Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাশ্মিরের রক্তমোচী সমস্যা

অশোক মুখোপাধ্যায়




প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও মানবাধিকার কর্মী, সেস্টাস-এর সম্পাদক

 

 

 

জেকেএলএফ নেতা ইয়াসিন মালিকের শাস্তি প্রসঙ্গে কথাটা আবার মনে পড়ল। কাশ্মিরের গত পঁচাত্তর বছরের রক্তমোচী সমস্যা জিইয়ে রাখার একটাই সহজ পথ। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে ভারত রাষ্ট্রের শত্রু চিহ্নিত করে বিচারের পালা সাজিয়ে অবশেষে জেলে ভরে দেওয়া অথবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া। কিংবা সিধা গুলি করে মেরে ফেলা। এর সুবিধা হল, রাষ্ট্র তার কাজের সমর্থনে সর্বদাই সাফাই গাইতে পারবে। আর অন্য দিকে সমস্যা যেখানে ছিল, সমাধানের মুখ থেকে আরও দূরে সরে যাবে। আর তার ফলে রাষ্ট্র সেই সমস্যা সৃষ্টিকারী ও শক্তি যোগানদায়ী কার্যকলাপের পেছনে আরও যুক্তি খুঁজে পাবে এবং আরও অস্ত্র নিয়োগ করতে পারবে। বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যেও প্রাণের চাঞ্চল্য বজায় থেকে যাবে।

এই পদ্ধতির আবিষ্কর্তা ছিল নেহরু ইন্দিরা ইত্যাদি পরিচালিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। এখন এই পদ্ধতির পেটেন্ট মালিক হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি।

কাশ্মিরকে ভারতভুক্তির সময় যে সমস্ত লিখিত আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তার সব কটাই দীর্ঘকাল আগে খেলাপি করে বিশ্বাসভঙ্গ করা হয়েছে। সেই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে কাশ্মিরিরা ভুল বা ঠিক যাই করে থাকুক না কেন, তা ছিল প্রতিক্রিয়া, ভারত রাষ্ট্রের বেইমানি ক্রিয়ার জবাবে।

কিন্তু স্টেপ জাম্প করে তাকেই দেখানো হয়েছে ক্রিয়া হিসাবে। ভারত রাষ্ট্র বন্দুকবাজ নামিয়ে আরও যা কিছু করে গেছে তাকে দেখানো হয়েছে নিতান্ত প্রতিক্রিয়া বলে। তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বিশ্বাস আস্থা আরও তলানিতে চলে গেছে। যেমনটি হওয়ার কথা।

নরেন্দ্র মোদির সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করে (ধারার কার্যকারিতা আগেই খতম হয়েছিল) রাজ্যটিকে ভেঙে তিন টুকরো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে আরও কঠোরতা দেখিয়ে ভেবেছে, ওখানে শান্তি ফিরিয়ে আনবে। এক দেশ এক আইন! সংবিধানে যে ৩৭১ নং আরও একটা ধারা আছে, যা হুবহু ৩৭০-এর অনুরূপ, এবং তা একটা দুটো নয়, এগারোটা রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য— সেই তথ্যটা মোদি সরকার, সংসদ, সংবাদ মাধ্যম এবং খাস শিক্ষিত ভাষ্যকারবৃন্দ সকলেই এক অদ্ভুত মৌনতায় ভুলে রইলেন! এক দেশ এক আইনই বটে!!

এরকম এক আইনের শাসনে যে শান্তি ফিরে আসেনি, এবং আসবেও না, কাশ্মির ফাইল্‌স সিনেমার কল্প-নির্মাণই তার বড় প্রমাণ। অর্থাৎ, অশান্তির খড়ের স্তুপে আগুনের ফুল্‌কি আরও ফেলতেই হচ্ছে। অন্তত ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত যে বিজেপি-র এটাই চুনাওয়ি ইয়োজনার অন্যতম অনুচ্ছেদ— তাতে সন্দেহ করার কারণ নেই।

সুতরাং ইয়াসিন মালিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না।

যে সমস্ত মামলার সঙ্গে মালিকের নাম যুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পুলওয়ামা হামলা। এই হামলার ছকটাই এমন ছিল যে প্রতিটি ধাপে সন্দেহ হয়, এর কতটা বাস্তব ছিল আর কতটা নাটক। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে এরকম একটা বড় মাপের ঘটনা না ঘটলে নরেন মোদির দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধান মন্ত্রী হওয়া সম্ভব ছিল কিনা তা নিয়ে এখনও তথ্যাভিজ্ঞ মহলে প্রশ্ন আছে। কোত্থেকে বিস্ফোরক ভর্তি লরি এসেছিল, কীভাবে তা সিআরপিএফ কনভয়ের কাছে অবধি পৌঁছতে পেরেছিল, সেই লরির চালকের কাছে কনভয়ের রুট কে জানিয়েছিল—এরকম আরও বহু টেরচা প্রশ্ন এখন পর্যন্ত উত্তরলাভে বঞ্চিত।

পাকিস্তান যে কাশ্মির উপত্যকায় ঘোলা জলে মাছ ধরতে সক্রিয়—এটা নতুন কোনও কথা নয়। কাশ্মিরের ভারতভুক্তির প্রশ্নের উত্থাপনই হয়েছিল পাকিস্তানেরই সামরিক আগ্রাসনের কারণে। কিন্তু পাকিস্তান কিছুই করতে পারত না যদি ভারত সরকার তার ঘোষিত ও প্রতিশ্রুত কর্তব্যগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। অস্ত্রের জোরে কাশ্মিরের কোনও জঙ্গি সংগঠনই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না—একথা যেমন সত্য, কেন না অস্ত্রের অঙ্কে তারা সর্বদাই পিছিয়ে থাকবে; অস্ত্রের জোরে বা রাষ্ট্রীয় তাকতের জোরে ভারত রাষ্ট্রও কাশ্মিরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না—সেও একই রকম সত্য, কেন না বন্দুক জেল ফাঁসি পেলেট গান কারও হৃদয়েই সাড়া জাগিয়েছে বলে আজ অবধি শোনা যায়নি।

নিরবচ্ছিন্ন চাঁদমারি অবশ্যই বানানো যায়, কিন্তু তাতে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বানানো যায় না!

কথায় বলে, যার শক্তি বেশি, তার দায়িত্বও বেশি হওয়ার কথা। কাশ্মিরের ক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্র যে এই দায়িত্বের কথাটা এত কাল ধরে ভুলে থাকতে পেরেছে, তাতে বোঝা যায়, সমস্যার সমাধান আদৌ হয়ত তার অভীপ্সা নয়। বরং কাশ্মিরের সমস্যাকে জীইয়ে রেখে তাকে ব্যবহার করে মুসলমান বিদ্বেষে হাওয়া দিয়ে বাকি দেশে ভোট প্রক্রিয়ায় সাফল্য পাওয়াটাই একটা বড় লক্ষ্য। ১৯৪৭ থেকে এযাবত।

এ যাবত এর কোনও ব্যত্যয় চোখে পড়েনি। দেখা যাক, আগামী দিনে কী ঘটে।