দেবকুমার সোম
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
পূর্বপ্রসঙ্গ: পুরাণকথা ও বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনা
ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাঁহার কোনও খাতির নাই। কেহ যদি উপন্যাসে ইতিহাসের সেই বিশেষ গন্ধটুকু এবং স্বাদটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া তাহা হইতে অখণ্ড ইতিহাস–উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন তবে তিনি ব্যঞ্জনের মধ্যে আস্ত জিরে-ধনে-হলুদ-সর্ষে সন্ধান করেন: মশলা আস্ত রাখিয়া যিনি ব্যঞ্জনে স্বাদ দিতে পারেন তিনি দিন, যিনি বাঁটিয়া ঘাঁটিয়া ‘একাকার করিয়া থাকেন তাঁহার সঙ্গেও আমার কোনও বিবাদ নাই; কারণ স্বাদই এ স্থলে লক্ষ্য, মশলা উপলক্ষমাত্র।[1]
১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস নিবন্ধে যে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আমরা বহু সময় দেখেছি আমাদের মান্য পণ্ডিত সমালোচকেরা ঐতিহাসিক উপন্যাস আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধিকে মান্যতা দিতে চাননি। ফলে তাঁরা ইতিহাসের ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে’ উপন্যাসের নথি যাচাই করতে চান আর সেই হিসাবেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিচার বিশ্মেষণ করে থাকেন। বিজিতকুমার দত্ত তাঁর বাংলাসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রবীন্দ্রনাথের বিচারকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘সূদূর অতীতের, সমধর্মী ও বিরোধী তথ্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি ঐক্যবদ্ধ রচনার প্রয়াসী ঐতিহাসিক উপন্যাস।’ তাঁর এই বক্তব্যকে আরও স্পষ্ট করতে তিনি বলেন:
ইতিহাসের মর্ম উৎদঘাটন করার জন্য ঔপন্যাসিক ঘটনার বিবরণে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা গ্রহণ করেন।… একটা নির্দিষ্ট কালে সত্যকে আবিষ্কার করবেন মানবজীবনের ধারাবাহিকতায়।… তিনি তথ্যের বন্ধনে বাঁধা পড়বেন না। মানবিক সংঘাতের টানপোড়েন বিশ্লেষণ করতে গেলে শিল্পীর স্বাধীনতা তাঁকে গ্রহণ করতে হবেই।[2]
কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ শব্দটার মধ্যে কিছু গোলমেলে ব্যাপার থেকেই যাচ্ছে। সেখানেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের সমগ্র সার্থকতা এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপাখ্যানের সংখ্যা কিছু কম নয়। বিভিন্ন সময় যেমন বিভিন্ন ঔপন্যাসিক বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন, ঠিক তেমনই একই ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করা হয়েছে দুই বাংলায়। এর কারণ বোধহয় এই, বাঙালি ইতিহাস-সচেতন জাত না হয়েও ইতিহাসের গল্প পড়তে বা শুনতে আনন্দ পায়।
আমরা যখন কোনও একটা বিশেষ শব্দের অর্থ বুঝতে অভিধানের শরণাপন্ন হই, তখন মোটের ওপর শব্দের একটা কাজ চালানো ধারণা আমরা পাই বটে, তবে শব্দটির গভীরতর অর্থ, দ্যোতনা সম্পর্কে পর্যালোচনা আমাদের অধরা থেকে যায়। অন্তত, এই পর্যন্ত বাংলা অভিধানে ‘ইতিহাস’ শব্দটির অর্থ আবিষ্কারে আমরা তেমন বিড়ম্বনার মুখে পড়ি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘ইতিহাস’ শব্দটির অর্থ ‘১. উপদেশপরম্পরা আধার। যাহা উপদেশপরম্পরায় আছে। লোকক্রমাগত কথা। পূর্ববৃত্তান্ত। প্রাচীন কথা। পৌরাণিক বিষয় বা উপাখ্যান।’ কাজী আবদুল ওদুদের ব্যবহারিক শব্দকোষ শব্দটির অর্থ-নিষ্পত্তি ঘটিয়েছে ‘অতীত কাহিনি; সত্য ও সুসম্বন্ধ আনুপার্বিক বিবরণ।’ সংসদ বাঙ্গলা অভিধান জানাচ্ছে ‘ইতিহাস’ শব্দটির অর্থ ‘অতীত বৃত্তান্ত, প্রাচীন কাহিনি, পুরাবৃত্ত।’ বাংলা অ্যাকাডেমি-র বাংলা বিবর্তনমূলক অভিধান জানাচ্ছে ‘১. প্রাচীন কথা, ৪. বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সভ্যতার কালানুক্রমিক বিবরণ।’ এই সবগুলি অর্থ থেকে আমরা সাধারণার্থে ইতিহাস কথার অর্থ ‘প্রাচীন কাহিনি’ এমনটাই মেনে নিতে পারি। ফলে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের যেটুকু আগ্রহ, তা ওই কাহিনির লোভে। প্রেম, বিরহ, বীরত্ব, বিদ্রোহ, শঠতা এমন সব মানবিক গুণ বা দোষগুলি মানবসমাজের জন্মলগ্ন থেকেই রয়ে গেছে। ফলে সমাজের বিবর্তনে, সভ্যতার অভিযোজনে এইসব মানবিক গুণ কিংবা দোষগুলি ভারি রকম ছাপ ফেলেছে। আমাদের আগ্রহ সেই ছাপ বা চিহ্ন আবিষ্কারে নয়, সেই ছাপ বা চিহ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাহিনিগুলোই আমাদের আকর্ষণ করে। আমরা যদি আমাদের সেই আগ্রহের জায়গাটা বন্ধ করে দিয়ে ইতিহাসের প্রেক্ষিতকে বিচার করি, তবে নিশ্চিতভাবে আমরা পথভ্রষ্ট হব।
ঐতিহাসিক উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে গিয়র্গ লুকাচ বলেছেন:
Both types of composition, however much they contrast, spring from the same feeling for genuine historicity, for real historical greatness; both endeavour to grasp in an adequate artistic form what is humanly and historically significant in the important figures of our development…. The historical novel does not differ from the novel in general… its specific problem, the portrayal of human greatness in past history, has to be solved within the general conditions of the novel.[3]
তাঁর মতে ঐতিহাসিক উপন্যাস সাধারণ অর্থে যাকে আমরা উপন্যাস বলি তেমনটাই। কারণ সেখানে অতীতকে পর্যালোচনা করতে হয় উপন্যাসের নিয়ম মেনে। এর সঙ্গে তিনি পশ্চিমের ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার কিছু সূত্র দিয়েছেন, যা হয়তো পাণ্ডিত্যের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমরা জেনে নিতে পারি। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে দীর্ঘকাল ইতিহাসের কোনও লিখিত নমুনা নেই। অশোকের শিলালিপি কিংবা প্রাচীন মুদ্রা থেকে আমরা কিছু উপাদান সংগ্রহ করতে পারি হয়তো কিন্তু ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তেমন পোক্ত হয় না। যেমন আমাদের দেশে শিশুকাল থেকে পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে দিয়ে জানানো হয় রাজা পুরুর সঙ্গে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর সক্ষাতের ঘটনাটি। কিংবা কালিদাসের কবি হওয়ার আগের বিভিন্ন মূর্খামি। এসবের পেছনে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। জনরব, জনশ্রুতি এইসব নিয়েই আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহাসিক উপন্যাস। ফলে সেখানে কষ্টিপাথরে সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই। নেই লুকাচ সাহেবের মন্তব্যকে নিপাতনে সিদ্ধ করার আয়োজন। আমাদের দেশের ইতিহাস যা অবশ্যই লিখিত, তা সুলতানি সময় থেকে প্রাপ্ত। ফলে দস্যু রত্নাকরের কবি বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনিই হয়ে ওঠে আমাদের ঐতিহাসিকের মূলধন। ফলে এখানে যেটা সবচেয়ে জরুরি, তা হল ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ। তাঁর অভিসন্ধি।
ঐতিহাসিক উপন্যাস পর্যায়ে আলোচনার সময় আমরা তার সংজ্ঞা নিরূপণের জন্য এত শব্দ ব্যয় করলাম কারণ ইতিহাসের বিকৃতি। ঐতিহাসিক উপন্যাসের নামে তথ্যের বিকৃতি মহামারির মতো বাংলা মূলস্রোতের সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রবণতা। এর আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম তিনটি উপন্যাস যথাক্রমে দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা এবং মৃণালিণীর প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর। তার মধ্যে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের বীজ স্থানিক লোকশ্রুতি নির্ভর। ফলে সেখানে ঐতিহাসিক তথ্যের যদি বিচ্যূতি ঘটে থাকে, তবে তা কাহিনির আড়ালে মিথ্যাচারে তীব্র হয় না। ‘দুর্গেশনন্দিনী’র পটভূমি ষোলো শতকে মোঘল আর পাঠান সংঘর্ষ। আবার ‘মৃণালিণী’র উপাখ্যান তেরোশো শতকে মগধে মুসলমান আক্রমণের প্রেক্ষাপটে রচিত। বঙ্কিমচন্দ্রের সারস্বত ধারণা সম্পূর্ণতই ছিল হিন্দু ধর্মের পক্ষে। তিনি ভারতবর্ষে মুসলমান শাসন মেনে নিতে পারেননি। তাদেরকে প্রায়শ ‘যবন’ (শ্লেষাত্মক অর্থে ম্লেচ্ছ বা অহিন্দু জাতি) নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর ঘটনার বর্ণনায় হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকের দৃষ্টি দেখতে পাওয়া যায়। যা সাহিত্যের বিনোদনগুণকে মর্যাদা দিলেও তথ্যগত বিকৃতি থেকে গেছে। আমাদের ঔপনিবেশিক সময়ে হিন্দু ইতিহাসবিদ এবং বহু হিন্দুত্ববাদী বৌদ্ধিক মানুষ দেশের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসকথার পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে সর্বদা যে বস্তুনিষ্ঠ ছিলেন তেমন নয়। বরং বহু ক্ষেত্রে তাঁরা তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। কতক স্বেচ্ছায়। কতক অনবধানে। বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিকে এই শ্রেণিতেই রাখতে হবে। এর ফলে একটা দীর্ঘ সময় অবধি তিনি ঔপনিবেশিক শাসকদের গুডবুকে থাকলেও দেশের মানুষ এবং আরও সঠিকভাবে বললে দেশের ইতিহাসের পক্ষে ‘সাহিত্যসম্রাট’ হিসাবে ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করেননি। আজকে ভারত উপমহাদেশে আবার সেই ঢেউ এসেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যেমন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। এবং চমৎকারভাবে রামচন্দ্রকে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসাবে আইনের আওতায় এনেছেন। তেমনই বাংলাদেশ থেকে খুব চতুরভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে হিন্দুধর্মের নাম ও নিশান। পাকিস্তান আক্ষরিক অর্থে একটি কৃত্রিম ও মৃত রাষ্ট্র। ফলে আমাদের আলোচনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবস্থান সংক্রান্ত আলোচনার কোনও অবকাশ থাকছে না। আজকের বাংলাদেশের জাতিসত্তা বাঙালি জাতিসত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। সেখানে বাংলাদেশি জাতিসত্তাই প্রধান। যার সংযোগ আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশকে তিন টুকরো করেও রাজনীতির কারবারিদের কলজে ঠান্ডা হয়নি। তারা এখন সর্বত্র চাইছেন এথেনিক ক্লিনসিং। সংখ্যালঘুর ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটন করে ফান্ডামেন্টালিস্ট রাষ্ট্র গঠনে একই সুর পরস্পর স্বার্থবিরোধী এই তিন প্রতিবেশীর। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। ফলে আফগানিস্তানের তালিবানেরা যেমন বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে তাদের অশ্লীল উল্লাস সারা বিশ্বে প্রচার করেছিল, ঠিক তেমনই তো দেশ–বিদেশের টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ‘এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’ স্লোগান তুলেছিল করসেবক নামধারী বর্বর হিন্দুত্ববাদী মানুষগুলো।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের সামারিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে ‘বাঙালি জাতীয়তা’ শব্দযুগলকে পাল্টে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তা’ এই নতুন শব্দজোড়কে সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনায় সেদিন খোন্দাকার আবদুল হামিদ লিখেছিলেন:
‘বাঙালি জাতীয়তা’ কথাটা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে ভ্রান্ত নয়, ঐতিহাসিক দিক থেকেও অবাস্তব। এমনকি, রাজনৈতিক দর্শন হিসাবেও এর অসারতা সপ্রমাণিত। ‘বাঙালি জাতীয়তা’ তাই মিসনোমার। আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তা’ বলাটাই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট বা সঙ্গত।… এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশানা-ওয়ারিশী উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, যবান-লিসান, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য-সঙ্গীত সবকিছু।[4]
সেদিন সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রকর্তারা বাংলার মূল জাতীয়তা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে শুধু বিচ্ছিন্নই করলেন না, ইসলামিক ধর্মদর্শনকেই পূর্বপুরুষ হিসাবে মান্যতা দিলেন। এর ফলে আমরা পরবর্তী সময়ে দেখলাম বাংলাদেশে সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা হচ্ছে। তাঁর জীবনধারণকে ভ্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে তিনি কতটা প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। লালন সাঁইয়ের জাত নির্ধারণে তাঁর জীবনের মূল অংশগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে প্রমাণ করা হচ্ছে লালন ছিলেন জন্মসূত্রে মুসলমান জোলার সন্তান। আরও আছে, লালন ফকিরের গান সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় নিয়ে এসে তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশ করলে বর্তমান যুগের বাংলাদেশি ইতিহাসকারেরা প্রমাণ করেন এসব আসলে চৌর্যবৃত্তি। তাঁরা নজরুলের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করেন। ফজলুল হকের নাম ও নিশান মিটিয়ে দেন। এইভাবে উনিশশো একাত্তর সালের ‘বাংলা’ মাত্র উনিশশো ছিয়াত্তর সালে পোঁছে হয়ে যায় মৌলবাদী ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসে নতুন মাত্রা এনেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা এই পর্যায়ে সংক্ষেপে দেখে নেব তাঁর রচিত উপন্যাসগুলি কতটা ঐতিহাসিকভাবে তথ্যনিষ্ঠ। শরদিন্দুর প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস কালের মন্দিরা গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্তের সময়কাল প্রেক্ষাপটে রেখে রচিত। এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণত কাল্পনিক। এখানে ঐতিহাসিক তথ্য অতি সামান্য। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস গৌড়মল্লার। এই কাহিনি রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে গৌড়বঙ্গে যে মাৎস্যন্যায় ঘটেছিল তারই ভিত্তিতে রচিত। শরদিন্দু এই লেখার ঋণস্বীকার করেছেন নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব থেকে। এই কাহিনিতে যে ঐতিহাসিক তথ্য যাচাই করে পাওয়া যায় তা হল, শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্রের আটমাস পাঁচদিনের রাজত্ব (সূত্র: মঞ্জুশ্রীমূলকল্প)। তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা উপন্যাসে ঐতিহাসিক তথ্য চেদিরাজের সঙ্গে পাল রাজাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে চেদিরাজকন্যাকে বিগ্রহপালের বিয়ে। বাকিটা ঔপন্যাসিকের কল্পনাপ্রসূত কাহিনি। কুমারসম্ভবের কবি উপন্যাসে তিনি মূর্খ কালিদাসের মহাকবি হয়ে ওঠার কাহিনি শুনিয়েছেন, যা সম্পূর্ণতই অনৈতিহাসিক। একমাত্র তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসের বিষয়ে শরদিন্দু খানিক ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। (তাঁর মন্তব্য অনুসারে রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদিত The Delhi Sultanate থেকে এই কাহিনির বিশদ তথ্য সংগৃহীত)। এত বিস্তারিত আলোচনা করা হল এই জন্য যে বাণিজ্যিকভাবে চূড়ান্ত সফল এই কাহিনিগুলির একটি ছাড়া বাকিগুলো মোটেও ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। শরদিন্দু বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ইতিহাস-আশ্রিত (?) উপন্যাস রচনা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সময়কার রাজনীতির বিষয়কে পরিহার করে মূলত রোমান্টিক উপন্যাস রচনা করে গেছেন। অধুনা মৌলবাদের প্রশয়দাতারা অনুরূপ উপন্যাস রচনা করছেন, তার মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে ধর্মান্ধতার রাজনৈতিক বিষ। বাংলা উপন্যাস পাঁকবদ্ধ ডোবায় পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ ঐতিহাসিক উপন্যাসের নামে ভুল তথ্য পরিবেশন। বিশেষত ধর্মীয় নেতাদের জীবনের ওপর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে দেখা যায় চরিত্রকে মহান প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্যের বিকৃতি এমনভাবে করা হয় যে পাঠকের সাধ্য নেই তার থেকে নিস্তারের।
অথচ, সমকালে বাংলা উপন্যাসের বিকল্প যে ধারায় ইতিহাস আশ্রিত বা ঐতিহাসিক বিষয় নির্ভর উপাখ্যান রচিত হচ্ছে, সেখানে ইতিহাসকে তার কড়ির মাশুল দিয়েই নির্মোহভাবে উপন্যাস রচনার দায় নিয়েছেন বিকল্পধারার ঔপন্যাসিকেরা। আমরা এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে রাজনগর উপন্যাস আলোচনায় অমিয়ভূষণ যে সার কথাটি বলেছিলেন, সেটা একবার স্মরণ করতে চাই:
ইতিহাসের এই এক নিয়ম, তার উপকরণ না–পেলে সংক্ষেপে বলা ভালো। আমাদের অনুমান ইতিহাস–কথাতেও সে-রকম প্রথা উচিত।… ইতিহাসের অসুবিধা এই যে তাদের সম্বন্ধে গল্প লিখলে সত্য গোপন করতে হবে কেননা সত্যই অবিশ্বাস্য।[5]
আমাদের এই আলোচনায় আমরা প্রথম যে উপন্যাসটির কথা উল্লেখ করতে চাই তার নাম মুসলমান মঙ্গল। জাকির তালুকদার তাঁর এই উপন্যাসে কাহিনির মোচড়ে পাঠককে জানিয়েছেন ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠার শুরুর পর্বের কথা। তার পর্বান্তর। ইসলামের স্বর্ণযুগের কাহিনি। ঐস্লামিক ধর্মের ধারাবাহিক পতন–বন্ধুর পথ। খালিফাতন্ত্র ইত্যাদি। আর এইসব আলোচনার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট দেশের কয়েকজন শিক্ষিত যুবকের চাওয়া আগামী প্রজন্মকে এক আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা বাতলে দেওয়া। কারণ এই বাংলায় ইসলামের বিস্তার যতটা তরবারির জোরে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ওয়াহাবি, ফরাজি, খেলাফত ইত্যাদি উদারনৈতিক মতবাদের সফল প্রয়োগের ফলে। যার নমুনা এখনও দুই বাংলার বাউল ও কর্তাভজা সমাজ বয়ে নিয়ে চলেছে। গল্পের নায়ক ইউসুফ তার মত জানাতে গিয়ে বলছে, ‘মুসলমানদের মধ্যে যুক্তিবাদী অনেক গোষ্ঠী ছিল। মনে রাখতে হবে, যুক্তিবাদী হলেই তাকে ধর্মবিরোধী হতে হবে, এই ধারণা ভুল।’ কাহিনির নায়ক ইউসুফ সেই যুক্তিবাদী বাঙালি যে জানে তার দেশের মোল্লারা প্রথাগত শিক্ষা পায়নি বটে, তবে তারা তাদের লাভক্ষতি বেশ ভালোই জানে। কারণ তাদের পরিচালনা করে যারা ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করে তারা। কেউ যদি আজ যুক্তিবাদী কথা বলে, তবে তাদের পিঠে মোল্লারা ‘মুরতাদ’ অর্থাৎ ইসলামবিরোধী কাফের স্ট্যাম্প দেগে দেয়। যা সব দেশের মৌলবাদের সার কথা।
ফলে শেষমেশ লম্পট আর দালাল চক্র ইউসুফকে নাস্তিক বানিয়ে দেয়। ইসলাম বিপন্ন এমন ঘোষণা করে মৌলবাদীরা কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে মিছিল বের করে। আমরা যখন উপন্যাসের এই জায়গায় এসে যাই, তখন আমাদের মনে পড়ে যায় অভিজিৎ রায়ের খুনের ঘটনা। ইউসুফের বিরুদ্ধে বিচারসভা বসে। একদিকে ইউসুফ। তার বিপরীতে ধর্মব্যবসায়ীরা। আমাদের ইতিহাসচেতনায় ঝলকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগের রোম সাম্রাজ্যের ঘটনা। একদিকে সমস্ত খ্রিস্টান ধর্মবিক্রেতা মৌলবাদীর দল। আর তাদের বিপরীতে একক গ্যালেলিও গ্যালিলি।
একজন বিচক্ষণ ইতিহাস-সচেতন মানুষের মতো ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেন সর্বদা তাঁর কাহিনিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রেখে বিচার করেন। তার নির্মোহ মাপদণ্ডে একজন নিপুণ শল্য চিকিৎসকের মানসিকতা বারবার ধরা পড়ে। তাঁর রচিত রহু চণ্ডালের হাড় কেবল বিষয়গত দিক থেকে নয়, প্রয়োগগত দিক থেকেও বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট। আমরা তাঁর রাজপাট-ধর্মপাট উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। শ্রীচৈতন্য একজন ঐতিহাসিক পুরুষ। আর একজন ঐতিহাসিক পুরুষ হিসাবে তাঁর চরিত্রের বিভিন্ন শেড, বিভিন্ন লৌকিক কাহিনি বারবার ঔপন্যাসিকদের প্ররোচিত করে তাঁকে নিয়ে কাহিনি রচনা করতে। কেউ তাঁর মৃত্যুরহস্যকে প্রেক্ষাপটে রেখে উপাখ্যান রচনা করেন। কেউ তাঁর ধর্মমত। কেউ আবার ছুঁয়ে যেতে চান তাঁর ব্যক্তিজীবন। তাঁর সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন। শৈবাল মিত্রের মত্যুর পরে প্রকাশিত তাঁর ম্যাগনাম ওপাস্ উপন্যাস ‘গোরা’ তেমন শ্রীচৈতন্যের জীবনের বিভিন্ন পর্দা ছুঁয়ে গেছে সফলতার সঙ্গে। অভিজিৎ সেন তাঁর ‘রাজপাট-ধর্মপাট’ উপন্যাসের কাহিনির সময় নির্বাচন করেছেন শ্রীচৈতন্য সমকালীন বাংলাদেশ। অভিজিৎ দেখাতে চেয়েছেন শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে। তখন গৌড়েশ্বর হুসেন শাহী রাজবংশ। বাংলার কোণে কোণে সুলতানি রাজত্বের বিরুদ্ধে নানাবিধ অসন্তোষ (আমরা তার কিছুটা আঁচ পেয়েছি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে)। অন্যদিকে কৌলীন্য প্রথার জাঁতাকলে ছিন্নভিন্ন সাধারণ হিন্দুরা। সে=সময় গৌড়বঙ্গ জুড়ে তুমুল এক প্রবাদ কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী উঠে এসেছিল, ‘গৌড়ে ব্রাহ্মণরাজা হব হেন আছে/ নিশিন্তে না থাকিও প্রমাদ হব পাছে।’ উপন্যাস যে টালমাটাল সময়কে বিবৃত করেছে, সেখানে একদল মানুষ শ্রীচৈতন্যকেই নির্দিষ্ট করে ফেললেন প্রবাদের সেই ‘ব্রাহ্মণরাজা’ হিসাবে। ফলে এই উপন্যাসে ভাগবত দর্শনের চেয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ মূখ্য হয়ে ওঠে। তখন গৌড়েশ্বরের সমস্যা বহুবিদ। একদিকে দীর্ঘকাল সুশাসনের সঙ্গে রাজত্ব করার পরে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ১৫১৯ সালে মারা যান। তার আগে দিল্লীশ্বর সৈয়দ রাজবংশ বাংলার ওপর বিশেষ কবজা করতে পারেনি। হুসেন শাহের মৃত্যুর পরে স্বভাবত গৌড়ের তখতে অভ্যন্তরীণ গোলোযোগ শুরু হয়। দিল্লির সঙ্গে দুশমনি চরমে ওঠে। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচারে গাঁ-দেশে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। একদিকে শাসনক্ষমতায় চলছে কাজীর বিচার। অন্যদিকে কুলীনদের অত্যাচারে মানুষ দিশেহারা। বাংলার নিরন্ন মানুষের কাছে তখন শ্রীচৈতন্য সাক্ষাৎ ঈশ্বর ব-ই অন্য কিছু নয়। তাঁর ভাগবত প্রেমে উন্মাদ গৌড়বঙ্গ। ধীরে-ধীরে শ্রীচৈতন্য হয়ে উঠলেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবেত্তাদের চক্ষুশূল। অথচ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে অবতারসরূপ শ্রীচৈতন্য আর তাঁর নতুন ধর্মমত।
অভিজিৎ সেনের কলমে সেদিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর তার কার্যকারণ ফুটে ওঠে রাজপাট-ধর্মপাট উপন্যাসে। উপন্যাস শেষ হয় শ্রীচৈতন্যের বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রার মধ্যে দিয়ে। কারণ তিনি সুস্পষ্ট রাজনীতি দিয়েই বুঝেছিলেন, মানুষের ধর্মীয় আবেগ এক, আর রাজনীতির অক্ষক্রীড়া আর এক বিষয়। দুই একত্রে মিলিত হতে পারে না। হওয়ার বাস্তবতাও নেই।
এই যদি হয় পাঁচশো বছর আগেকার গৌড়বঙ্গের রাজনৈতিক বাতাবরণ-নির্ভর উপন্যাস, তাহলে ভিন্নধারার ঔপন্যাসিকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না অতি সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক ঘটনা। যা কেবল যন্ত্রণার ইতিহাস নয়। অনতি-অতীতের কাহিনিও বটে। উপন্যাসের নাম জুবোফ্স্কি বুলভার। ঔপন্যাসিক মশিউল আলম। জুবোফ্স্কি বুলভার হল সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো শহরের একটি রাস্তার নাম। বিশিষ্ট একটি রাস্তার নাম। জোসেফ স্তালিনের সময়কালে ১৯৩১ সালে ওই রাস্তার ওপরে তৈরি হয়েছিল প্রগতি প্রকাশন। যেখান থেকে ১৯৯১ সাল অবধি নয়-নয় করে ষাট বছর ধরে বাংলা, ইংরাজি সহ ষাটখানা বিদেশি ভাষায় অতি স্বল্পমূল্যে অনুবাদের মাধ্যমে প্রকাশিত হত বিভিন্ন রাশিয়ান বই। সাহিত্য থেকে কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই। দাবাখেলার নিয়ম থেকে অর্থনীতি বিষয়ক বই। মার্কস্ এঙ্গেলস্ থেকে আলেজ়ান্দার পুশকিনের রচনাবলি। অজস্র অনুবাদ সাহিত্যের সম্ভার। আর সেখানে বাংলায় কারা অনুবাদক? সমর সেন, কামাক্ষীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ফল্গু বসু, শুভময় ঘোষ, অরুণ সোম আর এঁদের নেতা ননী ভৌমিক। কাহিনির মূল চরিত্র সৌমেন রায়। সে প্রগতি প্রকাশনের একজন কর্মী। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের এক সকালে বাংলা বিভাগের প্রধান রাইসা ভ্যাসিলিয়েভনা তাকে ফোনে জানালেন প্রগতি প্রকাশনা ভবন চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকাশকেরা। ততদিনে গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার ঢেউ আছড়ে পড়েছে ক্রেমলিনের প্রাসাদে। সেই ধাক্কায় ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউক্রেনে লেনিন মূর্তি ভেঙে ফেলছে সে-দেশের বিক্ষোভকারী মানুষ। রুমানিয়া থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন চেসেস্কুর মতো একনায়ক। এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য প্রগতি প্রকাশন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এই প্রকাশনের সঙ্গে যুক্ত রাশিয়ার মানুষগুলোর রাতারাতি চাকরি খোয়ান। আর বিদেশে থেকে যাওয়া অনুবাদকদের কাজে দীর্ঘকাল মস্কোয় থেকেছেন যাঁরা, তাঁরা মুখোমুখি হন চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের। অস্তিত্বের সঙ্কটের।
কাহিনির প্রায় চরিত্র রক্তমাংসের। তার মধ্যে অন্যতম সন্তান হারানো পঁচাত্তর বছর বয়স্ক লেখক ননী ভৌমিক। যিনি তখন সম্পূর্ণ স্মৃতিহীন এক মানুষ। তাঁকে যখন দুঃসংবাদটি দেওয়া হল, তখন তিনি আদৌ বিশ্বাস করলেন না প্রগতি প্রকাশন উঠে গেছে। তাঁর স্মৃতিতে তখনও জাগরুক সেই সদাই কর্মব্যস্ত বাংলা বিভাগ।
এক সময় বৃহৎ বাংলা ছিল বৌদ্ধধর্মের আঁতুরঘর। কনৌজি ব্রাহ্মণ কিংবা কর্ণাটকের মগরবংশীয় আচার্যরা তাই সেদিনের বাংলাকে বলতেন ‘বৌদ্ধ পাষণ্ড’। আমাদের জলবায়ুতেই রয়ে গেছে বৌদ্ধধর্মের উদারশীলতা। সহনশীলতা। প্রসারতা। যার সঙ্গে পরবর্তীকালে মেলে উদারনৈতিক মুসলমান ধর্মবোধ। তাই ব্রাহ্ম হয়েও আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের গৌতম বুদ্ধের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন শ্রদ্ধা আর সম্মান। তেমনই এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রয়াস সন্মাত্রানন্দ রচিত অতীশ দীপঙ্করের জীবনেতিহাস নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা। বহু শ্রম ও ক্ষেত্রসমীক্ষার নিদর্শন এই মহাকাব্যিক উপন্যাস। অথর সন্মাত্রানন্দ সময় বা কালকে তাঁর চৈতন্যপ্রবাহে উল্টো ঘন্টা (Bell Curve) বা একটা টিলার মতো ভেবে নিয়েছেন। তাঁর মতে টিলার একদিক যদি সমকাল বা বর্তমান হয়, তবে তার উল্টোদিকের ঢাল অতীত। কোন্ অতীত? এক হাজার বছরের পুরনো অতীত। যে অতীতে ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। আখ্যানকারের মতে সেই সুদূর অতীত আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু আমরা পারি না তাকে চিনতে। ফলে এই কাহিনি টিলার চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার মতো বারবার এক হাজার বছরের এপাশ-ওপাশ ঘোরাফেরা করে। যেমন বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুর জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের এক দুপুরবেলার ঘটনা। একটা প্রাচীন পুকুরের এক পাশে এক গরীব পরিবারের বাস। পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই। বুড়ো বাপ আর তাঁর কিশোরী অনুঢ়া কন্যা। সেদিন দুপুরে মেয়েটি পুকুরপাড়ে বসে নিজের খেয়ালে একটা ঢিল ছোঁড়ে পুকুরে। তার ফলে স্থির জলে বৃত্তাকার আলোড়ন ওঠে। সেই আলোড়ন কিংবা অপ্রগলভ ঢেউ পৌঁছে যায় পুকুরের অপরপাড়ে। যেখানে বর্তমান নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটে। ঢেউ যখন পুকুরের সেদিকের ঘাট ছোঁয়, তখনই সময় পিছিয়ে যায় হাজার বছর। চোখের ওপর ভেসে ওঠে রাজকুমার দীপঙ্কর আর তাঁর কিশোরী প্রেমিকার মান-অভিমানের রোমান্টিক দৃশ্য। অতীশ দীপঙ্করের জীবনের বিভিন্ন অজানা পরত আবিষ্কৃত হতে থাকে সময়ের পারম্পর্য না মেনে। সময়কে সম্পূর্ণ নির্মোহ বিশ্লেষণে।
তেমনই আর একটি সাড়াজাগানো ঘটনা ২০০৮–০৯ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে তদনীন্তন রাজ্য সরকারের জোর করে চাষের জমি কেড়ে নিয়ে গাড়ি তৈরির কারখানা প্রকল্প। এর ফলে সারা রাজ্য জুড়ে গড়ে ওঠে জমি বিরোধী আন্দোলন। ভেঙে পড়ে বাংলার রাজনীতির দীর্ঘকালের একরৈখিক শাসন ব্যবস্থা। এই সমস্যার মূলে পৌঁছাতে চেয়ে দেবকুমার সোম (এই প্রবন্ধ গ্রন্থের লেখক) তাঁর অন্বেষণ চালান দূর অতীতে। আর তিনি দেখতে পান চাষের জমি কেড়ে নেওয়ার এই সংস্কৃতি গৌড়বঙ্গে নতুন কিছু নয়। বারো শতকে সেন রাজা লক্ষ্মণ দেশটাকে কনৌজি কিংবা স্মার্ত ব্রাহ্মণদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জোর করে কৃষিজমি কেড়ে নিয়েছিলেন, সে-সব ঘটনার উল্লেখ ইতিহাসে আছে। সিঙ্গুরের সাম্প্রতিক ঘটনাকে আটশো বছর আগের গৌড়বঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য দেবকুমার রচনা করলেন অষ্টাদশ অশ্বারোহী উপন্যাস। এই উপন্যাসের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন:
দেবকুমার তাঁর গল্পকে শেষ করেন না। সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিকের আসনও ছেড়ে দেন। সময় যেমন প্রবহমান, তাঁর গল্পও তাই। ‘‘তারপর কি মধুবেনে এত অপমান সহ্য করে নুদিয়ায় পড়ে রইলেন? নাকি ভিনদেশি হলেন? এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ ইতিহাস রচিত হয় রাজার নির্দেশে। শোষিতের বিপক্ষে শোষকের ভাষণে, ভাষ্যে। রাজার সাথে যতক্ষণ বেনের বৈরিতা ছিল, ততক্ষণ তারা ছিল প্রাসঙ্গিক। তারপরের কথা ইতিহাসে রক্ষিত নয়।’’ দেবকুমার ইতিহাস বলতে কী বোঝেন তা এই উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট।[6]
আলোচনাটি শেষ করেছেন পার্থপ্রতিম এইভাবে, “আর তিনি তাঁর গল্পকে, বীক্ষাকে বাঁধেন এক ভাষার আধারে।…. এ উপন্যাসের ভাষায় কথ্য-চলিত টানের সঙ্গেই আরও একটি ভাষার স্তর আছে, যাকে উপন্যাসের কবিতা ছুঁয়ে যায়, আছে দীর্ঘ বর্ণনা। দেবকুমার তাঁর গল্পকে গল্পগুলিকে ঐ ভাষায় বাঁধতে পেরেছেন।” আমাদের বলার বিষয় এখন বাংলা উপন্যাসে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার যে তৎপরতা তৈরি হয়েছে, ঔপন্যাসিকেরা যে পরিশ্রম আর তিতিক্ষা নিয়ে এক একটি বিশেষ ঐতিহাসিক আখ্যানের জন্ম দিচ্ছেন, বাংলা উপন্যাসের সাহিত্যের প্রবহমান ক্ষীণতনুকে এইসব সৃষ্টি আগামীদিনে পুষ্টতা দেবে।
[ক্রমশ]
[1] ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। ঐতিহাসিক উপন্যাস: রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড। কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১২৫তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ। আশ্বিন ১৩০৫। পুনর্মুদ্রণ পৌষ ১৪০২। পৃষ্ঠা ৬৮৭।
[2] দত্ত, ডঃ বিজিতকুমার। বাংলাসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস। কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ। চতুর্থ সংস্করণ। জানুয়ারি ১৯৯৬। পৃষ্ঠা ৯।
[3] Lukacs, Georg. The Historical Novel. Translated from the German by Hannah and Stanley Mitchell. Lincoln and London: University of Nebraska Press. First Printing June 1983. Page No. 125-126.
[4] আনিসুজ্জামান। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: প্রাথমিক জিজ্ঞাসা; আত্মপরিচয় ভাষা–আন্দোলন স্বাধীনতা। ঢাকা: চন্দ্রাবতী একাডেমি। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫। পৃষ্ঠা ৭১।
[5] মজুমদার, অমিয়ভূষণ। রাজনগর। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং। প্রথম প্রকাশ: শ্রাবণ ১৩৯১, জুলাই ১৯৮৪। ব্লার্ব।
[6] বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম। পড়া বই। সম্পাদক: বিকাশ শীল। চুঁচুড়া: জনপদপ্রয়াস। বইমেলা জানুয়ারি ২০১৪ সংখ্যা। পৃষ্ঠা ৩৪।