Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্পর্ধা সকল ক্ষমতার কাছেই না-মঞ্জুর

শিমূল সেন

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার

 

 

 

 

রোদ্দুর (উনি নিজে লেখেন ‘রোদ্দূর’। তা, কী এল-গেল? এই নামে নিশ্চয়ই কেউ ভোট দেয় না, রেশন পায় না, এই নামে কারুর স্বাস্থ্যসাথী নেই। মোদ্দায়: এই নামে কোনও বৈধ নাগরিক ভারত-ভূখণ্ডে বসবাস করেন কি, আমরা জানি না আদৌ। ফলে ওঁর নাম ‘রোদ্দুর’ লিখতেই বা অসুবিধে কী?) রায় হাজতে গেলেন। অবশেষে। এক দিক থেকে ভাবলে, যাওয়ারই ছিল তো। দিল্লিনিবাসী এই ইউটিউব-ব্যক্তিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা অকাদেমি পুরস্কার লাভ করার পর, একাদিক্রমে বাংলা সরকারকে, ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীকে, এবং একাধিক মন্ত্রীসান্ত্রি, আমলা ও বিদ্বজ্জনকে নিশানা করে কাঁচা গালাগাল ওগরাতে থাকেন। অবশ্যই, গাঁজা খেতে-খেতে। পরিস্থিতি গর্ভাবস্থায় চলে আসে কেকে-র মৃত্যুর অব্যবহিত পর, যখন শ্মশ্রূগুম্ফময় রোদ্দুর প্রায় ঘণ্টাখানেকের একটি মনোলগ ফেসবুকে ছাড়েন। সে ভিডিওর গোড়াতেই ওঁর স্বকল্পিত মোক্সা-রীতিতে, আধো-ইংরিজি উচ্চারণে আড়ষ্ট অভিবাদন। তারপরই, জনতাকে প্রায়-বিমূঢ় করে দিয়ে, সুভাষিত-সহযোগে ভেসে আসে অভাবিত, ‘কী দিদি, শুনতে পাচ্ছেন? ভালো তো? সব ঠিকঠাক?’

রোদ্দুর রায় গ্রেফতার হতেনই। খিস্তি দিলেও। এখন মনে হচ্ছে, সম্ভবত, না-দিলেও। কেন-না, কোনও সরকারই— অন্তত আজকের ভারতে তো বটেই— তার প্রজাকে এত দূর স্পর্ধার অনুমতি দেবে না যে সে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ‘কী দিদি, সব ঠিকঠাক তো?’ বলার সুযোগ পায়। তার ওপর, গুচ্ছের অপশব্দ। শ-কার ব-কার। প্রপস হিসেবে গাঁজা। রোদ্দুর রায়ের গ্রেফতার হওয়ারই ছিল। তিনি হয়েছেন। কেবল এটুকু খেয়াল রাখলেই হবে, যে-তেরোটি লাগসই ধারা বেচারা রোদ্দুরের সঙ্গে হুড়কো দেওয়া হল, তার অধিকাংশই ধাতে এক। জনপরিসরে বিদ্রোহের উস্কানি, ধর্মীয় ভাবাবেগ-ব্যাহত করা, চক্রান্ত-গোছের। কেবল একটি বাদে, নারী-অবমাননা।

কেকে-র মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যে ভিডিও রোদ্দুর বাজারজাত করেন, তারপর আরও বেশ কিছু ভিডিও তিনি ছেড়েছিলেন মধ্যবর্তী এক সপ্তাহে। ভিডিওগুলি ধরে ধরে পরখ করলে বোঝা যাবে, প্রতিটিতেই, সুচতুরভাবে, রোদ্দুর ধাপে-ধাপে তাঁর ‘প্রতিবাদে’র মাত্রা চড়িয়ে গেছেন। কোনও শাসকই কি কখনও চায়, স্থিতাবস্থার ভাষায় অন্তর্ঘাত হোক এতটুকু? না। কোনও ক্ষমতাই সাধে চাইবে না, প্রজাপক্ষ— যার অন্তত সতেরো মাইল নিচু পাটাতনে বসে নিয়ত করতল বিদীর্ণবৎ ‘আজ্ঞে মাননীয়া, আমাদের রিট্রিভারশিপটা কি নেবেন মাননীয়া’ জপে যাওয়ার কথা নিরন্তর, সে একই সমতলে উঠে এসে, গাঁজা বানাতে বানাতে, ভীষণই ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করবে অচানক: ‘কী দিদি, খবর ঠিকঠাক তো?’ নব্য-রাজতন্ত্রের পটভূনিকায়, হালফিলের শ্বাসরোধী দেশদুনিয়ায় এই স্পর্ধা সকল ক্ষমতার কাছেই না-মঞ্জুর। তৃণমূল সরকারও, খুব স্বাভাবিক যে তার ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু, গল্প নিছকই ক্ষমতা ও প্রতি-ক্ষমতার হয়ে থাকলে, জের এত দূর গড়াত না সম্ভবত। ইতোমধ্যেই রোদ্দুরের পক্ষে ইন্টারনেটে জনমত তৈরি হয়ে গেছে, সমর্থন আসছে মুহুর্মুহু। এরই বিপ্রতীপে, একটা সংখ্যালঘু অংশ এখনও থেকে গেছে, যারা মনে করছে এ আসলে নিতান্ত বুর্জোয়াবিলাস, দৃষ্টি-ঘোরানো, সাজানো কোনও ইস্যু। আর একটা ছোট গোষ্ঠীর মত-অনুযায়ী, যে সব নিঘিন্নে বাণী ছেড়েছেন, তার পর রোদ্দুরের সমর্থনে দাঁড়ানো মানে প্রকারান্তরে পুং-আস্ফালনসূচক ভাষায় শিলমোহর দেওয়া। এই লেখকও মনে করে, রোদ্দুর রায়ের শিল্প নিয়ে মাথা ঘামাতে বসলে ঠ্যাকায় পড়তে হবে বিস্তর। তা কদ্দূর সিরিয়াস, কতটুকু দায়িত্বজ্ঞানহীন, সেই অঙ্কও গজফিতে-সহযোগে নিক্তি মিলিয়ে দ্রুত সমাধান করে ফেলা মুশকিলের। রোদ্দুর রায় ভীষণই স্থূল (সচেতনভাবেই), মিডিওকার (হয়তো সচেতনভাবেই) এবং ক্ষেত্র-বিশেষে দগদগে ধর্ষকামী। তবু, মনে রাখা ভাল, দু-বছর আগের রবীন্দ্রগানের শুদ্ধতা-রক্ষার ধারায় (যার জেরে কলকাতাস্থিত রবীন্দ্র-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন ইস্তফা দিতে) রোদ্দুর গ্রেফতার হননি। তাঁকে আটক করার কারণ: জনপরিসরে বিদ্রোহ, হুমকি, অশান্তিতে ইন্ধন।

এখানেই পণ্ডিতরা আসল প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন, হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই। রোদ্দুর রায় এতটা বন্দিতই বা হচ্ছেন কেন? এ-রাজ্যের যুবসমাজ রোদ্দুরে এতটা মথিত এবং আকৃষ্ট কেন? আশেপাশের বিকল্পহীনতা কি তার একটা বড় কারণ? না কি তার কারণ রোদ্দুর রায়ের ভিডিওয় ব্যবহৃত কিছু পপুলিস্ট তথা লোক-নাচানো রেটরিকের হামেহাল প্রয়োগ— অপশব্দ যার অন্যতম? না-কি, এ-কারণে যে রোদ্দুর একটা আপাত-বিপন্ন নাগরিক সমাজের ছাইচাপা উৎসমুখ খুলে দিয়েছেন বহুকাল পর (হোক না অসাংবিধানিক ভাষায়)?

এমনিতে, রোদ্দুরের অনস্ক্রিন আবির্ভাবটা ভাববার, খেয়াল করার মতো। প্রায়-কর্মহীন, পরের অন্নে দিন কাবার, সঙ্গে সর্বদুখহর গাঁজা, কথায় নিষ্ফল কামজনিত ফ্রাস্ট্রেশন, মুখে হবরখত খিস্তি। নিশানা: দেশের বৃহৎ ক্ষমতাকেন্দ্র— রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্র, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী। মনে রাখা ভালো, এই ভিডিওয় রোদ্দুর বৃহৎ-বৃহৎ অ্যাবস্ট্রাক্ট প্রতিপক্ষকে নিশানা করেননি। একদম সরাসরি আক্রমণ শানিয়েছেন মমতার নামে। উপরন্তু, ব্যাঁকাচোরাতে হয়নি একটি নামও। ফিরহাদ হাকিম, বিনীত গোয়েল, মদন মিত্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়… তালিকাটা লম্বা। যে সব মুখমণ্ডলকে দিবারাত্র মহিমাময় বিজ্ঞাপিত করে, এই নব্য-রাজতন্ত্র তার জীবিকা নির্বাহ করে— তার পশ্চাদ্দেশে কিছু আলতো সেফটিপিন জুড়েছেন— যাকে মনে হয় বিরাট ক্ষমতা-হনু, ক্ষুদ্র হিসেবে দ্যাখাতে চেয়েছেন তাকে।

এ কি নেহাতই বুর্জোয়াবিলাস? চিরকালই, ক্ষমতাসেবী সচ্ছল মধ্যবিত্তশ্রেণি আশ্রয় করে থাকে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি বড়-বড় বিষয়। সে ভাবিত হয় না স্কুলের মিড ডে মিলের পাতে ডিম পড়ল কি পড়ল না, অথবা, গ্যাসের দাম ক টাকা বাড়ল বা চা-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত দাঁড়াল-মার্কা বিষয় নিয়ে। লুম্পেন প্রকাশভঙ্গির নিক্তিতে, পশ্চিমবঙ্গর অবস্থাও কি ভিন্নতর কিছু? মোটেই নয়। শ্রমবিমুখ, কর্মে অনীহাগ্রস্ত একটি প্রতিবন্ধ যুবশক্তি; রাজ্যে কোনও বিনিয়োগ নেই, শিল্প নেই— কেবল, জনকল্যাণবাদী রাজনীতির প্রসাদ চুঁইয়ে তার দিনাতিপাত হয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে, রোদ্দুর সে-ভাষাতেই কথা বলেছেন, যে ভাষায় এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা কথা বলে থাকে। রাজনৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন কোনও নায়ক হওয়ার দায় এই জনতার নেই।

রোদ্দুরের এ-হেন তীব্র, উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, এবং যুবসমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা এক বিপদঘণ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে নিঃসন্দেহে: সাবেক কনস্টিটিউশনাল, লিবারেল ও মডারেট বুলিতে এ রাজ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতার মরণকাল প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। রোদ্দুরের এই ধূমকেতুসম উত্থান, আসলে, সেই চলতি এবং চিরাচরিত রাজনৈতিক ভাষার বয়ঃসীমারই নির্দেশক। পপুলিস্ট রাজনীতির (কেন্দ্রে ও রাজ্যে উভয়তই) তীব্র প্রসারের কারণহেতু, বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত সিভিল নাগরিকের অপমৃত্যু ঘটে গেছে। ভোটার মাত্রেই এখন ক্লায়েন্ট৷ সে হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খায়, মহারানির রাজত্বে উপযাচক হয়ে মুফতে-বিলোনো ক্ষমতার আস্বাদ নেয়— লেজুড় হিসেবে থাকে সিন্ডিকেট, পাড়ার ক্লাব ও কলেজ ইউনিয়নের ক্ষমতা-দখলের আকচাআকচি। রোদ্দুরের আমদানি-করা ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি নিয়ে বিরোধিতা থাকবে। কিন্তু, কেবল ব্যক্তির তরফে ‘লাইমলাইট পাওয়ার ছুতো’-গোছের বালখিল্য যুক্তি সাজালে রোদ্দুরের গণ-মনস্তত্ত্বটিকে নিছকই অবজ্ঞা করা হয়। রোদ্দুর সরাসরি মমতার নাম নেন, কেকে-র মৃত্যুতে মমতাকে দায়ী করেন। সর্বত্র কাঁধ ও মাথা ঝুঁকিয়ে গড্ডলপ্রবাহে সম্মতি জানানোটাই এখানে দস্তুর যে!

সরকার আর নাগরিকের অন্বয় থেকে টলতে টলতে আমরা ক্রমশ নেমে এসেছি শাসক আর শাসিতের অধমর্ণ সম্পর্কে। যেখানে একপক্ষ শক্তিশালী, অন্যপক্ষ কৃপাপ্রার্থী ও নতজানু। এই দমন আর বশ্যতার বোঝাপড়া শুধু মুখের ভাষায় মিলবে না— তার সুতো খুঁড়লে দ্যাখা যাবে আমজনতার শরীরী ভাষা কিংবা পোশাকআশাকেও এই জো-হুজুর-বলা বশ্যতারীতি আচ্ছন্ন হয়ে আছে ইদানীং। প্রজার উদ্ধত শরীরী ভাষা এলোমেলো করে দেয় শাসকের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিতটুকু। রোদ্দুর-ব্যবহৃত ভাষায় ও যুক্তিপ্রয়োগে নিহিত রয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতি এক ধরনের ইররেভারেন্স। এই অশ্রদ্ধার বীজ রোদ্দুর রায়ের বচনের অতিরেক (এক্সেস)-এ। এই অতিরেক— যাকে বহু সুশীলই বলছেন ‘বাড়াবাড়ি’— শাসকের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় সরাসরি— কেন না, সাংবিধানিক নীতি-মোতাবেক গণতন্ত্রে মানুষ যতটুকু ‘বলতে পারার কথা’, আর বাস্তবে সে ‘বলতে পারে’ যতটুকু— সেই পার্থক্যেই রচিত হয় শাসনতন্ত্রের প্রতি আম-নাগরিকের আধো-অজ্ঞান সম্মতির ভিতটুকু। রোদ্দুর যে অতিরেক প্রক্ষেপ করেন তাঁর বয়ানে, তা গড়পরতা আইনি যুক্তিতে টেকে না। কিন্তু, শাসকের চাপানো নীতিমালায় রোদ্দুরের এই ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা এক আসন্ন অ্যানার্কিরই বিপদসঙ্কেত— যা সে মানবে না কোনও অবস্থাতেই। ফল? যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।

প্রশ্ন উঠবে, এবং উঠছেও— এতে কি তৃণমূল-বিরোধী কোনও সদর্থক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠবে? উত্তর, না। কিন্তু, আন্দোলন যে গড়ে উঠতেই পারে— তার জ্বালানি রোদ্দুরের এই উত্তরোত্তর গণপ্রিয়তায় খানিকটা প্রচ্ছন্ন। ভাষাব্যবস্থা শাসকের শেষ খুঁটি। ভাষা তার বিপদের জায়গাও বটে (বিপদ না হলে কি সব কাজ পণ্ড করে সুদূর গোয়া থেকে গ্রেফতার করে আনতে হত রোদ্দুর রায়কে?)। ভাষার নিয়মপূত, বিধিসিদ্ধ শৃঙ্খলা দুমড়ে গেলে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। উপরন্তু, আজকের তরুণ জনতা, যারা তৃণমূল-বিরোধী কোনও স্পষ্ট শিবিরের চাঁদোয়ার তলায় ভরসা পাচ্ছে না ততটা, তারা ভাবে অনেকটা এভাবেই। এতটাই অসংবদ্ধ, অসংলগ্ন, এলোমেলো ও বিক্ষিপ্ত। কোনও সংহত ভাবনাপট, বিপ্লবী অগ্রগমনের নীল নকশা এই ধ্বস্ত পরিমণ্ডলে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তার দরকারও নেই। ঠিক এখানেই, রোদ্দুরের এই উল্কাসম উত্থান, আসলে, এ রাজ্যের বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস-শাসিত সুশীল, নিয়মতান্ত্রিক ও যথাসম্ভব ‘সাংবিধানিক’ বিরোধী পরিসরের প্রতি এক ধরনের হুমকিও বটে। এই পক্বকেশ, কেতাবি ও গণতান্ত্রিক ঘ্যানরঘ্যানর যে অনেকেরই পোষাচ্ছে না— অনির্বাণ দে-সৃষ্ট চরিত্রটির ব্যাপক উত্থান ও জনসমর্থন কি সে-বার্তাই দিল না?

চিরকালই গণতন্ত্রে এক ধরনের প্রতিবাদ সংঘটিত হয়ে থাকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে। এ-ধরনের লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যবিহীন, যুবকযুবতী-প্রধান, ‘শৌখিন’ রাজনীতিচর্চার একটা ঐতিহ্য বহু দশকই ছিল পশ্চিমবঙ্গে৷ গত কিছু বছরে তা-ও ক্রমশ মজতে মজতে কোটি টাকার জলসা আর বহুজাতিক-প্রযোজিত কলেজ ফেস্টে পর্যবসিত। এই ধারায় রোদ্দুর নিশ্চিতভাবেই সাম্প্রতিকের অন্যতম— না কি, একমাত্র— মুখ। কিন্তু, এই ধারার বলে তাঁকে অবজ্ঞা করার মানে হয় না। রোদ্দুর সরাসরি কারাগারে গেছেন, পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেননি। রোদ্দুর যা করেছেন, তার প্রভাব অদূর ভবিষ্যতেই অশ্বডিম্ব ও শূন্যগর্ভ ঘোষিত হতে পারে। আবার, সুদূরপ্রসারী কোনও জেরও থাকতেই পারে তার।

নিওলিবারাল রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রবৈশিষ্ট্য: সে একমেটে, কনসেনসাসের রাজনীতির পয়দা করে। এখানে বিরোধিতার জায়গা থাকে না বিশেষ— কারণ গোটা ‘রাজনীতি’র বুনোটটুকুই, প্রতিস্থাপিত হয়ে থাকে ‘এথিকস’-এর মাধ্যমে। নারীর সক্ষমতার স্বার্থে দেয় পাঁচশো টাকার সরকারি নীতি যখন দলীয় রাজনীতির পপুলিস্ট প্রকরণে পরিণত হয়— হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানো ছাড়া উপায় থাকে না তখন। আজ যে রোদ্দুরের বক্তব্যের বিরোধিতাতেও এত নাগরিক মুখ খুলেছেন, তা এ-রাজ্যের ঘটনাহীন নাগরিক পরিসরে বড় স্বস্তির। আজ রোদ্দুরের পিতৃতান্ত্রিক ও ‘প্রায়-ধর্ষকামী’ ভাষার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে পার্ক স্ট্রিট বা হাঁসখালির অব্যবহিত পরেই মহানেত্রীর উক্তিগুচ্ছ— তা-ও এই অর্ধমৃত কীটদষ্ট ও দুর্গন্ধযুক্ত নাগরিক সমাজের অর্জন এবং সাফল্য৷

প্রজাতন্ত্রে ইদানীন্তন রাগ আসে কম, হ্যাহ্যাহিহিহোহো আসে বেশি। রোদ্দুর রায়ের চলচ্ছবি অনেকের angst তথা রাগের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। শিরদাঁড়া-ন্যুব্জ, প্রৌঢ় বিদ্বজ্জনে ছয়লাপ বঙ্গভূমে কিঞ্চিৎ ফিরিয়ে এনেছে রাগতে-রাগতে ও সপাটে কথা বলার স্মৃতি। এই সাফল্যের কোনও দায়, অন্তত, রোদ্দুরের নেই। জনতার সে-দায় আছে কি?

ভবিষ্যৎ বলবে।