তুষার চক্রবর্তী
দর্জ বা দর্জি কথাটার মধ্যে কান পাতলে একটা চাপা গর্জন যদি কারও কানে ধরা পরে তাহলে অবাক হবার কারণ নেই। আসলে তিব্বতি ভাষায় শব্দটির অর্থই হল বজ্র-বিদ্যুৎ। কিন্তু উত্তাপ, গর্জন বা উৎপাত নয়, সমতলবাসী বাঙালির তাপদগ্ধ জীবনে দু’দণ্ড শীতলতা ও সস্তার সাহেবিয়ানার অপর নামই তো এতকাল ছিল দার্জিলিং। কিন্তু সেই ছায়াময় মায়াময় পাহাড় গত কয়েকদশক হল কেন সতত গর্জমান ও রক্তপাতময় তা এখন বাঙালির বিশেষভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। যদিও এক্ষেত্রে সেই সত্যি কথা ভাববার কাজ সহজ নয় মোটেই। আর তাই, বাস্তবতাকে বোঝার চাইতে ভাবাবেগ, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কড়া দাওয়াই দিয়ে পরিস্থিতি ক্রমশ আরও জটিল ও ঘোরালো করে তোলার উল্টো পথেই হাটতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার, যা এখন কার্যত এক নেত্রীর শাসন।
এই ব্যাপারে মুখ খুলতে গেলে গোর্খাল্যান্ড-এর আকাঙ্ক্ষা ও দাবির পেছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তা প্রথমেই এক পলকে দেখা নেওয়া দরকার।
দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও সংলগ্ন পাহাড় এলাকা যা নিয়ে আজ পৃথক রাজ্য হিসেবে গোর্খাল্যান্ডের দাবি উঠছে তা যে ঐতিহাসিকভাবে বাংলার অংশ ছিল তা নয়, বরং সিকিমের সঙ্গেই তার যোগ বেশি। আছে আরও অনেক জটিলতা। ১৭৮০ সালে গোর্খারা সিকিম সহ এই এলাকা দখল করে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধে গোর্খাদের পরাজিত করে কোম্পানি তা সিকিমকে ফিরিয়ে দেয় ও সিকিম ১৮৩৫-এ দার্জিলিং এলাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে লিজ দেয়। ভুটানের কাছ থেকে ইংরেজের দখল করে কালিম্পং। এই এলাকাকে ব্রিটিশ প্রশাসন সেই থেকে কার্যত এক বিশেষ এলাকা হিসেবে পৃথক মর্যাদা দিয়ে এসেছে। তা সত্বেও, ১৯০৭ সাল থেকে এই এলাকা বারংবার সমতল থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা ও আত্মশাসনের অধিকার দাবি করছে। ১৯১৭, ১৯৩০ এবং ১৯৩৪ সালে তো বটেই, এই নিয়ে ১৭ বার এই এলাকা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দাবি তুলেছে, এবং স্বাধীনতার পরেও ১৯৫০ থেকে পৃথক রাজ্যের আন্দোলন হিসেবে এই দাবি আরও বেশি বেশি করে উঠেছে। অবশেষে গোর্খা ন্যাশন্যাল লিবারেশন ফ্রন্ট-এর নেতৃত্বে ৮০ দশকের শেষে এই আন্দোলন প্রবল হিংসাত্মক চেহারা নেয়। সেবারেও তীব্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে এই আন্দোলন দমন করা হয়েছিল। তীব্র চাপের মুখে সেই আন্দোলন সেকালে রাজ্য সরকার সামলে নিয়েছিল দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল তৈরী করে। আন্দোলনের নেতা সুবাস ঘিসিং-এর হাতে এভাবেই আংশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার, যা ১৯৮৮ থেকে প্রায় ২৩ বছর পাহাড়কে ঘিসিং-এর সর্বময় নিয়ন্ত্রণে ফেলে রেখেছিল। তারপর দল ভেঙ্গে, ঘিসিং-এর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণকে চালেঞ্জ করে, হিল কাউন্সিল নয় – পশ্চিমবাংলা থেকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের অপূর্ণ দাবিকে সামনে রেখে বিমল গুরুং নতুন আন্দোলনে ঝাঁপ দিলেন। তৈরি করলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সেই সময়ে তার পাশে সহায়তার হার বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি ও পশ্চিমবাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মধ্যেই বামফ্রন্টকে হারিয়ে পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। ঘিসিং পাহাড় থেকে বিতারিত হন এবং ২০১১ সালের ১৮ই জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম, পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিমল গুরুং-সহ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বৈঠকে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিমল গুরুং, একসময় যিনি ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবারে হয়ে উঠলেন পাহাড়ের নতুন রাজা। কিন্তু মমতার রাজত্বে চুক্তি মোতাবেক প্রশাসনিক দপ্তর ও যা যা পাহাড়ের নতুন রাজার কাছে হাত বদল করার কথা ছিল তার বেশিরভাগটাই অপূর্ণ রাখা হল। তারপর বিমল গুরুঙের ক্ষোভের মুখে তার ওপর উল্টো চাপ তৈরি করতে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক পর্ষদ তৈরি করে বিভাজনের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তৃণমূলের এই বিরোধী নির্মূলীকরণের রাজনীতি গোর্খাল্যান্ডের পৃথক রাজ্যের দাবি ও প্রয়োজনে নতুন করে ইন্ধন যোগায়। এ বছরের জুন মাস থেকে শুরু হল আন্দোলন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সমস্ত স্কুলে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার দর্পিত সিদ্ধান্ত পাহাড়ের ক্ষোভের বারুদে যেন অগ্নিসংযোগ করল। সেই থেকে পাহাড় থেকে তো বটেই, পাহাড় নিয়ে মমতার মুখের হাসিও মিলিয়ে গেছে। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী– ১০৪ দিনের টানা বনধ্ চলেছে পাহাড়ে। শত চেষ্টাতেও যা ভাঙতে পারেননি মমতা এবং তখন থেকেই পাহাড়ের এই আন্দোলনকে দেশবিরোধী তকমা দেওয়া শুরু করেছে রাজ্য সরকার। এর উদ্দেশ্য – গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অগণতান্ত্রিক উপায়ে দমন করার লাইসেন্স আদায় করা। বিমল গুরুংকে জীবিত বা মৃত – যে কোনওভাবে হাতে পাওয়াটাই উদ্দেশ্য। আর বিমল গুরুং-এর জায়গায় আগেভাগেই তাই বিনয় তামাংকে বসানো হয়েছে পুতুল হিসেবে।
রাজ্য সরকারের এই ধরনের একের পর এক আগ্রাসী ও বেপরোয়া পদক্ষেপ না রুখলে পাহাড়কে ছন্দে ফেরানো আজ অসম্ভব।
প্রসঙ্গত, সুবাস ঘিসিঙের আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের বেশ কিছু তফাত আছে যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
প্রথমতঃ এবারের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন অহিংস পথে নাগরিক আন্দোলন হিসেবে চলার জন্যে সবরকম চেষ্টা করেছে, যা এবারকার আন্দোলনের সবচাইতে ইতিবাচক দিক। ফলে এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর বিভাজনের রাজনীতিকেও পরাস্ত করে তা পাহাড়ের সবকটি দলকেও ঐকবদ্ধ করতে পেরেছে। আন্দোলন দীর্ঘ ধর্মঘটের রাস্তা নিয়েছে। আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করছেন। তাঁরা জানেন যে ভারতীয় সংবিধানে তাঁদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আন্দোলন যে গতবারের আন্দোলনের চাইতে অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ রয়েছে তার কৃতিত্বের বেশিরভাগটাই আন্দোলনকারীদের দিতে হবে। যদিও এক্ষেত্রে সরকারের বয়ান এর ঠিক উল্টো। আন্দোলনের যে ছবি আমরা দেখেছি তাতে আগ্নেয়াস্ত্র কিন্তু মারমুখী রাজ্যবাহিনীর হাতেই চোখে পড়েছে, অন্তত আমাদের সাদা চোখে।
দ্বিতীয়তঃ ক্ষোভ প্রশমনের প্রয়াস দূরস্থান, মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদল আগ্রাসী ভুমিকা নিয়ে বিমল গুরুং ও গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকারীদের ওপর একের পর এক নজিরবিহীন আক্রমণ করে চলেছেন। এর শুরু হয়েছিল পাহাড়ে উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণার নাম করে, নির্বাচিত জি টি এ আধিকারিকদের পাশ কাটিয়ে, তৃণমূল রাজনীতির জমি তৈরি করা দিয়ে। তারপরে, পাহাড়ের নেতাদের একাংশকে কোনও গোপন মন্ত্রে রাজ্যের শাসক দলে আনার চেষ্টা চলল। পুতুল প্রশাসন তৈরির খোলা অপচেষ্টা দেখা গেল, বিনয় তামাংকে কেন্দ্র করে, যা পরিস্থিতি সরল করার বদলে ক্রমশ আরও জটিলতর করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয়তঃ কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস শুধুমাত্র আগামী দিনের নির্বাচনে নিজেদের আশু সর্বাধিক রাজনৈতিক মুনাফার কথাই এখন দিনরাত হিসেব করছেন। ফলে সমস্যা মেটাবার চাইতে তা জিইয়ে রাখার সম্ভাবনা বেশি। পাহাড় ও বিশেষত উত্তরবাংলার অর্থনীতি অচিরে এর ফলে ঘোরতর বিপণ্ণ হয়ে পড়বে, যা এলাকাকে এক সার্বিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তৈরি হতে পারে কাশ্মীরের মতোই আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। এই দেয়ালের লিখন মানুষ ইতিমধ্যেই পড়তে পারছেন।
এর মধ্যেই পাহাড়ে এক নতুন আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠছে, একজন নবনিযুক্ত সাব-ইন্সপেক্টরকে আচমকা অপ্রস্তুত অবস্থায় বিমল গুরুং পাকড়াও অভিযানে পাঠিয়ে। এই অভিযানে কী ঘটেছিল তা নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী বয়ান সংবাদ ও সরকারের মুখ থেকে ভেসে আসছে। এই পোস্ট-ট্রুথ যুগে, যার স্থান-কাল-পাত্র সবটাই উদ্দেশ্যমূলক নির্মাণ, ছবির কোনটা আসল কোনটা মডেল, কোনটা ফাইল পিকচার সেটাও বোঝা কঠিন। প্রথম বয়ানে ছিল একটি লেপচা বস্তির কথা, যেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা পুলিশকে আক্রমণ করে ও একটি জিপ পুড়িয়ে দেয়। তারপর ছবিতে দেখানো হল একটি নির্জন নদীতীর ও পাশের জঙ্গল, কোনও বসতির চিহ্ন সেখানে নেই। এখন দুটি বয়ানের মধ্যে গোঁজামিল দেবার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। কোনটা সত্যি কোনটা বানানো, উচ্চপর্যায়ের তদন্ত ছাড়া বলা মুশকিল। এখানেও যেন কাশ্মীরের ছায়াপাত।
মুশকিল হল – পাহাড়কে কাশ্মীর বানালে ভারত ও বাংলা কাশ্মীরের চেয়েও বিপণ্ণ হয়ে উঠবে অচিরেই। সতর্কতার শেষ ঘণ্টি এখন পাহাড়ে বাজছে। আপনারা শুনতে পারছেন তো?
আসুন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ফেলে যাওয়া অবশেষকে যক্ষের ধনের মতো আগলে না রেখে, সাম্রাজ্যবাদের চটিতে নিজেদের ধুলোমাখা পা গলানোর বৃথা অপচেষ্টা ছেড়ে– আমরা পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্মগত অধিকারকে সম্মানের সঙ্গে দেখতে শিখি।