল আমার জানতে ইচ্ছে করে। কারণ তখনই আমি কথাগুলি বলতে পারব। তখনই ভবিষ্যৎ ভারতের জনতার জন্য আমার মনের এই অশান্তিজ্বালানো ক্ষোভের অগ্নিশিখা অনির্বাপিত করে রেখে দিতে পারব। সেইজন্যই, কেবল সেইজন্যই সমস্ত কথাগুলি তোমাকে বলে যেতে চাইছি। কারণ প্রথমে তোমাকে কথাগুলি বুঝতে হবে। তারপরে অন্যেরা বুঝতে না পাওয়া কথাগুলি আসবে। তাই বীথিকা এতদিন একান্ত নিজের করে অন্তরের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মর্মদাহী দুঃখের ভাগ তোমাকে দিতে চাইছি। আমি জানি, তুমি সহ্য করতে পারবে না। তথাপি ভবিষ্যৎ ভারতের মহাজনতাকে প্রকৃত কথাগুলি জানিয়ে যাওয়ার স্বার্থে তোমাকে ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।

আজ তুমি জানতে পারবে আমার জীবনের অলিখিত ইতিহাসের এক সকরুণ অধ্যায়ের কথা।

আজ পর্যন্ত আমি ছাড়া আর কাউকে বহন করতে হয়নি সেই নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের স্মৃতি।

তোমাকে দিতে চাইছিলাম না অসহনীয় দুঃখের সেই দুর্বহ বোঝা।

তুমি যে আমার বড় আদরের। সেইজন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা না করার জন্য একপ্রকার নির্দেশই জারি করেছিলাম।

এতদিন পরে, এই মুহূর্তে কথাগুলি সবাইকে জানানোর অন্য একটি কারণ আছে বীথিকা।

আমি শুনতে পেয়েছি, মহামুনি ব্যাসদেব নাকি আমাদের যুগের একটি ইতিহাস রচনা করছেন। মহাভারত নামের সেই ইতিহাসে তিনি এই কাহিনির তাৎপর্য পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।

 

দুই.

তোমার প্রকৃত নামটাই বীথিকা বলে কেউ কেউ ভাবতে পারে। কিন্তু সেই নামটা যে আমি তোমাকে আদর করে দিয়েছি— সেটা কেবল তুমি আর আমি জানি।

নামটা মনে আসার দিন ঘটা ঘটনাটা আজও আমার মনে আছে। জনপদের কাছে তটিনী থেকে জল আহরণের জন্য যাওয়ার সময় তোমাকে একদল বাঁদর একসঙ্গে ঘিরে ধরেছিল। তুমি হাত পা আছড়ে চিৎকার করছিলে; আর একটা সময়ে পাশে থাকা বন-বীথিকার মধ্যে ঢুকে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিলে। তবু বাঁদরের দল তোমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। খ্যাকখ্যাক করে, ভয় দেখিয়ে তোমার অসহায় অবস্থাটা উপলব্ধি করে বেশ মজা পাচ্ছিল।

ঠিক তখনই, কোথা থেকে যেন আমি এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। আর তুমি এক দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে। তোমার কম্পমান যুবতী শরীর আমার দেহের সঙ্গে লেপটে ছিল। আমি যতই তোমাকে নির্ভয় দিয়ে তোমাকে আমার শরীর থেকে সরাতে চেয়েছিলাম— ততটাই জোরে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে। তোমার যুবতী দেহের উন্মনা সুবাস আমার গালে-মুখে লাগছিল।…….

অবশ্য আমাকে খুব একটা কিছু করতে হয়নি। হয়তো আমার হাতের  ধনু এবং পিঠে ঝুলিয়ে রাখা শরভর্তি তূণ দেখেই ওরা পরের পরিস্থিতিকে অনুমান করতে পেরেছিল। তাই বাঁদরের দল পশ্চাদপসরণ করেছিল।

কিন্তু সেদিন আমার বড় হাসি পেয়েছিল জান। অরণ্যানীতে পরিবেষ্টিত জনপদে বাস করেও তুমি যে বাঁদরের স্বভাব বিষয়ে কিছুই জানো না সে কথা ভেবে আমার হাসি পেয়েছিল। আসলে অপকার না করা পর্যন্ত বাঁদর কাউকে আক্রমণ করে না। অবশ্য, আনন্দিত মনে থাকলে কোনও দুর্বল প্রাণীকে আক্রমণের অভিনয় করে আমোদ লাভ করে। তুমি তাকেই প্রকৃত আক্রমণের প্রস্তুতি বলে ভয় পেয়েছিলে।

সে যাই হোক না, বাঁদরদের পশ্চাদপসরণের অনেক পরে আমি আমাকে তোমার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম। আর তারপর তোমার দিকে চাইতেই, তুমি কেবল নখ দিয়ে মাটিতে লিখছিলে। শরীরে নামমাত্র আব্রুর কথাও চিন্তা না করে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকা সময়টুকুর কথা মনে করে তুমি বোধহয় সেদিন খুব সঙ্কোচ বোধ করছিলে। সেই যে, বনবীথিকার মাঝখান থেকে দৌড়ে এসে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে, ক্রমে ক্রমে আমার জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়লে— সেইজন্যই তোমার নাম দিয়েছিলাম বীথিকা। অন্তত তোমার নামটা উচ্চারণ করলেই প্রথম দর্শনের সেই স্বর্ণাভ মধ্যাহ্নের স্মৃতি আমার মনে পড়ে যাবে।…

সেই স্মৃতি যে আমি কখনও ভুলতে চাই না।……

 

তিন.

আমাদের জনপদের প্রত্যেকেই যে অরণ্যবাসী তথা অরণ্যজীবী ছিল সে কথাটা তোমাকে আর  বুঝিয়ে বলতে হবে না। অরণ্যমাতৃর কোলে লালিতপালিত হয়ে সেই মাতার কৃপাধন্য হয়ে আমরা প্রত্যেকেই জীবনযাপন করতাম। অরণ্যের ফল-মূল, পশুপাখি আমাদের খাদ্যের অভাব পূরণ করত। অরণ্যের খড়ি কাঠ, ইকরা দিয়ে আমরা আমাদের বাসস্থান তৈরি করেছিলাম। অরণ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার জলে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলাম।

অরণ্যমাতার সন্তান হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই এক একটি সমাজে বসবাস করতাম। আমাদের মধ্যে কোনও বিভেদ কিংবা আক্রোশের অবকাশই সৃষ্টি হয়নি। কে বড়, কে ছোট, কে উঁচু, কে নিচু সেকথা অরণ্যমাতার কোনও সন্তানই ভাবতে শেখেনি। এভাবেই আরম্ভ হয়েছিল আমাদের শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবন। এভাবেই পার করেছিলাম জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।

তোমাকে নিশ্চয় না বললেও হবে যে, আমার পিতা হিরণ্যধনু আমাদের গোষ্ঠীপতি ছিলেন। তথাপি, গোষ্ঠীপতির পুত্র হিসেবে আমি কোনও ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার লাভ  করিনি, চাইওনি।

অন্যদিকে আমাদের গোষ্ঠীটা ছিল পাশের হস্তিনাপুরের দ্বারা আশ্রিত এবং প্রতিপালিত। সেইজন্যই পিতার সঙ্গে কখনও গিয়ে দেখেছিলাম, কখনও পিতার মুখ থেকে শুনেছিলাম অস্ত্রবিদ্যার গুরু দ্রোণাচার্যের অসীম দক্ষতার কথা। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভের এক অবারিত, দুরন্ত বাসনা মনের মধ্যে পোষণ করেছিলাম।

আর একদিন গিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিলাম।

সেদিন, আমার অভিলাষের কথা জানতে পেরেই আচার্য কড়াভাবে শুনিয়ে দিয়েছিলেন— রাজকুমার এবং ব্রাহ্মণসন্তান ছাড়া তিনি কোনও অস্পৃশ্য এবং ম্লেচ্ছজাতির সন্তানকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন না।

তুমি বিশ্বাস করবে বীথিকা, প্রথম অবস্থায় আমি তার কথাগুলি কিছুই বুঝতে পারিনি।

শিক্ষালাভের ক্ষেত্রেও যে উচ্চ-নিচের, স্পৃশ‍্য- অস্পৃশ্যের কথা থাকে সেকথা উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা আমি লাভ করিনি।

মানুষের মধ্যেও যে কাউকে স্পর্শ করা যেতে পারে, কাউকে স্পর্শ করা যায় না— এই ধরনের কথা কিছু রয়েছে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।

অবশ্য কথাগুলি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে না পারলেও দ্রোণাচার্য যে আমাকে শিক্ষাদান করবেন না সেকথা তাঁর মুখভঙ্গি লক্ষ করেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এবং আচার্যকে দণ্ডবৎ প্রণাম করে আমি চলে এসেছিলাম।

আর তারপরে, অরণ্যের কাছে একটা পর্ণকুটির নির্মাণ করে গুরু দ্রোণাচার্যের একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে নিয়ে সেই মূর্তিকে প্রণাম জানিয়ে সামনের বিস্তৃত প্রান্তরে একাগ্র মনে ধনুর্বিদ্যার অনুশীলন আরম্ভ করে দিয়েছিলাম।

একসময় আমার একাগ্ৰ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে, স্বকীয় প্রচেষ্টাতেই আমি ধনুর্বিদ্যার প্রতিটি কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ করার বহুদিন পরে জানতে পেরেছিলাম, আমার ধনুর্বিদ্যায় দক্ষতার কথা শুনে হস্তিনার রাজা এবং রাজপুরুষেরা খুবই  শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সেই শঙ্কা কেবল আমার ধনুর্বিদ্যার মহিমার  জন্য নয়, শঙ্কা হয়েছিল ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণরা সম্মিলিত হয়ে চালিয়ে থাকা শাসনব্যবস্থার জন্য। এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে গিয়ে দলিত এবং শূদ্রদের যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সে কথা কারও অজানা ছিল না। তারই ফলশ্রুতিতে শূদ্র এবং বৈশ্যদের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্রোধ এবং ক্ষোভ ক্রমাগতভাবে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।

বিস্ফোরণশীল এই ক্রোধের স্তূপে যদি আমি অগ্নিসংযোগ করি…

যদি নেতৃত্ব দিই দলিতদের এক বিদ্রোহের…

অন্যদিকে, ছোট হলেও আমি একজন গোষ্ঠীপতির পুত্র। তাই আমার কিছু যে সুবিধা নেই তাও নয়। যদি আমার বিদ্রোহে ভেসে যায় সমগ্র জম্বুদ্বীপের বনভূমি, জনপদ, গ্রাম গ্রামান্তর…

হস্তিনার সৈন্যবাহিনি পারবে কি বাধা দিতে সেই বিদ্রোহকে?

অন্যদিকে সেই রাজকীয় সৈন‍্যদলও যে গড়ে তোলা হয়েছে আমার মতো অরণ্যবাসী অথবা গ্রাম-গ্রামান্তরের জনতার সন্তান-সন্ততিদের সহযোগিতায়। যদি রাজকীয় সৈন্যদল অরাজি হয় নিজেদেরই স্বজাতি স্বজনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে? রাজসভার অমাত্যবর্গের কাছে এটাও অজানা ছিল না যে, অরণ্যের আশেপাশে বসবাস করা বাকি যুবকরাও আমার মতো ধনুর্বিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ। হয়তো আমার মতো নয়, কিন্তু দক্ষ।

প্রাপ‍্য অধিকারের জন্য কোনওভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে, এইসব অগণিত মানুষকে বেতনভোগী রাজকীয় সৈন্য দমন করতে পারবে কি?

এরকম এক সন্দেহের জন্যই রচিত হয়েছিল এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। ক্রীড়নক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল আচার্য দ্রোণকে। তিনি অপত্তি করেছিলেন।

কিন্তু রাজ-অন্নে প্রতিপালিত আচার্যের আপত্তি টিঁকল না। অবশ্য আচার্য বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ করেননি।

আর এই ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতেই গুরুদক্ষিণার কাহিনির অবতারণা। একটি সম্ভাব্য ‘বিদ্রোহ’কে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলা হবে অথচ ‘বিদ্রোহী’রা সেকথা অনুমান করতেও পারবে না— তার জন্যই গুরুদক্ষিণার কাহিনির সৃষ্টি।

যে দ্রোণাচার্য নিষাদপুত্র বলে আমাকে নিচ বলে, অস্ত্রশিক্ষা দান করবেন না বলে চরম অপমান করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, সেই দ্রোণাচার্য, পরবর্তীকালে একদিন, অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর করে রাখার উদ্দেশ্যে, মনের মধ্যে কূট সঙ্কল্প নিয়ে শিষ্যসমন্বিত ত্রস্ত-ব্যস্ত-সতর্ক অনেক অলেখ অরণ্যজীবী, অগণন প্রাচীন বৃক্ষ-তরু-তৃণ-লতা-গুল্মের মধ্যে দিয়ে এসে আমার সাধনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ শিষ্যদের মধ্যে ভীম, অর্জুন, দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি কয়েকজনের নাম আমি আগেই শুনতে পেয়েছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আমি দ্রোণকে প্রণাম করেছিলাম এবং কুটিরের ভেতরে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কুটিরের অভ্যন্তরে আমার নিজের তৈরি করে নেওয়া আচার্যের মূর্তিটা দেখে তাঁরা যেন অভীষ্ট সিদ্ধির আভাস দেখতে পেলেন।

কিছুক্ষণ পরে, সেই নীরব অপরাহ্নের আকাশ বাতাস উদ্বেলিত করে গুরু দ্রোণ নির্লজ্জভাবে আমার কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা দাবি করেছিলেন।

–হে বীর, তুমি যদি সত্যিই আমাকে গুরু বলে মেনে থাকো, তাহলে গুরুদক্ষিণা প্রদান করো।
–মহাশয়, অস্ত্রশিক্ষাদানের জন্য আপনার কাছে গিয়ে অনুরোধ করায় যদিও আপনি আমাকে নিষাদ বলে, অস্পৃশ‍্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদিও আপনি প্রত্যক্ষভাবে আমাকে কিছুই শেখাননি, তথাপি আপনার মূর্তিকে গুরু মেনে আমি অস্ত্রশিক্ষা করে চলেছি— সেইজন্য প্রকারান্তরে আপনিই আমার গুরু। তাই আপনি যখন নিজে এসে গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন— বলুন কী দিয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট করব?
–তাহলে তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ছেদন করে আমার চরণে অর্পণ করো।
–এ যে একেবারে অসম্ভব কথা গুরুদেব। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের অবর্তমানে আমি কীভাবে শরযোজনা করব; কীভাবে অস্ত্রচালনা করব? অস্ত্রচালনা তো দূরের কথা এই অরণ্যভূমির মধ্যে হিংস্র বন্য জীবজন্তু ইত্যাদি থেকে কীভাবে আত্মরক্ষা করব। আমাকে এভাবে ঘোর বিপদে ফেলবেন না মহাশয়।
–আমি সেসব কিছুই জানি না। আমার ইচ্ছাপূরণ না-করা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে যখন, এই দান না পাওয়া পর্যন্ত আমি ফিরে যাব না। তুমি তো জানোই ব্রহ্মবাক‍্য অলঙ্ঘনীয়। প্রয়োজন হলে বলপূর্বক আমার দক্ষিণা আদায় করব।
–গুরুদেব, আমি কিছুই জানি না, নিষাদের ছেলে। অরণ‍্যই আমার জীবন। নাগরিক জীবনের ছলনা বঞ্চনা কিছুই বুঝতে পারি না। তথাপি মনে প্রশ্ন জাগে, আপনি কি সত্যি অর্থেই গুরুদক্ষিণা হিসেবে আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা দাবি করছেন? নাকি তার অন্তরালে অন্য কিছু উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে?
–সে কথা তোমার বিচার্য নয়। অতি শীঘ্র দক্ষিণা দিয়ে তুমি আমাকে বিদায় দাও।
–যদি আপনার অন্যায় ইচ্ছা পূরণ না করি?
–বলপূর্বক আদায় করে নেব।

আমি আড়চোখে লক্ষ করলাম ইতিমধ্যেই ভীম দূঃশাসন আদি প্রস্তুত হয়েছে। ভীমসেন গদা, অর্জুন ধনু তুলে নিয়েছে। দুঃশাসনও তৈরি হয়ে রইল। সেই সময়ে কেবল দুর্যোধনকে কিছুটা বিমূঢ় যেন দেখা গিয়েছিল।

–আর শোনো। আমাদের প্রস্তাবে যদি রাজি না হও, একটি অসমান যুদ্ধ হবে। তুমি এবং তোমার সঙ্গীদের বিনা কারণে মৃত্যুবরণ করতে হবে। নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর এত মনোরম জনপদ নিমেষের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। তোমার পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকেই যমের অতিথি হবে। আমার মনে হয় তাদের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই তোমার আমাদের প্রস্তাবে রাজি হওয়া উচিত।

আমি রাজি হয়েছিলাম। এবং নির্ভীক নিষ্কম্প চিত্তে দক্ষিণ হস্ত গুরুর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাম।

এখন আমার ভালোভাবে মনে নেই, তাদের মধ্যে কেউ একজন তীক্ষ্ণ তরবারি বের করে আমার বুড়ো আঙুল ছেদন করেছিল।

যন্ত্রণায় আমার চোখের জল বের হয়নি। এক অক্ষম ক্রোধে থাকতে না পারার সময় কেউ একজন কাছের বনৌষধি দিয়ে বুড়ো আঙুলটা বেঁধে দিয়েছিল।

কুটিরের প্রাঙ্গণে বেরিয়ে এসে আচার্য ঘোষণা করেছিল, আমি নাকি স্বইচ্ছায় বুড়ো আঙুলটা কেটে গুরুদক্ষিণা হিসেবে অর্পণ করেছি। আমার মতো দানী শিষ্য তিনি নাকি কখনও দেখেননি।

তিনি ঘোষণা করলেন— সাধু, একলব্য, সাধু।

 

চার.

আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেকে গড়িয়ে পড়া তপ্ত রক্তে যখন সুশ্যামল বনভূমি রক্তিম হয়ে পড়েছিল, সেই সময় পিতা হিরণ্যধনুর আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠেছিল সেই অপরাহ্নের আকাশ বাতাস…

এক হীন বংশে জন্মলাভ করার জন্যই নিজপুত্রের আজ এহেন  দুর্গতি দেখে যেন অক্ষম আক্রোশে গর্জন করে উঠেছিলেন নিষাদরাজ হিরণ্যধনু।

আর আমার সঙ্গীরা।

দলিত বলে, নিষ্পেষিত বলে পদে পদে পেতে থাকা অপমানের জন্যই হয়তো তারা মুখ খুলে কোনও কথার প্রতিবাদ করতেই শিখেনি। আর করলেই বা, যতই যুক্তিপূর্ণ হোক না কেন, ওদের কথার যে কোনও মূল্য দেওয়া হবে না, সে কথা তো ওরা ভালো করেই জানে।

সেইজন্যই হয়তো, ক্ষোভে, বেদনায়, ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলেও ওদের মুখ থেকে একটিও কথা বের হয়নি। কিন্তু কৃষ্ণকায় শরীরের সেই সমস্ত যুবকের ছলছলে চোখের মণিতে যেন ঝলসে উঠেছিল আচার্যের প্রতি থাকা চরমতম ঘৃণা।

এক বন‍্য আক্রোশে যেন ফেটে পড়তে চাইছিল প্রত্যেকেই।

ওদের মৌন ঠোঁটের অলেখ-অযুত প্রশ্নের উত্তর তখন আচার্যের কাছে ছিল না।

সেইসময়, বল্কল-পরিহিত, কৃষ্ণবর্ণ নিষাদ যুবকবৃন্দের তেজস্বী চোখগুলির দিকে মাথা তুলে তাকানোর মতো, ওদের নীরব ভর্ৎসনার মুখোমুখি হওয়ার মতো আচার্যের সাহস ছিল না। বাইরে অবিচলিত যেন দেখিয়ে, ভেতরে ভেতরে চরম গ্লানি এবং অপরিমেয় অন্তর্দ্বন্দ্বের বোঝা বুকে বেঁধে আচার্য সদলবলে প্রস্থান করেছিলেন।

আমার এই স্বেচ্ছাপ্রদত্ত স্বীকারোক্তি হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবে না। না করলে নেই। কিন্তু আমি জানি, তুমি অন্তত আমাকে অবিশ্বাস করবে না বীথিকা। তাছাড়া আমি আশা করি অনেক যুগের পরে হয়তো এই পৃথিবীর কোনও প্রান্তরের কোনও মানুষ হয়তো উপলব্ধি করবে— হ্যাঁ হ্যাঁ কথাগুলি এভাবেও ভাবা যেতে পারে। যদি তাই হয়, সেটাই হবে আমার কাছে চরম এবং পরম প্রাপ্তি; তার চেয়ে বেশি কিছু আমার আর চাই না।

অথচ, সেইসময় প্রকৃত কথাগুলি আমি কাউকে বলতে পারছিলাম না।

এখন গ্রামে জনপদে প্রত্যেকেই জানে, আমি, হ‍্যাঁ আমি একলব্য, স্বেচ্ছায় আমি আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল গুরুর চরণে দক্ষিণা হিসেবে অর্পণ করেছি।

গুরু আমাকে ম্লেচ্ছ বলে, নিষাদপুত্র বলে, অস্পৃশ‍্য জ্ঞান করে অস্ত্রশিক্ষা দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেছিলেন, সেই গুরুর অবর্তমানে একাগ্র অনুশীলনের দ্বারা আয়ত্ত করা ধনুর্বিদ্যার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ডান হাতের বুড়ো আঙুল প্রদান করে চিরদিনের জন্য বিকলঙ্গ হতে আমার কী এত গরজ পড়েছিল বীথিকা…….

সেই দক্ষিণা স্বেচ্ছাপ্রদত্ত দক্ষিণা নয়; বলপূর্বক আদায় করা দক্ষিণা।

কিন্তু সেদিন সেকথা আমি কাউকে বলতে পারিনি।

বলতে গেলে প্রত্যেককেই লাফিয়ে উঠত। আর ভীম-অর্জুন-দুর্যোধন-দুঃশাসন-অশ্বত্থামা ইত্যাদি কুরুবীরদের হাতে প্রত্যেকেরই মৃত্যু ঘটত। সেজন্যই সে কথা আজ পর্যন্ত কারও কাছে প্রকাশ করিনি। পিতা হিরণ্যধনু, বন্ধুবর্গ, আত্মীয়কুটুম্ব প্রত্যেকেই আমার ত্যাগের জন্য গৌরবান্বিত হয়ে থাকুক…

সেইজন্যই তোমাকেও বলতে পারিনি বীথিকা।

আমার জীবনের এই অসহনীয় দুঃখের বোঝা তোমার উপরে চাপিয়ে দিতে চাইনি।

অন্তত তুমি শান্তিতে থাকো সেই আশায়। তোমার কোমল অন্তরে নেভাতে না পারা আগুন যেন জ্বলতে না থাকে— সেই কামনায়।

তার জন্য আমার যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে— পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো বীথিকা। আজ আমি প্রকাশ করলাম এতদিন বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো গভীর দুঃখের কাহিনি।

কারণ সমগ্র জম্বুদ্বীপের মহাজনতাকে জানতে হবে, শুধু দ্রোণের কথা শুনেই ধনুর্বিদ্যার জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা কেটে দিতে পারার মতো নির্বোধ আমি ছিলাম না।

অথচ আমি জেনেশুনেই দ্রোণের কপট মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছিলাম।

কারণ সেই সময় গুরুর ইচ্ছার বিরোধিতা করতে পারার সুবিধা আমার ছিল না। সেইজন্য আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম— গুরুর ইচ্ছা পূরণ করা হবে আর তার মাধ্যমে কপট গুরুর অন্যায় কাজের প্রতিবাদও করা হবে।

আজকেও আমি ভাবি, বর্ণবাদী ভারতের নিকৃষ্টতম সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করতেই হবে।

আমার সুবিধা ছিল না, আমি একা ছিলাম, সেইজন্য আমার প্রতিবাদের ধরন হয়তো কিছুটা আলাদা হল। সেইজন্যই ব্যাসদেব পৃথক এক তাৎপর্যে এই কাহিনি লিখবেন, আমার গুরুভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করে ঘটনাটা পৃথক ধরনে সাজিয়ে ফেলবেন— সেকথা কদাপি মেনে নেওয়া যায় না।

তাই কথাগুলি বলতে হল।

অন্তত ভবিষ্যৎ ভারতের মহাজনতাদের জানতে হবে একলব্য এক হীন ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেলে দলিত নিষ্পেষিতরা সম্মিলিতভাবে এক বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। এরকম আশঙ্কা করেই তৈরি করা হয়েছিল নিষাদপুত্রের এই ‘গুরুভক্তির কাহিনি’।

ভবিষ্যৎ ভারতের জনতাকে জানতে হবে, একলব্য গুরু দ্রোণের শিক্ষার মাধ্যমে নয়, একাগ্র সাধনার মধ্যে দিয়ে ধনুর্বিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেছিল।

আমার জীবন এবং কর্মের মাধ্যমে আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, প্রতিভা সাধনারই অন্য এক নাম। একান্ত চিত্তে করা সাধনাই প্রতিভাকে দ্বিগুণ প্রজ্বলিত করে। আর এই প্রতিভা সাধনা কিংবা প্রতিষ্ঠার জন্য তথাকথিত উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। তার জন্য প্রাথমিক শর্ত হল, ঐকান্তিক মানসিক স্থৈর্য এবং একাগ্র সাধনা।

দুঃখের কথা যে, এসবের একটাকেও আমি কার্যকরীভাবে দেখিয়ে যেতে পারলাম না।

আজ এতদিন হৃদয়ের মৌন ভাষায় সে কথা বারবার বলে এসেছি— তুমি আর যেই হও না কেন, গুরু হতে পারো না।

নিকৃষ্টতম পক্ষপাতিত্বে কোনও ষড়যন্ত্র রচনা করে কোনও প্রকৃত গুরু কি পুত্রতুল্য শিষ‍্যের থেকে এভাবে চরম মূল্য আদায় করে নেয়?…….

ডান হাতের বুড়ো আঙুলের তপ্ত রক্তে আমি গুরু দ্রোণাচার্যের জন্য মহাভারতের পাতায় অনাদিকালের জন্য খোদিত করে রেখে যেতে চেয়েছিলাম সেই চিরন্তন ধিক্কারবাণী—

তুমি গুরুর মতো মহান অথবা উদার হওয়া তো দূরের কথা, মানুষই হতে পারলে না….