Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোন দিকে অসমে বাঙালির ভবিষ্যৎ

সঞ্জীব দেবলস্কর

 



প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট

 

 

ঘটনাটি ১৯৭২ সালের ২৮ নভেম্বরের। ইউনিয়ন টেরিটরি ডিমান্ড কমিটির এক প্রতিনিধিদল দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে হাজির হয়েছেন। নেতা পরিতোষ পালচৌধুরী এবং অন্যান্যদের সঙ্গে বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ভারতের ফিনান্স কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, অশোককুমার চন্দ। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন ছিল, “কাছাড়কে আলাদা করে দিলে কি সমস্যা সমাধান হবে?” ওরা একবাক্যে বলেন কাছাড় আলাদা হলে অসমিয়া জনগোষ্ঠী একটা মানসিক তৃপ্তি লাভ করবেন— “This will bring a psychological solution for the Assamese.” প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীযুক্ত কে সি পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মন্ত্রীমহোদয়ও সেই পুরনো প্রশ্ন তুললেন যেমন তাঁকে কংগ্রেসি বিরাদরিরা শুনিয়েছেন, “কাছাড় আলাদা হলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের কী হবে?” যেন ওই উপত্যকার বাঙালিদের রক্ষা করার দায়িত্ব কাছাড়ের। ডিমান্ড কমিটি এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে বললেন, “আমরা কথা বলছি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। বলি, রাজ্যের একটা বিশেষ উপত্যকার নিরাপত্তার দায়িত্ব কি কাছাড়বাসীর, না কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের?” এরা মন্ত্রীকে পালটা প্রশ্ন করে বসলেন, “আমরা কি জানতে পারি, দিল্লিতে বসবাসকারী বাঙালিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের না কোনও বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ ভাষিকগোষ্ঠীর?”

পরিতোষ-টিম সেদিন একেবারে প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন। সহজেই ওঁরা স্বরাষ্ট্রসচিবেরও আরও কয়েকটি জটিল প্রশ্নের মোকাবিলা করলেন। বিব্রত মন্ত্রীমহোদয় এতে খুব একটা যে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তাও নয়। তিনি খুশি হয়েই বলে দিলেন, “ডু নট ওয়ারি, হ্যাভ পেশেন্স। থোড়া ঠেরো, কর দেয়গা সেপারেট।”

এর একমাস সাতদিন পর ৪ জানুয়ারি, ১৯৭৩ মহীতোষ পুরকায়স্থের নেতৃত্বে কাছাড়ের কংগ্রেস এমএলএ এবং এমপিদের ১৭ জনের একটি প্রতিনিধিদল পুনরায় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বসলেন। কিন্তু হায়, কাছাড়ের ভবিষ্যৎকে একেবারে অনিশ্চিতির মধ্যে রেখে একেবারে শূন্য হাতে এঁরা ফিরে এলেন। কে সি পন্থ তো ইতিপূর্বে বলেইছিলেন আলাদা করে দেবেন। কিন্তু আজ এঁরা যে একবাক্যে বলে দিলেন “সেপারেশন ইজ নো সলিউশন।” অসমিয়া লবির বিরুদ্ধে অসমে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাভাষার দাবি প্রসঙ্গে পন্থজি রাখঢাক না করেই বলে দিলেন, “দেখিয়ে জি, অসম মে বাংলা নেহি হোগা, আউর কুছ মাঙ্গিয়ে।”

তাঁকে কি আর দোষ দেওয়া যায়? তিনি তো কাছাড়কে আলাদা করে দিয়ে অসম সমস্যার স্থায়ী সমাধানই চেয়েছিলেন।

বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধি, কে সি পন্থের পাশে মইনুল হক চৌধুরীও ছিলেন। কী বিভ্রান্তিতে পড়ে কংগ্রেসিরা প্রস্তাবটি নাকচ করলেন কে জানে! অবশ্য এখানেও একটা ধর্ম-জাতিভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ভাবনাও অন্তর্লীন ছিল। আলাদা হলে ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে এদের মধ্যেও স্পষ্টতার অভাব ছিল।

কাছাড় সেপারেশনের একজন জোরালো দাবিদার মৌলানা আব্দুল জলিল সাহেব এসব দেখে পূর্বাপর চুপ করে বসে রইলেন। মহীতোষ পুরকায়স্থর বোধহয় সম্বিত ফিরে এসেছে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর। এখন তো যখন সব শেষ। বিমূঢ মহীতোষবাবু তাঁকে বললেন, “কিতা রে বা মৌলানা, তুমি তো মুখ খুললায়ই না।” জলিল সাহেব রাগে দুঃখে বললেন, “অয়রেবা! আমি একলা চাইতাম সেপারেশন, আর তুমরা কইতায় ভাসানীর চর।”[1]

 

যদিও কাছাড় পৃথকীকরণের প্রশ্নে জাতপাতের রাজনীতিও প্রতিবন্ধক হিসেবে ছিল, তবুও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের কী হবে এ চিন্তা কাছাড় পৃথকীকরণে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তখন অবশ্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত নিস্পৃহ ছিলেন না, নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সরবও ছিলেন। অসমের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে তো বটেই, সমাজজীবনেও বাঙালির ছিল বিরাট ভূমিকা। কিন্তু আশির দশক থেকেই শুরু হয় অবক্ষয়। অসম আন্দোলনের পরপরই আইনজীবী‌ অধ্যাপক, স্কুলশিক্ষক, ছোট বড় মাঝারি ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী— যাঁরা গৌহাটি, নওগাঁ, তেজপুর, গোয়ালপাড়া, শিবসাগর, জোরহাট, ডিব্রুগড়ে বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন— এঁরা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকলেন। নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতে থাকলেন যার চূড়ান্ত নিদর্শন হল ১৯৯৬ সালে (১৭ মে), বিশিষ্ট নেতা কালীপদ সেনের হত্যাকাণ্ড। এসবের বিচার, তদন্ত— এর কোনও কথাই ওঠে না।

এই প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বিতীয় প্রজন্ম ধীরে ধীরে অসম থেকে সরে যাওয়া শুরু করলেন। এদের তৃতীয় প্রজন্মের যাঁরা দিল্লি, বেঙ্গালুরুতে পাড়ি জমানোর পরও যে সংখ্যাটি অবশিষ্ট রইল, সেই চাকুরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র বা মাঝারি ভূস্বামী— এঁরা হয়ে গেলেন একেবারে গুরুত্বহীন। এই বাঙালির ভবিষ্যৎ কী?

দেখতে দেখতে অফিস আদালতে বাঙালির সংখ্যা কমতে থাকল। রাজধানী শিলং থেকে সরে এলে বাঙালির অবস্থান আর পূর্ববৎ রইল না। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল কলেজ থেকে দলে দলে অসমিয়ারা বেরিয়ে এলে (সঙ্গতভাবেই) সিভিল সার্ভিসে, সচিবালয়ে, স্কুল কলেজে বাঙালিদের পরিসর সঙ্কুচিত হতে লাগল। বাঙালিরা ক্রমে নিজেদের উদ্বাস্তু ভাবতে শুরু করলেন, যদিও অসমে এদের পূর্বপুরুষদের অধিষ্ঠান দেশবিভাগের শতবর্ষ পূর্ব থেকেই।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, গোয়ালপাড়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমগ্র উপত্যকাতেই বাংলা স্কুলগুলির সংখ্যা কমতে লাগল। দেখতে দেখতে বাংলা লিখতে পড়তে এমনকী বাংলায় নিজের নাম লিখতে সক্ষমদের সংখ্যাও কমতে লাগল। এদের মুখে যদিও রইল বাংলা বুলি, তবু এতে স্থান পেল প্রচুর অসমিয়া শব্দ, এদের বাংলা বাক্যগুলি তৈরি হতে থাকল অসমিয়া ভাষার ধাঁচে। অনেকে নিজস্ব পদবিতে কিছু সংযোজন করে হলেন সেনডেকা, দত্তগোস্বামী ইত্যাদি। নিজেকে অসমিয়া বলে পরিচয় দিতে প্রয়াস পেলেন। (কিছু কিছু পদবি, যেমন চৌধুরী, শর্মা, দাস এগুলির একটা বিশেষ সুবিধাও আছে, এর মধ্যে ভাষিক পরিচিতিটা অস্পষ্ট থাকে)। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁরা পূর্ণ মর্যাদা সহকারে ওখানে কল্কে পাচ্ছেন না, মাঝেমাঝেই অত্যাচারিত হচ্ছেন, বিদেশি, বাঙালি বলে ভর্ৎসনা লাভও করছেন।

ক্রমে মহানগরীর বাঙালি ঘরে ঘরে বাংলা পত্রপত্রিকা, বইয়ের প্রবেশ সঙ্কুচিত হল, এবং বাঙালি চেতনা, বাংলাবোধ অন্তর্হিত হতে লাগল। বাংলা স্কুলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাঠানো বন্ধ হয়ে এল। একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী সমাজের ছেলেমেয়েরা বাংলা স্কুল ছেড়ে অসমিয়া স্কুলে গিয়ে নাম লেখাতে শুরু করল।  গৌহাটি, নওগাঁ, তেজপুর, ডিব্রুগড়, ধুবড়ি প্রভৃতি শহরে অভিজাত বাংলা স্কুলগুলি গুরুত্বহীন হতে হতে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলল। এমতাবস্থায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আত্মপ্রকাশ করল নতুন প্রজাতির বাঙালি। বাংলা-বাঙালি-বাঙালিত্ব বোধ হারা এ বাঙালির নিজেদের সঙ্কটের স্বরূপ উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জনের সব রাস্তাই ক্রমে বন্ধ হতে লাগল।

 

বরাকে মাঝেমাঝে যে সব প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে, সে খবর ওদিকে পৌঁছোলে এঁরা তেমন সাড়া দেন না, বিরক্তও হন। একষট্টির আন্দোলনে যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলেন এঁরা, বাহাত্তর এবং ছিয়াশিতে তা আর হল না।

এরই মধ্যে যাঁরা নিজস্ব উদ্যোগে সাহিত্যচর্চা করেন, লিট্‌ল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন, যাঁরা সিরিয়াস গবেষণাধর্মী লেখলেখিও করেন এদের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। আর কারও কারও কর্মে আবার উগ্রজাতীয়তাবাদের কাছে নতিস্বীকারের স্বাক্ষর স্পষ্ট।

সংস্কৃতির কথা বললে— বাঙালি গায়করা আছেন, কিন্তু বাংলা গানের গায়কের সংখ্যা কমে আসছে। পুলক ব্যানার্জির কোনও বিকল্প আর তৈরি হল না, অসমিয়া দিলীপ শর্মা রবীন্দ্রসঙ্গীতে অদ্বিতীয় হয়েই রইলেন, বাঙালির মধ্যে বিশেষ কারও আত্মপ্রকাশ ঘটল না। বরাক থেকে ওদিকে পাড়ি জমানো ভারতকণ্ঠের গলায় ধ্বনিত হল কেবলই ‘জনমে মরণে মই অসমিয়া’।

নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গানের খাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি বা আধুনিক গানের সংস্থান হলেও এ গানের বয়ান ইংরেজি বা অসমিয়া হরফেই— বাংলা লেখা তো আজকাল কারও শেখা হয় না।

ওই উপত্যকায় বাংলা শিশুকিশোর সাহিত্যের চাহিদা প্রায় শূন্য। যা কিছু আছে তা আবার আলোকপ্রাপ্ত অসমিয়া সমাজেই, যেখানে বাংলা বই, পত্রপত্রিকার চাহিদা আছে পূর্ববৎ। বাঙালি শিশুকিশোরদের হাঁদাভোদা, বাটুল দি গ্রেট, কিংবা প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর, লীলা মজুমদার— এরা অপরিচিত। হোজাই, বঙ্গাইগাও, ধুবড়ি, এবং উজান আসামেও বাঙালিদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আজ একেবারে ঝাপসা। উনিশে মে, একুশে জুলাই, পঁচিশে বৈশাখ, তেইশে জানুয়ারি বরাকে যেমন সাড়া পড়ে, ওদিকে আজকাল এসবের বালাই নেই— পাণ্ডু, মালিগাঁও, লামডিং, নওগাঁর কিছু এলাকা বাদ দিয়ে অবশ্য।

মোট কথা, যে পথ দিয়ে নিজ জাতির ভবিষ্যৎচিন্তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে সে পথ আজ বিলকুল অবরুদ্ধ।

 

তবে প্রকৃতি কোনও কিছুই শূন্য রাখে না। এদের মনোজগতে আজ অনুপ্রবেশ করেছে ভিন্নতর দর্শন— হিংসা, বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা। একটার পর একটা নির্বাচনে এবং এর পরবর্তী দিনে প্রশাসন কিংবা নীতি নির্ধারণে এর প্রকাশও দেখা যায়।

শিক্ষাপর্ষদ, প্রকাশনা পর্ষদ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্ট সর্বক্ষেত্রে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব সঙ্কুচিত। প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসে রাজধানীর জাতীয় পর্যায়ে প্যারেডে বাঙালিদের কোনও ট্যাবলো থাকে না— কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করেন কি?

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শহরগুলোতে লোকচক্ষুর অগোচরে যে ক-টি বাংলা সাইনবোর্ড রয়ে গেছিল এখন দেশপ্রেমিক সেনারা সেগুলো খুঁজে খুঁজে নামাবেন। কালো কালি নয়, সাদা জলের পোঁচ দেবেন এর ওপর। কেউ কিচ্ছুটি বলতেও পারবে না। বাঙালিদের কপালে জনসমক্ষে হাঁটু গেড়ে বসা, গালে চপেটাঘাত নিয়ে উচ্চগ্রামে ‘আই’ বন্দনাসূচক ধ্বনি উচ্চারণ করতে বাধ্য হওয়া তো আছেই। তথাপি আমরা তোমাদের সমর্থক, কারণ তোমরা শুনিয়েছ আমাদের শত্রুকে এ দেশ থেকে বিতাড়ন করবে তোমরা। ক্রান্তিকালে বুঝি কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তিনসুকিয়া, মরিয়ানি, শিলাপাথার, কোকরাঝাড়, নওগাঁ, সদিয়ায় বাঙালির এখন সেই ত্যাগ স্বীকারের পর্ব চলছে।

সেদিন টিভির পর্দায় দেখলাম এক জাতীয়তাবাদী সেনানায়ক প্রচণ্ড রেগে বলেন, বাঙালিরা নাকি রবীন্দ্রজয়ন্তী আর নেতাজিজয়ন্তীতে রাস্তায় নামেন, রূপকুঁয়র জ্যোতিপ্রসাদ, কলাগুরু বিষ্ণুরাভার জন্মদিনে বাঙালিরা নেই। এঁরা কী করে জানবেন, প্রাক্‌-স্বাধীনতাকালীন দিন থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রগতিশীল আন্দোলনের সূত্রে এঁরাই বাঙালির কাছে অধিক জনপ্রিয়? বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক জীবনেও এঁরা বন্দিত। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড, এবং গণনাট্যের বাঙালি শিল্পীদের খুব ঘনিষ্ঠজন এ দুই স্রষ্টাকে বরাকে বাঙালির পরবর্তী প্রজন্ম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রেখেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তাঁদের মূর্তি পূজিত হলেও এদের সৃষ্টি অর্থাৎ গণনাট্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গান, কবিতায় প্রতিফলিত দেশপ্রেমের ভার্সন যে আজকের জাতীয়তাবাদী শিবিরের দেশপ্রেম থেকে অনেক দূরে।

ওদিকে যারা নব্য অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন এঁরা ভাষাকে প্রায় জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মের ধ্বজাটাকেই তুলে ধরতে উৎসাহী। এ বাঙালি আজ দুই্টি আলাদা শিবিরেই বিভক্ত। মিঞাঁরা কবিতা লিখবেন, বাবুরা ছেটাবেন থু থু; বাবুরা নিত্যনতুন স্লোগানে গলা মেলাবেন, মিঞাঁরা উচ্চগ্রামে করবেন ওয়াজ; বাবুরা দলবদ্ধ হয়ে দেখতে যাবেন রক্ত গরম করা বায়োস্কোপ, মিঞাঁরা ফেসবুকে কুৎসিত ইঙ্গিত দেবেন।

মিঞাঁ-বিবিকে পুলিশ এসে ডিটেনশন ক্যাম্পে টেনে নিয়ে গেলে বাবুরা থাকবেন উদাসীন, বাবুরা পুলিশ নোটিসের ভয়ে গলায় ফাঁস লাগালে মিঞাঁরা থাকবেন চুপ। উনিশ লক্ষ বাঙালির নাম নাগরিকপঞ্জি থেকে ছিটকে গেলে উভয়পক্ষই হিসেব কষতে বসেন কতজন ‘আমরা’, আর কতজন ‘ওরা’।

বড়পেটাতে ৫ জন শহিদ হয়ে (২১ জুলাই ২০১০) সমগ্র বাঙালির নাগরিকপঞ্জিতে নামভুক্তির আবেদনে সুরাহা করে দিলেও বাঙালি একযোগে এঁদের শহিদত্ব মানতে অরাজি। এমতাবস্তায় ২৮.২ শতাংশ বাঙালির ভাষাকে ডিঙিয়ে ৪.৫৪ শতাংশ লোকের ভাষাকে রাজ্যে দ্বিতীয় সহযোগী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি (১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১) দিলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি নীরবতা পালন করে।

 

ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রথম মহড়া অবশ্য হয়ে যায় ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর, যখন ‘অসম ভাষা গৌরব’ প্রকল্পের আওতায় ২২টি ভাষিকগোষ্ঠীর সাহিত্যসংস্থার মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে মোট ৭৫ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল, ‘করপাস ফান্ডে’র সংস্থান করে বাঙালিকে এর বাইরে রেখে দেওয়া হয়। এখানেও মুগ্ধ নীরবতা! ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির কোনও ভাবান্তরও নেই। বরং স্বভাষীয় কৃপাপ্রার্থীরা উল্লাস প্রকাশ করেছেন এ জন্যেই যে, বরাক উপত্যকার প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাকেও এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে কারণ এরা নাকি একান্তই আঞ্চলিক। যে সম্মেলন নাগরিকপঞ্জি নবায়ন উপলক্ষে গোটা অসমে বাঙালিকে বিপন্ন করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির দরবারে পর্যন্ত যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অনুযোগ করতে দ্বিধা করে না (১০/১০/২০১৬); অসমিয়ার সংঞ্জা নিরূপণ করার লক্ষ্যে বিধানসভার অধ্যক্ষ প্রণব গগৈ মহোদয় যখন সংখ্যালঘুর বৈধতাকে প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে রাখতে প্রয়াসী হন, তখন যে সংগঠন বিধানসভায় উপস্থিত হয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনায় এগিয়ে যায় (২৯/০৩/২০১৫); যে সংগঠন নাগরিক আইন সংশোধন প্রকল্পে দিল্লিতে বিশেষ পার্লামেন্টারি কমিটিতে দরবার করতে যায় (২৫/১০/২০১৬), অসম চুক্তি রূপায়ণকল্পে ‘বিপ্লবকুমার শর্মা কমিশন’কে সংখ্যালঘুর বঞ্চনার সম্ভাবনার দিকটি দেখিয়ে দিতে যে সংগঠন এগিয়ে যায় (১৭/০৯/২০১৯)— সে সংগঠনকে আঞ্চলিক বলতে এই সব স্বভাষীয়ের গলা কাঁপে না। কেউ কেউ আবার পরামর্শও দেন, অর্ধশতক ধরে রাজ্যের বাঙালিসহ অপরাপর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার পরম নির্ভর হিসেবে যে অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক বৌদ্ধিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ, এখন এর নাম ‘সম্মেলন’-এর পরিবর্তে সভা-টভা জাতীয় কিছু করলে কৃপা নাকি লাভ হবে।

সে যাক গে, ২০২০ সালের ২২ মে বিধানসভায় Assamese Language Learning Learning Act পাশ করিয়ে নেওয়া হলে ওদিকের সবাই আহ্লাদে বিগলিত, আর এদিকে যাঁদের সরব হবার হক্‌ ছিল ওঁরা সঙ্গত কারণেই এরা ফুলাম গামছা কেটে মুখবন্ধনী বেঁধে সদনে বসে থাকলেন। প্রাণঘাতী মারণব্যাধির আতঙ্কের মুহূর্তে মুখ খোলার প্রশ্নই আর ওঠে না। বরাকের দুর্জনেরা কিছু বাঁকা কথা বললেও ওদিকের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজসচেতন ব্যক্তির অবশিষ্ট যাঁরা রয়েছেন এঁরাও নির্বাক। এ ‘অসমিয়া ভাষাশিক্ষা আইন-২০২০’ নিয়ে তেমন কিছু বলার থাকতে পারে না যতক্ষণ এ আইন অপর ভাষিকগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু হায়, এ আইন যে ঠিক তা-ই করতে চলেছে। রাজ্যের স্কুলগুলিতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অসমিয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়ার ফর্মান আসছে এ আইনের হাত ধরে। কাছাড়ের জন্য ১৯৬১ সালে সংশোধিত ‘রাজ্য ভাষা আইন’ ১৯৬০-কে মান্যতা দিয়েই অবশ্য এ কথাটিও জুড়ে দেওয়া হল যে ৬ষ্ঠ তফশিলের অঞ্চল এবং বরাককে এর বাইরে রাখা হল। এই ছাড়ের মধ্যে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এটা বুঝতে হলে দেখতে হয় ২০২১ সালের ১৭ মার্চ সেবা সচিব, শ্রীমতী সুরঞ্জনা সেনাপতি মহোদয়ার জারি করা নির্দেশনামাটি, যেখানে সংশোধিত ভাষা আইনের ৫ নম্বর ধারা মতে বাংলাভাষার জন্য প্রদত্ত রক্ষাকবচকে যথাস্থানে বহাল রেখেই বাংলাভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ফন্দি নিহিত। এ জটিলতা সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়। কিন্তু অসমে কি একজনও শিক্ষাবিদ অবশিষ্ট নেই যিনি বিষয়টি অনুধাবন করে সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন? (২০২১ এর মার্চ মাসে ‘দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ’ এবং ‘আরম্ভ’-তে বর্তমান লেখক এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন)। এ ক্ষেত্রেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নীরব, ওখানে জনপ্রিয় বাংলা কাগজও নীরব। কীভাবে ভাষিক অধিকার হরণ হবে এ নিয়ে অতি সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন।

 

বলছিলাম ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সব বাঙালির নিজ সন্তানকে ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সঙ্গতি নেই। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে নিন্দিত, ঘৃণিত, ডি-ভোটার হিসেবে তাড়িত বাঙালির এ সঙ্গতি থাকার কথাও নয়। এদের সন্তানরা MIL বাংলা যদি রাখতে চায় পারবে, কিন্তু নতুন এ নির্দেশ মতে Optional Assamese বিষয়টি রাখতেই হবে। এ কম্মটি সমাধা করলে অবশ্যই Advance Maths, Advance Science বিষয়গুলো আর রাখতে পারবে না। অর্থাৎ মাতৃভাষা যদি চাও তবে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশা ছাড়তে হবে। এ শর্ত বাঙালির সামনে এক ধর্মসঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এত বড় ত্যাগ স্বীকার করে ‘মোদের গরব মোদের আশা’ করার বুকের পাটা আজকের দিনে ক-টা বাঙালির আছে? বাঙালির, অর্থাৎ অসমের বাঙালির এখন নীরব হওয়ারই সময়। কোনটা তাঁর কাছে বড়? ভাষা, না অন্য কিছু?

অসমের মূল অঞ্চল অর্থাৎ কোর এরিয়া ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওঁরা নিজেরাও আজ খুব একটা চিন্তান্বিত নন। যে ক-জন চিন্তা করছেন এঁদের মেধা, বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে এঁদের অনেকেরই উদ্দেশ্য এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা খুব প্রশ্নাতীতও নয়। বিগত একটা দশক ধরে বাঙালিকে ভেতরে বাইরে বিপর্যস্ত করার চক্রান্ত, প্রশাসনিক এবং আইনি মারপ্যাচে বাঙালিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধে যে ক-জন আইনজীবী সচেষ্ট রয়েছেন এদের অন্যতম হাফিজ রশিদ চৌধুরী সহ আরও বাকি সবাই-ই বরাকমূলের। অসহায় হিন্দু মুসলমান সন্দেহজনক অভিযুক্ত বাঙালির একমাত্র অবলম্বন এঁরাই। কিন্তু এঁরা এত অসংগঠিত যে সমাজজীবনে এঁদের প্রভাব প্রায় নেই।

অ্যকাডেমিকসের দিকে তাকালে— এ রাজ্যে বাঙালির নাগরিক বৈধতা, তাদের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক ভিত্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় এবং অসমের অর্থনীতিতে বাঙালির ভূমিকা নিয়ে চিন্তাচর্চার মানুষজন আজ প্রায় নিঃশেষ। বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক বাঙালি ইতিহাসবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানীর আত্মপ্রকাশের সমস্ত সম্ভাবনাই যেন নিঃশেষ। পঞ্চাশ বা ষাট সাল পর্যন্ত সূর্যকান্ত ভুঁইয়া, হেড়ম্বকান্ত বরপুজারি, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ছত্রছায়ায় অধ্যাপকের দল তাঁদের কর্মসমাপনান্তে নিজ রাজ্যে ফিরে গেছেন, অনেকে প্রয়াত হয়েছেন। মুকুন্দমাধব শর্মা, অমরেশ দত্ত, হীরেন গোঁহাইদের দিনও বিগত। এদের উত্তরাধিকার ধারণ করার কেউ রইলেন না। বরপুজারি মহোদয়ের সুযোগ্য শিষ্য জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্য মেঘালয়কে কেন্দ্র করে উত্তরপূর্বে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান গবেষকদের নিয়ে উন্নতমানের গবেষণা কর্ম জারি রেখেছেন। এদের গবেষণার সদ্ব্যবহার করার ক্ষমতাও এ সময়ের বাঙালির কতটুকু আছে তা নিয়ে সন্দেহ।

 

১৮৭৪ সালে গভর্নর জেনারের প্রতিনিধি, চেরাপুঞ্জিস্থিত গভর্নর জেনারেলের উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিনিধি-শাসিত ৫টি জেলা নিয়ে আদি অসম যখন চিফ কমিশনার-শাসিত রাজ্যের মর্যাদা লাভ করল তখনই অসম তার exclusive identity-র সঙ্গে সমঝোতা করল— সে হল ব্রিটিশ-ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীভূত, ভারতীয় উপমহাদেশের দরজা খুলে অসমে নবযুগের সূচনা হল, ভারতবর্ষের মূলভূমির কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, মৎস্যজীবী, পেশাজীবী এবং অতঃপর শিক্ষিত চাকুরিজীবীর আত্মপ্রকাশ ঘটল অসমে। বৃহত্তর ভারতভূমির সন্তানদের আগমনে অসম মধ্যযুগের খোলস ছেড়ে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেল, শিল্পপ্রযুক্তির বিকাশ হল, স্কুলকলেজ, আইন-আদালত, ছাপাখানার আত্মপ্রকাশ ঘটল। এমতাবস্থায় নিজেদের একমাত্র ভূমিপুত্র বা খিলঞ্জিয়া ঘোষণা করে অন্যদের বহিরাগত হিসেবে দেগে দেওয়া কতটা ইতিহাসসম্মত, কতটা সংবিধানসম্মত, কতটা মানবিক— এ চিন্তা বরাকের নয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার। বরাকের ইতিহাস ভিন্ন, এবং এ ইতিহাসের সুস্পষ্ট অবয়ব বরাকবাসীর অজানাও নয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা নিজেদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতনতার প্রমাণ দিতে পারেননি— তাই এরা ‘অসমিয়া-বাঙালি’ বা ‘বাংলাভাষী অসমিয়া’ ইত্যাদি অবাস্তব পরিচিতির আশ্রয় খোঁজেন, জাতীয়তাবাদী শিবিরে ঢুকে স্বভাষীয় অপর জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করেন, এবং এমনি করে নিজেদের এক মেরুদণ্ডহীন জাতি হিসেবে পরিণত করছেন।

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি নিজেদের ভাষিক সত্তাকে অস্বীকার করে প্রলোভন বা ভয়ে ভিন্ন ভাষার আতিথ্য গ্রহণ করে বাঙালির এক বিরাট অংশ অসমিয়া ভাষিকগোষ্ঠীর জনস্ফীতি ঘটিয়ে দিয়েছিলেন (স্মর্তব্য ১৯৫১ সালের সেন্সাস কাণ্ড)। এঁদের কী পরিণাম হয়েছে তা আমরা জানি। নিজভাষা সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়েও এরা আশির দশকে হাজারে হাজারে প্রাণ হারিয়েছেন। নব্য-অসমিয়া বলে গোরেশ্বর, নেলি, গহপুরের হতভাগা কেউই রেহাই পায়নি। অর্ধশতাব্দী পর এরা এখন ঘরে ফিরতে চাইছেন। মাইকেলের ‘যা ফিরে ঘরে তুই যা-রে ফিরি ঘরে’ এখন ওদের কানে মিষ্টি সুরের অনুরণন তোলে। কিন্তু হায়! এদিকে আবার আরেক দল নব্য উন্মাদনায় ওই ওদেরই পরিত্যক্ত পথে হাঁটতে চাইছেন। ইতিহাসের কী অদ্ভুত লীলা— বাঙালির আরেকটি তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত অংশই এখন ভাবছেন, কী ক্ষতি ‘ব’য়ের পেট কেটে ‘র’ হলে, সাইনবোর্ড, রেলস্টেশন, শ্মশানঘাটে বাংলা হরফ না হলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়? মোবাইল, টেলিফোনে প্রদত্ত নির্দেশাবলি তোমার ভাষাতেই হতে হবে— এটা একটু বেশি আবদার হয়ে যাচ্ছে না কি?

ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে বরাকের তীরেও যাঁরা এসব চিন্তাকে নিজের মনের মধ্যে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এঁদের চোখ আজ অন্ধ, এঁরা আছেন ভিন্নতর এক স্বপ্নের ঘোরে। এরা অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারার গূঢ় অভিসন্ধি বুঝতে চাইছেন না। এ ধারা মতে যে একেবারে পঞ্চায়েত থেকে কেন্দ্রীয় সংসদ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিত্ব একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য (সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ) সংরক্ষিত রাখা হবে, যদিও খিলঞ্জিয়া বা আদি বাসিন্দার সংজ্ঞাটি অনির্ণীত। তবে এর আওতায় যে বাঙালি নেই এটা স্পষ্ট। আবার এ সঙ্গে রয়েছে হরিশ ব্রহ্ম কমিশনের সুপারিশ, যেখানে সমতলবাসী অর্থাৎ অ-খিলঞ্জিয়া অর্থাৎ বাঙালির জমির অধিকার কেড়ে নেওয়ার সব আয়োজনও সম্পূর্ণ।

আমাদের আশঙ্কা কেবলমাত্র ভাষা হারানোর নয়, পা রাখবার মাটি হারানোরও।

 

এটা লক্ষ করেছি বিগত শতকের সাতের দশক অবধি বরাক এবং ব্রহ্মপুত্র— দুই উপত্যকার বাঙালির মধ্যে একটা মানসিক নৈকট্য ছিল। তখনও বাংলা স্কুলগুলোর এত অবক্ষয় সূচিত হয়নি। বাঙালির মনোজগৎকে গড়ে দিতে স্কুলগুলোর বিশেষ ভূমিকা ছিল। পাঠ্যপুস্তক এবং সঙ্গে শিক্ষককূলও এক্ষেত্রে অনুকূল ভূমিকায় ছিলেন। এমন-কি বিচিত্র জনজাতিসহ অসমিয়াদের উপরও এ পুস্তকের বা শিক্ষকের ইতিবাচক প্রভাব ছিল। কিন্তু আশি-পরবর্তী দিনে সব কিছু একেবারে তছনছ হয়ে গেল। বিগত চারটি দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধ, বাঙালি-চেতনা নিষ্প্রভ হতে লাগল। বরাকে বিশ্ববিদ্যালয়-আন্দোলন, এনআরসি আন্দোলন, নাগরিক আইন সংশোধনী আন্দোলনে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির কোনও কণ্ঠ শোনা গেল না। বাঙালির নিজস্ব অস্তিত্ব জাহির করার দায়ভার পড়ল বরাক উপত্যকার উপরই। ওঁদের মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজনেরা এসব নিয়ে আর ভাবতেও রাজি নন— এঁদের পূর্বপুরুষেরা অসমে কবে এলেন, এঁরা যে সঙ্গত কারণেই অসমে ‘খিলঞ্জিয়া’ (স্থানীয় বাসিন্দা) অভিধার অধিকারী, নিজস্ব ভাষিক পরিচিতি নিয়েই যে এঁরা অসমের বৈধ নাগরিক, অসম রাজ্যে এঁদের আত্মপ্রকাশের পেছনে দেড়হাজার বছরের প্রামাণ্য (সরকার প্রকাশিত) ইতিহাসের সাক্ষ্য রয়েছে— ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শিক্ষিত, উচ্চ-শিক্ষিত বাঙালিরা এসব আর জানতে চান না, মানতেও চান না। উগ্র জাতীয়তাবাদের কাছে নতি স্বীকার করে ওদের প্রদত্ত শর্তসাপেক্ষে বরাক-ব্রহ্মপুত্র মৈত্রীর প্রচার না করে ওঁদের খুব প্রয়োজন ছিল ১৪০০ বঙ্গাব্দে যেমন বরাকে হয়েছিল তেমনি ওঁদেরও একটা ‘ইতিহাস অনুসন্ধান বর্ষ’ পালন করে নিজস্ব ইতিহাস অনুসন্ধানে তৎপর হওয়া।

কিন্তু হায়! এদের এখন অনুসন্ধান— কবে কোন অসমিয়া পণ্ডিত বাঙালিদের গুণগান করেছিলেন, অসমিয়াদের বাঙালি-বিদ্বেষের পেছনে কোন্‌ ঔপনিবেশিক চক্রান্ত কাজ করেছিল, অথবা কবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে গঞ্জনা, ব্যঙ্গ আর কৌতূক সইতে হয়েছিল, কিংবা কোথায় শ্রীচৈতন্যদেব থেকে সমকালীন বাঙালিদের বহুজনকে ’কটাক্ষে বিদ্ধ’ করেও এহেন লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া বাঙালিদের প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এ হল বাঙালি বিদ্বজ্জনের গবেষণাকৃতির মাঝে বিচ্ছুরিত কয়েকটি অগ্নিস্ফূলিঙ্গ যা থেকে আলোক নয় অন্ধকারই বিকীর্ণ হয়।

আজকাল যে দেশব্যাপী মনীষী-হাইজাকিং শুরু হয়েছে এর মধ্যে অসমও এগিয়ে আছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাঙালি পরিচিতি উহ্য রাখা, অমলেন্দু গুহর শোকসভা বা প্রয়াণলিপিতে তাঁকে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মতো কাজ দেখে ওই উপত্যকা নিশ্চুপ। জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করা বাঙালি ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার, সিনেমার নায়িকা, আর বিখ্যাত গায়কের ভাষিক পরিচিতি পালটে দেওয়া তো হয়েই গেছে।

প্রাচীন চর্যাপদর কবিকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়ায় বাঙালি আর অসমিয়াদের তৎপরতার কথা আর না-ই বললাম, ‘পদ্মাপুরাণে’র কবি নারায়ণদেবকেও appropriation করার সেই tradition আজও চলছে। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কতিপয় বাঙালিও মাঝে মাঝে সহযোগী হয়ে যান, এতেই বোঝা যায় বাঙালির বিভাজন কত স্তরে ঘটে চলেছে— কেবলমাত্র ধর্মীয় নয় আরও অনেক স্তরেও।

কথা ছিল অসমে বাঙালির ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং সমমর্যাদার ভিত্তিতে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর অবস্থিতির উপরই অসমের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। রাজ্যের অন্যতম একটি জনগোষ্ঠীকে অবদমিত করে রাখার মধ্যে যে অশনিসঙ্কেত, এটা দুই উপত্যকার বাঙালিরা যদি উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয় তবে এদের ভবিষ্যৎ খুব আশাপ্রদ হবে, এত আশাবাদী আমরা হতে পারছি কই?

 

মে, ২০২২


[1] দ্রষ্টব্য: বর্তমান লেখক রচিত ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস, ‘আলোর মানুষ’, পৃ.৫৫