সুব্রত রায়
প্রাবন্ধিক, যুক্তিবাদী সমিতির নেতৃত্বস্থানীয় কর্মী
History is a tool used by politicians to justify their intentions.
—Ted Coppell
অযোধ্যা তো বাস ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তাদের রাজনৈতিক দোসর বিজেপি কথা রেখেছে। রামমন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে কয়েক দশকের মহড়ার শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আশীর্বাদে মধুরেণ সমাপয়েৎ এবং তজ্জনিত দাঙ্গাহাঙ্গামায় কয়েক সহস্র মৃত্যুর অভিঘাত, এইসব কমতে না কমতেই সামনে চলে এল নতুন বিতর্ক। চলে এল একেবারে দিনক্ষণ মেপে, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চড়া দামদস্তুর সামলাতে সামলাতে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। সঙ্ঘী স্লোগানের নির্দিষ্ট ক্রম বজায় রেখে এবার ‘মিশন কাশী’! বলে নেওয়া দরকার যে, বিতর্কিত স্থানটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে এবং অযোধ্যায় দখলিকৃত সঙ্ঘী কীর্তিভূমি থেকে মাত্র দুশো কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।
জ্ঞানবাপী মসজিদ ও বিশ্বেশ্বর মন্দির। কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাট থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে পাশাপাশি অবস্থান করছে ধর্মস্থান দুটি। এ দিক থেকে দেখলে, এ বিতর্ক রামজন্মস্থান বিতর্কের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে কিছুটা আলাদা। এখানে ঐতিহাসিক কাল থেকে মন্দির ও মসজিদ উভয়েরই অস্তিত্ব সন্দেহাতীত। অভিযোগ এই যে, সপ্তদশ শতকে বিশ্বেশ্বর মন্দিরেরই একটি অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। অর্থাৎ মসজিদটি মন্দিরেরই একটি অংশ। প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে, হিন্দুরা সেখানে পুজোআচ্চা করতে পারবে না কেন? বাস্তবিকই, ২০২১ সালে পাঁচজন স্থানীয় মহিলা আদালতের কাছে এই প্রশ্নেরই জবাব চেয়েছিল। বিতর্কটাকে অবশ্য একেবারে আনকোরা বলা যাবে না। বলা যাবেই বা কী করে! ইসলামি শাসনের ‘অপকীর্তি’র একটা আগমার্কা হিসেব সঙ্ঘ অনেককাল যাবৎ পেশ করে রেখেছে যে— ত্রিশ হাজার মন্দির ধ্বংসের ফর্দ (অবশ্য তা চর্মচক্ষে দেখেনি কেউই)!
লিঙ্গোত্থানের কাহিনি
যতদূর জানা যায়, ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় উত্তরভারতে ভয়াবহ দাঙ্গার সময় থেকেই একে ঘিরে টেনশনের সূত্রপাত। এরপর ভিনধর্মের দুটি সৌধের মধ্যবর্তী জমির অধিকার কায়েমের জন্য আইনি-বেআইনি নানান পথে তৎপরতা চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ইতিমধ্যে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটে, এবং ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৮০-র দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রামমন্দিরের দাবিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানবাপী মসজিদের বসতভূমিরও অধিকার দাবি করে। মজার কথা হল, বিজেপি রামমন্দির নির্মাণের রাজনীতিতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করলেও জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে আপত্তি জানায়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেও এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল এই যে, জ্ঞানবাপী একটি সক্রিয় উপাসনাস্থল হওয়ায় তা পুরাতাত্ত্বিক বিচারের আওতার বাইরে— রামমন্দিরের যুক্তি ওখানে প্রযোজ্য নয় (পাঠক, বিষয়টি মাথায় রাখুন)।[1]
মামলামোকদ্দমা কিন্তু চলতেই থাকে। অন্যদিকে, দেশব্যাপী মন্দির-মসজিদ বিতর্কের আবহে সম্ভ্রম রক্ষার্থে ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও-এর কংগ্রেসি সরকার ‘প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে, যার সাহায্যে কোনও ধর্মস্থানের ক্ষেত্রে (বাবরি মসজিদ ব্যতীত) ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তারিখে তার যা চরিত্র ছিল তাইই বজায় রাখার আইনি রক্ষাকবচ গড়ে ওঠে। বলা হয় যে, কেবলমাত্র প্রাচীন স্থাপত্য ও পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহের বেলায় আইনটি প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু, ওই একই বছর, বারাণসী সিটি সিভিল কোর্টে প্রণীত আইনকে পাশ কাটিয়ে জ্ঞানবাপী মসজিদের সম্পত্তি হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে মামলা গৃহীত হয়। ১৯৯৮ সালে নিম্নতর কোর্ট মন্দির-মসজিদ সমস্যার মীমাংসা করার অধিকারী নয়— এই যুক্তিতে বিরোধীপক্ষ মামলাটির অগ্রগতি থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এভাবে, ২২ বছর মামলাটির শুনানি বন্ধ থাকে।
২০১৯ সাল থেকে শুরু হয় নতুন তৎপরতা। গোপনে মসজিদের জমিতে শিবানুচর ‘নন্দী’র মূর্তি পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তা ধরা পড়ে। আদালতের দরজাতেও নানাভাবে কড়া নাড়া শুরু হয়। এরই ফলাফল হিসেবে ২০২২ সালের মে মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তড়িঘড়ি মসজিদে এএসআই-সমীক্ষা ও তা ভিডিওগ্রাফি করার অনুমতি দেয়। লক্ষণীয় যে, ১৯৯১ সালের ‘প্লেসেস অব ওরশিপ অ্যাক্ট’কে বারবার উপেক্ষা করেই আদালত এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলে। এরপর ঘটনাক্রম দ্রুত এগোতে থাকে। এএসআই-সমীক্ষায় মসজিদসংলগ্ন পুকুর, যেখানে নমাজিরা ওজু করেন, তা থেকে গম্বুজাকৃতি একটি বস্তু উদ্ধার হয়। বস্তুটিকে সঙ্ঘ পরিবার ‘শিবলিঙ্গ’ বলে অভিহিত করে। অন্যদিকে, মসজিদ পক্ষের লোকজন একে প্রাচীন কোনও ফোয়ারার অংশবিশেষ বলে বিবৃতি দেয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যকরী সভাপতি অলোক কুমারের ভাষ্য অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ পাওয়ার অর্থ হল এখন এটা একটি মন্দির এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টেও তাইই ছিল। কাজেই, ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী কোনও গর্হিত কাজ করা হয়নি।
সরযূ থেকে গঙ্গা
১৯৯২ সালে বিজেপি যে যুক্তি দেখিয়ে জ্ঞানবাপী সম্পর্কে অনাগ্রহের ভান করেছিল, সেই মুখোশ অচিরেই খসে পড়ে। ২০২১ সালে পার্টির পূর্বতন মুখপাত্র অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে ‘প্লেসেস অব ওরশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১’-এর যৌক্তিকতাকেই চ্যালেঞ্জ জানান। উক্ত আইনের ধারাগুলি নাকি সংবিধানের সেকুলার ঐতিহ্যের বিরোধী! একই বিষয়ে আরেকটি আবেদন জমা পড়ে। লক্ষণীয় যে, বিজেপির পূর্বতন রাজ্যসভা সাংসদ সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী ও আইনজীবী সত্য সাভারওয়ালের দায়ের করা দ্বিতীয় আবেদনটি জমা পড়ে চিফ জাস্টিস শরদ অরভিন্দ বোবদের অবসরগ্রহণের সামান্য কয়েকদিন আগে। বোবদে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে দ্বিতীয় আবেদনটির সঙ্গে প্রথম আবেদনটি জুড়ে দেন এবং মামলাটির মাধ্যমে শতাব্দী-প্রাচীন মন্দির-মসজিদ বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলে দেন। বোবদে ব্যক্তিটিকে নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে বাবরি মসজিদ নিয়ে যে বেঞ্চ বিতর্কিত ও আশ্চর্য রায় দেয়, ইনি তার অন্যতম সদস্য ছিলেন। আরও স্মরণীয় যে, ওই বেঞ্চের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন সেই বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই মামলাটির অব্যবহিত পরে অবসরান্তে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন স্বয়ং রাষ্ট্রপতির মনোনয়নে।
কাজেই, জ্ঞানবাপী কাণ্ডে বাবরি মামলার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বাবরি মামলায় প্রত্নসাক্ষ্য ও নথিভিত্তিক সাক্ষ্য কোনওটাই রামমন্দিরের সপক্ষে না থাকলেও মন্দির স্থাপনে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মসজিদ ভাঙার দুষ্কর্মে জড়িত কেষ্টুবিষ্টুরাও সাজা পায়নি। সঙ্ঘের পরিকল্পিত মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে এ কাজে যোগ্য সঙ্গত করেছিল, এমনকি, প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতত্ত্ববিদরা এবং এএসআই। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে অযোধ্যার খননকার্যে যুক্ত ছিলেন সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল স্টাডি-র অধ্যাপক ডঃ বি বি লাল এবং কে বি সৌন্দররাজনের মতন কয়েকজন বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ। মসজিদ চত্বরে মন্দিরের কোনও প্রমাণ তাঁরা খুঁজে পাননি। পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে এএসআই অযোধ্যায় যে খননকার্য চালায়, তাতে বাবরি মসজিদের কাঠামোর নীচে একটি বিশাল উত্তরভারতীয় মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়। তথাকথিত যে যে প্রমাণের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছিল, তার প্রতিটিই প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতাত্ত্বিক মহল নস্যাৎ করে দেয়। খননকার্যটি সংঘটিত হয়েছিল অভূতপূর্ব লুকোছাপার মধ্য দিয়ে এবং এমনভাবে খোঁড়া হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে সেখানে আর নতুন কোনও তত্ত্বতালাশের অবকাশ না থাকে। উল্লেখ্য যে, খননকার্য শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে এএসআই-এর তদানীন্তন মহাঅধীক্ষক প্রত্নতত্ত্ববিদ কস্তুরি গুপ্তমেননকে সরিয়ে মুরলীমনোহর যোশির নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় শিক্ষাদপ্তরের একজন আমলাকে ওই পদে বহাল করা হয়েছিল।[2] তখন থেকেই এএসআই-এর তথ্যনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীন সত্তাটি নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। কাজেই, জ্ঞানবাপীর গম্বুজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আরও একটি অদ্ভুত ব্যাপার পাঠকদের জানানো দরকার। ডঃ বি বি লাল অযোধ্যায় এএসআই-এর খননকার্যের পর থেকেই তাঁর নিজস্ব পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে, খননের সময় তিনি আদৌ যা যা দেখেননি, সেই জিনিসগুলি দেখার দাবি করে বসেন এবং ‘ঐতিহাসিক’ রামমন্দিরের অস্তিত্বের সমর্থক হয়ে যান। এর পর থেকে তাঁদের পুরনো খননকার্যের বিস্তারিত রিপোর্টটিও জনান্তরালে চলে যায়। আমাদের জানা দরকার যে, ডঃ লাল কিন্তু খননকার্যের অব্যবহিত পরে কোনও আর্কিওলজিক্যাল জার্নালে প্রবন্ধ লিখে এসব দাবি জানাননি, যে কোনও গবেষকের পক্ষে যা ছিল স্বাভাবিক আচরণ। এ ছিল ধর্মান্ধ শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে তাঁর পদস্খলনের চিহ্ন। হিন্দুত্ববাদীরা আর যাই হোক, অকৃতজ্ঞ নন। যখনই তারা ক্ষমতায় এসেছে, ডঃ লালকে উপঢৌকনে ভরিয়ে দিয়েছে। ২০০০ সালে তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ, এবং ২০২১ সালে পদ্মবিভূষণ। এখানে কোথাও কিছু অস্পষ্ট আছে কি?
‘সত্য হি শিব হ্যায়’
জ্ঞানবাপী মসজিদের পুকুর থেকে ‘শিবলিঙ্গ’ উদ্ধারে উৎফুল্ল হয়ে উত্তরপ্রদেশের সহকারী মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য টুইট করেছেন এটি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে, সাধের হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্প সার্থক করে তোলার জন্য ইতিহাসকে যথেচ্ছ বিকৃত করাই যাদের অভীষ্ট, তারা কেমন ‘সত্য’ খুঁজে বেড়ায়? মন্দির-মসজিদ ভাঙাগড়া সংক্রান্ত সমস্ত সত্যকে ধারণ করার সহনশক্তি তাদের আছে তো? ভারতের ইতিহাসে মন্দির লুণ্ঠন আর ধ্বংসের কারণ হিসেবে সঙ্ঘ পরিবার যেভাবে কেবলমাত্র ধর্মান্ধতাকে খাড়া করে, তা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়াতে গিয়ে তারা যা যা প্রচার করে, সেগুলো ইতিহাসের সত্য নয়, সঙ্ঘের নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত ‘সত্য’। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশে মুসলিমরা এসেছে এরকম প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তুরস্কের অভিযানকারীদের কাছে দক্ষিণভারতের মন্দিরগুলি লোভনীয় ছিল, কারণ সেগুলো ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। কাজেই, এটা আশ্চর্যের নয় যে, সেগুলো বারবার লুণ্ঠিত হত। পরবর্তীকালে এদেশে যখন পুরোদস্তুর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হল, তখনও ওই সাম্রাজ্যের অন্যতম স্থপতি ছিল স্থানীয় হিন্দু রাজা-জমিদাররাই। স্বভাবত, হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে দেওয়ার মূর্খামি তাঁরা করেননি কেউই। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, কোনও মন্দির ধ্বংস করা হয়নি। প্রধানত তা করা হয়েছে বিদ্রোহী রাজার ক্ষমতা, অহমিকা ও বৈভবকে খর্ব করার জন্য। করা হয়েছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে দমন করার জন্য। কেবল মুসলমান শাসকরাই হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেনি, হিন্দু শাসকরাও করেছে। কেবল মুসলমান শাসনকালেই তা হয়নি, তার আগেও যথেচ্ছ ঘটেছে। হিন্দু শাসকরা ভাঙাভাঙিতে মোটেও কম যান না। কাশ্মিরের হিন্দু রাজা হর্ষদেব নিয়মিতভাবে মন্দির ভাঙার জন্য ‘দেবোৎপাটননায়ক’ নামক কর্মচারীও নিয়োগ করেছিলেন। মৌর্যরাজারা অজস্র বৌদ্ধস্তূপ ধূলিসাৎ করেছেন, বৌদ্ধ মঠে অগ্নিসংযোগ করেছেন। শশাঙ্ক বৌদ্ধদের পবিত্র ‘বোধিবৃক্ষ’ উপড়ে দিয়েছেন। আবার, মুসলমান শাসক একই উদ্দেশ্যে মসজিদ ধ্বংস করেছেন এরকম নমুনাও আছে। আওরঙ্গজেব থেকেই দৃষ্টান্ত হাজির করা যায়। গোলকোণ্ডার মুসলমান শাসক তানাশাকে জব্দ করার জন্য সম্রাট জামা মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং এর নিচে পোঁতা সম্পদ উদ্ধার করেছিলেন।
জ্ঞানবাপী মসজিদ স্থাপনের পেছনে অনেকগুলি সমান্তরাল কাহিনি প্রচলিত আছে। কোনটি কতদূর ‘সত্য’, তা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাই কেবল বলতে পারে। একটি কাহিনি আকর্ষণীয়। এটি বিবৃত হয়েছে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বি এন পান্ডের Islam and Indian Culture[3] শীর্ষক গ্রন্থে। প্রকৃতপক্ষে, এটি ১৯৮৫ সালে পটনায় অনুষ্ঠিত খুদা বক্স স্মৃতি বার্ষিক বক্তৃতায় পঠিত প্রবন্ধ। এখানে তিনি খুব জোরের সঙ্গেই বলেছেন যে, ধর্মস্থান ধ্বংসের ব্যাপারে আওরঙ্গজেবের যে দুর্নাম তার অধিকাংশই কল্পকাহিনি মাত্র। তবে দুটি ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। একটি হল গোলকোণ্ডার মসজিদ, যার উল্লেখ আগেই আছে। দ্বিতীয়টি হল কাশীর বিশ্বেশ্বর মন্দির। এই দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাহিনিটি অসাধারণ, এবং গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। একবার দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেব রাজ-অমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে বাংলার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন। পথে বারাণসীতে পত্নীদের অনুরোধে রাজারা তাঁকে একদিন বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করেন, যাতে দলের ইচ্ছুক পুণ্যার্থীরা গঙ্গাস্নান সেরে বিশ্বেশ্বর মন্দিরে পুজো দিতে পারে। সম্রাট আবদার মেনে নেন। যথাসময়ে স্নান ও পুজোআচ্চা সেরে মহিলারা একসঙ্গে ফিরে আসে, কিন্তু কচ্ছের রানি বেপাত্তা হয়ে যান। সম্রাটের সেনাবাহিনি পুরো এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর হদিশ পায় না। তখন সম্রাটের আদেশে মন্দিরে তল্লাশি চালানো হয় এবং এক গুপ্তগৃহে অলঙ্কারবিহীন ও লাঞ্ছিত অবস্থায় রানিকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই ঘটনা সম্রাটকে এতটাই ক্ষুব্ধ করে যে, তিনি মন্দির ভেঙে ফেলতে হুকুম করেন এবং মন্দিরের মহন্তকে গ্রেপ্তার করে কঠোর সাজা দেন। ঘটনার একই বিবরণ পাওয়া যায় মধ্যপ্রদেশের প্রথম রাজ্যপাল ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি পট্টভি সীতারামাইয়া-র জেল ডায়েরি ‘Feathers and Stones’[4]-এ। এতে বাড়তি হিসেবে উল্লেখ আছে যে, মন্দিরের একাংশ ভেঙে পড়ার পর কচ্ছের রানির একান্ত অনুরোধে সম্রাট সেখানে একটি মসজিদ গড়ার আদেশ দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ, আওরঙ্গজেব কর্তৃক মন্দির ভাঙা ও মসজিদ নির্মাণের কাহিনির সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু লাখ টাকা দামের প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘সত্য’ যদি সত্যিই এরকম হয়, তা কি সঙ্ঘীদের জন্য আদৌ খুব গৌরব বহন করবে? মন্দিরের পুরোহিতদের ধনলিপ্সা ও লাম্পট্যের কাহিনি কি তারা মেনে নিতে প্রস্তুত? এই কাহিনি যদি সত্যি হয়, তাতে মন্দির ভাঙার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলমান শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেবের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা কি সঙ্ঘীরা অস্বীকার করতে পারবে? আর সর্বোপরি, এ গল্প যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ হিন্দু রানির সম্মানরক্ষার্থেই যদি আওরঙ্গজেব এহেন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, তবে মুসলমানের হাতে হিন্দুর লাঞ্ছনার তত্ত্বের হালই বা কী দাঁড়াবে?
ইতিহাস পুনর্নিমাণ নাকি ইতিহাস সংরক্ষণ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সত্যিই এটি শিব্রামীয় গল্পে কথিত ‘দেবতার জন্ম’-র দৃষ্টান্ত না হয়, এবং পুকুর থেকে খুঁজে পাওয়া গম্বুজাকৃতি বস্তুটি বাস্তবিকই আরাধ্য শিবলিঙ্গ বলে শনাক্ত করা যায়, তাহলে আমাদের কী করণীয়? অযোধ্যার চিত্রনাট্য ডাহা মিথ্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত হলেও সবক্ষেত্রে তেমনটা তো না-ও হতে পারে। আমরা কি তবে এরকম দাবি করব যে, মসজিদটিকে বাবরি ধ্বংসের চেয়ে অধিক উন্মত্ততায় ধূলিসাৎ করে সেখানে শিবের সুরম্য মন্দির নির্মাণ করা উচিত? আসমুদ্রহিমাচল তোলপাড় করে নন্দীভৃঙ্গীদের বয়ে আনা ইষ্টকখণ্ড দিয়ে রচিত হবে যার ভিত ও দেওয়াল? আর অযোধ্যা থেকে কাশী পেরিয়ে ডমরু বাজিয়ে আমরা ছুটে চলব মথুরার দিকে আরও আরও ইতিহাস পুনর্নিমাণের মহান কর্তব্যকর্ম স্কন্ধে বহন করে? ইতিহাস কি এই শিক্ষা দেয়? এই কি আধুনিকতার অভীষ্ট? এই কি সমাজ-কল্যাণ রাষ্ট্রের আকাঙ্খা?
আচ্ছা, খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা যাবই-বা ঠিক কতদূর? কাশীর পর কি মথুরার নম্বর উঠবে? ‘তোজো মহালয়া’-কে সুপ্রিম কোর্ট ধমক দিয়ে সাময়িক চুপ করিয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কুতুব মিনার। লখনউয়ের তিলি-ওয়ালি মসজিদ, সেও নাকি লক্ষণটিলা? বেশ, যদি ধরেই নিই এভাবে ইতিহাসের পুনর্নিমাণ করতে হবে, তাহলেও তার অভিজ্ঞতা কি খুব সুখকর হবে? যদি একই কায়দায় বৌদ্ধমঠগুলি ফিরিয়ে দেবার দাবি ওঠে? সঙ্ঘীরা সোল্লাসে জগন্নাথদেবের মন্দির ভেঙে কি পুরীর বৌদ্ধমঠ গড়ে দেবে? ভেঙে ফেলা জৈন মন্দিরগুলোরই বা কী হবে? কিংবা, মনে করুন, ইতিহাসের দোহাই পেড়ে, বাঙালিরা যদি শিবাজি ও তাঁর অনুচর দস্যুদের বর্গিহানার প্রতিশোধ নিতে তামাম মহারাষ্ট্রবাসীর ওপরে খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে? কিংবা, ধরা যাক, সঙ্ঘীয় দাবি মেনে ‘বহিরাগত’ মুসলিমদের দেশছাড়া করা হল। এবার, বনবাদাড়ে কোনওরকমে টিঁকে থাকা দেশের আদিম আদিবাসীরা যদি ‘আর্য’দের ঠেঙিয়ে বার করে দিতে চায়? ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার চাইলে তো তেমনটাই করার কথা! দেশের বর্তমান আর ভবিষ্যতের উন্নতির পক্ষে এগুলোকে খুব কাম্য আর মঙ্গলজনক বোধ হচ্ছে কি?
ইতিহাস জানা দরকার। জানতে চাইলে সংরক্ষণও করতে হবে। ইতিহাসচর্চার মূল উদ্দেশ্য হল অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে আগুয়ান হওয়া। এই শিক্ষাটার জন্যই ইতিহাসের শরণ নেওয়া। এর বদলে ইতিহাস যদি বোঝা হয়ে বুকে চেপে বসে অতীতের রক্তক্ষয়ী হানহানির দিনগুলো ফিরিয়ে আনে, তাহলে সভ্যতা কথাটির আর কোনও তাৎপর্য থাকে কি? হিন্দুরাষ্ট্রের নেশায় মশগুল উন্মাদদের কঠোর ভাষায় এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।
*সময়াভাবে সমস্ত তথ্যনির্দেশ দেওয়া সম্ভব হল না। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কিত তথ্যের জন্য অন্তর্জালের নানা সূত্র ব্যবহৃত হয়েছে। উইকিপিডিয়া-র সাহায্যও নিয়েছি।
[1] Katju, Manjari. Vishva Hindu Parishad and Indian Politics. New Delhi: Orient Longman, 2003. pp.113-114.
[2] মুখোপাধ্যায়, অশোক। মন্দির-মসজিদ বিসম্বাদ। কলকাতা: বোধোদয় মঞ্চ, ২০০৪। পৃ. ১১৪-১১৫।
[3] Pandey, B.N. Islam and Indian Culture. Patna: Khuda Baksh Memorial Annual Lecture (1985), 1988. pp.54-55.
[4] Sitaramayya, P. Feathers & Stones. Bombay: Padma Publication Ltd., 1946. pp.177-178.