Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুনগুনের জ্যান্ত টিয়ে ও কেশবতীর বিবাহ

গুনগুনের জ্যান্ত টিয়ে ও কেশবতীর বিবাহ | আহমেদ খান হীরক

আহমেদ খান হীরক

 

গুনগুনের জ্যান্ত টিয়ে

মন খারাপ গুনগুনের। বাবার কাছে সে-ই কবে থেকে একটা পাখি চেয়ে আসছে সে। যে পাখিটার চোখ আছে, ঠোঁট আছে, আর আছে ডানা। বাবা গতরাতেই ফিরেছে একটা পাখি নিয়ে। পাখিটা একটা সবুজ টিয়ে। পাখিটার চোখ আছে ঠোঁট আছে এমনকি ডানাও আছে। কিন্তু পাখিটা তাকায় না, ডাকে না, উড়তেও পারে না। পাখিটা প্লাস্টিকের। বাবার মাথায় যে এত বুদ্ধি কম গুনগুন বুঝতেও পারেনি। এখন এই প্লাস্টিকের টিয়ে নিয়ে গুনগুন কী করবে?

গুনগুন ভেবেছিল পাখিকে তার ফ্রেন্ড বানাবে। তার সাথে কথা বলবে, ইচ্ছে হলে গানও গাইবে। কিন্তু এই প্লাস্টিকের পাখিটা নড়ে না, চড়ে না, ওড়ে না! গুনগুনের কান্না চলে আসে। পাখিটাকে বিছানায় ছুড়ে দিয়েই গুনগুন বারান্দায় চলে যায়। তার চোখ ছাপিয়া কান্না।

বারান্দায় ছোট্ট একটা আকাশ। আকাশে কোনও পাখি নেই। ইশ, আকাশ থেকে একটা পাখি এসে বসত যদি বারান্দায়! উঠত যদি ডেকে। বলত যদি, হ্যালো গুনগুন, কেমন আছ?

ইশ, এমন যদি হত!

এমন সময় কে যেন সত্যি সত্যি ডেকে উঠল। বলল, অ্যাই মেয়ে, তুমি আমাকে ছুড়ে ফেললে কেন?

গুনগুন ফিরে তাকাল। আরে ওই প্লাস্টিকের টিয়েটা। বারান্দায় দাঁড়ানো! বেশ রাগী রাগী চোখে, ডানা দুটো কোমরে উঠিয়ে, গুনগুনকে দেখছে। গুনগুন অবাক হয়ে বলল, কী, তুমি হাঁটতে পারো?

–পারি না আবার? না পারলে বিছানা থেকে এখানে এলাম কীভাবে?
–মানে তুমি জ্যান্ত পাখি?
–কী মুশকিল! জ্যান্ত না হলে তোমার সাথে কথা বলছি কীভাবে?
–কিন্তু বাবা যে বলল তুমি প্লাস্টিকের?
–ধুর, বাবারা কিছু জানে নাকি বোকা? আর তুমিও বাবাকে এসব বলতে যেও না! বাবারা খুব বোকা তো এসব বিশ্বাস করে না!
–তাহলে তুমি খেলবে আমার সাথে, গান গাইবে, কথা বলবে? আচ্ছা তুমি উড়তে পারো?
–পারি না আবার?

বলেই টিয়েটা ফড়ফড় করে উড়তে লাগল। উড়ে বারান্দায় গ্রিলে গিয়ে বসল। হাততালি দিয়ে উঠল গুনগুন। টিয়েটা এবার গুনগুনের কাঁধে এসে বসল। বলল, কী গান শুনবে বলো?

–টুইংকেল টুইংকেল পারো?
–ধুর, ওইটা তো ওল্ড গান! নতুন কিছু গাই?
–গাও!

টিয়েটা গলাখাকারি দিল। তারপর অদ্ভুত সুরের একটা গান গাইতে শুরু করল। এমন সুর কখনও শোনেনি গুনগুন। গুনগুনের ইচ্ছা হল একবার জিজ্ঞেস করে টিয়েটা এমন অদ্ভুত গান কোথায় শিখল? কিন্তু গানের সুরে এতই হারিয়ে গেল যে কিছুই মনে থাকল না।

 

২.

রাতের বেলা বাবা ফিরলেন খাঁচা নিয়ে। খাঁচায় ভরা এক টিয়ে। জ্যান্ত। কিন্তু টিয়েটা ডাকে না, ওড়ে না, ঠিকমতো তাকায়ও না। টিয়েটাকে দেখেই গুনগুনের মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, বাবা, টিয়েটা ছেড়ে দাও।

–ছেড়ে দিব? তুই না টিয়ে টিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলি!
–আমার তো টিয়ে আছেই!
–আরে ওটা তো প্লাস্টিকের টিয়ে… জ্যান্ত না!

গুনগুন মুখ টিপে হাসে, বাবাকে কিছু বলে না। কিন্তু খাঁচার টিয়েটার দিকে তাকাতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। টিয়ে ডাকে না, কথা বলে না, ওড়ে না। জ্যান্ত হয়েও টিয়েটা জ্যান্ত না।

খাঁচাটা ধরে বাবাকে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল গুনগুন। তারপর খাঁচার মুখটা দিল খুলে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল টিয়েটা। গুনগুন হাসল, বাবা হাসল। উড়ে যাওয়া টিয়েটা দেখিয়ে গুনগুন বলল, এখন থেকে ওই টিয়েটা জ্যান্ত। টিয়েটা এখন উড়বে কথা বলবে গান গাইবে, তাই না বাবা?

–আর তুই? তুই খেলবি কার সাথে? গান গাইবি কার সাথে?

তখনই গুনগুনের ঘরের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত সুরের গান ভেসে এল। বাবা খুবই অবাক। বললেন, এরকম অদ্ভুত সুরে কে গান গাচ্ছে?

গুনগুন আবারও মুখটিপে হাসে। কিচ্ছু বলে না। কিন্তু গুনগুন না বললেই কি আমরা জানি না ওরকম অদ্ভুত সুরে আসলে কে গান গাইছে!

 

কেশবতীর বিবাহ

এক যে ছিল রাজা। রাজার ছিল সুন্দরী এক কন্যা! কন্যার নাম কেশবতী। কেশবতী কন্যার হল বিয়ের বয়স। রাজা ডাকল রাজঘটককে। ঘটকমশাই ও ঘটকমশাই! কন্যার যে বিয়ে দিতে হয়!

ঘটক বলল, চিন্তা কী!

এই না বলেই রাজঘটক তার ইয়াব্বড় ল্যাপটপটা খুলে ফেলল। ভেতর কত্ত পাত্রের ছবি!

ক্ষীররাজ্যের ক্ষীর রাজপুত্র তো মিষ্টিপুরের চমচম রাজপুত্তুর!

ফজলি শহরের আমজাদা তো রুইনগরীর একেবারে চ্যাংড়া ট্যাংড়াকুমার!

শত শত রাজপুত্তুর… কিন্তু কেশবতীর মুখে রা নেই। একটু হাসিও নেই। নাহ, কাউকেই তো পছন্দ হল না!

রাজঘটক বলল, সর্বনাশ!
রাজা বলল, সর্বনাশ!
পুরো রাজ্য বলল, সর্বনাশ!

তাহলে কি কেশবতীর বিবাহ হবে না!

তখনই শোনা গেল চিঁহিঁহিঁ আওয়াজ। সবাই অবাক হয়ে দেখল কেশবতী তার টগবগে ঘোড়ায়। ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। রাজা বলল, কোথায় চললে মা?

কেশবতী বলল, পাত্র খুঁজতে বাবা। না পেলে আর ফিরবই না!

কত যে মাঠ পেরোল ঘাট পেরোল কেশবতী… নদী পেরোল, পেরিয়ে এল জঙ্গল আর বন! বনের ভেতর কত্ত পশু পাখি… সবাই কেশবতীকে জায়গা করে দিল। বন পেরোতেই কেশবতী দেখল এক কাঠবেড়ালিকে। ওকে দেখেই কাঠবেড়ালিটা বলে উঠল, হেই! শুনছ! তুমি তো দেখি বেজায় সুন্দরী! তোমার সঙ্গে ফুলকুমারকে যা মানাবে না!

–ফুলকুমার কে?
–এই দেখো, চেনো না? এখান থেকে তেরো নদী পেরোলে যে তেপান্তর, ওইখানেই পাবে তাকে! ফুলের ভেতর ফুলকুমার! ওখানে গিয়ে ওকে যদি ছুঁতে পারো তুমি তাহলে সে তোমার হবে!

ঘোড়া ছোটাল কেশবতী… টগবগ টগবগ…

এক নদী দুই নদী করে একে একে শেষ হল তেরোটা নদী। আর তেরো নদীর পরেই বাগান… লাল নীল হলুদ কমলা ফুলের বাগান… এত এত ফুল! কেশবতীর চোখ জুড়িয়ে গেল। মন হারিয়ে গেল। আর তখনই দেখল হাজার হাজার ফুলের ভেতর সবচেয়ে বড় একটা সূর্যমুখীর ভেতর বসে আছে ফুলকুমার!

বাহ! ফুলের মতোই তার শোভা! কী সুন্দর হাসি… সবার চাইতে সুন্দর! কাঠবেড়ালির কথামতো কেশবতী গেল ফুলকুমারকে ছুঁতে! কিন্তু অমনি ফুলকুমার উঠে গেল মগডালে!

কী হল এটা? কেশবতী গেল রেগে। ছুঁতে গেল আবার! কিন্তু এবার আরও উঁচুতে উঠে গেল ফুলকুমার। ভীষণ রেগে গেল কেশবতী!

–আমি তোমাকে ছুঁতে পারব না?

ওপর থেকে ফুলকুমার বলল, খুব পারবে! কিন্তু তার আগে তো হাত পরিষ্কার করতে হবে!

–আমার হাত তো পরিষ্কারই, দেখো, কেমন ঝকঝকে তকতকে!
–পরিষ্কার দেখালেও পরিষ্কার থাকে না হাত। চোখে দেখা যায় না এমন জীবাণু থাকে। সেই জীবাণু থেকে ভয়ানক সব অসুখ!
–তাই নাকি?
–হুম। আগে হাত ধোও। সাবানপানি দিয়ে কচলে কচলে… আঙুল নখ সব আলাদা করে… পুরো বিশ সেকেন্ড… কত সেকেন্ড?
–বিশ সেকেন্ড।
–হুম। ভালো করে সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়ে হাতটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছলেই তুমি আমাকে ছুঁতে পারবে কেশবতী কন্যা!

ফুলকুমার যা বলল কেশবতী ঠিক তাই তাই করল। সাবানপানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে শুকনো কাপড় দিয়ে হাতটা মুছে নিল। আর তখনই কেশবতীর কেশে একটা ফুল পড়ল টুপ করে। কেশবতী হেসে উঠল। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে! সাথে সাথেই বিবাহের সানাই বেজে উঠল।