Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গাজা এফএম ১০০.৯ মেগাহার্টজ

সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় ও সোহেল ইসলাম

 

আজকের সান্ধ্য অনুষ্ঠান: আমার শহর… ধ্বংসস্তূপের শহর, আমার শহর… নোনা পানির শহর

১০০.৯ মেগাহার্টজ গাজা এফএম-এর পক্ষ থেকে সকলকে শুভ সন্ধ্যা। প্রতি সন্ধ্যার মতোই আমরা হাজির আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান ‘আমার শহর… ধ্বংসস্তূপের শহর, আমার শহর… নোনা পানির শহর’ নিয়ে। আমাদের আজকের বিষয় ‘আপনার গল্প আমাদের গল্প’। আমাদের আজকের অতিথি ৫ জন তরুণ গল্পকার, একে একে যাঁদের মুখে আমরা গল্পগুলো শুনব।

প্রথমেই পরিচয়পর্ব সেরে নেওয়া যাক। আমাদের প্রথম গল্পকার আয়া এল-জিনাতি। ২৬ বছরের আয়ার পড়াশোনা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। আয়া নিজেকে একজন চিন্তক, সাংবাদিক, ব্লগার, স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং চিত্র পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আয়া একজন ভিন্নধারার পরিচালক হতে চান। যুক্তিযুক্ত, সত্য এবং আকর্ষক গল্প আয়া পছন্দ করেন। আয়া বিশ্বাস করেন এবং বলেন, “যদি কেউ বিশ্ব সম্পর্কে আরও জানতে চান, তবে তাঁকে আরও শিখতে হবে, পড়তে হবে এবং সত্য বলার জন্য নিজেকে উৎসাহিত করতে হবে।” আয়ার গল্প শুরুর আগে একটা সংবাদ বিরতি—

আজকের বিশেষ বিশেষ সংবাদ হল ইজরায়েলি বাহিনি ৫৬টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। তারা প্যালেস্তিনীয়দের বাসস্থান লক্ষ্য করে ১২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপ করেছে। অন্যদিকে প্যালেস্তাইনের বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে তারা ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ১০০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে। প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, গাজায় ২১ জন প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে নয়জন শিশু নিহত হয়েছে এবং ডজনেরও বেশি সংখ্যক প্যালেস্তিনীয় আহত। ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান এমন অনেক জায়গায় বোমাবর্ষণ করেছে যেখানকার ক্ষয়ক্ষতি এখনও জানা সম্ভব হয়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গাজা এবং খান ইউনিসের তিনটি জায়গা থেকে ৩২টি মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

 

সংবাদ বিরতির পর আমরা আবার ফিরে এলাম আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠানে, শ্রোত বন্ধুরা নিশ্চয়ই সকলে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। আমরা শুরু করতে চলেছি আজকের বিষয় ‘আপনার গল্প আমাদের গল্প’। মাইক্রোফোনে আসছেন আয়া এল-জিনাতি–

শ্রোতাবন্ধুরা প্রথমেই আপনাদের সকলকে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আশা করি আপনারা প্রত্যেকেই সুস্থ আছেন, ভালো থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি আয়া, আজ আপনাদের আমার গল্প শোনাতে এসেছি। আমার আজকের গল্প ‘গাজার জলসঙ্কট’।

 

গাজার জলসঙ্কট

যদিও সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী যুদ্ধ শেষ। কিন্তু যুদ্ধ এখনও চলছে… আর সে যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী শিশুরা। অভাব এখানে ঘরে ঘরে, দৈনন্দিন জীবনে মৌলিক চাহিদার অভাব এখানে একটা স্বাভাবিক বিষয়। এখনকার শিশুরা পুতুল খেলার বয়স থেকেই মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে।

আসুন আপনাদের সঙ্গে খান ইউনিসের ১৫ বছরের শাজা হেন্দিকের পরিচয় করিয়ে দিই, যে বাবার সঙ্গে গাধার গাড়ি চড়ে প্রতিদিন পানীয় জল সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের জল লবণমুক্ত করে পানীয় জল তৈরি করে এমন এক কারখানায় যায়। ওদের এই অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয় ২০১৪-এর গাজা যুদ্ধের সময় থেকে।

যুদ্ধের সময় শাজাদের পরিশ্রুত জলের জন্য প্রতিদিন গাধার গাড়ি চালিয়ে এতটা পথ যেতে হয়েছিল। এই অগ্নিপরীক্ষা শাজাকে শৈশবেই পরিণত করে তুলেছিল। তার জীবনের কথা শুনলে আপনারা বুঝতে পারবেন শৈশব থেকে শাজা কীভাবে বঞ্চিত হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার আমরা আগের মতো বাঁচব গোছের সান্ত্বনা এক্ষেত্রে দেওয়া সম্ভব নয়।

প্রথমটায় শাজা বেশ উত্তেজিত ছিল এই ভেবে যে অবশেষে সে বাড়ির বাইরে বের হতে পারবে এবার। বাবা জল আনতে শাজার সাহায্য চায়, শাজার আনন্দের শেষ নেই, সে এক কথাতেই রাজি।

বাইরে বেরোতেই শাজা বুঝে যায় চার দেওয়ালের বাইরের জীবন যথেষ্ট ঝুঁকির। ঝুঁকি দেখতে দেখতে সচেতন হয়ে ওঠে শাজা, সে জেনে গিয়েছিল জল নিয়ে ফিরে আসাটা বাবা ও তার পক্ষে মোটেই সহজ হবে না।

সাধারণত সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরই গাড়ি নিয়ে বের হত বাবা-মেয়ে। রওনা দেওয়ার সময় বাবার উদ্বিগ্নতা দেখতে দেখতে শাজা শিখে গিয়েছিল এই বেঁচে থাকা। প্রথম দিন প্ল্যান্টে যাওয়ার পথটা শান্তই ছিল, কিন্তু ফেরার পথে বেশ কাছেই একটা বোমা এসে পড়ে। বাবা শাজাকে দু-হাত দিয়ে আগলে ধরে, কিন্তু বোমার শব্দগুলো যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। সেদিনই শাজা বুঝে গেছিল বাইরে বেরোনোটা মোটেই মজার নয় বরং যথেষ্ট ঝুঁকির।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও সমস্যা শেষ হয়নি। শাজা ও তার পরিবার এখনও গাধার গাড়িতে করে জল আনতে যায়। ওদের আশঙ্কা যেকোনওদিন আবার যুদ্ধ শুরু হবে। আর তারই প্রস্তুতি হিসেবে ওরা গ্যালন গ্যালন জল ভরে রাখতে চায়।

শাজা ও তার পরিবার গাজা যুদ্ধের পর থেকে জলসঙ্কটের একটা বড় উদাহরণ। গাজা স্ট্রিপ জলের ইস্যুতে ইজরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হচ্ছে কিন্তু সমাধানের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। প্যালেস্তাইনের জনসম্পদ দপ্তরের রিপোর্ট থেকে যে তথ্য সামনে এসেছে সেটা হল গৃহকর্মের জন্য পৌরসভা কর্তৃক সরবরাহ করা জলের মাত্র ৩.৮ শতাংশ পানযোগ্য, বাকি ৯৬.২ শতাংশ জলই পানের অনুপযুক্ত। বিশুদ্ধ পানীয় জল পাওয়ার একমাত্র উপায় হল গাজা স্ট্রিপে অবস্থিত পাবলিক ডিসালিনেশন প্ল্যান্ট। প্যালেস্তিনীয় জনসম্পদ কর্তৃপক্ষের মতে গাজায় ১৫০টি ডিসালিনেশন প্ল্যান্ট রয়েছে কিন্তু বাস্তবে মাত্র কয়েকটি প্ল্যান্ট চালু রয়েছে যা থেকে মাত্র দেড় মিলিয়ন গাজাবাসীকে পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব।

 

সংবাদ বিরতি      

আজকের বিশেষ বিশেষ সংবাদ হল আক্রমণের দ্বিতীয় দিনে ইজরায়েলি বিমান কয়েক ডজন হামলা চালিয়েছে। আর এই হামলার কারণে ১১ জন প্যালেস্তিনীয় নিহত হয়েছেন যার মধ্যে একজন মহিলা ও তার প্রতিবন্ধী শিশু, যে শিশুটি সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছিল। আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ। বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হানাদি রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার, শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত আল-জাহরা রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার এবং একটি বেসরকারি ইস্কুল। এছাড়াও আল-জুন্দি, আল-মাজহুল টাওয়ার ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

বন্ধুরা এবার গল্প শোনাতে আসছেন দোয়া মোহাসিন। ১৯ বছরের দোয়া গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া। মনোবিজ্ঞান এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও সে যথেষ্ট আগ্রহী। বাকিটা দোয়ার মুখেই শুনুন—

সকলকে সালাম, শুভেচ্ছা। ভাষার কথা যখন উঠলই তখন যে কথাটা না বললেই নয়, আমি একবার ফরাসি ভাষা শেখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমার চরিত্রের মস্ত বড় খামতি হল খুব সহজেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলি সে কারণে কয়েক মাস যেতে না যেতেই আমি ফরাসি বাদ দিয়ে জার্মান শিখতে শুরু করি। আসলে যে কোনও ক্ষেত্রেই আমি বড্ড তাড়াহুড়ো করি। তাছাড়া আমার ইচ্ছেগুলোও কিছুটা অদ্ভুতুড়ে, সামঞ্জস্যহীন। যেমন আমি ইতালি যেতে চাই শুধুমাত্র ইতালির পিৎজা খাব বলে। আমার খুব ইচ্ছে ব্রডওয়ে নাটকে অংশ নেব। সে কারণে আমি দেওয়ালে একটা থিয়েটারের ছবি টাঙিয়েছিলাম। ওই ছবিটা টাঙিয়েছিলাম নিজেকে অনুভব করানোর জন্য যে আমি অন্তত স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি। আমার ইচ্ছে গ্রীষ্মে তুষারপাত এবং বৃষ্টি দেখতে চাই। আমি পর্বতারোহণ করতে চাই আর সেই অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে একটা বই লিখতে চাই। আমি প্রেমে পড়তে চাই, অদ্ভুত কিছু একটা করতে চাই, আমি চাই পর্তুগালের অ্যাজোরেসের কভো দ্বীপে যেতে। টেভি ফাউন্টেন দেখতে যেতে চাই। আমি নিশ্চিত সেখানে এখনও কেউ প্যালেস্তিনীয় মুদ্রা শেকেল ফেলেনি। আমি হ্যারি পটারের একজন বড় ভক্ত বিশেষ করে আমার প্রয়োজনের সময়, বাস্তবতা এবং পরীক্ষা থেকে বাঁচার জন্য। আমি কার্টুন অ্যাডিক্টেড। লেখার চেয়ে পড়তে অনেক বেশি পছন্দ করি কারণ পড়াটাই আমার জীবনে অন্ধকার মুহূর্তগুলো থেকে বাঁচিয়েছে। শ্রোতাবন্ধুরা বকবক করে আপনাদের অনেকটা সময় নষ্ট করলাম, এবার গল্প শুরু করা যাক।

 

নেভারল্যান্ড

আমার ঘুমের ভেতর যাতে দুঃস্বপ্নেরা ঢুকতে না পারে তার জন্য মা লোরি শোনাতেন। আর তাতেই দুঃস্বপ্নগুলো অদৃশ্য হয়ে যেত, মায়ের কণ্ঠস্বরই ছিল আমার সুস্থতার সিরাপ।

পরী আর নেভারল্যান্ডের গল্পটা আমাকে লিলিই শুনিয়েছিল। লিলি আমার সেই বন্ধু যার সঙ্গে আমি পরিবারের একমাত্র স্মারক ট্রি-হাউজ শেয়ার করেছিলাম। লিলিকে আমি বলেছিলাম বাস্তববাদী হও। নেভারল্যান্ডের কখনও কোনও অস্তিত্ব ছিল না।

কিন্তু সে আমাকে বলেছিল, শ্যাম তোমাকে দেখতে চায়, চলো তার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই, জোরে পা চালাও। আমি কোনও তর্ক করিনি কারণ তাকে যদি বলতাম বা নিষেধ করতাম তবে তার ভেতরে যতটুকু আশার আলো অবশিষ্ট ছিল সেটুকুও ভেঙে চুর-চুর হয়ে যেত। আমি সেই অনুভূতি ভালোভাবেই জানি।

বাবা একবার কানে কানে বলেছিলেন আমার যদি খুব মন খারাপ থাকে বা দুঃখ পেয়ে থাকি তবে ‘তাঁর’ নাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেই বা ডাকলেই তিনি সামনে এসে হাজির হবেন। আমি হাজারবার ডেকেছি কিন্তু কেউ আমার ডাকে সাড়া দেয়নি, আমার কাছে এসে বসেনি। আমি নিজেই নিজেকে ঘৃণা করি কারণ বাবা-মা, বন্ধুরা উধাও হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি কখনও তাদের ডাকার কথা ভাবিনি।

লিলি ভাইয়ের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার কথা আমাকে বলত। গতরাতে আমরা উড়তে উড়তে শহরটাকে উপর থেকে দেখেছি সবকিছু কী নীরব, কী শান্ত। যতক্ষণ না আমরা মেঘের ডানায় ঘুমিয়ে পড়ি তার আগে পর্যন্ত তারা গুনেছি।

সব শুনে লিলিকে বলেছিলাম, এসব নিছক স্বপ্ন লিলি। এটা যে কতটা অবাস্তব তা একবার অন্তত ভেবে দেখো।

লিলি বলেছিল, আমি এসব পারি তবে রাতের দিকে। যখন আমাকে দেখতে পায় না।

লিলির সঙ্গে তর্ক করা অর্থহীন। একদিন সে বুঝবে আশা করি। কারণ আমি নিজেও একটা সময়ে তার মতো ছিলাম যতক্ষণ না যুদ্ধ আমার সমস্ত বিশ্বাস, আশা এবং আমাকে নিঃস্ব করে দেয়নি। আসলে হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করতে আমার সময় লেগেছিল।

কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ভোরের আকাশে সূর্যোদয় দেখি তখন সেই আলোর ছোঁয়ায় আমার ঠোঁটে ও চোখে উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সেই অনুভূতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল যা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম। আমি ট্রি-হাউজে উঠে লিলিকে জাগালাম, সে চিৎকার করে উঠল। ঘুম-ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল— কী হয়েছে? বললাম, দেখো, আমার শরীর জুড়ে আলোর ছটা, এই সেই আশার আলো লিলি, তুমি ঠিক ছিলে… তুমিই সত্যি। লিলির শরীর তখন কাঁপছে।

মৃদু হেসে সে শুধু বলেছিল, আমি জানতাম, আগে থেকেই জানতাম।

 

সংবাদ বিরতি

বিশেষ বিশেষ সংবাদ হল ইজরায়েলি বাহিনি গাজা স্ট্রিপের বিভিন্ন এলাকায় ২০০টিরও বেশি অভিযান চালিয়েছে। হামলাগুলো চালানো মূলত সরকারি সদর দপ্তর, মিডিয়ার সদর দপ্তর, বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, প্যালেস্তাইনের বিপ্লবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য। আজকের হামলায় ৩৩জন নিরীহ প্যালেস্তিনীয় নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ।

 

বন্ধুরা এবার গল্প শোনাতে আসছেন সারাহ্ সোভি। সারাহ্ একজন লেখক ও অনুবাদক। গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে গ্রাজুয়েশন করেছেন। সারাহ্-এর আশা সৃজনশীল লেখা ও অনুবাদ নিয়ে বিদেশ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা। সারাহ্-এর স্বপ্ন গাজা একদিন সবুজে সবুজ হবে, যেখানে কোনও যুদ্ধ থাকবে না, মিসাইল থাকবে না। যেহেতু তার স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি তাই গল্পেই গাজার সেই ছবিটা আঁকার চেষ্টা করে সারাহ্। শুধু যুদ্ধ আর দুর্ভোগ নয় বিশ্বের কাছে গাজাকে নিজস্ব সৌন্দর্যে তুলে ধরতে চায়। শোনা যাক সেই গল্প।

 

পেনম্যানিয়া

এই গল্পের শুরু মরিয়মকে নিয়ে। মরিয়মের সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটা তার স্কুলজীবনের কথা। এক বাক্যে মরিয়ম ছিল সুন্দর, সৃজনশীল। গাজার ইউএনআরডব্লিউ-এর একটি ইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত মরিয়ম। অসাধারণ ছোট গল্প লিখত মরিয়ম, নিজের প্রতিভার জোরে ওই বয়সেই যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছিল। মরিয়মের উৎসাহ ছিল তার বাবা। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী, সমাজকর্মী এবং গাজার একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী। তিনিও মেয়ের জন্য গর্বিত ছিলেন এবং মেয়ের সৃজনশীলতার কারণে নিয়ম করে ইস্কুল থেকে আমন্ত্রণ পেতেন। শেষবার যখন গল্প লেখার জন্য মরিয়ম প্রথম পুরস্কার পায় সেবারই ইজরায়েলের বোমা হামলায় পরিবারের সকলকে হারায়, সালটা ছিল ২০০৮। গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর মারিয়াম মানসিক বল পেয়েছিল, সঙ্গে পেয়েছিল অর্থনৈতিক সাহায্য। শব্দ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী সেদিন বুঝতে পেরেছিল মরিয়ম।

অন্য যে কোনও কিছু করার থেকে লিখতেই বেশি ভালোবাসত মরিয়ম। তার ইস্কুলের প্রতিটি বইয়ের মার্জিন জুড়ে লেখা সুন্দর আরবি ক্যালিগ্রাফি। একবার এক বন্ধু ছোটগল্পগুলোকে নিয়ে একটা সঙ্কলন করার পরামর্শ দেয়, উত্তরে মরিয়ম হাসতে হাসতে বলেছিল, এখনও সে তার প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়।

একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে মরিয়ম দেখল, মা অঝোরে কাঁদছে। ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? বারবার জিজ্ঞাসার পরও উত্তরের বদলে মা শুধু কাঁদতেই থাকেন। অমন অস্বাভাবিক কান্নাকাটি দেখে মরিয়ম ভয় পেয়ে যায়। ঠিক তখনই দাদি তাকে জড়িয়ে ধরে দুঃসংবাদটা জানায়। সেটা ছিল মরিয়মের বাবার বিষয়ে। কূটনৈতিক মিশনে মরিয়মের বাবাকে প্যালেস্তাইনের প্রতিনিধি হিসেবে গাজা থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে পাঠানো হয়েছিল। সেই সফরের পরিকল্পনা হয়েছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলোচনায়।

দাদির কথায় মরিয়মের মনে পড়ে, যাওয়ার আগে সে বাবাকে সাবধানে থাকার কথা বলেছিল। তার মানে বাবা কথা শোনেনি।

জেরুজালেম দলের একজন সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে মরিয়মের বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়ে। সে ঘটনাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। মরিয়মের বাবা জানতেন না, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ৫০ বছরের কম বয়সী প্যালেস্তিনীয়দের প্রবেশ নিষেধ। ফলে মরিয়মের বাবাকে ইজরায়েলি ফোর্সের হাতে গ্রেফতার হতে হয়।

 

সংবাদ বিরতি

ইজরায়েলি বোমারু বিমানের লাগাতার হামলায় আজ ৩৪ জন প্যালেস্তিনীয় নিহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে কুড়িজন উত্তর গাজা অঞ্চলের। আজকের হামলায় একটি আবাসিক সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী পুরো অঞ্চলটাই তছনছ হয়ে গিয়েছে। বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে ১৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের জন্য উদ্ধারকাজ চলছে। গাজা স্ট্রিপের উত্তরাংশে বিশেষত ওম আল-নাসের এলাকায় সাধারণ মানুষের উপর বোমা হামলার কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

 

বাবার গ্রেফতারের খবর শুনে মরিয়ম নির্বাক হয়ে যায়। নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলে। এতটাই হতাশ হয়ে পড়ে যে তার মনে হতে থাকে সে ঘুমের মধ্যে রয়েছে। সে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে চলেছে, বাবা ছাড়া আমি চলব কী করে? এই ঘটনার তিনদিন পর মায়ের পীড়াপীড়িতেই মরিয়ম আবার ইস্কুলে ফেরে। ইস্কুলে কেউ তাকে তিনদিন অনুপস্থিত থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেনি কারণ তারা বাবার গ্রেফতারের খবরটা জেনে গিয়েছিল। দুই পিরিয়ড পর প্রধানশিক্ষিকা মরিয়মকে ডেকে বলেন, প্যালেস্তিনীয় বন্দি দিবস উপলক্ষে একটা লেখার প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে ইস্কুল। যেহেতু মরিয়ম এখন একজন বন্দির মেয়ে এবং সে যদি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তা একটা ভালো বিষয় হবে।

কিন্তু মরিয়ম প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে অস্বীকার করে। শিক্ষিকা তাকে ডেকে জোর দিয়ে বোঝাতে থাকেন— প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে তুমি নিজের কথা সবাইকে জানাতে পারবে। এতে তোমার ও বাবার জন্য একটা নতুন পথ তৈরি হতে পারে। মরিয়ম জানায়, ম্যাম, আমি লেখার মতো পরিস্থিতিতে নেই। প্রধানশিক্ষিকা জানান, আমরা সবটা জানি, এটা আসলে তোমার বাবাকে সাহায্য করার একটা সুযোগ।

কথাটায় মরিয়াম খুব অবাক হয়। এবং ম্যামকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইস্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ে, তারপর বোমাবিধ্বস্ত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দৌড়াতে থাকে। আর ভাবতে থাকে— বাবাকে ফিরিয়ে আনার জন্য, জড়িয়ে ধরে জন্য, বাবার বুকে মাথা রাখার জন্য সে কিছু একটা করবেই।

এক সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সেই প্রতিযোগিতা। গল্প লেখার জন্য প্রতিযোগীদের সময় দেওয়া হয় তিন ঘন্টা। মরিয়ম তার গল্পে বাবাকে সমস্ত প্যালেস্তিনীয় প্রশাসনিক বন্দির প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক এনজিও-র হয়ে কাজ করার জন্য তার বাবারও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সুরক্ষা পাওয়ার কথা। মরিয়মের লেখাটি ছিল বাস্তব আর সাহিত্যের মিশেল।

প্রতিযোগীদের বিচারকদের মধ্যে একজন ছিলেন মানবাধিকার কর্মী, যিনি মরিয়মের বাবাকে নিয়ে লেখাটা আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সামনে তুলে ধরেন। বেশ কজনকে ফোনেও জানান। ফলে সামনে আসে যে মরিয়মের বাবার গ্রেফতারিটা অন্যায়ভাবে হয়েছে এবং মুক্তির আবেদনপত্র গৃহীত হয়।

প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার তিনদিন পর মরিয়ম ঘরে ফিরে দেখে বাবা তার জন্য অপেক্ষা করছে। মরিয়ম এখন বিশ্বাস করে— কলম আর সবকিছুর চেয়ে শক্তিশালী।

 

সংবাদ বিরতি

আজ সকাল থেকে ইজরায়েলি বিমান ১৫৫টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন প্যালেস্তিনীয় এবং আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। যাদের মধ্যে ৮ জন শিশু এবং দুজন নারী। আজকের এই ধ্বংসলীলার সাক্ষী সেন্ট্রাল গাজা স্ট্রিপের আলগালা টাওয়ার এবং এর পাশাপাশি গাজার দক্ষিণ-পশ্চিমের আন্দালুস ও কায়রো টাওয়ারের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তিনটি বহুতল বাড়ি।

 

আমাদের চতুর্থ গল্পকার আফনান শারাভি। কুড়ি বছরের আফনান গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে গ্রাজুয়েট হয়েছেন। সে এখন সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আফনানের আশা একদিন মানুষ ভয়ের অনুভূতি ছাড়াই সত্য বলতে পারবে। এই গল্পটি আফনান ২০১৪ সালে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কর্মশালায় লিখেছিলেন। আমরা এখন আফনানের হাতে মাইক্রোফোন তুলে দিচ্ছি।

 

আইডেন্টিটি

সেটা ছিল মে মাসের এক শ্বাসরুদ্ধকর সকাল, যখন ১৫তম গল্পের জানলা দিয়ে একরাশ সূর্যের আলো আমার মুখে এসে পড়েছিল। সবেমাত্র চোখ খুলেছি, স্বপ্ন আর বাস্তবতার রেশ থেকে তখনো ঠিকঠাক বেরিয়ে আসতে পারিনি।

আমি তখন হাইস্কুলের পড়ুয়া, যার বিশেষ কোনও স্বপ্ন নেই। কিন্তু একটা বিষয়ে পরিষ্কার ছিলাম আমি, সেটা হল এই আরবদেশ আমার জন্মস্থান আর এখানেই থাকতে চাই আমি।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে টেলিভিশনে শোকাহত গলায় গাজা সম্পর্কে খবর শুনি আর নিত্যদিনের মতোই মা ডাকে নাস্তা করার জন্য। জানি খাবার টেবিলে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। না তাই বলে রুটি বা ডিমসেদ্ধর কথা বলছি না। আমি বলছি হুমকির কথা যা রাতদিন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আফনান তুমি যদি ইস্কুলে ভালো ফল না করো তবে আমরা তোমাকে গাজায় পাঠাব, তুমি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।

সকালের নাস্তার টেবিলে প্রতিদিনই হুমকির সুরে এই কথাগুলো বলতেন বাবা। এমনভাবে কথাগুলো বলতেন যাতে মনে হয় গাজা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম জায়গা, ওটা যেন একটা জেলখানা। বাবার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বলতাম না কিন্তু বই নিতে রুমে গিয়ে দেওয়ালগুলোকে বলতাম, আমি গাজায় যেতে চাই না। নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি কী এমন জায়গা— গাজা? কী আছে সেখানে?

গাজা কী, তা উপলব্ধি করলাম যখন টুয়েলভে পড়ি। আমার মোবাইলটা আরও কয়েকজন সহপাঠীর মোবাইলের সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। প্রিন্সিপাল স্থানীয় মেয়েদের মোবাইল ফিরিয়ে দিলেও আমার মোবাইল ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। আমি পরে বুঝেছিলাম স্থানীয় বলতে ওরা ইজরায়েলের মেয়েদের বুঝিয়েছিল। প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বলে এসেছিলাম— আপনি কীভাবে এমনটা করতে পারেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তুমি একজন প্যালেস্তিনীয়, তোমাকে যে আমাদের দেশে থাকতে দিয়েছি এটাই যথেষ্ট। তার কথা শুনে আমার যন্ত্রণা নিমেষে ক্ষোভে বদলে যায়। আমি সেদিন বুঝেছিলাম প্যালেস্তিনীয় হওয়ার অর্থ কী। আমার অবস্থা খাঁচার পাখির মতো, দূর থেকে নিজের বাড়ি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু পৌঁছাতে পারছি না। কারণ আমি প্যালেস্তিনীয়। আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে আমি কতটুকু বলতে পারব, কী করতে পারব, কী করতে পারব না। তাই একজন উদ্বাস্তু হিসেবে নিজের পরিচয় নিয়ে সচেতন হয়েছি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝতে শিখেছি কেন প্যালেস্তাইন একটি নিষিদ্ধ শব্দ। প্রিন্সিপালের উত্তর আমাকে সবকিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে। সেই মুহূর্ত থেকে একটা স্বপ্ন আমার হৃদয়ে গেঁথে যায়। স্বপ্নটা নার্স, শিক্ষক সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন নয়, স্বপ্নটা নিজের দেশের মাটিতে বসবাসের স্বপ্ন।

যত দিন যেতে লাগল, যাদের জন্য প্যালেস্তিনীয়রা নিজের পরিচয় হারিয়েছে তাদের প্রতি আমার ভেতরে প্রতিশোধস্পৃহা দানা বাধতে লাগল।

জুন মাস আসতেই আমরা কলেজ পাশের সার্টিফিকেট পেতে শুরু করি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে তখনও অবস্থান করছি। একদিন আমিও হাতে সার্টিফিকেট পেলাম, নিজের ফলাফল দেখে উৎফুল্ল হয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরে চিৎকার করে বাবাকে বললাম— বাবা তুমি বিশ্বাস করবে না আমি সত্যিই ভালো ফল করেছি। তিনি খুশি হয়ে প্রশংসা করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন— তুমি কোথায় পড়তে চাও এবার?

আমি বলেছিলাম— গাজায়।

 

সংবাদ বিরতি

১৯৭১ সালের পর আজ আবার গাজার পশ্চিমে আল-ওয়েহদা স্ট্রিট এবং আল-রিমাল এলাকার বাড়িগুলোর উপর ইজরায়েল সবচেয়ে হিংসাত্মক বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় সমস্ত গাজা স্ট্রিপ জুড়ে ৫১ জন প্যালেস্তিনীয়র মৃত্যু হয়েছে। কোনওরকম সতর্কীকরণ ছাড়াই আল-ওয়েহদা স্ট্রিটের ছটি আবাসন বিল্ডিংকে বোমা ফেলে ধ্বংস করা হয়েছে, আর এই ধ্বংসলীলায় ৪৪ জন নিহত হয়েছেন যার মধ্যে ১৮ জন শিশু এবং ১৩ জন নারী রয়েছেন।

 

বন্ধুরা আজকের আমাদের অনুষ্ঠানের শেষ গল্পকার ২১ বছরের ইয়াসমিন এইচ আল-মাসরি। মাসরি গাজা শহরেই থাকেন। আমাদের পঞ্চম গল্পকার গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির পড়ুয়া। মাসরির স্বপ্ন আরব দুনিয়া কী, প্রকৃত মুসলিম এবং ইসলাম ধর্ম কী— একদিন সে সত্য সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরবে। শুরু হচ্ছে আজকের মতো আমাদের শেষ গল্প।

 

একটি আতঙ্কের মুহূর্ত

আমি কখনও কল্পনাও করতে পারি না সেদিন আমার হার্টবিট যতটা দ্রুত হচ্ছিল তেমন হার্টবিট কোনও মানুষের হতে পারে। সেটা ছিল গত গ্রীষ্মে গাজা যুদ্ধের সময়কার ঘটনা। সেই রাতে টানা গোলাবর্ষণ চালিয়েছিল ইজরায়েলি হামলাদার।

আমাদের মন, মাথা, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ওই বীভৎসতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার পরিবারের সদস্যরা এই উৎকণ্ঠায় সময় গুনছিলাম যে কোনও একটা গোলা যেন বাড়ির ওপর এসে না পরে। সেদিনটায় গরম ছিল অস্বাভাবিক, কিন্তু তবুও আমরা সকলে জামাকাপড় পড়েই শুয়ে পড়েছিলাম। আমরা প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে রেডিও শুনতাম, সেদিন রেডিওতে দু ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির খবরটা শুনে স্বস্তি পাই। আমি ভেবেছিলাম যাক অনেকদিন পর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে, কতদিন যে আমরা রকেট বিস্ফোরণের শব্দ ছাড়া ঘুমোইনি তা বলতে পারব না। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘন্টায় কমপক্ষে একটি রকেট আমাদের মহল্লায় এসে পড়েছে আর আমরা কেঁপে উঠেছি।

আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, আচমকা একটা বিস্ফোরণের শব্দ আমাকে জাগিয়ে তোলে। বারুদের গন্ধ নাকে আসতেই মাথার ভেতর যতসব খারাপ চিন্তাগুলো আসছিল। বাবা-মা-ভাই-বোন সকলে ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি পাগলের মতো এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটছি। ছোট বোনগুলো অঝোরে কাঁদছে। আমাদের বিল্ডিংয়ের সাততলাটা তখনও কাঁপছিল। আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলাম কী ঘটছে। এর আগে আমরা দুটো যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু এই প্রথম আমরা চোখের সামনে মৃত্যু দেখছি। আমাদের বিল্ডিংটা ঠিকই ছিল কিন্তু রাস্তার পাশের অন্য বিল্ডিংগুলো সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের মতোই একটা সাততলা বিল্ডিং যার প্রতি তলায় চারটি করে অ্যাপার্টমেন্ট ছিল সেটাই ছিল রকেটের লক্ষ্যবস্তু। হাজার হাজার ভাবনা সেই মুহূর্তে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরে জানতে পারি ইজরায়েলি বাহিনি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে এবং তিনজনকে হত্যা করেছে।

এরপর দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আর এই এক সপ্তাহ জুড়ে আমরা শুধু টিভিতে শহিদদের সংখ্যা গুনে গেছি। এই ঘটনার ৫১ দিন পর একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা আমাদের কাছে স্বর্গে যাওয়ার মতো মনে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া, ক্লাস শুরু হওয়া, পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সমবেত হওয়া সবকিছুকে উপহারের মতো মনে হয়েছিল যা আমার চাওয়া-পাওয়ার থেকেও ছিল অনেক মূল্যবান।

আমার পক্ষে এটা কল্পনা করা যথেষ্ট কঠিন পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে চিন্তা না করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে। শান্তিতে বসবাস করাটা আমার কাছে অলৌকিক মনে হয়, কারণ আমি একটা যুদ্ধক্ষেত্রে বাস করি, যে যুদ্ধটা অভিশপ্ত। যদিও এই যুদ্ধই আমার জীবনকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে এবং আমাকে শিখিয়েছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান।

 

শ্রোতাবন্ধুরা আমরা অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে পৌঁছে গেছি। এতক্ষণ আপনাদের সামনে আমাদের ৫ তরুণী গল্পকার গল্প পাঠ করে শোনালেন, আমরা আশা রাখছি সেই সব গল্পের ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে ইনবক্সে মতামত জানাবেন। আমাদের সময় কমে আসছে। আজকের মতো অনুষ্ঠানের শেষ ঘন্টা বাজানোর আগে গল্প নয় আসুন শেষ করি একটা কবিতা দিয়ে। কবি তহা মোহাম্মদ আলি। প্যালেস্তিনীয় কবি। ইজরায়েলি হামলার কারণে যাঁকে ১৭ বছর বয়সের পর থেকে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাতে হয়েছে। আসুন এবার তাঁর কবিতায় পৌঁছানো যাক—

 

প্রতিশোধ

মাঝে মাঝে ভাবি
যদি বাবার হত্যাকারীকে খুঁজে পেতাম
বাড়ি ধ্বংস করে
দেশ থেকে নির্বাসন দিয়েছিল যারা— খুঁজে পেতাম
এবং যে আমাকে হত্যা করে
হেসে উঠতে চায়
তাকে যদি পেতাম
নিজেকে প্রস্তুত করতাম প্রতিশোধের জন্য

কিন্তু পারতাম কি?
তারও তো মা বাড়িতে অপেক্ষায় আছে
বাবা আছে— দেরি করে বাড়ি ফেরা ছেলের দুশ্চিন্তায়
ভাই-বোন আছে
প্রতিবেশী আছে
অন্তত ফেরার মতো একটা বাড়ি আছে

স্ত্রী আছে
সন্তান আছে
তারা যদি অনুপস্থিতি সহ্য করতে না পেরে খোঁজ শুরু করে
হাসপাতালে
বন্ধুর বাড়িতে
রাস্তায়

না, আমি পারব না
মৃত্যুযন্ত্রণা দিতে
মরে যাওয়ার দুঃখ দিতে
তার চেয়ে সে যদি গাছের শুকনো ডাল হয়ে ভেঙে পড়ে
আর তাকে উপেক্ষা করতে পারি
এতেই আমি সন্তুষ্ট
এই যে মনোযোগ না দেওয়া
সেই তো এক প্রতিশোধ