Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তারান্তিনো, সিজন দুই — একুশ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ভর বিকেলে গঙ্গার ধারে রামলীলা হচ্ছে। রোহিতাশ্ব এর মধ্যে বেশ কয়েকবার গঙ্গার ধারে এসেছে। প্রতিবারই সন্ধের দিকে। দেখেছে, ঘাটের রাস্তা ধরে হাঁটার পথে মাঝেমধ্যেই এমন অদৃশ্য ও অলীক রামলীলা দেখা যায়, মনে হয় যেন উনিশ শতকের বাবুয়ানির উচ্ছিষ্টদের ছায়ারা ভিড় করে রয়েছে। আজ ছায়া নয়, সশরীরে ডোমদের ভিড় করে রামলীলা করতে দেখছে সে।

রোহিতাশ্বর মাথার ভেতর অনেককিছুই কাজ করছিল। সে জানে, যা তাকে করতে বলছে আদিনাথ, তা সে নিজে না করে সাহেবের মতো ওদের বংশের এই প্রজন্মের একটা ছেলে করলে কাজটা অনেক সোজা হবে। তাছাড়া ওদের বংশের পুরনো পাপের একটা প্রায়শ্চিত্তও হয়। অজগরের পেট থেকে কাফ্রি বালক ওমান হিরেটা লুঠ করেছিল বটে, কিন্তু লুঠ করা হলেও ওই হিরে দিনের শেষে তারই তো সম্পত্তি। ডাকাত সাহেব, কলকাতার সেকালের হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা সেই হিরে কীভাবে লুঠ করে তুলে দিয়েছিল ইন্দ্রকমল সিংহের পূর্বপুরুষের হাতে, সেই ইতিহাস এখন কেউই জানে না। কিন্তু একথা জানে রোহিতাশ্ব, ইন্দ্রকমলের লালসা মেটাতে সেই হিরে হাতবদল হয়ে গিয়েছিল আদিনাথের পূর্বপুরুষ রমাকান্তর কাছে। কিন্তু জেমসন সাহেবের সৌজন্যে রমাকান্তর জমিদারির প্রজা মোহনের কাছে সেই আংটি ফিরে গেল বটে, কিন্তু ছলেবলে মোহনের বংশধরদের ওই আংটির বশেই দাস করে রাখল রায়েরা। এই অভাবনীয় অন্যায়ের ইতিহাস তো আদিনাথ বলেছে রোহিতাশ্বকে। রায়বাড়ির মেয়ে রমার প্রেমে পড়েছিল খগেন। তাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল, সঙ্গে ছিল আংটিটা। তার জন্য চোর অপবাদ পেতে হয়েছিল খগেনকে! ভাবা যায়! কে কাকে চোর বলে! কিন্তু নকশাল আদিনাথ পর্যন্ত এর বিহিত করল না, উলটে ব্যবহার করল ওদের এই সামন্ততান্ত্রিক পাপকে!

ইতিহাসের গতিপথটা ভেবে সত্যিই আশ্চর্য লাগছিল রোহিতাশ্বর।

সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছিল ততক্ষণে।

এবার রোহিতাশ্বর আড়চোখ গেল একটা গাড়ির দিকে।

গাড়িটা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে দুটো অস্পষ্ট লোক। সম্ভবত রিফারে গাঁজা টানছে।

বিপ্লব-প্রচেষ্টায় অংশ নিয়ে রোহিতাশ্বর জীবনের অন্য কোনও উত্তরণ হোক বা না হোক, ওর ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছে সাংঘাতিক। বিশেষত, পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একটা অভ্যেস হয়েছে ওর, কেউ নজর রাখলে রোহিতাশ্বর তা টের পেতে অসুবিধে হয় না। আর সেদিন আদিনাথদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও যখন আবিষ্কার করল, ওর পিছু নেওয়া হচ্ছে, তখন থেকেই ও আরও বেশি সজাগ।

–আপনি… কি…

গলাটা পেয়ে রোহিতাশ্ব ফিরল।

চমকে ওঠার মতো চেহারা।

আদিনাথের কিশোরবেলার ছবি দেখেনি রোহিতাশ্ব, জানে, দেখলে এমনটাই দেখত, বাড়ির নিয়ম মেনে হয়তো ধুতি-পাঞ্জাবি পরত তখন আদিনাথদা, এ পড়েছে একটা টি শার্টের ওপর হুডি ও একটি থ্রি কোয়ার্টার।

এক্ষুনি একে সঙ্গে করে নিয়ে এখান থেকে চলে গেলে লোকদুটোও পিছু নেবে। ওদের বোকা বানানোর একটাই রাস্তা, আংটিটা ওর কাছে আছে না নেই, তা ওদের বুঝতে না দেওয়া।

কিন্তু ওরা জানল কী করে, যে আজ এখানে আসবে রোহিতাশ্ব? খবর পেল কোত্থেকে?

ওর ওপর কি কেউ নজর রাখছে?

গাড়ির ভেতর বসে নজর রাখতে রাখতে রাইটু আর ভগা ভাবছিল অন্য কথা।

আজ ওদের একটা অন্য অপারেশন আছে।

এভাবে বসে বসে নজর রাখা, অর্ডার না পেয়ে হাত গুটিয়ে— এমনটাতে ওরা অভ্যস্ত নয়। এই মালটা কে? কেন এর ওপর হঠাৎ নজর রাখতে বলল বস? কে জানে! মালটাকে সাইজ করতে হবে বললেও কথা ছিল! কিন্তু স্রেফ বসে বসে দেখে যাওয়া!

যে ছেলেটা কথা বলতে এল মালটার সঙ্গে, তাকে চেনা চেনা লাগল ভগার। কোথায় বেশ দেখেছে? জন্টির জিমে কি?

রোহিতাশ্বর সামনে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল সপ্তর্ষির। বয়স্ক লোক বলে মনেই হচ্ছে না, এরকম তরতাজা আর ইয়ং ওর কজন বন্ধুকে লাগে, তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। এই লোকটা জেঠুর বন্ধু! জেঠুর ব্যাপারে যা শুনেছে, তাতে এমন তারুণ্যে ঠাসা একটা লোক কী করে জেঠুর বন্ধু হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় জাগছে ওর‌। এবং এই কৌতূহল থেকেই প্রশ্নটা করে ফেলল ও।

–আপনার বয়স কত?

একটু হাসল রোহিতাশ্ব।

–তোমার জেঠুর চেয়ে আমার বয়স বেশ কিছুটা কম।
–আমি কী বলে ডাকতে পারি আপনাকে?
–আমাদের সময় আমরা দাদা বলেই ডাকতাম কমবেশি সকলকে। নো ম্যাটার হোয়াট দ্য এজ ইজ! তুমিও তাই বলতে পারো।

সপ্তর্ষি একটু দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, রোহিতাশ্বদা বলি?

রোহিতাশ্ব একটু হেসে বলল, বলতে পারো।

কিন্তু রোহিতাশ্বর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হল। সে জানে, বেশ কিছুক্ষণ একথা-সেকথা সপ্তর্ষির সঙ্গে হালকা চালে বললে ওই লোকগুলো একটু অলস হয়ে পড়বে, আর তখনই সপ্তর্ষিকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে রোহিতাশ্ব।

সে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতে লাগল, কতক্ষণে একটু হাল ছাড়ে লোকগুলো।

ওদিকে ভগা আর রাইটু ততক্ষণে অল্প জয়েন্টের নেশায় দুলছে। রাইটুর চোখ প্রায় নিভু নিভু। হাতে মেশিন তোলার সময় এলে ওর চোখ আবার সিধে হয়ে যাবে, জানে ভগা। ভগা কিন্তু একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছিল লোকটার হালচাল। কত বয়স লোকটার? পঞ্চাশ-ষাট হবে। কিন্তু কী কেত লোকটার!

ওরা এসব ভাবতে ভাবতেই রোহিতাশ্ব হঠাৎ সপ্তর্ষিকে বলে বসল, চলো একটু হাঁটি।

রোহিতাশ্বর মতলব খুব পরিষ্কার। ওরা পিছু নেয় কি না দেখা।

ভগা সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাইটু ওর হাতটা ধরে আটকাল। বলল, আগে বসকে জানাই, দাঁড়া।

শুধু শুধু এই লোকটার পিছু নেওয়ার মতো একটা বোরিং কাজ করতে ভালো লাগছিল না রাইটুরও।

ফোন বাজছে।

ওপার থেকে গলা।

–কী হল?

গলাটা হাড়হিম করা যেন, শুনলেই বোঝা যায়, এই গলার আওয়াজেই খুন হয়ে যেতে পারে মানুষ।

রাইটু লোকটার গতিবিধি বর্ণনা করে বলল,

–একটা ছোকরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটা লাগাল। কোনও লোচা মনে হল না।
–লোচা কি লোচা নয়, তা বোঝার জন্য তোকে ভাড়া করিনি। ফলো করতে বলেছিলাম। আর ছেলেটা কে?

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল বেগুনিবাবু।

–কে জানে! এপাড়ায় দেখিনি ছেলেটাকে।
–আমি দেখেছি।

বলে উঠল ভগা।

–কোথায়?

ঘড়ঘড়ে গলায় বলল রাইটু।

–কী বলছে ভগা?

ওপার থেকে বলল বেগুনিবাবু।

–বলছে ওই হাফব্যাটারি মালটাকে ও চেনে!
–দে দেখি ওকে!

ফোনটা রাইটু দিল ভগাকে।

–কে ছেলেটা?
–মনে হচ্ছে, জন্টির জিমে যায়।
–খোঁজ লাগা। মনে হলে আমার চলবে না।

ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল বেগুনিবাবু।

–আর বস, আজকের অপারেশনটা?
–নামিয়ে দিস।

ভগার মুখে একচিলতে হাসি দেখা দিল। অ্যাকশন আছে তার মানে আজ!

–লিঙ্কিন পার্ক? সপ্তর্ষি আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল। সে ভাবেইনি, এই বয়সের একটা লোক এতরকমের রক মিউজিক শুনতে পারে!

চায়ের দোকানটা ওদের আগের জায়গার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। রোহিতাশ্ব নজর রেখে চলেছে, ওই গাড়িটা আসছে কি না।

–হুমম। তবে অতটা ভাল লাগে না।

চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুক দিয়ে ভাঁড়টা ফেলতে ফেলতে বলল রোহিতাশ্ব।

সপ্তর্ষি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। এইটুকু সময়ে বেশ জমে গেছে ওদের আড্ডা।

কিন্তু ওকে থামতেই হল।

একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল এক লহমায়।

একটা সাঁই শব্দ।

রোহিতাশ্বর মাথা ঘেঁষে একটা ডার্ট সজোরে বেরিয়ে এসে গেঁথে গেল চায়ের দোকানের দেওয়ালে।

রোহিতাশ্ব তার সহজাত রিফ্লেক্সে মাথাটা একচুল সরিয়ে নিয়েছিল। নইলে ওটা তার খুলিতে গেঁথে যেত।

বিস্ময় আর আতঙ্কে সপ্তর্ষি বোঝার চেষ্টা করছিল পরিস্থিতিটা।

চায়ের দোকানের বাকিরাও বুঝভম্বুল হয়ে তাকিয়ে।

রোহিতাশ্ব দেখল দূরে, গাড়িটা আসছে না। আশপাশে তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ‌

সবচেয়ে যেটা অবাক করছে ওকে, ডার্টটা এসেছে গঙ্গার দিক থেকে ধেয়ে।

গঙ্গায় বিভিন্ন দিকগামী দু-একটা স্টিমার, দূরে একটা সাবমেরিন, আর কয়েকটা জেলে নৌকো।

তারপর কী ভেবে সপ্তর্ষির হাত ধরে বিদ্যুৎগতিতে ‘চলো’ বলে উলটোমুখে হাঁটতে লাগল রোহিতাশ্ব। হতভম্ব দোকানি টাকাটা চাইতেও গেল ভুলে।

দূরে ভিড় স্টিমারে লোকটার হাত থেকে ডার্টটা বেরোল কী করে, তা কেউ দেখতে পায়নি। এতটাই অদৃশ্য আর ক্ষিপ্রগতি লোকটার হাতের। লক্ষ‍্যভেদ সত্যিই করতে চাইলে এতক্ষণে রোহিতাশ্বর খুলিতে ফুটো হয়ে যেত।

কালো চশমা আর কালো পোশাকে মোড়া লোকটার চোখের দৃষ্টিতেই যেন বাইনোকুলার। সেই বাইনোকুলারে পরিষ্কার দেখল লোকটা, সপ্তর্ষিকে সঙ্গে নিয়ে রোহিতাশ্বর মোটরসাইকেল ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল‌।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]