প্রবুদ্ধ বাগচী
ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের কাজ সেরে মোবাইলটা অন করতেই টুং শব্দ করে ভেসে উঠল মেসেজটা। বাংলায় লেখা। তোমার সঙ্গে আমার এই শেষ মেসেজ। আমি চলে যাচ্ছি। বেশ খানিকটা অবাক হয়ে রুনা দ্বিতীয়বার পড়ল মেসেজটা। বাংলায় মেসেজ লিখলে অনেক সময় যুক্তাক্ষরের সমস্যা হয়। হয়েওছে। সঙ্গে হয়ে গেছে সঙগে আর যাচ্ছি ভেঙে গেছে যাচছি-তে। কিন্তু সবথেকে বড় কথা মেসেজটা এসেছে একটা অচেনা নম্বর থেকে। অন্তত যে নম্বরটা রুনার এই সদ্য কেনা মোবাইল সেটটায় সেভ করা নেই। কে পাঠাল এই মেসেজটা? সাতসকালে একটা আশ্চর্য প্রশ্নের মধ্যে আটকে গেল রুনা।
শীতের সকালে বাড়ির বাকি সবাই এখন বিছানায়। মুনাই আর মান্তু দুজনেরই স্কুলে এখন ছুটি চলছে। ওরা লেপের তলায় আরামে ঘুমোচ্ছে। আর, তাপস হয়তো অতটা গভীর ঘুমে নেই তবে বিছানাতেই আধোঘুমের ঘোরে সুখস্বপ্ন দেখছে। তবে ওকে ডেকে তুললেই যে এই কথাটা বলার ফুরসত পাওয়া যাবে এমন নয়। কারণ, বিছানা ছেড়ে উঠলেই তাপসের প্রথম গন্তব্য বাথরুম, মাঝে আর কোনও স্টপেজ নেই। প্রকৃতির ডাক মিটলে তারপর মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে ওর দিন শুরু হয়, তখন ওর সঙ্গে কথা বলা বা অন্যের কথা শোনার অবসর। ভাগ্যিস ফ্ল্যাটটা কেনার সময় দুটো টয়লেট দেখে নেওয়া হয়েছিল। নতুবা রোজ সকালে চারটে মানুষের কাজেকম্মে বেরোনোই মুশকিল হয়ে যেত!
সুতরাং রুনা ভাবল, বাকি তিনজনকে আপাতত এই প্রশ্নের সমাধানে না জড়ানোই ভালো। দুই মেয়ে আর বাবা এখন ঘুমোক। ও নিজেই বরং একটু ভেবে দেখুক ব্যাপারটা। এমনও তো হতে পারে যে মেসেজটা পাঠিয়েছে সে ভুল করে এই নম্বরে পাঠিয়ে ফেলেছে। নম্বর লেখার সময় একটা সংখ্যার এদিকওদিক হলেই তো মেসেজ ভুল নম্বরে চলে যেতে পারে। এই সম্ভাবনার পাশাপাশি রুনার মনে হল পুরনো ফোন থেকে নতুন ফোনে নম্বরগুলো ট্রান্সফার করার সময় কোনও কোনও নম্বর বাদ পড়ে যায়নি তো? এইসব বিষয় রুনা বিশেষ বোঝে না, মান্তু এসবে এক্সপার্ট। মায়ের নতুন ফোন আসার পর ওই এইসব করে দিয়েছিল। রুনার মনে হল দশ সংখ্যার মোবাইল নাম্বার সাধারণত কেউ মনে রাখে না, সবাই সেভ করে রাখা নম্বর দেখেই ফোন বা মেসেজ করে। তাহলে কোনটা আগে করা সুবিধে? পুরনো নম্বর থেকে কারও নম্বর বাদ পড়ে গেছে কি না সেটা খুঁজে বার করা অনেক সমস্যা। সব একটা একটা করে মেলাতে হবে। আর তাছাড়া মেসেজে যে কথাগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো কোনওভাবেই রুনার জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয়। এমন নয় যে কারও কোথাও যাওয়ার কথা ছিল ও সেটা রুনাকে জানানোর কথা ছিল। তাছাড়া ‘তোমার সঙ্গে আমার এই শেষ দেখা’ এই কথাটার মধ্যে একটা ব্যক্তিগত উষ্ণতা ও পরিচয়ের ছাপ আছে। কে তুমি? আমিই বা কে? আর ‘শেষ দেখা’, ‘চলে যাওয়া’ এইসব কথার মধ্যে অন্য একরকম সম্পর্কের লুকিয়ে থাকা ইশারা আছে। পনেরো বছরের ওপর দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে দুই মেয়ের মা হয়ে যাওয়ার পর রুনার কাছে এইসব তুমি আমির সংজ্ঞা ও চেহারা পাল্টে গেছে। রুনার জন্য আর কেউ কোথাও অপেক্ষা করে থাকে না। কেউ চলে গেলে রুনার বুকের মধ্যে কোনও আলোড়ন উঠবে এমন নয়। আসন্ন বিচ্ছেদের অনুষঙ্গে রুনার চোখ সজল হয়ে উঠবে বা ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে অবসাদ ছেয়ে আসবে গোটা শরীরে এমন নয়। সাড়ে আটশো স্কোয়ার ফুটের থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট, মেয়েদের স্কুল, প্রাইভেট টিউশন, তাপস আর তার নিজের একটা ছোট্ট ঘরকন্নার জগত নিয়ে রুনার তো কোনও অ-সুখ নেই।
তার চেয়ে বরং ওই নাম্বারটায় একটা ফোন লাগানো যাক। অন্তত কেউ যদি ভুল করেও মেসেজটা ওকে করে থাকে সেটা তাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। তার জীবনের তুমি আমি, চলে যাওয়া, শেষ দেখা এগুলোর সঙ্গে যে রুনার জীবন যুক্ত নয়, এটা তার জানা দরকার। তাছাড়া আজকাল অনেকে ফোনে মোবাইলে মহিলাদের বিরক্ত করে, রুনা জানে, এগুলো আইনের চোখে অপরাধ। বলা তো যায় না কার মনে কী আছে? সেক্ষেত্রে মেসেজ যে পাঠিয়েছে তার মানসিকতাটাও একটু বোঝা যাবে। তেমন বুঝলে একটু ধমক-চমকও করে দেবে রুনা। অবশ্য এমনও হতে পারে মেসেজটা যে ফোন নম্বর থেকে এসেছে সেটা হয়তো একটা মেয়ের! সে হয়তো তার গোপন প্রেমিকের কাছে পাঠাতে গিয়ে নিতান্তই ভুলে পাঠিয়ে দিয়েছে রুনার নম্বরে!
একদিক দিয়ে ভাবলে ব্যাপারটা খুব মজার। একটা সংখ্যার এদিক-ওদিকে কারও গোপনীয়তা প্রকাশ্য হয়ে যায় আর কারও কাছে। মেসেজটা আর একবার পড়ল রুনা। তারপর নম্বরটা লিখে নিল একটা টুকরো কাগজে। এর পরের কাজটা নিতান্তই সহজ, কারও সাহায্য লাগবে না। মোবাইল ফোন নামক এই বিচিত্র যন্ত্রটির বিস্তারিত খুঁটিনাটি না জানলেও এটা হচ্ছে তার একেবারে প্রাথমিক কাজ। একটা ফোন নম্বরে ফোন করা। রুনা হাতের কাগজটা দেখে দেখে বোতাম টিপতে থাকল হাতে ধরা মোবাইলের।
২.
শীতের সকাল বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেলেও তাপসের বিছানা ছেড়ে ওঠার নাম নেই। রুনা ভাবল, অফিস আছে তো, ঠিক সময়ে না উঠলেই তো শেষ মুহূর্তে সেই তাড়াহুড়ো করবে। বিছানার পাশে রুনা একবার তাপসকে ডাকল। তাপস ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কী হল? ডাকছ কেন?
–বেলা হল তো, অফিস যাবে না?
–ধুস, রোজ রোজ অফিস যেতে ভালো লাগে না!
–তাহলে আজ যেও না…
–বলছ?
–আমি কোথায় বললাম? তুমিই তো বলছ!
–ঠিকই বলেছ মাই সুইট হার্ট, আজ আর অফিস টফিস পোষাচ্ছে না।
–ন্যাকামি রাখো, পাশের ঘরে মেয়েদুটো ঘুমোচ্ছে, এখুনি উঠে পড়বে।
মশারির ধারে এসে তাপস রুনার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, আচ্ছা সাত সকালে নিজের বউকে সুইট হার্ট বলা কি ন্যাকামি? ইজ ইট জাস্টিস, ম্যাডাম!
রুনা হাত ছাড়িয়ে নেয় না। বলে, ঠিক আছে, ধরো, আমিই আজ তোমায় অফিস যেতে বারণ করছি। আজ আমাদের সঙ্গে সারাদিন কাটাবে। মেয়েদুটোরও ছুটি চলছে। ওরাও এনজয় করবে।
রুনার হাত ধরে রাখা অবস্থাতেই তাপস বলে, আর তুমি?
রুনা হাল্কা একটা হাসি মুখের ওপর ঝুলিয়ে রেখে বলল, আমিও… ইংরিজিতে যাকে বলে মি অলসো।
তাপস এই কথায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। বলল, তাহলে এটাই ফাইনাল… আজকে সিমপ্লি ডুব!
রুনা আবার হাসল। হাল্কা হাসি। বলল, মেয়েদুটো খুব খুশি হবে।
বিছানা থেকে নেমে তাপস বলল, দাঁড়াও এখনই ওদের কিছু বোলো না। আমি দিনের প্রথম কাজটা আগে করে আসি। তাপস দ্রুত পায়ে টয়লেটে ঢুকে গেল।
সকালের চা-পর্ব শেষ করতে করতেই মুনাই আর মান্তু উঠে পড়েছিল। বাবাকে হঠাৎ হাল্কা মেজাজে এই সময় মায়ের সঙ্গে টেবিলে বসে গল্প করতে দেখে মান্তু বলল, বাবা, অফিস যাবে না?
তাপসের হয়ে রুনাই জবাব দিল, না রে, তোদের বাবাকে আজ আমি আটকে দিয়েছি।
তাপস খুব কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, আসলে তোদের মা হল আমার লোকাল গার্জেন, তাই কথাটা ফেলতে পারলাম না বুঝলি!
মুনিয়া বলল, তাহলে আমরা বিকেলে কোথাও বেরোব।
মান্তু কথাটা লুফে নিয়ে বলল, অবশ্যই! আজ আমাদের বাইরে খাওয়াতে হবে বাবা।
তাপস একবার ওদের দিকে তাকাল। একবার রুনার দিকে। রুনারও ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে তাপস বলল, তথাস্তু!
ছুটির দিনে দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়া তাপসের বরাবরের স্বভাব। আজ ছুটি নয়। তবু বাড়িতে থাকা মানেই একটু দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা। ওদের ঘরে জানলার দিকে শুয়েছিল রুনা। আর অন্যদিকে তাপস। ওর মোবাইলটা বালিশের পাশেই। অফিস না যাওয়ার কথা বসকে একবার জানানো ছাড়া আজ আর ওটার ব্যবহার হয়নি। ফ্রিজের মাথায় কখনও, কখনও বিছানায় ওটা গড়াচ্ছিল। মোবাইলটারও যেন আজ ছুটির মেজাজ। কিন্তু ঘুমোবার আগে ওটা বন্ধ করা দরকার নয়তো আচমকা নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে দুপুরের এই সংক্ষিপ্ত অথচ আয়েশি নিদ্রাটুকুর বারোটা বাজিয়ে বসবে। মোবাইলটা বন্ধ করতে গিয়েই তাপসের চোখ আটকে গেল ফোনের স্ক্রিনে। একটা মেসেজ। কখন এল এটা? নম্বরটা তো চেনা নয়! কৌতূহলে মেসেজের টেক্সটটা খুলে ফেলল তাপস।
–আমি চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না।
আশ্চর্য! দশ সংখ্যার একটা নম্বর। একদম অচেনা। কে করল এই মেসেজ? তাপস খুব চিন্তায় পড়ে গেল ব্যাপারটা নিয়ে। আড়চোখে দেখল একবার রুনাকে। রুনা জানলার দিকে পাশ ফিরে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আরেকবার ভালো করে পড়ল কথাগুলো। ‘আমি চলে যাচ্ছি’— মানে? আমি কে? কার সঙ্গে দেখা হবে না? তাপসের সঙ্গে? এরকম তো কারও সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল না আজ তাপসের। ছিল কি? ভালো করে মনে করার চেষ্টা করল তাপস। না, কিছু তো মনে পড়ল না। নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে কোথাও! অন্য কারও মেসেজ চলে এল ওর কাছে? ভাবনাটাকে আর বাড়তে না দিয়ে মোবাইল অফ করে শুয়ে পড়ল তাপস। কিন্তু কী আশ্চর্য, এমন একটা পড়ে পাওয়া ছুটির দুপুরে ঠিক ঘুম এল না তাপসের।
৩.
দুই মেয়ের আবদারে বিকেলের আউটিং ঠিক হয়েছিল রাজারহাটের সদ্য চালু হওয়া ইকো পার্ক এবং সেখান থেকে ফেরত পথে নিউটাউনের নতুন শপিং মলে টুকিটাকি কেনাকাটা ও রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া। বিকেল থেকে একটানা ঘোরাঘুরির পড়ে শপিং মলে ঢুকে একটু হালকা হওয়ার দরকার হয়েছিল রুনার। বাবা আর দুই মেয়েকে একটা জামাকাপড়ের দোকানে ঢুকিয়ে ও গিয়েছিল ওয়াশরুমে। ঠিক বেরোনোর মুখেই ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যার সঙ্গে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ও ভাবতেই পারেনি। ত্রিদিব। ও অবশ্য একবারে চিনতে পারেনি। ছেলেদের আর মেয়েদের ওয়াশরুম দুটো পাশাপাশি। রুনা যখন বেরিয়ে আসছে, ত্রিদিব তখন সেদিকে যাওয়ার মুখে। কিন্তু ওকে দেখে একবারেই চিনতে পেরেছে ত্রিদিব। প্রায় কোনও ভণিতা না করেই বলল, আরে তুমি রুনা না?
রুনা প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, চিনতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ে গেল ত্রিদিবের পুরনো চেহারাটা। খুব একটা বদলায়নি। শুধু সামনের দিকে চুল একটু পাতলা হয়েছে।
ত্রিদিব খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল, কী ব্যাপার তুমি এখানে?
রুনা বলল, আমারও তো ওই একই প্রশ্ন!
ত্রিদিব বলল, আমার ভাই পেটের ধান্দা।
–মানে?
–মানে খুব সিম্পল। আমাদের কোম্পানি এই শপিং মলে খুব শিগগিরি একটা আউটলেট খুলবে। সেইসব কাজে আমায় প্রায়ই আসতে হয় এখানে। আজও তাই। তা তোমার কেসটা?
–আমারটাও ভেরি সিম্পল। কর্তা আজকে অফিসে ডুব দিয়েছে, তাই দুই কন্যার অনুরোধে আজ বিকেলের আউটিং কাম ইটিং। ওদের একটা দোকানে বসিয়ে রেখে আমি টয়লেটে এসেছিলাম।
–তা বুঝলাম। কিন্তু এতদিন পর দেখা— সে কি এই টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে দু-চারটে কথাতেই খতম করে দেবে নাকি?
–না না, মোটেও নয়। তুমি এসো আমার সঙ্গে। ওরা ওই কর্নারের দোকানটাতেই আছে।
রুনা আর ত্রিদিব শপিংমলের করিডর ধরে হাঁটতে লাগল। অনেকদিন পর।
অল্প সময়ের আলাপেই ত্রিদিবের সঙ্গে তাপসের দিব্যি জমে গেল। মুনাই ও মান্তুও মায়ের জোগাড় করে আনা এই নতুন বন্ধুকে সহজেই নতুন আঙ্কল করে ফেলল। সেই সঙ্গে জোরালো দাবি জানিয়ে ফেলল রাতের খাওয়াটা ওদের সঙ্গেই খেয়ে যেতে হবে নতুন আঙ্কলকে। ত্রিদিবের হয়তো কোনও কাজ ছিল, ও প্রথমে কিছুটা অসুবিধের কথা বললেও শেষে রাজিও হয়ে গেল। ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছিল রুনা।
কোথা থেকে যে কী হয়ে যায়! উত্তরপাড়ায় রুনার বাবা ছিলেন খুব নামকরা কমার্সের টিচার। বাড়িতে প্রচুর ছাত্র পড়তে আসত। ত্রিদিব ছিল তেমনই এক কিশোর। সে সব অনেক বছর আগের কথা। রুনার থেকে এক ক্লাস উঁচুতেই পড়ত ত্রিদিব। পরে যখন রুনা উত্তরপাড়া কলেজে বিএ পড়তে এল তখন ত্রিদিব বিকম সেকেন্ড ইয়ার। ছাত্র ইউনিয়নের কী একটা যেন পোস্ট ছিল ওর। সেই ইউনিয়নের সূত্রে পুরনো যোগাযোগের একটা নবীকরণ ঘটেছিল কলেজে। কখনও কলেজের ছাত্ররাজনীতি ছাড়িয়ে একটু বাড়তি কিছু। রুনা টের পাচ্ছিল ইশারাটা। কিন্তু ও জানত বাড়ির অমতে বেশি এগোনোটা নিরাপদ নয়। মেয়েদের তো একটা বাড়তি ইন্দ্রিয় থাকে। রুনা বুঝত ত্রিদিব ওকে একটু আলাদা করেই চায়। কাঁচা বয়সে অমন তো হয়েই থাকে। কলেজের খোলা মাঠের পাড়েই চওড়া গঙ্গা। সেখানে জোয়ারভাঁটার টান। জোয়ারে জল উঠে আসে অনেক ওপরে। তখনও ওদিকটা কংক্রিটের প্রাচীরে বাঁধানো ছিল না। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে ক্লাস অফ থাকলে গঙ্গার পাড়ে বসে দু-চারটে কথাও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু তার বেশি কিছু সাহস হয়নি রুনার। হয়তো ত্রিদিবেরও। হাজার হোক পুরনো স্যারের মেয়ে। তিন বছরের স্নাতক স্তরের দুটো বছর এই ইশারাতেই থেমে গিয়েছিল রুনার। হয়তো বয়সের কারণে সামান্য দুর্বলতার এক ক্ষীণ ধারা ফল্গু হয়ে বইত মনের ভিতর। তা আর প্রকাশ্যে এল না। ত্রিদিব বিকম পাশ করে কলেজ ছাড়ল। তার পরের বছর রুনা। এমএ-তে ভর্তি হওয়ার মতন রেজাল্ট হয়নি। অগত্যা বিএড। তার অল্প পরেই বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে জীবনের সুতো গেঁথে যাওয়া। তাপসদের কলকাতার বাড়ির যৌথ পরিবারে মুনাইয়ের জন্ম। তারপর ওদের নতুন ফ্ল্যাট হল কসবায়। মান্তু ওখানেই। মাঝখানে কখন কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। রুনার এখন ভরা সংসার। ভরা কোটালের মতো ভরা জীবনও অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভাঁটার টানে। মোহনার দিকে। অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। ত্রিদিব তেমনই এক হারিয়ে যাওয়া কচুরিপানা। আজ ওর সঙ্গে এইভাবে হঠাৎ দেখা না হলেও কিছু আসত যেত না রুনার। কবেই তো ও ভেসে গেছে জীবনের ঘেরাটোপের বাইরে।
খাওয়ার টেবিল থেকে একটু আগেই উঠে পড়ল ত্রিদিব। ওর কয়েকটা কাজ সারতে হবে বলল। ঠিকানা, ফোন নম্বর আদানপ্রদান হল। তখনই রুনা জানল, ত্রিদিব ওদের কলকাতার অফিসে আর অল্পদিনই আছে। ওর বদলির অর্ডার হয়েছে ভুবনেশ্বরে।
রুনা বলল, একদিন বাড়িতে এসো।
ত্রিদিব আসলে সেই সূত্রেই কথাটা জানাল। খুব বেশিদিন ও আর কলকাতায় নেই। এই শপিং মলে আউটলেটটা খুলে গেলেই ওর কলকাতার কাজ ফুরোবে।
তাপস বলল, হিল্লি-দিল্লি বদলি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তা আসল কাজটাই তো এখনও করে উঠতে পারেননি!
–না, তাপসদা এখনও হয়ে উঠল না।
রুনা বলল, আমরা পাত্রী খুঁজব নাকি? অভয় দাও তো চেষ্টা করে দেখি, নাহলে নিজে খুঁজে নাও এবার।
ত্রিদিব পকেট থেকে পার্স বার করে নিজের একটা কার্ড তুলে নিয়ে রুনার হাতে দিয়ে বলল, সময়টা বোধহয় পিছলিয়ে গেছে… এই নাও এটা রাখো। কী জানি তোমাদের সঙ্গে এই হয়তো প্রথম আর শেষ দেখা… কবে চলে যেতে হয় কলকাতা ছেড়ে!
মুনাই আর মান্তু হইহই করে উঠল। না, আঙ্কল তা হবে না, আমাদের বাড়ি আসতেই হবে!
আর, রুনার হঠাৎ মনে পড়ে গেল সকালের সেই আশ্চর্য মেসেজটার কথা। ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিল এতক্ষণ।
ত্রিদিব চলে গেল।
৪.
ত্রিদিব চলে যাওয়ার পরেও রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারিতে বসে টুকটাক কথা। তাপস আক্ষেপ করছিল, হঠাৎ পড়ে পাওয়া ছুটির দিনটা তাহলে শেষ হয়ে গেল! আবার কাল থেকে অফিস।
মুনাই বলল, আমাদের স্কুলের মতো তোমাদের অফিসে শীতের ছুটি দিতে পারে না!
আশ্চর্য সরল প্রশ্ন। মেয়েটা আর বড় হল না।
এদিকে রাত বাড়ছে। শীতটাও আজ খুব কম নয়। বাইরে বোধহয় ঝাপসা কুয়াশা।
রুনা বলল, এই তোমার এক বাতিক। কেন, কালকের দিনটা অফিস করলেই তো আবার শনি-রবি ছুটি।
তাপস বলে, তা অবশ্য ঠিক। তারপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তো তাহলে উঠতে হয়। এরপর রাত বেড়ে গেলে ট্যাক্সিগুলো আবার ঝামেলা করবে। চলো এবার আস্তে আস্তে ওঠা যাক।
রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল যথারীতি গাড়ির আকাল। অনেকেই রানিং ট্যাক্সির পেছনে পেছনে ছুটছে। শপিং মলের সামনের চত্বরটায় কিছু ট্যাক্সি আছে কিন্তু তারা খুশিমতো দর হাঁকছে। মিটার-ফিটার নয়, তাদের দরে গেলে তবেই তারা যাবে নয়তো নয়। কলকাতা শহরে এই ট্যাক্সিসমস্যা এখনও আর মিটল না, বেশি পয়সা খরচ করলেও সুবিধা নেই। এদিকওদিক করে রুনা আর তাপস ট্যাক্সি খুঁজছিল। রুনা বোধহয় একটা ট্যাক্সিকে পাকড়াও করেও ফেলেছিল, সেটা সামনে এসে দাঁড়াতেই কোত্থেকে ছুটে এলেন এক মহিলা। তিনি দাবি করছেন, এটা তিনিই আগে বুক করেছেন। ট্যাক্সিওয়ালা নাকি ওকেই আগে হাত নেড়েছে। রুনাও মানবে না। হাত রুনাও দেখিয়েছিল এবং ট্যাক্সিটা রুনার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলা তবু ট্যাক্সিওয়ালার ওপর খুব হম্বিতম্বি করে যাচ্ছেন। উনি ওটাতেই উঠবেন।
তাপস একটু এগিয়ে গিয়েছিল। মেয়েদুটোকেও চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে। দিনকাল ভালো নয়। ও খানিকটা দূর থেকে ঝামেলাটা টের পেয়ে রুনার দিকে এগিয়ে এল।
–কী হয়েছে রুনা ? তাপস বলে, এত ঝামেলা কীসের?
–দ্যাখো না, এত দৌড়ঝাঁপ করে এই ট্যাক্সিটা ধরে যেতে রাজি করালাম, এখন ওই মহিলা বলছেন উনিই নাকি এটা আগে বুক করেছেন! রুনা বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে।
–কে? কোথায় তিনি? তাপস জানতে চায়।
ঠিক তখনই ট্যাক্সির অপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসেন মহিলা। তাপসের মুখোমুখি। আবছা আঁধারে মহিলাকে দেখে ধন্দ লাগে তাপসের। তারপর হঠাৎই দৃষ্টি থমকে যায় তার। আরে তুমি সুব্রতা না?
মহিলা এবার সরাসরি তাপসের দিকে তাকায়। একটু নিরীক্ষা করে। তারপর বলে ওঠে, আরে তাপসদা তুমি! এখানে? কী ব্যাপার?
তাপস বলে, একই প্রশ্ন আমিও তোমায় করতে পারি কিন্তু!
–আর কী? এই শপিং-এ এসেছিলাম। ছেলের আবদারে ঘুরতে ঘুরতে দেরি হয়ে গেল। এবার তো বাড়ি ফিরতে হবে। কর্তা এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। বারবার ফোন করছে। তাই এই ট্যাক্সি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ।
রুনা এই কথাবার্তা ঠিক ধরতে পারছিল না। তাপস সেটা বুঝল। সুব্রতার দিকে তাকিয়ে বলল, তা আমার গিন্নি তো বলছে ট্যাক্সিটা ওই আগে বুক করেছে।
সুব্রতা বলল, ওরে বাবা, উনি তোমার গিন্নি! সরি সরি! আমি মাফ চাইছি।
সুব্রতা রুনার দিকে তাকায়, হাতজোড় করে নমস্কার জানায়। রুনাও। তাপস বলে, তা একটা সমাধান তো বের করতে হবে, না কি?
সুব্রতা বলে, সমাধান আবার কী? তোমরা ট্যাক্সিটা নিয়ে চলে যাও। আমি অন্য গাড়ি দেখছি।
তাপস বলে, সেটা কি ভালো দেখায়! এতদিন পরে হঠাৎ দেখা, আর তোমাদের ফেলে রেখে চলে যাব? কী বলো রুনা?
রুনা একটু থতমত খেয়ে বলে, না, না, সেটা খুব খারাপ ব্যাপার হবে। দেখুন আমি তো আপনাকে চিনি না তাই একটু খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি— প্লিজ কিছু মাইন্ড করবেন না!
–না, না, মাইন্ড করার কিছু নেই। আসলে সবারই তো এখন বাড়ি ফেরার তাড়া, সবাই গাড়ি খুঁজছে, এতে আপনার কী দোষ? সুব্রতা বেশ সপ্রতিভভাবেই বলে।
এবার তাপস মাথা গলায়। বলে, তা তোমার গন্তব্যটা কোথায় সুব্রতা? তোমায় ফেলে যেতে মন চাইছে না।
সুব্রতা বলে, আমাদের ফ্ল্যাট বাগুইহাটি, বিনোদিনী সিনেমা হলের কাছাকাছি। তারপর একটু থেমে বলে, তাপসদা তুমি কিন্তু আমায় ফেলেই চলে গিয়েছিলে একদিন, মনে পড়ে! সুব্রতার গলায় কপট অভিমানের সুর।
তাপস বলে, তাহলে তো প্রবলেম সলভড হয়েই গেল। তোমার ছেলেকে ডাকো। আর রুনা তুমিও মুনাই আর মান্তুকে ডেকে নিয়ে এসো, ওদের ওই গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি। আমরা সবাই এই গাড়িটাতেই যাব। আগে বাগুইহাটিতে সুব্রতাদের নামাব তারপর আমরা বেরিয়ে যাব।
সুব্রতা বলে, তোমাদের গন্তব্যটাও কি আমার কাছে গোপন রাখবে নাকি তাপসদা?
–নট অ্যাট অল। আমরা যাব সাউথে, কসবায়।
ছজন গাড়িতে চাপতে যেতেই এবার শুরু হল ট্যাক্সিওয়ালার ঝামেলা। ছজন চাপলে পুলিশে আটকাবে, নিতে পারব না ।
তাপস রেগে বলে, বেশি ঝামেলা কোরো না তো! পুলিশের নিয়ম মেনে তো তোমরা একেবারে উল্টে যাচ্ছ!
–না স্যার, পুলিশে ধরলেই কেস দেবে, বহুত হুজ্জুতি।
সুব্রতা বলে, কেস দিলে দেবে। তুমি এখন আর বেশি ঝামেলা পাকিও না তো, চলো। কেস দিলে আমরা বুঝব। এত রাতে কেস দেওয়ার জন্য পুলিশ বসে নেই, ছাড়ো ওসব ফালতু কথা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
–না, ম্যাডাম মুশকিল আছে। ট্যাক্সিচালক নারাজ।
তাপস বলে, শোনো তোমার কোথায় মুশকিল আমি জানি, কিছু বাড়তি চাও, তাই তো? চলো, এখন গাড়িটা ছাড়ো, আমরা ওটা পুষিয়ে দেব।
খানিকটা দরকষাকষির পর ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় ওদের। সুব্রতাকে ওদের হাউসিং-এর গেটের সামনে নামিয়ে তাপসরা বাড়ি পৌঁছায় প্রায় দশটা। আজকে শীতটাও বেশ কামড় দিচ্ছে। মা আর এক মেয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকেছে। তাপস ব্যালকনির দরজাটা ফাঁক করে একটা সিগারেট ধরায়।
পাশ করে বেরিয়ে প্রথম যে কোম্পানিটায় চাকরিতে ঢুকেছিল তাপস, সুব্রতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেখানেই। ওরও সেটা প্রথম বছর। জুনিয়র ব্যাচ বলতে যাদের বলা হত তাদের মধ্যে ওরা ছিল আটজন। তার মধ্যে ওরা তিনজন বাঙালি। ওদের সর্বভারতীয় কোম্পানিতে সারা দেশ থেকে রিক্রুটমেন্ট হয়। বাকি পাঁচজন ছিল অন্য রাজ্যের— কেরল, ইউপি, মহারাষ্ট্র এইসব। তবে তিনজন বাঙালির মধ্যে তাপস আর সুব্রতাই পশ্চিমবাংলার, অন্য ছেলেটা শুভেন্দু ছিল এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালি। খুব ভাল বাংলাও বলতে পারত না। ফলে সুব্রতার সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতাই হয়ে গিয়েছিল তাপসের। তাপসরা তখন থাকত ওদের আহিরীটোলার যৌথ পরিবারে আর সুব্রতা হাওড়া সালকিয়ায়। পার্ক স্ট্রিটে অফিস থেকে বেরিয়ে বাস বা ট্যাক্সি ধরে দুজনেই আসত আহিরীটোলা, ওখানে গঙ্গার ঘাটে লঞ্চ পেরোলেই ওপারে সালকিয়া। তাপস অনেকদিন সুব্রতাকে পৌঁছে দিত লঞ্চঘাট অব্দি। নতুন চাকরি পাওয়া ও উপার্জন করার একটা উত্তাপ তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল একটা অন্যরকম তাগিদ। সবে তো তখন জীবনের শুরু।
চাকরি পাওয়ার পর সব বাড়ির মা-বাবারাই ছেলেমেয়ের পরের সাংসারিক জীবনের কথা ভাবে। তাপস বা সুব্রতার পরিবার তার ব্যতিক্রম ছিল না। ওদের দুজনের মধ্যেও যে এ নিয়ে কিছু কথা হত না তা নয়। তবে সেটার মধ্যে এমন কিছু ছিল না যা ওদের সম্পর্কটা নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবায়। অন্তত তাপসের এমন কখনও মনে হয়নি। ফলে বছর দুয়েকের মাথায় যখন তাপস অন্য একটা কোম্পানিতে আরও ভালো একটা চান্স পেল দিল্লিতে তখন দ্বিতীয় কোনও চিন্তা ওর মাথাতেও আসেনি। ও অফারটা নিয়ে নিল। আর একদিন ফেরার পথে ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসে সুব্রতাকে জানিয়েও দিল কথাটা। সুব্রতা চুপ করে তাকিয়েছিল জানলার বাইরে। ট্যাক্সিটা শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরে যাচ্ছে আহিরীটোলার দিকে। সুব্রতাকে চুপ দেখে তাপস বলল, কিছু বললে না?
সুব্রতা সত্যিই কোনও জবাব দেয়নি সেদিন। আহিরীটোলার যেখানে পুজো হয় হয় সেখানে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ওরা। তাপসের বাড়িটা এখান থেকে হাঁটাপথে চার-পাঁচ মিনিট। তাপস বলল, আমাদের বাড়ি যাবে?
সুব্রতা মাথা নাড়ল। নেড়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে রাস্তা ধরল। তাপস পাশে পাশে আসছিল। গঙ্গার ধারে প্রাণজুড়োনো হাওয়া। লঞ্চ আসতে দেরি আছে কিছুটা। তাপস ভাবল, এই অপেক্ষার সুযোগে সুব্রতাকে আবার প্রশ্নটা করে। কিন্তু করা হয়ে উঠল না। জীবনের অনেক জরুরি মুহূর্ত বোধহয় এইভাবেই পেরিয়ে যায়, জরুরি কাজটা আর করা হয়ে ওঠে না। লঞ্চ এসে দাঁড়াল জেটিতে। সুব্রতা ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল সামনের দিকে ডেকে। তারপর তাপসের দিকে তাকিয়ে বলল, আসি। তাপসের কী যেন একটা মনে পড়ছিল না। কী একটা যেন। টুং করে ঘণ্টি বাজতেই নড়ে উঠল লঞ্চ। তাপস দেখল গঙ্গার বুকে ভেসে ভেসে ক্রমশ ছোট আর আবছায়া হয়ে যাচ্ছে সুব্রতার মুখ। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছিল সেদিন।
–আরে তুমি ঠান্ডার মধ্যে এখানে বসে আছ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!
রুনার কথায় চমক ভাঙে তাপসের। দুটো ঘরের সঙ্গে পাশাপাশি দুটো বারান্দা। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রুনা পাশের বারান্দায় এসেছে তোয়ালে মেলে দিতে। সেখান থেকেই দেখতে পেয়েছে তাপসকে। তাপস যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। হঠাৎ চমকে ওঠে। বলে, না, মানে সিগারেট খাচ্ছিলাম তো, ঘরের মধ্যে তো সব বন্ধ!
রুনা বলে, সে পর্ব মিটেছে তো?
–হুঁ, তাপস জবাব দেয়। সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল স্মৃতির এলোমেলো ছবি। হঠাৎ কেমন সুব্রতার সঙ্গে দেখা হওয়া। এইসব কথা কি রুনাকে বলা যায়?
–তাহলে এবার ঘরে এসো। রাত হয়েছে। শুতে হবে। কাল তো আর ছুটি নয়।
তাপস ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে ঘরে আসে। তারপর খাওয়ার জায়গায়। জল খেতে হবে। জলের বোতলটা থেকে জল গলায় ঢালতে ঢালতে শুনতে পায় রুনা কারও সঙ্গে কথা বলছে। এত রাতে কে ফোন করল? ঘড়ির কাঁটায় প্রায় এগারোটা। কিন্তু অতিরিক্ত কৌতূহল দেখানো কি ভালো? তাপস খাওয়ার টেবিলের পাশে চুপ করে বসে। হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায় দুপুরবেলা দেখা মোবাইলের মেসেজটার কথা। আশ্চর্য, দুপুরের পর থেকে ওটা মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার এখন মনে পড়ে গেল। ওর মোবাইলটা কোথায়? জামার পকেটে নাকি বিছানার ওপর রেখেছে? মনে করতে করতেই রুনা বেরিয়ে আসে অন্য ঘর থেকে। বলে, ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না!
–কে? তাপসের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।
–আর কে! ত্রিদিব। এতদিন পড়ে দেখা হওয়ার পর এই ভালো লাগার উত্তেজনা ও নাকি আর সামলাতে পারছে না!
–বেশ তো, ওকে একদিন আসতে বলো।
–সে তো তখনই বললাম। আমার চেয়ে তোমার মেয়েরাই তো জোরাজুরি করছিল বেশি।
–অবশ্য ও তো বদলি হয়ে যাচ্ছে, সেইরকমই বলছিল না?
–হ্যাঁ, রুনা বলে, সেইরকমই তো বলল।
–তাহলে ওকে তাড়াতাড়ি একদিন নেমন্তন্ন করো।
–দেখি। রুনা প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে যায়।
৫.
রাতে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে রুনা তাপসকে বলল, সুব্রতা বলে তোমার কোনও বন্ধু ছিল জানতাম না…. কখনও বলোনি তো!
তাপস বলে, ওই আর কি! বন্ধু আর কী? আমার আগের কোম্পানিতে কলিগ ছিল।
রুনা বলে, আগে বলোনি।
–এটা আর কী বলার মতো কথা!
–তা অবশ্য ঠিক।
তাপস বলে, সে ধরো ত্রিদিবের সঙ্গে যে তোমার আগে পরিচয় ছিল তাও তো আজকেই জানলাম। তাতে আর কী আছে?
রুনা বলে, কিছুই নেই। তবে আমি সুব্রতাকে চিনতাম একসময়। আগে ওরা উত্তরপাড়ায় থাকত না?
–হ্যাঁ, শুনেছিলাম ও গ্র্যাজুয়েশন অবধি উত্তরপাড়ায় ছিল, পরে ওর বাবা সালকিয়ায় চলে আসে… ও হো তুমিও তো উত্তরপাড়ার মেয়ে! একদম খেয়ালই ছিল না।
রুনা বলে, না, সেটা কোনও বিষয় নয়। উত্তরপাড়া জায়গাটা নেহাত ছোট নয়। তবে আমি ওকে একটা অন্য সূত্রে চিনতাম। অবশ্য আজকে একদমই চিনতে পারিনি, চেহারা অনেক পাল্টে গেছে।
তাপস বলে, আমিও তাই। আসলে আমি এই কোম্পানিতে জয়েন করে দিল্লি চলে যাওয়ার পর ওর সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। ফের যখন কলকাতায় ফিরলাম তখনও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। আর, তারপরেই তো তোমার সঙ্গে গাঁটছড়া….
রুনা বলে, হ্যাঁ, জীবন বড় আশ্চর্য। অথচ এর উল্টোটাও তো হতে পারত।
তাপস বলে, ধ্যাত, কী যে বলো না!
রুনা বলে, কেন? সম্ভাবনা! জীবন তো আসলে কতগুলো সম্ভাব্যতার যোগফল! তাই নয় কি?
–কী সব ভারী ভারী কথা বলছ? তাপস বলে। ডানহাত দিয়ে রুনাকে আলতো করে বেড় দেয়। ওকে ছোঁয়। রুনা চুপ করে থাকে। তবে বাধা দেয় না।
তাপস গাঢ় স্বরে বলে, সুইট হার্ট!
রুনা কিছু বলে না দেখে তাপস আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়। তাপসের ঠোঁট যখন রুনার গাল স্পর্শ করতে যাচ্ছে তখন রুনা বলে, জানো, আজ ভোরবেলা আমার মোবাইলে একটা আশ্চর্য মেসেজ এসেছে।
তাপস থেমে যায়। তবু ওরও মনে পড়ে যায় কথাটা। ওর কাছেও তো একটা মেসেজ এসেছে যার কোনও কিনারা করতে পারেনি ও। সেটা কি ও রুনাকে বলবে? ঠিক বুঝতে পারে না তাপস। মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তাপসের। ও ঠিক কথা খুঁজে পায় না।
রুনা বলে, বোধহয় ভুল করে।
তাপস চুপ। ওর ঠোঁট থেমে থাকে রুনার গালের খুব কাছে। ও। ত্রিদিব। সুব্রতা। রুনা। সম্ভাব্যতা? শীতরাত্রি ঘন হয়ে নামতে থাকে শহরে। দূরে কোথাও টায়ার ফাটার শব্দ হয়। কয়েকটা কুকুর চেঁচিয়ে জানান দেয়। অনর্থক। রাত বাড়ে মশারির ভিতর।