শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (কংগ্রেস) না কংগ্রেসওয়ালা? এই দ্বিত্ব তুলে ধরেছেন ভারতের সংবাদমাধ্যম পাঠক্ষেত্রের প্রথম সারির শিক্ষক অধ্যাপক শশীধর নাঞ্জুনদাইয়া। ভারতের একাধিক সংবাদপত্রের প্রাক্তন সম্পাদক নাঞ্জুনদাইয়া কংগ্রেস আর কংগ্রেসওয়ালাদের মৌলিক বিভেদের কথা সাফ সাফ বলেছেন: দেশের মানুষ চায় কংগ্রেস দরকার, কিন্তু কংগ্রেসওয়ালাদের দেশের মানুষ চায় না। যেসব কংগ্রেসওয়ালা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বা লাঠি ঘোরায়, তারা কংগ্রেসের অবস্থা বা সাংগঠনিক অস্তিত্ব নিয়ে ভাবিত নয়, কারণ তারা নিজেদের গজদন্তমিনারে (অর্থাৎ বিশাল বাংলোয়) জীবনযাত্রা করে, এদের জবাবদিহি করে না কেউ। দুর্ভাগ্যবশত, এদের কার্যকলাপ ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) এদের দেশদ্রোহী বলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
নাঞ্জুনদাইয়া অকপটে বলেছেন কংগ্রেসই দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী দল। আর কংগ্রেসকে তাঁর মতো অনেকেই মনে করেন সাম্প্রদায়িকতাবাদী, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও দাঙ্গাবাজ বিজেপির একমাত্র বিকল্প। জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসকে আজ দরকার। তার মানে কংগ্রেসই পারে বিজেপির জাতীয় বিকল্প হয়ে উঠতে। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (যিনি নিজেও চেয়েছিলেন কংগ্রেস এক দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ অন্তত ১০/১৫ বছরে এক ‘কাউন্টার-ন্যারেটিভ’ গড়ে তুলে আবার বিজেপি-র বাস্তব বিকল্প গড়ে তুলুক, কিন্তু কংগ্রেসওয়ালারা কলকাঠি নেড়ে সেই প্রস্তাব নাকচ করায়) দেখিয়ে দিয়েছেন যে গত সাত-আট বছরে যেখানেই কংগ্রেস-বিজেপি নির্বাচনী লড়াই হয়েছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে কংগ্রেস হেরেছে। এটা কিন্তু রহস্যজনক। কেননা কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার বা কোনও রাজ্যের বিজেপি সরকার জনকল্যাণমূলক কাজ তো কিছু করেইনি, বরং তাদের জমানায় নিম্নবর্গীয় ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের দুর্গতি অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
কংগ্রেসই একমাত্র দল যার দেশের প্রতিটি ব্লকে সংগঠন আছে। কাজেই কংগ্রেসকে ঘিরেই বিরোধী ও সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থাশীল এক সাম্প্রদায়িকতাবাদবিরোধী সমাবেশ গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটা যেমন সত্য, তেমনি প্রাক-১৯৯০ কংগ্রেসের যে এক সর্বভারতীয় সামগ্রিক সত্তা ছিল, মণ্ডল–কমণ্ডল রাজনীতির দৌরাত্ম্যে সেই কংগ্রেস আজ খণ্ডিত। কংগ্রেস এই বিকৃত মেরুকরণের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। তবু কংগ্রেসের উপর আস্থা একেবারে নেই তা মোটেই নয়। এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা জুড়তে চাই: কংগ্রেসই একমাত্র দল যা পরোক্ষভাবেও বিজেপির (বা ভারতীয় জনসঙ্ঘের) সঙ্গে হাত মেলায়নি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বা সিপিআই(এম) ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিআইও ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বে ১৯৮৯ সালে যখন জনতা দলের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়, সেই সরকারকে বাইরে থেকে বিজেপি ও দুই কমিউনিস্ট পার্টি (তার সঙ্গে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক) সমর্থন করে। তৃণমুল কংগ্রেস, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপি, সমাজবাদী পার্টি, শিব সেনা, দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম বা ডিএমকে প্রভৃতি সব দল কোনও না কোনও সময় বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় জনতা দল কখনও বিজেপির সঙ্গে হাত মেলায়নি। উল্টোদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের-র মতো আঞ্চলিক দলগুলি সংসদে জাতীয় ভূমিকা গ্রহণ করছে, কিন্তু জাতীয় পরিস্থিতির যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তা শুধু অযৌক্তিক নয়, তা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিকল্প গড়ে তোলার পথে অন্তরায়। আঞ্চলিক দলগুলির অধিকাংশই মতাদর্শগত দিক থেকে শুধু অস্বচ্ছ নয়, অনেকাংশে সুবিধাবাদী। অথচ শিব সেনা তার অবস্থান পালটাচ্ছে, যা কৌতূহলোদ্দীপক। পর্যবেক্ষণ এবং সমালোচনার মাধ্যমে। ব্যক্তিগতভাবে, আমি পার্টির ধারণা এবং নীতির বিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে তার আদর্শের তরলতার সঙ্গে একমত: উদাহরণস্বরূপ, এটি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে, যথাযথভাবে প্রযোজ্য সময়ে অর্থনৈতিক নীতিগুলি গ্রহণ করেছে। বিপ্রতীপে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আদানি গোষ্ঠীকে (বেদান্তকেও) সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এরা মোদি-ঘনিষ্ঠ। এ কারণেই কংগ্রেসকে দরকার। সাবেক শিল্পপতিরাও আদানি-আম্বানিদের মত ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের উত্থানে বিরক্ত, শঙ্কিত। কংগ্রেসের মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তারা ফিরে পেতে চায়, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিও (আইএনটিইউসি থেকে সিআইটিইউ) তাই চায়।
কংগ্রেসের দ্রুতভঙ্গুর অবস্থার জন্য কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটা বড় অংশের অভ্যন্তরীণ কোন্দলবৃত্তি, ক্ষমতাগৃধ্নুতা ও লোভলালসাই দায়ী, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স সরকারের (২০০৪-১৪) আমলে লাগামহীন দুর্নীতি তার নজির (যদিও এখন দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলগুলি, বিজেপি থেকে সিপিআই(এম), সংবাদমাধ্যমের যোগসাজশে বেশ কিছুটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল)। এসব কারণে কংগ্রেসের আস্থাভাজনতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু আজ হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারকে হঠিয়ে এক সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থাশীল বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা অতি বাঞ্ছনীয় আর সেটা পারে কংগ্রেস, কোনও আঞ্চলিক দল নয়। অন্তত তিনটি বিরোধী দল চাইছে কংগ্রেসকে ঘিরে ব্যাপক ‘ফ্যাসিস্ট’ বিজেপি সরকারের পরিবর্তে এক জাতীয় সরকার গঠনের দিকে যেতে হবে। সেটা কতটা বাস্তব, তা কোনও সাংবাদিক বা পণ্ডিতম্মন্য কলমচির পক্ষে বোঝা বা বলা সম্ভব নয়, যদিও বেশ কিছু বরিষ্ঠ সাংবাদিক কংগ্রেসের কী করা উচিত, তার নিদান দিয়ে চলেছেন। তাঁরা কি বোঝাতে পারবেন কেন উত্তরপ্রদেশে এই বছরে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস তিন শতাংশ ভোটও পায়নি? উত্তরপ্রদেশের কি তিন শতাংশ মানুষও কংগ্রেসকে চায় না?
অনেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে (কেঊ কেউ তৃণমূলেশ্বরী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই খোয়াব দেখছেন) বিকল্প দেখছেন। এবছরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে বিপুল জয়লাভ সম্ভব করে তুলেছিল, যা গোটা দেশের হিন্দু(ত্ব) ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমতকে বিপুল উৎসাহ জুগিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতটা দায়বদ্ধ তা নিয়ে সংশয় আছে, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ তো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। যদিও অন্তত গোটা দশেক এমন কর্মসূচি রূপায়ণ করছে এই সরকার— কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যপরিষেবা, দুয়ারে সরকার ইত্যাদি— যা অন্য কোনও রাজ্য করেনি। এতদসত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করার ঝুঁকি অনেক। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি তিনি দৃষ্টিকটুভাবে অসহিষ্ণু (যেমন নির্বাচিত বিধায়ক/সাংসদদের কার্যত কিনে ফেলা)। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে বিপুল ব্যবধানে পরাস্ত করার প্রায় বছর খানেক আগে প্রখ্যাত চিন্তক ও প্রবন্ধকার অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার লিখেছিলেন মমতার ‘পপুলিজম’-এর কথা: “বর্ণহিন্দু পদবি সত্ত্বেও উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে নন, কোনও বংশগৌরব নেই, অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড নিদেনপক্ষে প্রেসিডেন্সিতে পড়া নয়, কোনও গডফাদার নেই, কোনও নিহত নেতার পত্নী নন, যাঁর সম্পর্কে ‘ঝিক্লাসের মেয়ে’ বলতে শুনেছি, সেই মহিলার একক উদ্যোগে সংগঠিত তত্ত্বপোষিত পিতৃতান্ত্রিক সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে আমূল নাড়িয়ে দেওয়া একটা ব্যাপার বইকি… অনেক সময় তাঁর ভাষা বুঝিনে, টিভিতে তাঁর বক্তৃতার সময় আমি প্রায়ই বোবা করে দিই, কিন্তু তাঁর ভাষা তারা (নিম্নবিত্ত) ঠিকই বোঝে।” কিন্তু অশ্রুদা এটাও বলেন, “এই পপুলিজমের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বীজ নিহিত নেই, তা নয়।” তার মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (তাঁর সরকার) ফ্যাসিবাদী আচরণ করছেন, তা এখনও বলা যায় না, যদিও সিপিআই(এম), সিপিআই (রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ) ও কিছু নকশালপন্থী দল মনে করে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ও দলের নীচের তলায় ‘ফ্যাসিবাদী উপসর্গ’ ফুটে উঠেছে।
নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত কুলদীপ নায়ার ঢাকা-র ‘প্রথম আলো’ দৈনিকে একটি দূরদর্শিতাপূর্ণ উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন: “আগামী এক দশকের মধ্যে কংগ্রেস আবার ফিরে আসবে। সেটা করতে হলে তাদের নতুন নেতৃত্ব লাগবে, নতুন প্রাণশক্তি লাগবে। কিন্তু দলটির সভাপতি সোনিয়া গান্ধি পারিবারিক রাজনীতির বাইরে যেতে পারেননি, ফলে দলটি যে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।… কংগ্রেসের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তা এখন প্রকাশ্য হয়ে গেছে। দলের কর্মীদের ওপর হতাশা জেঁকে বসেছে। কংগ্রেসের অনেক পুরেনো যোদ্ধা অবশ্য সাহস করে বলেছেন, রাহুল গান্ধি ও তাঁর ঘনিষ্ঠরাই এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। কিন্তু দলের ভেতরে এমন সাহসী উচ্চারণের শেষ পর্যন্ত অকালমৃত্যু ঘটবে। সোনিয়া ও রাহুল গান্ধি দল পরিচালনা করেন। কথা হচ্ছে, তাঁরা উভয়েই ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ এখন কাদের দিকে ঝুঁকবে। তিনি (সোনিয়া গান্ধি) দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে কংগ্রেসের ফিরে আসা নিয়ে একটি অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দেন। ‘এটি দীর্ঘ এক পথ, এটা জয় করতে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়তা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আপনারা এই প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠবেন। আপনাদের সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকবে।’”
সেই দীর্ঘ পথ যেতে কত শত প্রাণ ফুরিয়ে যাবে কে জানে। স্বাধীনতোত্তর ভারতে জওহরলাল নেহরু থেকে রাজীব গান্ধির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ভারত সীমিতভাবে হলেও যে আর্থ-সামাজিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছিল, তা মোদি আমলে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আজ না হোক কাল এর বিরুদ্ধে জনমত জাগ্রত ও সোচ্চার হবে। তার জন্যে চাই হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার-বিরোধী ব্যাপক ঐক্য। সেখানে কংগ্রেসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে, কিছু কিছু আঞ্চলিক নেতা কংগ্রেসের বর্তমান সঙ্কটকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। এতে যে সুবিধে হচ্ছে বিজেপির, তা এঁরা বুঝেও বোঝেন না।