সত্যব্রত ঘোষ
প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা
গত ১ মে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১২তম দাদাসাহেব ফালকে চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকদের রায়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হল ডগরমণি টুডুর হাতে। পল্লব রায় পরিচালিত ‘আশা’ নামের সাঁওতালি ভাষার ছবিতে অভিনয়ের জন্য উনি এই পুরস্কারটি পেলেন।
এর আগে গত ২৯ এপ্রিল ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও Unheard India: Rare Language Films বিভাগে ‘আশা’ প্রদর্শিত হয়েছে। অনেকের মতে, এবারের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অন্যতম আকর্ষণই ছিল সাঁওতালি ভাষার এই ছবিটি। এবং তাঁরা ছবিটির পাশাপাশি আলাদা করে ডগরমণি টুডু-র অভিনয়েরও প্রশংসা করেছেন।
রায়গঞ্জের দক্ষিণ সোহারই গ্রামের পরিবেশ ও জাতীয় সড়কের পাশে থাকা একটি অনাথ আশ্রমের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল সাঁওতালি চলচ্চিত্র ‘আশা’। সেই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে বিশেষভাবে সক্ষম এক আদিবাসী তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডগরমণি টুডু। সেই তরুণীর জীবনযুদ্ধকেই নিয়ে তৈরি হয়েছে সাঁওতালি ভাষার ছবি ‘আশা’।
এই সংবাদটি নিঃসন্দেহে খুশির সংবাদ। কারণ, পুরুলিয়া জেলায় মানবাজারের মেয়ে ডগরমণি টুডুর প্রতিভাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। অর্থাৎ, ডগরমণি টুডু-র একটি সর্বভারতীয় পরিচিতি তৈরি হল। এবং প্রথম সারির একজন অভিনেতা হিসেবে ডগরমণি টুডু-র এই সম্মানপ্রাপ্তি বাংলার অন্যান্য নবীন শিল্পীদের নিজেদের প্রতিভার বিকাশে নিরন্তর পরিশ্রমে আরও উৎসাহিত করবে।
সংবাদমাধ্যমেও ডগরমণি টুডু-র এই স্বীকৃতি যথেষ্ট আলোচিত। অন্তত এটুকু তো বলাই যায়, জাতীয় ও রাজ্যস্তরে একটির পর একটি কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতার মধ্যে এই স্বীকৃতির সংবাদটি ক্ষীণ হলেও একটি আশার আলো। অথবা এভাবেও দেখা যেতে পারে যে প্রাদেশিকতার উগ্র আস্ফালনের ভিড়ে আদিবাসী সমাজের এক শিল্পী নিজের অভিব্যক্তিকে নিরুচ্চারে প্রকাশ করে জানিয়ে দিলেন ধর্মের উন্মাদনা যতই হোক না কেন, বহুত্ববাদকে এখনও ভারত উদযাপন করে।
২০০১ সালে Chando Likhon নামে প্রথম সাঁওতালি ছবি বড় পর্দায় মুক্তি পেয়েছিল। এবং পরবর্তীকালে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অসমে প্রতি বছর সব মিলিয়ে ৮-৯টি সাঁওতালি ছবি তৈরিও হয়েছে। সেগুলি সিডি ও ডিভিডি-র মাধ্যমেই স্থানীয় স্তরে সাধারণত মুক্তি পায়। রাঁচি, কলকাতা তথা অন্যান্য শহরের প্রেক্ষাগৃহে বড় পর্দায় সেই ছবি প্রদর্শন করতে হলে অবশ্য ‘Unheard India: Rare Language Films’ ধরনের একটি বিভাগ উদ্ভাবন করতে হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিতরণ এবং প্রদর্শনে ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষা সর্বার্থেই জরুরি। তাই উৎসাহ প্রদান বা ভারতে প্রচলিত অন্যান্য ভাষাগুলিতে নির্মিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে দর্শকসাধারণের পরিচয় করে দেওয়ানোর ঝুঁকি নেবেন, এমনটা অকল্পনীয়। বিশেষ করে এই সময়ে যখন হিন্দি চলচ্চিত্র (পড়ুন তামিল ছবির ডাবড ভার্সন) নিয়ে হইচইয়ের বিরুদ্ধে ‘বাংলা ভাষার ছবি দেখাতে হবে’ বলে রীতিমত ফেস্টুন, ব্যানার সহ বিক্ষোভ অনুষ্ঠান চলছে।
এই পরিসরে তা নিয়ে আলোচনা না করে বরং ডগরমণি টুডু-র স্বীকৃতি নিয়ে আরও কিছু কথা বলে এই লেখার ইতি হবে। তবে এই সুযোগে অন্য একটি সাম্পতিক সাঁওতালি ছবি নিয়ে অতি সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যেতেই পারে। ‘Dharti Latar Re Horo’, যার ইংরেজি সাবটাইটেল ‘Tortoise under the Earth’ ছবিটি ইউরেনিয়ামের প্রাচুর্যে ভরা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রেক্ষাপটে বানিয়েছেন শিশির ঝা।
প্রথম ছবিটিতেই শিশির বলতে চেয়েছেন সেই আদিবাসীদের কথা যাদের থেকে জমি ছিনিয়ে শিল্পদ্যোগীদের দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। তাঁদেরই একজনের পরিবারে নেমে আসা বিপর্যয়ের গল্প। কিন্তু পরিবেশ বা পারিবারিক বিপর্যয় নিয়ে প্রতিবাদী বা আবেগঘন মেজাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শিশির বলতে চেয়েছেন সাঁওতাল সমাজের মধ্যে, তাঁদের প্রথাবদ্ধ জীবনযাপনে এই আগ্রাসন কীভাবে সামগ্রিক বিপর্যয় ডেকে আনছে।
ডগরমণি টুডু অবশ্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শক ও বিচারকদের সম্ভ্রম আদায় করেছেন। ২০২১ সালে তৈরি ‘আশা’ ছবিটিতে পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জের আদিবাসী সমাজের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পাশাপাশি অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলতে চেয়েছেন প্রযোজক কৃষ্ণ কল্যাণী এবং পরিচালক পল্লব রায়। আমাদের সমাজে মানসিক অক্ষমতাই প্রকৃত অক্ষমতা, শারীরিক অক্ষমতা অক্ষমতা নয়। তাঁদের এই বার্তাটিকে সুচারু রূপে পর্দায় ফুটিয়ে তোলবার দায়িত্বটি ডগরমণি টুডু অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গেই করতে পেরেছেন।
সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে ডগরমণি টুডু সাঁওতালি ভাষায় গান লিখে, সুর দিয়ে গেয়ে চলেছেন নিরন্তর। তাছাড়া, সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি তাঁর সামাজিক দায়িত্বগুলি পালনেও সচেতন। নিজের শিল্পীসত্তাকে ইউটিউব চ্যানেলে ব্যবহার করে তিনি সমাজসেবামূলক বহু প্রকল্পে কাজ করেছেন। ইউটিউবার হিসেবে সাঁওতালি সমাজের উন্নয়ন তাঁর লক্ষ্য। তার পরিচয় সম্প্রতি অতিমারির কারণে লকডাউনের দীর্ঘ সময়ে আরেকবার লক্ষ্য করেছেন নেটিজেনরা। এই সময়ে বহু সাঁওতাল পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন দুইবেলা অন্ন সংস্থানের জন্য যথাসাধ্য করেছেন ডগরমণি।
সম্প্রতি একটি সাঁওতাল টিভি চ্যানেলের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। ওড়িয়া ভাষায় বিভিন্ন মিউজিক ভিডিওতেও ইদানিং তাঁকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। মাত্র বাইশ বছরের এই তরুণীর খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে গত কয়েক বছরে তাঁর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
আমরা তাঁর আরও সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করি। আমাদের বিভিন্ন জেলায় বাস করা ডগরমণি টুডু-র মতো মেয়েদের প্রতিভা এভাবেই বিকশিত হোক। তাঁদের কঠোর পরিশ্রমকে যেন কুর্নিশ জানায় শহরকেন্দ্রিক আত্মপ্রিয়তায় ভুগতে থাকা মানুষ।