বুদ্ধদেব ঘোষ
সাংস্কৃতিক কর্মী, ‘সাতচল্লিশের দেশভাগ’ গ্রন্থের সম্পাদক
মৃত্যুর পর বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে দেবতা বানানো উপমহাদেশের চিরায়ত রেওয়াজ। তাতে সুবিধা অনেক। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান দেবতা। দূর থেকে শুধুমাত্র সুবিধাবাদী শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেই চলে, আর কোনও দায় থাকে না। কিন্তু একটু অন্যরকমভাবে ভাবলে কিছু না কিছু দায়দায়িত্ব সমকালীন বাস্তবতায় এসেই যায়। চিন্তার এই ধারায় হেঁটে বিচার করতে হয়, মানুষটা ঠিক কতটা বড়। মানুষ তাঁর চিন্তার সমান বড় এবং চিন্তার কারণেই বড়।
উপমহাদেশ জুড়ে আজ ধর্মীয় উগ্রতার কালো মেঘ সম্প্রীতির ভূখণ্ড বাংলার আকাশকেও অন্ধকারে খানিকটা ছেয়ে ফেলেছে। ঠিক এখনই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার জাগ্রত প্রহরী সদ্যপ্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরী-র চিন্তাগুলো আমাদের আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া খুব জরুরি। তাঁর জীবনব্যাপী রেখে যাওয়া কাজই তাঁর চিন্তার কাঠামোকে স্পর্শ করার প্রধান সড়ক।
জীবনের শুরু বা অতীত সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশালের উলানিয়ার মাটির সন্তান বরিশালিয়া উচ্চারণেই বলতেন “আমার অতীত, গ্রাইম্য অতীত।” কৃষিপ্রধান পূর্ববাংলার সবারই অতীত তাই। খুব অল্প বয়সেই সাংবাদিকতার হাতেখড়ি তাঁর। ১৯৫০ সালে বরিশালের আসমত আলী খান ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেই ‘ইনসাফ’ নামে একটি পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এই অবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স পাশ করেন। এর কিছুদিন পরে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে নিজেই সম্পাদনা করেন ‘দৈনিক আওয়াজ’, যা মূলত ৬ দফার প্রচার করত।
দেশভাগের পরে আব্দুল গাফফার চৌধুরী জীবনের শুরুতে অল্প কিছুদিন সোস্যালিস্ট পার্টি করেছিলেন, যাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল ছিল আরএসপি-র সঙ্গে। এই পর্বে তাঁর নেতা ছিলেন বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখ। সহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোজাম্মেল হক— এঁরা ছিলেন ঐ সময়পর্বে তাঁর রাজনৈতিক সাথী। পরবর্তীতে মোজাম্মেল হক কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
সারাজীবন ধরে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। কলকাতার আনন্দবাজার সহ ৩/৪টি পত্রিকায় নিয়মিত কলামনিস্ট ছিলেন। লন্ডনেও সুদীর্ঘকাল কলামনিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। সাংবাদিক জীবনের দায়িত্ব সামলেও লিখেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক। টেলিভিশন-নাটক রচনা করেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং অভিনয়েও কিছুটা পা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
কিন্তু জীবন জুড়ে সমস্ত কাজের মধ্যে তাঁর রচিত একটিমাত্র কবিতাই তাঁকে অমরত্ব দিয়ে গেল। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”— এই চিরঅমর বেদনানীল সঙ্গীতের জন্যই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর অন্যান্য সৃষ্টিগুলো সামান্য ঢাকা পড়ে গেছে, কিন্তু মুছে যায়নি। এছাড়াও তাঁর যে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিবিড় বাঙালি পাঠকের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে আছে, তা হল দীর্ঘ ষাট বছর ধরে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর অনবদ্য নিবন্ধগুলি। কী লিখেছেন তিনি? বিষয় একটাই। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার তিনি নিরলস কথাকার। এক মুহূর্তের জন্যও এই পথ থেকে তিনি কক্ষচ্যূত হননি। একেই তো অনেকে বলেন ‘একুশের চেতনা’। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস থেকেই পবিত্র একুশের চেতনা উৎসারিত। বাংলার ইতিহাস মূলত লোকায়ত ইতিহাস। রাজরাজাদের দর্প-দাপটের বাইরে সেই ইতিহাসের পরতে পরতে সম্প্রীতির যূথবদ্ধ যাপন। ইসলামও এখানে লোকায়তই ছিল। বাঙালি সাময়িকভাবে তার নিজের মৃত্তিকার দিকে না তাকিয়ে কেউ দূরের আরবদেশ অথবা পাকিস্তানের হোমল্যান্ডে মজে ছিল। কেউ উত্তর ভারতের ব্রাক্ষণ্যবাদের সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছিল। তার ভাষাসংস্কৃতিতে টান মারার পরে বুকে হাত দিয়ে সে বুঝল, বাঙালিত্বই তার একমাত্র ঠিকানা। বদরুদ্দীন উমর এই অনুসন্ধানকেই বলেছেন “বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ যাত্রা”।
সৃজনশীল মানুষের কোনও কোনও সৃষ্টি জাতির প্রয়োজনেই অমর হয়ে যেতে পারে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর অমর সৃষ্টি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” কবিতাটাও তাই। তিরিশ লাইনের কবিতা থেকে সম্পাদিত ছয় লাইনের গান আবিশ্ব বাঙালির হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গেছে, যা অকল্পনীয়। তিনি নিজেও কি ভেবেছিলেন তাঁর কবিতা গান হয়ে জাতির ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কতই বা তাঁর বয়স ছিল তখন। মাত্র আঠারো উনিশ বছরের এক কিশোর। ঢাকার আকাশে সেদিন মেঘ ছিল না। কিন্তু কালো পিচের রাস্তা ছাত্র-জনতার রক্তে ভেসে গিয়েছিল। সেই জমায়েতে উপস্থিত গাফফার চৌধুরী আহতদের দেখতে বন্ধুকে নিয়ে মেডিকেল কলেজে ছুটলেন। গিয়ে দেখলেন একটা লাশ। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গেছে। শহিদ রফিকের লাশ। তাঁর মনে হল এটা তাঁর ভাইয়েরই মৃতদেহ। বর্ণমালার মর্যাদার জন্য যে প্রাণ দিয়েছে। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় কবিতাটি লিখে ফেললেন। বাকিটা ইতিহাস। কবিতাটি প্রথমেই বিখ্যাত হয়নি। মুদ্রিত আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা ওই বছর শহিদ স্মরণে প্রচারপত্র বা লিফলেট বের করে। সেই লিফলেটের পিছনের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছিল কবিতাটি। গান আকারে প্রথম সুর দিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ। তারপরে সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তিনজনেই বরিশালের লোক। তিনজন যখন বসেন, আব্দুল লতিফ প্রস্তাব দেন আলতাফ মাহমুদের সুরটি অনেক হৃদয়স্পর্শী। তাঁর সুর বাদ দিয়ে আলতাফ মাহমুদের সুর যেন গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১ সালে রাজাকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করে। হয়তো এই সুর দেওয়ার অপরাধে। আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর লেখনীতে বলেছেন যে, পশ্চিম ভারতের শাসকশ্রেণি চায় না বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। তাদের ভয় পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। এতে দুই বাংলার আরও কাছাকাছি আসার স্পৃহা বেড়ে যাবে। বরং ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিনত হলেই তাদের লাভ। এই একটা বিষয়ে পশ্চিমপাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর সাথে তাদের অদ্ভুত মিল।
পাকিস্তানের গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম ব্যক্তি যিনি দাবি করেছিলেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। একাত্তরে তাই সপুত্র ধীরেন দত্তকে পাক মিলিটারি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। বাহান্নতে ছাত্ররা দাবি করেছিল “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। গোটা পূর্ব বাংলা গর্জে উঠেছিল ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠায় সেপাই’ উপন্যাসের খিজির আলি বা ‘হাড্ডি খিজির’-এর মতো মেহনতি জনতাও এই আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়েছিল। যাদের কথা ইতিহাসে লেখা হয় না। বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শ্রমজীবীর ঐক্য গড়ে দিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। তারই ধারাবাহিকতায় ত্রিশ লক্ষ শহিদ, দু লক্ষ মা বোনের উপর পাশবিক নির্যাতন পেরিয়ে একাত্তরের বাংলাদেশ অর্জন করেছিল পদ্মার পূর্বপারের বাঙালি। সেই বাংলাদেশে কী করে সাম্প্রদায়িকতা মাথা চারা দিচ্ছে, সেইটেই ছিল আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উদ্বেগের কেন্দ্রীয় বিষয়। এ প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধুর পার্টি আওয়ামী লীগের বিচ্যুতি দেখলে নির্মম সমালোচনা করেছেন তাঁর লেখনীতে। অর্জিত বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য, ক্ষেতমজুরের অধিকার, শ্রমিকশ্রেণির লড়াই— এই বিষয়গুলিতে গাফফার চৌধুরী খুব বেশি অবস্থান নেননি তাঁর লেখনীতে। তাঁর রাজনীতিগত অবস্থানটা বুঝতে হবে। তবুও একজন আলোকিত, অসাম্প্রদায়িক মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সারাজীবন কলমকে তলোয়ার হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। এ কম কথা নয়। যে জাতীয়তাবাদ বা জাতিসত্তার লড়াই মৌলবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তা অবশ্যই প্রগতিশীল। সেই জীবনটাই তিনি রেখে গেলেন আমাদের সামনে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা জাতিসত্তার লড়াই কখনও বাংলার একাংশে সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, এই বিশ্বাসে তিনি স্থিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন তিনি মৃত্যুর আগে প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের যুগান্তর পত্রিকায়। সত্যজিৎ রায় তাঁকে বলেছিলেন “বঙ্গবন্ধু বিশাল ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু তোমাদের বঙ্গবন্ধু নন, আমাদেরও বঙ্গবন্ধু। কিন্তু মুশকিল হল তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তোমরা শুধু বাংলাদেশে আটকে রেখেছ। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম সহ সারা ভারতে বাঙালি জাতির লড়াইয়ের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে প্রয়োজন।” তিনি এও বলেছিলেন জাতির অর্ধাংশে পূর্ণ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বলেছিলেন আবেগ খানিকটা কমে এলে এবারের সাম্প্রদায়িকতা আর পাকিস্তানের হোমল্যান্ড ধরে আসবে না। আসবে আন্তর্জাতিক ইসলামের রূপ ধরে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন না ততদিন। বাংলাদেশ একা পারবে না সেই চাপ রাখতে। আর এপারেও সর্বভারতীয় হিন্দুত্বের চাপ রাখতে পারবে না এপারের বাঙালিরা। সেইজন্যই ভাষার ভিত্তিতে অখণ্ড বাঙালিয়ানার চর্চায় জোর দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কীভাবে মিলে গেল বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রস্রষ্টার ভবিষ্যদ্বাণী।
আমাদের প্রয়োজনের তাগিদেই তাই একুশের চর্চাকে প্রবাহিত করা উচিত। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের চক্রব্যুহে ঢূকে পড়েছি আমরা। নাগরিকত্ব আইনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ভারতরাষ্ট্রের বাঙালিরা। অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পের ভিতরে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নির্বিকার। ভাষা-সংস্কৃতি-জাতিসত্তার প্রবল লড়াই এই পিপু-ফিসুদের ঘুম ভাঙাতে পারে। শুধুমাত্র কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু বাঙালির উপর ভর করে হবে না। যেতে হবে অনেক দূর। হাড্ডি খিজিরদের কাছে। যদি এই লড়াই কারও অভীষ্ট লক্ষ্য হয়, সেক্ষেত্রে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মতো মানুষদের চিন্তাচেতনাই আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।