আত্রেয়ী কর
লেখক জনসংযোগ ও সমাজকর্মী। বর্তমান লেখাটি একটি সারভাইভার’স অ্যাকাউন্ট। ফলে লেখাটিতে যৌন নির্যাতন, আত্মহত্যার চিন্তা, মানসিক অবসাদ ও অ্যাংজাইটি-র উল্লেখ আছে।
যখন প্রথম বুঝতে পারি যে আমি অন্যদের মতো নই, তখন আমার বয়স এগারোর কাছাকাছি। বুঝতে পারতাম যে আমি নিজের সুবিধার্থে নিজের মাথায় একটা অন্য জগৎ সৃষ্টি করে, সেখানে বাস করতে ভালোবাসি। সে জগতে খারাপ কিছু নেই, ভয় নেই, লজ্জা নেই, শোষণ নেই, নেই কোনও শাস্তি। বুঝতে পারতাম যে খুব একটা কারও সঙ্গে কথা বলতে অত ভালো লাগে না আর।
বছর তেরো যখন বয়স, তখন বাবা মারা যান। কথা বলা বন্ধ হয়। আসে আরও অনেক আচরণগত পরিবর্তন। শুরু হয় অকারণে কান্না পাওয়া, সর্বক্ষণ মনে হওয়া যে কেউ বুঝি পিছু নিয়েছে, হঠাৎ হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে ওঠা, মনে হওয়া কেউ যেন নাম ধরে ডাকছে, মৃত্যুচিন্তা। ডায়রির পাতার পর পাতা ভরে যেতে লাগে— আমি কেন খারাপ, কতটাই বা খারাপ, আমাকে অপছন্দ করার কোটি কোটি কারণে।
এভাবে কাটে অনেকগুলো বছর। কোনওদিন ভাবতে বসিনি বাকিরা কেন আমার মত এত কষ্ট পায় না। মনে হত বোধহয় কোনও ভুল করেছি, তারই শাস্তি। কোন ভুলের শাস্তি বুঝিনি। নাহঃ বোঝার চেষ্টা করেছি বললেও মিথ্যে বলা হবে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মনে হত এই কষ্টটাই আমার প্রাপ্য। বন্ধুবান্ধব ছিল, স্কুলে ভালো ছাত্রী বলে নামডাকও ছিল, খুব কাছের কিছু বন্ধুও ছিল। দূর থেকে বোঝার উপায় ছিল না কিছু। পরীক্ষার ফলাফলে, অথবা স্কুলের অন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ছাপ পড়েনি কোনওদিন। দূর থেকে দেখে আর পাঁচটা হাসিখুশি কিশোরীর মতোই মনে হত আমাকে। শুধু হয়ত বয়সের তুলনায় একটু বেশি পরিপক্ক। বাড়ির যা অবস্থা, তাতে বাড়ির বড় মেয়ের সেটাই হওয়া স্বাভাবিক।
আমি কোনওদিন কোনও সমাধান খোঁজার চেষ্টা করিনি, সমাধান হয় বলে জানতামও না। তখনও মানসিক অবসাদ নিয়ে কথা বলা হয় না কোথাও। ছিচকাঁদুনে, উদাস, দুঃখবিলাসী, অতি-সংবেদনশীল (over-sensitive) ইত্যাদি বলে অনেক ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যেত সহজেই। আমি নিজেও নিজেকে সেই চোখেই দেখতাম। উনিশ বছর বয়সে পৌঁছে কলেজে সোশিওলজির ক্লাসে বসে প্রথম জানতে পারি, এগারো বছর বয়সে যেটা আমার সঙ্গে অনবরত হত, তাকে যৌন নির্যাতন বলা হয়।
রীতিমত পড়াশোনা করা, ক্লাসে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকা মেয়ে আমি। তবু বিশাল এক অপরাধবোধ গ্রাস করে আমাকে সেই মুহূর্ত থেকে। আত্মহননের চিন্তা বা ইচ্ছে বেড়ে যায়। প্রিয় মানুষগুলির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার ইচ্ছে জোরদার হয়ে ওঠে আরও। খুব বেড়ে যায় নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা। ঠিক কতখানি সহ্যশক্তি আমার, সেটা পরখ করে দেখার কৌতূহলটাও বাড়তে থাকে। কারও সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে যেই বুঝতে পারতাম যে এই মানুষটি আমাকে কষ্ট দেবে, বা ব্যবহার করবে, বা খুব অত্যাচার করবে, তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ত। যারা সত্যি ভালোবাসে, তাদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যে আমি বেশিদিন বাঁচব না, বা খুব শিগগিরই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলব আমি।
মানসিক নির্যাতনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় হয়েছে জীবনে। তার সঙ্গে তৈরি হয়েছে নিজেকে সবথেকে পিছনে রাখার অভ্যাস। আশেপাশের মানুষ যে খুব বুঝতে পারতেন যে তাঁরা যেটা করছেন সেটা মানসিক নির্যাতনের পর্যায় পড়ে, তা নয়। আমরা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে এত কম সচেতন, যে কোন কথা বলা উচিত, কখন বলা উচিত, কীভাবে বলা উচিত, অথবা কোন কথা কাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, কার মানসিক অবস্থা কীরকম, সেকথা না ভেবেই আমরা অনেক কথা বলে ফেলতাম। আজও যে পরিস্থিতি খুব বদলে গেছে তেমনটা নয়।
মানসিক অসুস্থতার ব্যাপারে কিচ্ছু না জেনে, তার সঙ্গে বাস করেছি আমি প্রায় ত্রিশ বছর। ২০১৩ নাগাদ অবস্থার অবনতি ঘটে। সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারি। সেই প্রথম মনে হওয়া শুরু হয় যে, আমি বোধহয় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। আমি সাইকোসোমাটিক— অর্থাৎ আমার মন এবং শরীর খুব গভীরভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে। তাই শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায় এই সময়ে। এমনও হয়েছে যে মানসিক অবসাদের কারণে মারাত্মক কোমরের যন্ত্রণায় ভুগেছি, ওজন বেড়ে গিয়েছে, টানা ৫৪ দিন ধরে ব্লিডিং হয়েছে পিরিয়ডের। কেউ ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়লে, একটা সময়ে তার অসুস্থতাটা অনেকেই অজুহাত হিসেবে দেখতে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়। সারাক্ষণ মনে হত যে, আমার কারণে আশেপাশে অনেকেই বিব্রত হয়ে পড়ছেন। অপরাধবোধ বেড়ে যায়। ‘সরি’ শব্দটা আমার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ হয়ে ওঠে। অবসাদের সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় উদ্বেগের (anxiety) উপসর্গ।
সত্যি বলছি, ইউটিউবে দীপিকা পাড়ুকোনকে কান্নায় ভেঙে পড়তে না-দেখলে আমি হয়ত বুঝতে পারতাম না যে আমি মানসিক অবসাদের রুগী। অনেকগুলো ধাঁধা হয়ত আরও কয়েকদিন ধাঁধাই থেকে যেত। মনে এই দ্বন্দ্বটাও আসত না, যে আমার কি চিকিৎসার প্রয়োজন? আমার কি মনোবিদ বিশেষগজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত? আমি কি সুস্থ হতে পারি? একদিন, মাঝসমুদ্রে (সত্যিই) এক বন্ধু হঠাৎ হাত ধরে বলে যে সেও কাউন্সেলিং করায়, এবং তাতে তার খুবই সাহায্য হয়েছে। তার কথা শুনে, ভাবনাচিন্তা করে, নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে, ফোন নম্বর নিয়ে থেরাপিস্টকে প্রথম ফোনটা করে উঠতে আমার পাঁচ মাস সময় লেগেছিল।
আজ আমার বয়স সাঁইত্রিশ ছুঁইছুঁই। আমি কি পুরোপুরি সুস্থ? নাহ, নই। অ্যাংজাইটি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি অনেকটাই। আমি নিজেকে আগের থেকে অনেক ভালোভাবে সামলাতে পারি। নিজেকে অগ্রাধিকার দিতে শিখছি। শিখছি নিজের কথা বলতে। বুঝেছি যে, কিছু-কিছু মানুষকে খুব ভালোবাসলেও, বা আঁকড়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করলেও, তারা যদি টক্সিক হয়ে ওঠে, মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটায়, তাদেরকে বাদ দিয়ে বাঁচতে শিখতে হবে। কিছু-কিছু পরিস্থিতি থেকে জোর করে নিজেকে সরিয়ে আনতে হয়, নিজের ভালোর জন্যই। নিজের ভালোটা নিয়ে ভাবতে শিখতে হয়।
এখনও এমন অনেক দিন আসে, যখন বিছানা থেকে উঠে সামান্য কোনও কাজ করতে পারা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এমন কিছু রাত আসে, যখন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার উপায়টাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। আসে এমন কিছু-কিছু মুহূর্ত, যখন প্যানিক অ্যাটাক হয়। মাসের পর মাস বুঝতে পারি আমি ঠিক নেই, তবু থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করার সাহস পাই না। তা-ও বলব, আগের চেয়ে ভালো আছি। কারণ এখন আমি জানি আমি অসুস্থ, আমি জানি আমার চিকিৎসা কোন ডাক্তার করতে পারেন।
তার চেয়েও বড় কথা হল, এখন আমি সাহায্য চাইতে পারি।
আমি জানি যে, আমার নিজস্ব একটি চালিকাশক্তি আছে, যা আমাকে থামতে দেয়নি আজ অবধি। যখনই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, সকলকে ভুল প্রমাণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা অদম্য ইচ্ছে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই ইচ্ছেটাই বোধহয় আজ অবধি নিজেকে সারিয়ে তুলতে, অথবা শেষ মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেতে সাহায্য করে। সেই চালিকাশক্তির একটা বড় অংশ আমার মা। কারও ক্ষেত্রে তা হয়তো সন্তান, কারও ক্ষেত্রে বন্ধু, কারও বা প্রিয় মানুষ অথবা পোষ্য। কারও ক্ষেত্রে তা হয়তো জাগতিক সাফল্য, অথবা টাকা, অথবা নাম-যশ। অথবা কারও ক্ষেত্রে কেউ নয়, কিছুই নয়। কারণ মানুষ মাত্রই আলাদা। সকলের অসুস্থতার লক্ষণ আলাদা, তাদের ওষুধ আলাদা, তাদের চিকিৎসার আলাদা পদ্ধতি। এটা আমাদের বোঝা খুব দরকার।
বোঝা দরকার যে, দুঃখ এবং মানসিক অবসাদ এক জিনিস নয়। মানসিক অসুস্থতা মানে পাগল হয়ে যাওয়া নয়। মানুষের অভিব্যক্তি দেখে সবসময় বোঝা যায় না সে অসুস্থ কিনা। যে সারাক্ষণ হাসে, সে যে অবসাদে ভোগে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। বোঝা দরকার, যে সকলে নিজের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নন।
অনেকে আমাকে বলেছেন আমি নিজের মানসিক অবসাদ নিয়ে এত কথা বলি কারণ আমি “অ্যাটেনশন সিকার”— আমি অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পছন্দ করি। তাঁদের তেমনটা মনে হতেই পারে। মনে হতে পারে যে, আমার এই মানসিক যন্ত্রণা আমাকে কোনও এক ধরনের আনন্দ দেয়। তবে এটাও সত্যি যে, আমি নিজের অসুখের কথা বলি বলে অনেকে তাঁদের অসুখের কথাও আমাকে বলেন। অনেকে সাহস পান চিকিৎসা করানোর। অনেকে জাজড ফিল না-করে সাহায্য চাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। ঠিক যেমন দীপিকার সেই ভিডিওটি দেখে আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম।
সচেতনতা এভাবেই বুঝি অনেককে বাঁচিয়ে রাখে।