প্রবীর মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা রাজদ্রোহ এক বিরাট অপরাধ বলে গণ্য করা হত। এই অপরাধের শাস্তি আগের আমলে হত রাজার ইচ্ছানুসারে— হয় প্রাণদণ্ড, নয় নির্বাসন। এখন রাজা বড় একটা নেই। সবদেশেই এখন যে কোনও অপরাধেরই শাস্তিবিধান হয় সেই দেশের প্রচলিত দণ্ডসংহিতা বা পেনাল কোড মেনে। এমন কী যে দু-একজন রাজা টিঁকে আছেন তাদেরও দেশের আইন মেনে চলতে হয়, যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার নেই। এখন দেশের প্রকৃত শাসনক্ষমতায় যারা আসীন তারা বরাবর ঐ আসনে থাকবেন এমন কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। কিছুদিন বাদে বাদে জনমতের ভিত্তিতে দেশের শাসনক্ষমতায় কে থাকবেন অর্থাৎ সরকার কারা চালাবেন সেটা স্থির করা হয়। স্বভাবতই বিভিন্ন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে অন্যদের মতবিরোধিতা থাকতেই পারে। আর সেই বিরোধিতা প্রকাশ করার বিভিন্ন আইনগ্রাহ্য পন্থা দেশের দণ্ডসংহিতায় লিখিত থাকে।
ইংরাজিতে যাকে ‘সিডিশন’ বা বিদ্রোহপূর্ণ আচরণ বা বিদ্রোহ [Samsad English Bengali Dictionary] বলে সেই ধরনের অপরাধের কী শাস্তিবিধান হতে পারে সেটা লেখা আছে ভারতের দণ্ডসংহিতা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি)-র ১২৪এ ধারায়। এই ধারায় বলা হচ্ছে কোনও ব্যক্তি যদি কথ্য বা লিখিত ভাষার মাধ্যমে, বা কোনও চিহ্নের মাধ্যমে অথবা দেখা যায় এমন কোনও মাধ্যমের সাহায্যে বা অন্য কোনও প্রকারে আইনসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা অথবা অবজ্ঞা সৃষ্টি করে বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে অথবা আইনসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করতে অন্যকে প্ররোচিত করে বা প্ররোচিত করার চেষ্টা করে তাহলে সেই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর এই অপরাধের শাস্তি আর্থিক জরিমানা সহ তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। এই ধারার প্রথম ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে ‘অসন্তোষ সৃষ্টি’ বলতে ‘আনুগত্যহীনতা’ এবং ‘ঘৃণাসৃষ্টির সব ধরনের অনুভব’-ও এর মধ্যে যুক্ত থাকবে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় অবশ্য আইনানুগ পথে সরকারি কাজকর্মের সমালোচনা ও প্রতিকার দাবী করাকে এই ধারার বাইরে রাখা হয়েছে। তৃতীয় ব্যাখ্যাতেও বলা হয়েছে যে সরকারি কাজকর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি অন্যকে উত্তেজিত না করা হয় তাহলেও এই আইন সেখানে প্রযুক্ত হবে না।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-র আধিকারভুক্ত ভারতীয় এলাকার জন্য থমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৭৩ সালে এক খসড়া ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (ড্রাফট পেনাল কোড) প্রস্তুত করেন। সেখানে ১১৩ নম্বর ধারায় ‘সিডিশন’-কে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় আর এর জন্য শাস্তিবিধানের ব্যবস্থার কথা লেখা থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ড্রাফটের অন্য অধিকাংশ ধারা আইনের অন্তর্ভূক্ত করা হলেও এই ধারাটি এবং ‘সিডিশন’ প্রসঙ্গ প্রায় কুড়ি বছর ধরে পেনাল কোডের অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। সেই সময়ের ব্রিটিশ সরকারের আইন বিভাগের সেক্রেটারি, যিনি আবার ১৮৭২ সালের ইন্ডিয়া এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর মূল রচয়িতা, সেই স্যার জেমস ফিৎজেমস স্টিফেন বলছেন যে ‘ব্যাখ্যাতীত ভ্রম’ (‘unaccountable mistake’)-এর কারণে এই ধারাটি তখন বাদ পড়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে ভারতে ‘সিডিশন’ বা বিদ্রোহাত্মক ধারণা প্রধানত স্থানীয় সংবাদ ও সাংস্কৃতিক মাধ্যম যেমন খবরের কাগজ ও নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছিল। সেইজন্য আরও কঠোর নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন ও ছাপাখানা (প্রিন্টিং প্রেস) নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করা হয়। সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা এধরনের কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করলে শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা পেনাল কোডের ১২১ ও ১২১-এ ধারায় ইতিমধ্যেই ছিল। কিন্তু ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, ওয়াহাবি বা ফিরৌজি আন্দোলন ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনের ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকমহল বুঝতে পারে যে ‘সিডিশন’ নিয়ন্ত্রণে এক ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন আইন প্রয়োজন। আর সেই কারণে ভারতীয় পেনাল কোডে ১২৪-এ ধারা সংযোজিত হয় ১৮৭০ সালের ২৫ নভেম্বর। এটি প্রধানত ইংল্যান্ডের ‘Treason Felony Act’ অনুসারে রচিত। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ তারিখে এই ধারাটি সংশোধন করে “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা” এবং “রাষ্ট্রবিরোধী যুদ্ধে সহায়তা প্রদান” এই দুটি বিষয়কেও ‘সিডিশন’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
R. Palande সম্পাদিত বোম্বাই সরকার প্রকাশিত Source Material for A History of the Freedom Movement in India (Collected from Bombay Government Records), Volume I, 1881-1885 এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আকরগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে সঙ্কলিত বিভিন্ন সরকারি দলিল থেকে সিডিশন প্রসঙ্গে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত সরকারের মনোভাব খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন, এই সরকারি দলিলটি:
Measures for the suppression of the dissemination of sedition and of the promotion of illwill between classes.
Nos. 1269-1279.
Government of India,
Home Department, Public:
Simla. 3rd June 1907.
Resolution.“(…) and he (Governor General in Council) is unable to tolerate the publication of writings which tend to arouse the disorderly elements of society and to incite them to concerted action against the Government (…) Accordingly, in supression of previous orders on the subject, His Eixcellency in Council empowers local Governments to institute prosecutions in consultation with their legal advisers in all cases where the law has been wilfully infringed…
(Signed) H. D. Risley,
Secretary to the Government of India.
আইপিসি-তে এই ১২৪-এ ধারা অন্তর্ভূক্তির প্রধান কারণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র বিরোধিতাকে যাতে কঠোরভাবে দমন করা যায়। এই ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করা বা জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। লোকমান্য তিলক, মহাত্মা গান্ধি, প্রায় সব নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী এই ধারার অধীনে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তি পেয়েছেন। “নাগরিকের স্বাধীনতাকে অবদমিত করে রাখার যত আইন ভারতের দণ্ডসংহিতার রাজনৈতিক ধারাগুলিতে আছে তাদের মধ্যে এই ধারাটি যেন রাজপুত্র” বলেছিলেন গান্ধিজি।
আইপিসি-র অন্য ধারাগুলির তুলনায় এই ১২৪-এ ধারাটি বিশেষ কঠোর। এই ধারার অপরাধ আদালতের বিষয়ীভূত (বিচারযোগ্য) [cognisable], জামিনযোগ্য নয় [non-bailable] এবং অন্য অপরাধের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় না [non-compoundable] এমন এক অপরাধ। কেবলমাত্র ফৌজদারি আদালতেই এর বিচার হয়। এই ধারার অপরাধের প্রকৃত চরিত্র নির্ধারণ বিশেষ বিষয়কেন্দ্রিক [subjective]। সেই কারণে পীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা এর সুযোগ খুব সহজেই নিতে পারে। এই আইনের সাহায্যে বাক্-স্বাধীনতা ও অন্যান্য মৌলিক স্বাধীনতার সংবিধানস্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘন করা শাসকের পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে।
পেনাল কোডের ১২৪-এ ধারার ‘সিডিশন’ যে দমনমূলক এক ব্যবস্থা এ প্রশ্নে আমাদের সংবিধান সভা [Constituent Assembly]-র সদস্যদের মধ্যে কোনও ভিন্নমত ছিল না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কোনও কারণেই বেঁধে রাখার সুযোগ তারা দিতে চাননি। সেই কারণে খুব সচেতনভাবে এবং বিস্তারিত আলোচনার পরেই খসড়া সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদ থেকে ‘সিডিশন’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
কিন্তু আইপিসি-র ১২৪-এ ধারা ১৯৪৭-এর পরবর্তী সময়েও চালু থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে এই ধারার অধীনে অভিযোগ দায়ের করে আদালতে মামলাও করা হতে থাকে। এমন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। রমেশ থাপার, রামনন্দন আর তারা সিং-এর বিরুদ্ধে রুজু তিনটি মামলায় আদালত এই ধারাটিকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেয়। সংবিধান মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে কোনও আইনপ্রণেতাই সেই মৌলিক অধিকার হরণ বা সীমিত করতে পারে না— তারা সিং-এর মামলায় ইস্ট পাঞ্জাব হাইকোর্ট জানায়।
এই পরিস্থিতিতে জওহরলাল নেহরুর সরকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। এই প্রস্তাবে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদ ১৯-এর সঙ্গে (২) উপধারা যোগ করে ‘সামাজিক শৃঙ্খলা [public order]’ ও ‘বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক [relation with friendly states]’ বজায় রাখার প্রয়োজনে কিছু অনুমোদনযোগ্য বিধি-নিষেধ [permissible restrictions] আরোপ করার ব্যবস্থা করা হয়। এমন কী অনুচ্ছেদ ১৯(১)(এ) ধারায় যে বিধিনিষেধের কথা বলা আছে তার আগে ‘যুক্তিগ্রাহ্য [reasonable]’ শব্দবন্ধ যোগ করা হয়। সংবিধানের প্রথম সংশোধন বিষয়ে পার্লামেন্টে বিতর্কের সময় নেহরু বলেন যে ‘সিডিশন’ অথবা এইধরনের বিষয়কে আইনগ্রাহ্য করার জন্যে এই সংশোধন আনা হয়নি। পেনাল কোডের ১২৪-এ ধারাকে তিনি ‘আপত্তিকর ও নিন্দনীয় [objectionable and obnoxious]’ বলেন আর জানান যে আইপিসি-তে এই ধারাটি বজায় রাখার কোনও যুক্তি নেই।
তবুও পেনাল কোডে এই ধারাটি বহাল তবিয়তে আছে। ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময়ে এবং তার পরবর্তী সময়ে ‘বামপন্থী জঙ্গি [Left Wing Extremism]’ আন্দোলন ও অন্যান্য জঙ্গি আন্দোলন দমনের অজুহাতে এই ধারার ব্যাপক ব্যবহার-অপব্যবহার লক্ষ করা গেছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এই ধারার প্রয়োগ বেশ বেড়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র ২০১৯ ও ২০২০ সালের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে, অর্থাৎ মোদিজির সরকার আসার পর থেকে সিডিশন মামলা বহুগুণ বেড়ে গেছে। ২০১০ সাল থেকে দেখতে গেলে বর্তমানে প্রায় ১১,০০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৮১৬টি সিডিশন মামলা চালু আছে। এর মধ্যে শতকরা ৯৫টি রুজু হয়েছে ২০১৪-এর পরে। প্রধানমন্ত্রী মোদিজির বিরুদ্ধে ‘সমালোচনামূলক [critical]’ ও ‘আপত্তিজনক [objectionable]’ মন্তব্য করার জন্য ১৪৯ জন এই ধারায় অভিযুক্ত আছেন। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথজির বিরুদ্ধে এই একই ধরনের মন্তব্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১৪৪ জন। ২০১৪ থেকে ২০২০ এই সময়ে প্রতি বছর সিডিশন মামলা রুজু করার হার প্রায় ২৮ শতাংশ হারে বেড়েছে।
রাজ্যস্তরে দেখলে ২০১০ থেকে ২০২০ অবধি যে পাঁচটি রাজ্যে এই ধারার মামলা সর্বাধিক তার চারটিই বিজেপি-শাসিত— বিহার, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক ও ঝাড়খণ্ড। ২০১৪ থেকে ২০১৯ অবধি ৩২৬টি সিডিশন মামলা রুজু হলেও চার্জশিট হয়েছে মাত্র ১৪১ মামলায় আর সাজা পেয়েছে মাত্র ৬ জন।
২০১৯-এ পুলওয়ামা ঘটনার পরে ৪৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২৭টি অভিযোগ দায়ের হয় আর ২৬টি-ই বিজেপি-শাসিত রাজ্যে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?— ‘পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেওয়া’ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘দেশ-বিরোধী অ্যান্টি-ন্যাশন্যাল’ বিবৃতি দেওয়া।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়ে ৩৭৫৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২৫টি সিডিশন মামলা রুজু হয়। ৩৭৫৪ জন ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ৯৬ জন চিহ্নিত, বাকিরা ‘অজানা’। ২৫টি মামলার ২২টি বিজেপি-শাসিত রাজ্যের। ২০১৮ সালে ঝাড়খণ্ডের পাথালগডি আন্দোলনে যুক্ত শত শত আদিবাসীর বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। ওই রাজ্যে তখন বিজেপি সরকার ছিল।
সালতামামি হিসাবে ২০১৪ সালে ৪৭টি, ২০১৫ সালে ৩০টি, ২০১৬ সালে ৩৫টি, ২০১৭ সালে ৫১টি, ২০১৮ সালে ৭০টি এবং ২০১৯ সালে ৯৩টি মামলা এই সিডিশন ধারার অধীনে রুজু করা হয়েছে দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মহিলা সহ মোট ৫৫ জনের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এনসিআরবি-র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৯ সালে মাত্র ৩.৩ শতাংশ মামলায় শাস্তিবিধান করেছে আদালত।
২০২১-এর জুলাই মাসে এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া-র এক আবেদনের শুনানির সময়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমান্না এই আইনের সমালোচনা করে প্রশ্ন করেন: “সিডিশন এক ঔপনিবেশিক আইন। এই আইন স্বাধীন সত্তাকে দাবিয়ে রাখে। মহাত্মা গান্ধি, তিলক এঁদের বিরুদ্ধেও এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। পঁচাত্তর বছরের স্বাধীনতার পরেও কি এই আইনের প্রয়োজন আছে?”
স্বাধীন ভারতে এই ধারার ব্যবহার অপব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এমনকি স্বাধীন ভারতে এরকম কোনও আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না সেই প্রশ্নও বারবার সামনে এসেছে। অতি সম্প্রতি ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের এক ডিভিশন বেঞ্চ সরকারের কাছে আইপিসি-র এই ১২৪এ ধারার ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আদালতের সামনে উপস্থাপিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব চেয়েছেন এবং সেই জবাব আদালতের সামনে না আসা অবধি এই ধারার প্রয়োগে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
এতদিন ধরে এরকম একটা আইন আমাদের দেশে যে শুধু বজায় আছে তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে এর ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ গণতন্ত্রপ্রিয় যে কোনও নাগরিককে সন্ত্রস্ত করে দেবে। সরকার বা তার নীতি অথবা কাজ নিয়ে সমালোচনা করা বা বিরোধিতা করা কোনও অপরাধ হতে পারে না। অথচ শুধু সাধারণ নাগরিকই নয়, একেক সময়ে মনে হয় যে মহামান্য আদালতের বিচারকেরাও হয়ত এই ধরনের বিরুদ্ধাচরণকে ‘অপরাধ বা ক্রাইম’-এর তালিকাভুক্ত করে ফেলছেন। আইপিসি-তে এই ১২৪-এ ধারা ‘সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধ’ এই অংশে আছে। যে কোনও ধরনের সরকার-বিরোধিতাকে কি অপরাধের তালিকায় এনে ফেলা যায়?
ভারতের পেনাল কোডে যখন ‘সিডিশন’ ধারা উপস্থাপন করা হয় তখন আমরা ছিলাম ব্রিটিশ রাজার অধীন। সব ক্ষমতার তখন উৎস একটিই, আর সব প্রজাই রাজানুগত হতে বাধ্য। যে কোনও উপায়ে এই রাজাকে উচ্ছেদ করা, এমনকি উচ্ছেদ করার চিন্তা করাও অপরাধ বলে গণ্য করত সরকার। কিন্তু এখন তো অবস্থা ভিন্ন। এখন ক্ষমতার উৎস দেশের সংবিধান, কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও ‘শাসক রাষ্ট্র’ নয়। ‘স্টেট (State)’ বলতে এখন বোঝায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমষ্টিকে। সুতরাং সরকার পরিবর্তন বা পরিবর্তনপ্রচেষ্টা আর কোনও যুক্তিতেই ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হতে পারে না। সরকার আসবে যাবে, কিন্তু স্টেটের মূল ভিত্তি সেই পরিবর্তনের ফলে প্রভাবিত হবে না। সহজ কথায় বলতে গেলে সিডিশন শব্দটি এখন অর্থহীন হয়ে গেছে।
তবুও পেনাল কোডে ১২৪-এ ধারা এখনও টিঁকে আছে। কারণটা বোঝা খুব শক্ত নয়। আসলে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা একবার হাতে এলে তার আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার বিশাল ভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়ে যায় ক্ষমতা যারা পেয়েছে তাদের কাছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসারে এই সুযোগ কিন্তু সময়বদ্ধ, কারণ নির্দিষ্ট সময়ান্তে জনগণের রায় নিয়েই ক্ষমতায় থাকা যায়। সুতরাং একবার ক্ষমতায় এলেই সেই ক্ষমতাকে দীর্ঘকালীন করার একটা কায়েমি স্বার্থ কাজ করতে শুরু করে। যে কোনও ধরনের বিরোধিতাকে, বিশেষ করে যে সব বিরোধিতাকে তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক স্তরে হারিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে মোকাবিলা করা সহজতর। ঠিক এই কারণে স্বাধীন ভারতে আজ অবধি কোনও সরকার ১২৪-এ ধারা বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেনি। এমনকি বামপন্থী বলে পরিচিত সরকারও এই ধারাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধিতার মোকাবিলা করেছে এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
১২৪-এ ধারাকে টিঁকিয়ে রাখার পক্ষে একটা সাধারণ বহুপ্রচলিত যুক্তি হচ্ছে যে এরকম আইন না থাকলে ‘দেশদ্রোহিতা’ কী করে প্রতিরোধ করা যাবে? যারা এই যুক্তি সামনে আনেন তারা দেশ আর সরকারকে হয় ইচ্ছে করে গুলিয়ে ফেলেন অথবা এই দুইয়ের পার্থক্য না বুঝেই কথা বলেন। ধ্বংসাত্মক বা হিংসাত্মক যে কোনও কাজ প্রতিরোধের জন্য আমাদের পেনাল কোডে অনেক ব্যবস্থা আছে। সেইসব আইনের সাহায্যে ও উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সব ধরনের ‘অপরাধ’ প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য ১২৪-এ ধারা বজায় রাখার যুক্তি নেই।
ঠিক এই কারণেই ল কমিশন ২০১৮ সালে একটি পরামর্শপত্র বা কনসাল্টেশন পেপার দিয়ে এই আইনের উপযোগিতা পুনর্বিচার করার কথা বলে। সেখানে বলা হয়েছে যে ইংল্যান্ড থেকে এই সিডিশন আইন আমাদের দেশে এসেছে সেই ইংল্যান্ডে-ই আজ এই আইন তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে এই আইন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের বর্তমান সরকার যেন-তেন-প্রকারেণ এই আইনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত আজকের ভারতে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে, সেই সময়ে যত দেরি করা যায় তার চেষ্টা সরকার করে চলেছে। একই সঙ্গে যা আমরা আগেই দেখেছি যে কী হারে এই ধারার অধীনে মামলা রুজু করে সরকার বিরোধী মতপ্রকাশের রাস্তাকে রুদ্ধ করে চলেছে। তুচ্ছ কারণে নাগরিকদের নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে, ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে এই আইনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতেই হবে।