Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, নীল হ্রদের তীরে — পর্ব ৭ (শেষাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তিনটে শালিখ

৩.

এলোপাথারি ঘুরে বেড়াতে শানুর বরাবর ভালো লাগে। উদ্দেশ্যহীন, যেদিকে দুচোখ যায়। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। এইসময়টা তার নিজের, বাবার শাসনের আওতার বাইরে। নিয়মের বেড়াজাল কেটে পালিয়ে থাকার ইচ্ছাটা এখন একটা আকর্ষণীয় অভ্যাসের নিয়মিতি পেয়েছে। কোন রাস্তায় যাচ্ছে সেটা নিয়ে যখন ভাবনা থাকে না তখন নানানরকম উৎপটাং চিন্তা মাথায় জড়ো হয়। স্কুলের পথে যেতে যেতে হামেশাই তার অমন দিক ভুল হয়ে যেত। ফেরার সময় বেশি। কখনও ইচ্ছায়, কখনও বা না-বুঝে। যেদিকে প্রাণ চায় চলেছে, কখনও এমন হয়েছে যে বাড়ি ফেরার রাস্তা গেছে গুলিয়ে। তেমন হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যেত আর তার জন্য বাঁধা ছিল পরমেশের বকা। মারও কি কম খেয়েছে!

এখন সেই রাশটা একটু হলেও আলগা। স্কুল ফাইনাল হয়ে গেছে। পরমেশের চাপে তার হায়ার সেকেন্ডারির পড়া শুরু হয়ে গেছে যদিও। বিনিত স্যারের খপ্পর থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে সেই যে একবার বলেছিল বাবার কাছে পড়তে তার ভালো লাগে, ব্যস! শুরু হয়ে গেছে পরমেশের রুটিন। ছেলেকে এগিয়ে রাখার জন্য যা যা করার দরকার কিছুতেই খামতি রাখে না পরমেশ। অঙ্কটা ভালো করে করলেই দেখবি আর কোনও বাধা নেই। হায়ার সেকেন্ডারির ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই আমি তোর সিলেবাসের পুরো অঙ্কটা করিয়ে দিতে চাই। একবার ক্লাস শুরু হয়ে গেল তখন শুধু তোর আইআইটির জন্য পড়া। ফিজিক্সটাও। ওরা গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের কনসেপ্ট থেকে অনেক প্রশ্ন করে। চাল থেকে কাঁকড় সরাতে হবে তো। তখন তোর সঙ্গে সেগুলো নিয়ে বসব।

সুতরাং বাবার হাত থেকে সেরকম নিস্তার নেই শানুর। কিন্তু তবুও স্কুল না-থাকায় দিনের অনেকটা সময় ফাঁকা থাকে। পরমেশ কলেজে, সুতরাং সেও তখন কাটা ঘুড়ি। সাইকেল নিয়ে যেদিকে প্রাণ চায় টো টো কোম্পানি। দুপুরের শোতে সিনেমাও দেখেছে কয়েকটা, একা। বাড়িতে জানে না। কিন্তু ওসবের থেকেও শানুর আকর্ষণ দিকবিদিক সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। দুর্গাপুরে এখন অসম্ভব তাপদাহ। যে গরমে রাস্তাগুলো ভাজা ভাজা হয়ে যায়, পিচ গলে গাঢ় কালো, রোদের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে কেমন ঝাপসা লাগে। চাঁদিতে গরমের টুপি হয়ে বসে যাওয়া সেই রোদ মাথায় নিয়ে শানু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

কোথায় যাবে না জেনে ঘুরলেও শানুর ফেভারিট জায়গা রেলস্টেশন। খুব ভালো লাগে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেনের আসাযাওয়া দেখতে। একেকটা ট্রেন এসে দাঁড়ায়, কত লোক যে নামছে! দুর্গাপুর বড় স্টেশন, এখানে এতরকমের কারখানা, কতরকমের কাজে লোকে আসছে রোজ। তেমনি যাচ্ছেও। যারা আসে অন্য জায়গা থেকে তারা ফিরে যায়। এখানকার লোক যায় কলকাতা। সামনেই আসানসোল, সেখানে যাওয়ার লোকেরও তো অভাব নেই। স্টেশনে তাই সব সময়েই জনস্রোত। শানু বসে বসে দ্যাখে। মাথায় মাল নিয়ে কুলিরা ছুটে যায়। কতরকমের হকার যে ফেরি করতে আসে এই স্টেশনে। পকেটে টাকা থাকলে শানুও কিছু কিনত। বাদামভাজা কেনে হয়তো, বসে বসে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম খায় আর মানুষ দ্যাখে।

মাধ্যমিকের আগে বাবা একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। এইচএমটি। ঘড়িতে বিকেল চারটে বাজতে টুকটুক করে স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে হাঁটা মারে শানু। স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে স্টেশন রোড ধরে। সামনেই রেলের খেলার মাঠ। এই সময়ে এখানে অনেকে ফুটবল পেটাপেটি করে। খেলাধুলায় শানু কোনওদিনই তেমন দর নয়। তবু অন্যেরা খেলছে দেখতে বেশ লাগে। মাঠের ধারে সাইকেল রেখে ছেতড়ে বসল ঘাসের উপর। বেলা পড়েছে। কিন্তু গরমে মাঠ এখনও তেতে আছে। তবু যারা খেলছে তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। ফুটবল প্র্যাক্টিস চলছে। এরা সব সত্যিকারের সিরিয়াস খেলুড়ে, রোদ জল নিয়ে ভাবে না। শানুর চোখে পড়ল মাঠের ধার দিয়ে একা দৌড়ে চলেছে একটা ছেলে। একটার পর একটা পাক খেয়ে চলেছে, কোনও ক্লান্তি নেই। যারা ফুটবল খেলছে তাদের তাও অপোনেন্ট থাকে, একটা উত্তেজনা। কিন্তু এমন একা দৌড়ে চলে, কোথায় এত মোটিভেশান পায় কে জানে!

মাঠ ছেড়ে আকাশের দিকে তাকাল শানু। ফটফটে নীল আকাশ দেখা যায় না দুর্গাপুরে। কোক ওভেনের কালো ধোঁয়া সব সময়েই। এত কারখানা থাকলে আকাশের নীল থাকে নাকি? এই জন্য দুর্গাপুরের আকাশ ভালো লাগে না শানুর। তার ছোটবেলায় একটা আকাশ ছিল, বড় পরিষ্কার, স্বচ্ছ। হিউস্টনেও গরম ছিল। কিন্তু এমন গা কড়কড়ে নয়। এখানের মাঠের ঘাস যেমন চলটা ওঠা, মাটি দাঁত বের করেছে এখানে ওখানে, তার ছোটবেলার পার্কগুলো ছিল ঘন সবুজ। কার্পেটের মত। ফুলের গাছ থাকত কেয়ারি করা। কেন যে বাবা ওই দেশটা ছেড়ে চলে এল! কলেজ শেষ করে সে আবার ফিরে যাবে ওই দেশে।

ছেলেটা দৌড় থামিয়ে শানুর থেকে একটু দূরে এসে পা ছড়িয়ে বসেছিল। বেশ পেটানো চেহারা। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিচ্ছে। গায়ে ঘাম জবজব। হবে না, কতক্ষণ দৌড়াচ্ছিল। খানিক বাদে আরেকটা লোক দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির। এ এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে! এসেই হম্বিতম্বি। থামলি কেন স্বপন? মোটে তো চার পাক মেরেছিস। আরও দুই পাক দেওয়ার কথা আজ।

–ফালতু কিচাইন করো না তো। আমি আর পারছি না ব্যস। তাছাড়া আমি এত পাক মেরে কী করব বলো তো? আমি কি পাঁচ হাজার মিটার দৌড়ে নামব এবার? শুধু শুধু খুঁজলি করছ।
–নখরা করিস না স্বপন! তেড়ে উঠল লোকটা। একটা রেস জিতেই মুখে খুব বড় বড় বুলি বেরোচ্ছে দেখি। কোচ কে রে, কালীপদ মাস্টার না স্বপন গুই? একটু চোখের বাইরে হলেই তোর এই ইঞ্চি মারা স্বভাব। একবার অন্য দিকে তাকিয়েছি, ব্যস উনি মাঠের থেকে হাওয়া।

ছেলেটা তবু ওঠার নাম করে না।

–ওঠ বলছি স্বপন, না হলে আমি শিউলির বাপকে গিয়ে বলছি। একে তোমার আর জামাই করা হল না, এক নম্বরের ফাঁকিবাজ।

এবার দাঁত বের করে হাসল ছেলেটা। তুমি না একটা ঘাঘু মাল। ওই এক তুরুপের তাস পেয়েছ, বারবার খেলছ। তোমার ওই বংশী মিত্তির না একটা চ্যাটের বাল। পিলহারামি। শিউলির বাপ না হলে দিতাম দুটো উল্টে। বলে কি না ওর হোটেলে আমাকে বিকেলে গিয়ে বাসন সাফ করতে হবে। দেবে সাকুল্যে দশ টাকা। এমন পিছনছাঁচা লোক আগে দেখিনি।

–তুই না বলে দিলি?
–তো? একে দৌড় করিয়ে করিয়ে আমার ব্যাটারি ডাউন করে দাও রোজ। এরপরে গিয়ে আমি ওর পাত কুড়াতে পারব না। স্বপনের কোনও চাঁই-চুকুর নেই, মুখে পেটে এক কথা।

তার মানে বংশী মিত্তির খেপবে। আবার না বাড়িতে হানা দেয়। লোকটাও তেমনি হারামি। জামাই করবে যদি ঠিক করে থাকে তাহলে বাসন তোলার কাজ দেওয়া কেন? ভেবেই মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে গেল কালীপদর। রেগেমেগে বলল, মুখ খারাপ করাস না আমার স্বপনা। যেটা করতে হবে, সেটা করতেই হবে। ক মাস গেলেই স্টেট মিট, এখন একটু এদিকওদিক হওয়ার জো নেই।

স্বপন গাঁইগুঁই করলেও এবার উঠে দাঁড়াল। ব্যস শুধু দুই পাক, তারপর আর খুঁজলি কোরো না। আবার দৌড়ের ছন্দে ফিরে গেল ছেলেটা। পিছন পিছন গরু তাড়ানোর মত কালীপদ।

শানু কান পেতে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। কালীপদ যেন ঠিক পরমেশের মত। শুধু ভাষাটাই যা আলাদা। কিন্তু শানু এই ছেলেটার মত এমন চটাস চটাস কথা বলতে পারে না। এর কথায় বেশ ধার। তবে সে এমন মুখে মুখে উত্তর দিলে পরমেশ ছেড়ে দিত না এরকম। দমাস দমাস করে পড়ত দু ঘা।

আরও দু পাক দৌড়ে এসে থপ করে বসল ছেলেটা। পিছন পিছন কালীপদ। অ্যাই, অ্যাই বসলি কেন?

–কথায় কথায় কানের কাছে চমকিও না তো।
–এরকম হুট করে বসতে বারবার মানা করেছি। মাসলে টান পড়ে কতবার বলেছি তোকে? পায়ের কাছে বসে দুহাতে কালীপদ স্বপনের কাফ মাসল মালিশ শুরু করে দিল।

এবার ফিক করে হাসল স্বপন। তুমি মাইরি আমাকে খুব ভালোবাসো কালীদা। আমার বাপও কোনওদিন এরকম করবে না।

–এই জন্যেই তো আমি তোর বাপ না। কোচ। বাপের কথা শুনিস কি না শুনিস, আমার কথা মন দিয়ে শুনবি। এই কমাস একটু নিয়ম মেনে চল। শরীরটাকে মনে করবি মন্দির। রাত্তিরে ঠিকঠাক সময়ে ঘুমাবি। না হলে সকালবেলায় দৌড়ে তেজ থাকে না।
–বস্তিতে তো থাকো না, তাহলে বুঝতে। সন্ধ্যার পর সব ব্যাটা মাল খেয়ে হল্লা করবে। তারপর শুরু হবে কিচাইন, কারও না কারও সঙ্গে লাগবেই। মাগ পেটানো তো আছেই। সেসব থামল তো শুরু হবে গাবগুচি খেলা, দরমার বেড়া বেয়ে আহা উহু শুনলে কোন চুদির ভাই ঘুমাতে পারে বলো তো কালীদা?
–ব্যস ব্যস হয়েছে। তোর মুখটা না নর্দমা। শিউলি যে কেন তোর সঙ্গে ঝুলে পড়ল সেটা ভেবেই আশ্চয্যি লাগে। যা বললাম মনে রাখবি, আর সকালবেলা ঠিক পাঁচটায়। কাল তোদের বৌদি রুটিমাংস পাঠাবে বলেছে।
–কেন, কাল অন্নপূর্ণার খাবার আসছে না? চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল স্বপন। হোটেলের খাবার না এলে, শিউলির সঙ্গেও দেখা হবে না। সেটাই মাথায় ঘাঁই মারল প্রথমে।
–কালকে ডাবল খাবার, রবিবার তো।
–তাহলে তো তিনগুনা খাটাবে। তুমি মোটে সিধে লোক নও। খাওয়াবে শক্ত, হাগাবে রক্ত।

কালীপদ এর উত্তর না দিয়ে মাঠের পাশে ফেলে রাখা সাইকেল তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। স্বপন সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের উপর চিত হয়ে শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিল। কালীদাটা বড্ড খাটায়।

ছেলেটার কথাবার্তা একদম অন্যরকম। শানুর পরিচিত মহলে এরকমভাবে কথা বলে না কেউ। গালাগালিও ছুটছে ফুলঝুরির মত। একটা অজানা জীবন, বেঁচে থাকার ভিন্ন সুর। সব মিলিয়ে যেন এক ধরনের শক্তির প্রকাশ যেটা শানুকে খুব আকর্ষণ করছিল। বাইরে আলাদা হলেও একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছিল যেন। দৌড়ানো নিয়ে ছেলেটা যেরকম খ্যাঁচখ্যাঁচ করছিল আর কালীদা বলে লোকটা ওকে তাড়া করে ফিরছিল, শানুর নিজের দৌড়ের সঙ্গে অসম্ভব মিল।

–দৌড়ানো নিয়ে লোকটা তোমাকে খুব জ্বালায়, তাই না?
–এই মাকরা, তোর আবার পিতলা পিরিত কিসের? খুব বিরক্তির সঙ্গে এক চোখ ফাঁক করে কথাটা বলে স্বপন আবার চোখ বুঁজল।

ওর কথাগুলো এতক্ষণ শুনতে খুব মজা লাগছিল। কিন্তু নিজের উপর একটা নমুনা ঝরতেই চুপসে গেল শানু।

ছেলেটা আবার চোখ মেলল। ফিক করে হেসে বলল, ঝিনচ্যাক কাটিং দেখেই মনে হয় ভদ্দরবাড়ির মাল, আমার সঙ্গে গাঁড় ঘষাঘষি করে কী করবি?

এইভাবে কেউ বললে তার সঙ্গে কেমন করে কথা চালাতে হয় শানু জানে না। মুখ খুলে বোধহয় ভুলই হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, পাশে বসেছিলাম, কানে আসছিল তোমাদের কথাগুলো, তাই বললাম।

–আমার আন্টসান্ট কথায় ব্যোমকে গেলি? একদিক হয়ে ফিরে হাতে ভর দিয়ে মাথাটা তুলে ধরল স্বপন। কিসের ফিকিরে এসেছিস এখানে?
–এমনি বসে ছিলাম। নার্ভাস হয়ে ঠোঁট চাটল শানু।
–অ। মালদার বাপ, মাঠে এসে হাওয়া খাবি। একা কেন? আমার বাপের রোকরা থাকলে আমি ঠিক একটা চামরি মাগী জুটিয়ে বসতাম।
–চামরি মাগী মানে কি?

হো হো করে হেসে উঠল স্বপন। যাসসালা, মদনার ঘরের বদনা একটা। চামরি মাগী মানে আইটেম বে, খাপচু মাল। বলে নিজের চ্যাটাল বুকের উপর হাত মুঠো করে মেয়েদের বুক বানিয়ে দেখাল স্বপন। টিপেছিস কখনও?

ওর কথায় শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠছিল শানুর। কী টিপব?

–আরে ল্যাওড়া, তোদের ঘরের মেয়েদের চুলকুনি হয় না?

কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল শানুর। টপ করে উঠে পড়ল।

–পালাচ্ছিস কেন বে? বোস এখানে।

শানু যন্ত্রচালিতের মত আবার বসে পড়ল।

স্বপন এবার উঠে বসল। সাদা কাঠি আছে?

শানু বোকার মত চেয়ে রইল।

–ও, তুই তো আবার একটা উদো, আমার কথা বুঝবি না। সিগারেট বে, সিগারেট। এই কালীমাস্টারের পাল্লায় পরে বিড়ি খাওয়া ভুলেই গেছি।
–না, আমি তো সিগারেট খাই না।
–তোর জীবনটা কী রে? কোনও মেয়ের চুসকি কাটিসনি, সাদা কাঠি ফুঁকিস না। তোরও মনে হয় আমার মত একটা কালীমাস্টার আছে।

এইবার মাথা নাড়ল শানু। আছে তো। আমার বাবা ঠিক তোমার কালীমাস্টারের মত, সারাক্ষণ ছুটিয়ে বেড়ায়।

–আরে ম্যাওড়া, তুই দৌড়াস না কি?
–না, না সেরকম দৌড় নয়। ওই পড়াশোনা-টোনা আর কি। শানুর মনে হল এই ছেলেটা হয়তো কোনওদিন স্কুলের ছায়াও মাড়ায়নি। তার পড়াশোনা করাটা এর কাছে আর একটা হাসির খোরাক হবে।
–কোন ক্লাসে পড়িস তুই?
–স্কুল ফাইনাল দিলাম।
–পাশ করেছিস?
–রেজাল্ট বেরোয়নি এখনও।
–আমার না বেরোলেও জানি, ডাহা ফেল।
–তুমিও স্কুল ফাইনাল দিয়েছ? স্বপনের চেহারা আর পুরুষ্টু গোঁফ দেখে এরকমটা ভাবেনি শানু।
–দুইবার। ইংরাজি আর অঙ্কে হড়কেছিলাম। গান্ডুগুলো আমাকে পাশ করতে দেবে না ঠিক করেছে। অঙ্কে আবার টপকাব।

শানু প্রবোধ দিল। তুমি এত ভালো দৌড়াও, এইসব পরীক্ষার হিসাবকিতাবে তোমার কী কাজ?

–চোদনাগুলোকে কে বোঝাবে রে? যত্তসব ফালতু বখেরা। চুপ করে একটু ভাবল স্বপন। পাশ না করলে রেলের চাকরিটা ফসকে যাবে আর বাপটা আমার ছালচামড়া তুলে নেবে। শিউলির চক্করটাও ফেঁসে যাবে।
–শিউলি কে?

এবার দাঁত বের করে হাসল স্বপন। আমার আইটেম। মারকাটারি মেয়ে একটা।

–অঙ্কটা আমি দেখিয়ে দিতে পারি। ঠিক পাশ করিয়ে দেব।
–যাত্তেরি! তুইও আমার মাস্টার হবি? এক কাজ কর না, তুই আমার হয়ে খেপ খেলে দে না।
–মানে? এইসব কথার অর্থ বের করতে হিমশিম খাচ্ছিল শানু।
–আরে মাকরা, আমার জায়গায় তুই বসে যাবি। পাশ করার জন্য যতটা দরকার, করে কেটে পড়বি।

শানু মাথা নাড়ল। না, না সেটা করতে পারব না। তুমি ভেবে দেখো। আমি তো রোজ এদিকে আসি। তোমার দৌড়ের পর অঙ্ক দেখিয়ে দেবো।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল স্বপন। দ্যাখ  তুই কি আমার মত ছুটতে পারবি? ব্যাটারি ডাউন হয়ে যাবে। ওরকম যতই বোঝাস, লসাগু গসাগু দেখলেই আমার প্যান্টে গু। মজার কথা বলেছে এমন ভাব করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল স্বপন।

–তুমি যদি এখন আমাকে মারতে তাড়া করো, আমি ছুটব না? তোমারও তেমনি, শিউলিকে পেতে হলে তোমাকে চাকরি পেতে হবে, চাকরির জন্য অঙ্কে পাশ চাই।
–তুই তো তিলেখচ্চর একটা! হাসতে হাসতে না বললে ভয় পেয়ে যেত শানু। বাইরে থেকে উদগান্ডু মনে হলেও, তোর ক্যাপাকাইটি আছে। এই হচ্ছে স্বপনের প্রশংসার ধরন।
–আমি কালকে আমার অঙ্কের বইটা নিয়ে আসব। একটা খাতাও।
–আমিও তোর জন্য একটা বই আনব। পিচিক হেসে বলল স্বপন।
–আমার জন্য? কী বই?
–তুই বাঁড়া, মেয়েদের মাই ধরিসনি এখনও। দ্যাখ তো একবার। এমন বই আনব না, ইঞ্জিন গরম হয়ে যাবে।

শানুর কান এখনই গরম হয়ে গেছিল। শানু জানে না কিসের মধ্যে জড়াচ্ছে। কিন্তু একটা নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার আনন্দ হচ্ছে। জীবনের একটা দিক যেটা বাবা জানবে না।

 

৪.

বিকেল হলেই মাঠের ধারে আসাটা শানুর কাছে এখন নেশার মত।

কালীপদও এখন চিনে গেছে শানুকে। দেখলেই দূর থেকে হাত নাড়ে। শানু স্বপনকে অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছে শুনে খুব খুশি। দ্যাখ না পরপর দুবার অঙ্কে ডাব্বা পেল। কত পেলি যেন স্বপন?

–তেরো।
–আহা, এমন অপয়া নাম্বার পেলি!
–গাঁড় মারি তোমার অপয়া নাম্বারে। চোদ্দ পেলে চোদনাগুলো কি পাশ করিয়ে দিত?
–থাক, থাক আর মুখ খারাপ করিস না। তুমিও তো এবার স্কুল ফাইনাল দিয়েছ, ভালো পাশ দিয়েছ নিশ্চয়।

শানু মাথা নেড়ে হ্যাঁ করল। তার নিজের ওইদিকটা যত গোপনে রাখা যায় ততই ভালো। কি দরকার ওদের জানিয়ে যে সে এখন সাতশো ষাট শানু।

–বা বা বেশ বেশ। অঙ্কে কত পেলে?

শানু একশো পেয়েছে। কিন্তু একটু কমিয়ে বলল, সত্তর।

–দারুণ, দ্যাখ স্বপন সত্তর পাওয়া ছেলে তোকে অঙ্ক শেখাচ্ছে, অন্তত তিরিশ পার করিয়ে দেবেই।

কালীপদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর আরও খোঁজখবর নিয়েছে। ও, তুমি প্রফেসারের ছেলে? এবারে কালীপদ একেবারে গদগদ। তাহলে আর চিন্তা নেই রে স্বপন। পড়ানোটা ওর রক্তে আছে। কিন্তু কথা শুনিস। বাচ্চা বলে ওর উপর হম্বিতম্বি করলে আখেরে তোরই ক্ষতি।

শানু এখন স্বপনকে অতটা ভয় পায় না। হাসতে হাসতে বলল, এখন আমাকে ম্যাওড়া, মাকরা বললেও আমি টসকাই না।

দৌড়ে এসে বসে বসে দম নিচ্ছিল স্বপন। চোখ তুলে বল, আমিও কেমন ট্রেনিং দিচ্ছি দেখো কালিদা। কদিন আগেও শানুটা কিরকম উদগান্ডুমার্কা কথা বলত, এখন কথায় কেমন পিড়িং এসে গেছে।

–ওকে বেশি পিন করিস না স্বপন। বখাস না ছেলেটাকে। তোর কাজ অঙ্কে পাশ করা, সেটার দিকে দ্যাখ।

কিন্তু কালীপদ সাইকেল প্যাডেল করে বেরিয়ে গেলেই, চোখ চকচক করে শানু জিজ্ঞেস করে, এনেছিস?

–রোকরা আছে? হাফ পাত্তি লাগবে। ইংরিজি মাল, ফাটাফাটি আইটেম একেকটা। আগেরটার থেকে আরও চাপকি, কোনও পাইলিং নেই। স্বপনের চোখ দিয়ে রস গড়াচ্ছিল যেন। আমাকে এই বইটা তোর জন্যে কিনতে হল। শানু পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা নোট বের করে স্বপনের হাতে ধরিয়ে দিতেই স্বপন তার ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে গামছায় জড়ানো একটা বই বের করল।

উত্তেজনায় শানুর গায়ের রোঁয়া উঠে গেছিল। বইটা হাতে নিয়ে সামনের পাতাটা দেখেই কেমন দম আটকে এল যেন। তাড়তাড়ি আধাআধি মুড়ে নিজের ব্যাগে অঙ্কের বইয়ের পাশে ঢুকিয়ে দিল।

–ওরে ঢ্যামনা। ব্যাগে ঢুকালি কেন? আসার আগেই হাতে পেয়েছি, আমিও বাঁড়া একবার চোখ বুলাইনি।
–এইখানে সবার সামনে দেখব?
–তো? এতবড় মাঠ, কে কোথায় কী করছে কেউ জানে? দ্যাখ গিয়ে কেউ ঝোপের আড়ালে গাবগুচি খেলছে, আর আমরা দুটো ফুদি মারানোর ছবি দেখলেই দোষ?

শানু আবার ভয়ে ভয়ে বইটা ব্যাগ থেকে বের করে। প্লেবয় ম্যাগাজিন, আমেরিকার। বছর খানেকের পুরনো, দু-এক জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ। স্বপন কোথা থেকে জোগাড় করল কে জানে!

–দাগগুলো কিসের বুঝতে পারছিস? চোখ টিপল স্বপন। কোনও হারামি বইয়ের উপরেই খিঁচে দিয়েছে।

গা ঘিনঘিন করে উঠল শানুর। কিন্তু মুখে কিছু বলতে ভরসা পেল না। তাছাড়া দেখার ইচ্ছে শানুরও ষোলো আনা। তবুও মিনমিন করে বলল, অঙ্কটা আগে করে নিলে ভালো হত না?

–দেখলি তোর চোখের সামনে কালীদা কিরকম দৌড় করাল। বিচি শুকিয়ে গেছে একেবারে। কটা আইটেম দেখে নিয়ে ইঞ্জিন গরম হলে তোর অঙ্কটাও মাথায় সেঁধাবে ভালো।

স্বপন আর শানু এবার হুমড়ি খেয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। পাতার পর পাতায় দেশবিদেশের মেয়েদের উন্মুক্ত শরীর যেন তার দিকে তাকিয়েই হাতছানি দিচ্ছে। স্বপন আগের বইটা দিয়েছিল সেটা ছিল দেশি। ছবিও ভালো নয়, এত কিছু খোলামেলাও নয়। এই বইটায় কোনও রাখঢাক নেই। নারীশরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্নভাবে পাতায় পাতায়। আর সেইসব মেয়েদের চোখের চাহনি যেন বলছে আয় আয় আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখ, ধরে দ্যাখ। শরীরের মধ্যে কিরকম একটা করছিল শানুর। কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে, স্পর্শসুখ পাওয়ার জন্য একটা ছটফটানি।

স্বপন থপ করে শানুর প্যান্টের উপর হাত রাখল। উরিত্তাড়া! তোর ঘোড়া তো টগবগাচ্ছে শানু।

শানু ছিটকে সরে গেল। বিনিত স্যারের কথা মনে এলো। আমাকে ছুঁবি না স্বপন! আমার ভালো লাগে না। এরকম তেজের সঙ্গে কোনওদিন স্বপনের সঙ্গে কথা বলেনি শানু।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই নিজেই খিঁচে নিস। স্বপনের কোনও ফারাক পড়ল না। চাইলে একটা মাল জোগাড় করে দিতে পারি তোকে। শুধু ছবিতে কি হয়, একেবারে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকবি।

শানুর যেন দম আটকে আসছিল উত্তেজনায়। কীভাবে?

–সে লাইনের মেয়ে আছে। টকিজে ঢুকে পাশাপাশি বসে যাবি। তারপর যেমন ইচ্ছা চুসকি নে। পর্দায় অমিতাভ ক্যালাবে, তুই বসে বসে রগড়া। তেমন পয়সা ফেললে ফুদ্দিতেও আঙ্গলি করতে পারবি।

শানু জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটছিল।

–দম আছে তো বল। কিন্তু এর জন্য পুরো এক পাত্তি লাগবে। একটা কচি মাল জোগাড় করে দেব।

শানুর এতক্ষণে অঙ্ক শেখানো মাথায় উঠেছিল।

পরে মনে হয়েছে কেন যে স্বপনের কথায় রাজি হয়ে গেল।

দুর্গাপুর টকিজে শানুর সঙ্গে একটা মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল স্বপন। ততক্ষণে ভয়ে শানুর হাত পা ঠান্ডা। মেয়েটা আগে থেকে সিট নিয়ে বসেছিল। চাপা ঘামের গন্ধ সস্তা পারফিউমের সঙ্গে মিশে একটা বন্য সুবাস শানুর নাকে এল। কচি মেয়ে কিছুই নয়, অন্ধকারে একটু একটু চোখ সইতে মনে হল বেশ ডাঁটো মহিলা। স্বপন অবশ্য বলেছিল পাকা মালে শাঁস ভালো পাবি, নাহলে চামড়ার নিচে সিধে আঁটি!

শানু কী করবে বুঝতে পারছিল না। শরীর উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপছিল ভিতর থেকে। সিট ছিল একেবারে শেষের সারিতে এক কোনায়। হলেও বেশি লোক নেই। তাই ভয়ের কিছু নেই অত। কিন্তু শানু জানে না কী করা উচিত। কোলের কাছে হাত জড়ো করে বসেছিল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়েটা নিজেই ফিসফিস করে বলল, নতুন নাকি? যা করবার ঝটপট করে নে, আমি তিন ঘণ্টা এলিয়ে বসে থাকতে পারব না এখানে।

–কী করব? শুকনো গলায় বলেছিল শানু।

চাপা গলায় হাসল মেয়েটা। অ, ন্যাকা! বলে নিজের মাথাটা শানুর মুখের খুব কাছে নিয়ে এসে অন্ধকারে মাপল একবার। ওর মুখের হালকা পানের সুবাস গরম হলকার মত শানুর গালে এসে পড়ল। দুধের দাঁত পড়েনি ছেলের, এসে গেছে কচলাকচলি করতে। মাল জোটে বটে একেকটা। খপ করে মেয়েটা শানুর ডান হাতটা ধরল। ওর আঙুলগুলো শিশ্ন ছুঁয়ে যেতেই কেঁপে উঠল শানু। মেয়েটা অবশ্য ওখানে একটু টোকা মেরেই ওর হাত ধরেই টান দিয়েছে। সোজা শানুর ডান হাতটা ঢুকিয়ে নিল ওর শাড়ির আঁচলের তলায়। ওর পেটের চামড়ার সঙ্গে ঘষা লাগতেই শরীরটা কিরকম গুলিয়ে উঠল শানুর। ভিতরে কীরকম যে হচ্ছে।

–মরণ! এবার কি দুদু নিয়ে মুখে ধরতে হবে নাকি? হিসিহিসিয়ে বলল মেয়েটা। ভয়ে শানু পাশ ফিরে তাকাতেও পারছিল না। মেয়েটা নিজেই পটপট করে ব্লাউজের বোতাম খুলে শানুর হাতটা চেপে ধরল নিজের বুকের উপর। বেশ ভরা বুক মেয়েটার, অর্ধনমিত। আঙুল পুরো ছড়িয়েও বেড় পেল না শানু। এরপর শানু নিজেই জানে না ও কী করছিল। হাতের উপর নিজেরই যেন কোনও জোর নেই আর। পাগলের মত ওর ডান হাত মেয়েটার স্তনমর্দন করে যাচ্ছিল। নখ বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল ওর উঁচু হয়ে ওঠা স্তনের বোঁটায়। মেয়েটা ব্যাথায় আঁতকে উঠল। এই আস্তে আস্তে, শকুনের মতো এমন হামলে পড়ছিস কেন রে ম্যাওড়া। ময়দা মাখছিস নাকি তুই?

শানু থতমত খেয়ে হাত সরিয়ে নিতেই মেয়েটার এবার খিলখিল হাসি। যদিও খুব চাপা, শানুর মনে হল ফাঁকা হলেও দু-একটা লোক মাথা ঘুরিয়ে দেখল যেন। শানুর ভয় লাগছিল এখুনি কেউ না ডেকে ওঠে, আরে সাতশো ষাট শানু, এখানে কী করছিস?

–ওরে আমার কচি নাং, লাজুকলতা হয়ে গেলি যে। মাইয়ে যত খুশি হাত বোলা, কিন্তু চিমটি কাটিস না অমন। দেখি তোর বাঁড়াটা! খপ করে ওর প্যান্টের উপর হাত রেখে আবার চাপা হাসি। ইঞ্জিন একেবারে তেতে আছে তো রে। রুমাল আছে সঙ্গে?

মেয়েটার হাত ওর প্যান্টের বোতাম খুলে ভিতরে ঢুকে গেছে। কী অসহ্য সুখে অস্থির লাগছিল শানুর শরীরটা। মেয়েটার আঙুলগুলো শানুর যৌনাঙ্গের উপর খেলে বেরাচ্ছে। মুঠো পাকিয়ে ঘন ঘন ওঠা নাবা করাচ্ছে। যেন চকমকি পাথরে ঘষাঘষি হচ্ছে, এখুনি আগুন জ্বলে যাবে। শানু হ্যাঁ বলতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। কিংবা মুখ খুললেই অন্যরকমের শব্দ বেরিয়ে যাবে ভয়ে দাতে দাঁত চেপে থাকল। শুধু বাঁ হাত দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে কোনও মতে রুমাল বের করে থাইয়ের উপর ফেলে দিল শানু।

মেয়েটা কাজ শেষ করে শানুর পায়ের কাছে ভেজা রুমালটা ফেলে উঠে চলে গেছে। অনেকক্ষণ শানুর যেন নড়বার কোনও শক্তি ছিল না। সব হয়ে গিয়ে এখন ওর মনে একরাশ ভয়। ঘৃণাও। এটা সে কী করল। এ কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে শানু।

তার চেয়েও বেশি ভয়, কেউ যদি দেখে ফেলে থাকে। আজকাল দুর্গাপুরে অনেক লোক তাকে চিনে গেছে। বাবার কানে কোনও খবর পৌঁছালে একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না। এই কথাগুলো হ্যাঁ বলার আগে কেন যে মনে আসেনি!

ঠিক করল আর ওই মাঠে ফিরে যাবে না। কক্ষনও না।

 

৫.

এবারের ন্যাশানাল মিট নাগপুরে।

কালীপদর ন্যাশানালে যাওয়ার সাধ এতদিনে সার্থক। নিজে যখন দৌড়াত সে সুযোগ এসেছিল, হাতে এসেও ফসকে গেছে। তারপর সুবীর গেল, কিন্তু রেলের হয়ে। নিজে যেতে পারেনি, সে দুঃখ কালীপদর বহুদিনের। স্বপন স্কুল ফাইনাল পাশ করতে না পারায় একদিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে, রেলে কিংবা অন্য কোথাও চাকরি হয়ে যেত না হলে ঠিক। স্টেট মিটে জাতীয় রেকর্ড ভেঙে যা সাড়া ফেলে দিয়েছে স্বপন। আনন্দবাজারের খেলার পাতায় ছবি, দু লাইন লেখাও। দৌড়ের জন্য যেটুকু বরাদ্দ। মল্লিকা খবর পড়ে রেগে গেছিল, ছেলেটা কি বেইমান! তোমার কথা একবার বলতে পারত।

–না, না মল্লি সেরকম নয়। ও তো আর গাভাস্কার নয় যে ফলাও করে একপাতা জুড়ে লিখবে। আমার সামনেই তো কথা হচ্ছিল। আমার কথা বারবার বলেছে স্বপন। তবে ন্যাশানালে যদি সোনা পায় আর এশিয়ান গেমসের জন্য কোয়ালিফাই করে, তখন— ভেবেই চকচক করে উঠেছিল কালীপদর চোখ। জানে শুধু ওইরকম সময়েই দৌড়ের লোকদের খেলার পাতায় জায়গা হয়, চাই কি প্রথম পাতায় তেমন তেমন হলে। শ্রীরাম সিং এসেছিল তো সারা পাতা জুড়ে।

কিন্তু সাড়া পড়েছে দুর্গাপুর শহরে। বংশী মিত্তির হেলেদুলে বসেছে। কালীপদ যে মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি সেটা ধরতে পেরেছে।  এই আনন্দে সকালের খাবারটা ফ্রি করে দিল। বংশীর যেরকম এক পয়সা ফাদার-মাদার, ওর জন্য সেটা বিশাল ব্যাপার। তবে সবচেয়ে সুবিধা হয়েছে স্বপন আর শিউলির। স্বপনের আজকাল অন্নপূর্ণা হোটেলে জামাই-আদর। শিউলির সঙ্গে দেখা করাতেও আর সেরকম অসুবিধা নেই। এমনকি নাগপুরে যাওয়া নিয়েও বংশী হ্যাঁ করে দিল। কালীপদ এতটা আশা করেনি। যদিও স্বপন বারবার খোঁচাচ্ছিল। যাও না কালীদা, বলে দ্যাখো। শিউলি সঙ্গে গেলে তেজ পাব।

শুনে রাগ হয়েছিল খুব। কেন রে, শিউলি তোর কোচ না ডাক্তার?

–ও তুমি বুঝবে না কালীদা। তুমি খোঁচরের তাড়া খেয়ে সুবলকে ছুটতে দেখেছ? একেবারে গাঁড়ে দম দিয়ে ছোটে তখন। তোমার স্টপ ওয়াচ নিয়ে দাঁড়িও তখন, দেখবে অলিম্পিক রেকর্ডের ঝাড় উখরে নিয়েছে।
–তাহলে কি দৌড়ের সময় তোর পিছনে লাঠি নিয়ে তাড়া করব?
–সুযোগ থাকলে সেটা তুমি ছাড়তে না। আমার জন্য শিউলিও তেমনি গো। আমি দৌড়াবার সময় শিউলিকে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখি। সব সময়ের এঁড়েপনা ছেড়ে একটু লজ্জা লজ্জা মুখে বলেছিল স্বপন। নিজের ভালোবাসার কথাটা এমনভাবে শিউলিকেও বলেনি কোনওদিন। মনে মনে ভাবি যত ভালো ছুটব, শিউলির বাপ তত তাড়াতাড়ি ওকে আমার হাতে দিয়ে দেবে।
–আচ্ছা, আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।

কালীপদ গিয়েছিল বংশীর কাছে। শিউলি যদি আমাদের সঙ্গে নাগপুরে যায়, ছেলেটার দৌড় আরও ভালো হবে বংশীদা। আমাদেরই মঙ্গল। মেয়েকে ছাড়বে?

বংশীর মোটেই মত ছিল না। সোমত্ত মেয়ে, কীভাবে ছেড়ে দিই বলো তোমাদের সঙ্গে? সমাজ বলে একটা ব্যাপার আছে না?

–আহা ছেলেটাকে তো তুমি মেনে নিয়েছ বংশীদা। আজ বাদে কাল তোমার জামাই হবে। একটু ইয়ে করলে যদি দেশবিদেশে যাওয়ার সুযোগটা হয়ে যায়। নাগপুরে জিতলে যাবে ব্যাঙ্কক এশিয়াডে, ভেবে দ্যাখো একবার! কালীপদ সবরকমভাবে বুঝিয়েছে। সে না হয় মল্লিকাও আসবে আমাদের সঙ্গে। তাহলে তোমার অসুবিধা হবে আর?
–এই বয়সের মেয়ে, এমনভাবে ছাড়তে ভয় লাগে। বুঝলে না? কিন্তু কিন্তু করছিল। দেখি একবার ওর মার সঙ্গে কথা বলে। শেষ অবধি রাজি হয়ে গেল। তবে মিনতি মল্লিকাকে পাখিপড়া করিয়েছে, মেয়ের একদম ল্যাজ ধরে থাকবে। ওরা দুটিতে সুযোগ বুঝে ঘষাঘষি করবে এমন না হয়। মেয়ের যেন গায়ে একটা আঁচড় না লাগে।
–আহা, ওকে কেউ মারধোর করবে নাকি ওখানে?
–আমি কি সেই কথা বলেছি। বিয়ের আগে কোনও কাণ্ড ঘটলে ওর বাপের চেহারা দেখো তখন। এমনিতেই ছোট জাত, রিক্সাওয়ালার ছেলে বলে মনে হুতোশ চেপে রেখেছে। নেহাত কাগজে নামটাম বেরোল, তাই মান্যতা দিচ্ছে। পান থেকে চুন খসলে আমাকে ধরে পেটায়, মেয়ের মুখে নুড়ো গুঁজে দেবে।

মল্লিকা শুনে শিউরে উঠেছে। যতরকমভাবে পারে শিউলির মা মিনতিকে ভরসা দিয়েছে। আমি আছি দিদি, মনে সোয়াস্তি রাখো। তবু নিজের মনে খুচখুচ, দায়িত্ব নিচ্ছে পরের মেয়ের। কোনওরকম বখেরা না হয়!

মল্লিকা যাবে এমন কথা ছিল না শুরুতে। শিউলির জন্যেই যত। স্বপনের সঙ্গে কালীপদ যাবে, সেটায় স্টেট অ্যাসোসিয়েশানের পারমিশান ছিল। কোচ সঙ্গে থাকবে। কিন্তু মল্লিকা তো পারবে না।

–সে না হয় আমি দেব তোমার ট্রেনের খরচ। তুমি আর শিউলি হোটেলে থাকবে একসঙ্গে। আমি থাকব স্বপনের সঙ্গে স্পোর্টস হস্টেলে। অসুবিধা কি তোমার?

সত্যি বলতে অসুবিধা আর কি। বাচ্চাকাচ্চা নেই। কোথাও কক্ষনও যাওয়া হয় না। বেড়ানোও হল এই ফাঁকে। তাই খারাপ লাগছিল না মল্লিকার। কিছু দেখার আছে ওখানে?

–এত বড় শহর, কিছু তো থাকবেই দেখার। তাছাড়া ওখানকার কমলালেবুর খুব নাম। শীতকাল, কমলা খাবে মন ভরে।

চলল ওরা নাগপুর। কালীপদ, মল্লিকা, স্বপন, শিউলি। আর হরেন। এই ছেলেটাও ভালো করছে, একশো মিটারে ন্যাশানালের জন্য কোয়ালিফাই করেছে। যদিও পদক পাওয়ার আশা নেই এবার, কিন্তু সুযোগটা তো পেয়েছে। কালীপদর এতদিনের পরিশ্রম, এবার ফল পাকছে। তবে হরেনের জন্য মল্লিকারও দান আছে। ছেলেটাকে এমনভাবে আগলেছে, এখন একদম মল্লিকার ন্যাওটা।

হাওড়া থেকে গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস, নাগপুর যেতে সতেরো ঘণ্টা। ওরা কেউ কোনওদিন এত বড় ট্রেনযাত্রায় বেরোয়নি। উত্তেজনায় টগবগ। ট্রেনে খাবে বলে মল্লিকা অনেক খাবার বানিয়ে এনেছে। ঘন্টায় ঘণ্টায় খেলেও শেষ হওয়ার নয়। অন্নপূর্ণা হোটেল থেকেও এসেছে অঢেল খাবার। এসব কে গিলবে এখন কে জানে। কালীপদ স্বপন আর হরেনকে নিয়ে খুব স্ট্রিক্ট। খাবার নিয়ে হাঘরেপনা করবি না একদম। এই কটা দিন তোদের তপস্যা। খাওয়া একদম ইঞ্চি মেপে। আর রেস্ট নে। দুজনকে পারলে একটু বাদে বাদেই উপরের বাঙ্কে শুতে পাঠিয়ে দেয়। হরেন শাকালুর মত দাঁত বের করে হাসল। কালীদা, তুমি মাইরি এমন আন্টসান্ট কথা বলো, মনে লাগছে কি কুম্ভকর্ণ এলে খুব ভালো দৌড়াত।

–তোমায় আর পোঙাপাকামি করতে হবে না। হারামির হাতবাক্স তোরা একেকটা। চোখে চোখে না রাখলেই খুজলি করবি। গিয়ে দুদিন মাত্র হাতে সময়। যদি ভালো করে শোয়া বসা না করিস, দৌড়াতে নেমে করবি লবডঙ্কা।

মল্লিকার নজরদারি শিউলির উপর। বাবা মা তার ভরসায় পাঠিয়েছে। একটা দায়িত্ব থেকে যায়। তবে শিউলি মেয়েটা এমনিতে ভালোই। মল্লিকার সঙ্গে খুব জমে গেছে। বৌদি বৌদি করে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। স্বপন বারকয়েক পাঁয়তারা কষতে এসেছিল, পাত্তাও করেনি। স্বপন গুম হয়ে উপরের বাঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এই বয়সের মেয়ে, আগুন নিয়ে ঘোরা। নিশ্চয় মা মেয়েকে যথেষ্ট শাসিয়ে পাঠিয়েছে। এসব দেখে মল্লিকা অনেকটা নিশ্চিন্ত। একবার নাগপুরে পৌঁছে তো আর একসঙ্গে থাকার উপায় নেই! সেটা একদিক দিয়ে ভালোই। এইসব ভাবতে ভাবতে মল্লিকারও চোখটা লেগে এল। ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমটা ভালো আসে বেশ। কালীপদ তো তখন থেকে ঘুমাচ্ছে, নাক ডাকছে ফোঁরত ফোঁরত।

শিউলি অনেকক্ষণ মটকা মেরে পড়েছিল। বৌদি কখন ঘুমায় সেই ফিকিরে ছিল। মল্লিকা ঘুমাতেই আস্তে আস্তে উঠে বাঙ্কের সাইডে পা রেখে রেখে উপরের বিছানায় মুখ বাড়াল। স্বপন ঘুমাচ্ছে। কী করে যে পারে? তখন থেকে একবার ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য শিউলির বুকে ঢেঁকির পাড়, এর কোনও চার নেই নাকি? শিউলি স্বপনের ঠোঁটের উপরে তর্জনী রাখল। যদি হঠাৎ চমকে উঠে আওয়াজ করে বসে, সেই ভয়টাও আছে। কী ঘুম রে বাবা, সাড়া নেই? এইভাবে কেউ যদি এখন শিউলিকে দেখে, কী ভাববে কে জানে? স্বপনের সারা মুখে নরম হাতে বুলাতে থাকে শিউলি। গোঁফের চুলে কুড়কুড়ি দিল। ঝুঁকে পড়ে হাতটা থুঁতনি, গলা থেকে নেবে বুকের রোমে ঘুরতে শুরু করে। যখন শিউলি ভাবতে শুরু করেছে যে স্বপন কুম্ভকর্নের মেলায় হারান ভাই, তখনই খপ করে হাতটা পাকড়ে ধরল স্বপন। ধরেই উল্টো টান, আর একটু হলেই পড়ছিল শিউলি। কোনওমতে বাঁ হাতের পাতা স্বপনের মুখে না ধরলে ওর হাসির আওয়াজেই সবাই উঠে যেত। স্বপনের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, হাড়হাভাতে ছাড় আমাকে, উঠে আসতে দে আগে।

বাঙ্কের জায়গাটা এতো সরু। একজনের জায়গা হয় কোনওমতে। তার মধ্যে শিউলি স্বপনের পাশে সেঁধিয়ে গেল। যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় দুজন। স্বপনের কানে কানে বলল শিউলি। স্বপনের যেন আপত্তি!

এক কম্বলের নিচে জড়ামুড়ি করে দুইজনা। শরীরে শরীর লাগিয়ে যেন আগুন আর বাতাস। এমন কাছে আসায় বড় সুখ। সেই সুখের ওমে স্বপনের বুকে মুখ গুঁজে কি আরামে ঘুমিয়ে পড়ে শিউলি।

নাগপুরে ট্রেন পৌঁছায় একদম সকালে। কালীপদ আগে উঠেছিল। উঠে শিউলিকে না দেখে তার যায় যায় অবস্থা। মল্লি, মল্লি! মেয়েটা কোথায়?

মল্লিকাও ধড়মড় করে উঠে বসেছে। পাশের বাঙ্ক খালি। চাপা গলায় ডাকল, শিউলি, শিউলি! মেয়েটা যখন জামার বোতাম আঁটতে আঁটতে উপর থেকে নামল, প্রথমেই মনে হল ঠাস করে একটা চড় কষায়। পরের মেয়ে ভেবে সামলে নিল। হিসহিসিয়ে বলল, উপরে গিয়েছিলি কেন?

–কী করব বৌদি, এমন হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। উপরে বেশ গরম, দুটো শান্তিতে ঘুমাতে পারলাম। মুখে ভাব যেন কিছুই হয়নি।

কালীপদ খিঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, মল্লিকা সামলাল। এখন থাক, আগে নামার জোগাড় দেখো।

বাক্সপ্যাঁটরা প্ল্যাটফর্মে নামানো হল। যেতে হবে অম্বাঝারি। আগে ঠিক ছিল মল্লিকা আর শিউলিকে কোনও হোটেলে উঠিয়ে তারপর এরা যাবে। কালীপদ মত বদলাল। শিউলিরা কোথায় আছে স্বপন না জানাই ভালো। স্বপন যদি হোটেলে হাজির হয়, মল্লিকা সামলাতে পারবে না। অম্বাঝারিতে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি। ওদের টেকনিসিয়ান হস্টেল খালি করে অ্যাথলিটদের থাকার জায়গা হয়েছে। কালীপদ স্বপন আর হরেনকে নামিয়ে সেখানে ঢুকিয়ে দিল প্রথমে। মল্লিকা আর শিউলি বসে রইল ঝাড়া একটা ঘণ্টা। শিউলি এখন আবার মল্লির নেওটা হয়ে বসে আছে। রাগ কোরো না বৌদি গো। সারাদিন মনের মধ্যে চাঁই-চুকুর করে, একটিবার উপরে গেসলাম।

–আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। মল্লিকা এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায়নি। বয়সের গরম, ওর কী দোষ। তাকেই সামলে রাখতে হবে। এরা এখানে দৌড়াক শিউলি, আমি আর তুই জায়গাটা ঘুরে দেখব বরং।

কালীপদ ওদেরকে নিয়ে শ্রীলক্ষ্মীবিলাস বলে একটা হোটেলে তুলে দিল। এলাকাটার নাম সীতাবাল্ডি।

–সীতা তো বুঝলাম, বাল্ডি কী?
–এসব হবে কিছু এদের ভাষায়। শহরের কাছাকাছি, দিনে পঞ্চাশ টাকা। সামনে বাজারহাট আছে, ঘুরেফিরে দেখো। আমাদের থেকে একটু দুরেই থাকো, এই দুদিন কম দেখা হলেই ভালো। কালীপদ তখন ছেলেদের নিয়ে গ্রাউন্ডে যাবে বলে মুখিয়ে আছে। এদেরকে উঠিয়ে দিয়েই অটো নিয়ে চলে গেল।

মল্লিকা কোনওদিন কোনও হোটেলে থাকেনি। দোতলা ঘর থেকে বাইরের রাস্তা দেখে কী মজাই লাগছিল। এখানে অনেক বেশি লোক দুর্গাপুরের থেকে, না রে শিউলি?

শিউলিরও জীবনে প্রথম হোটেলবাস। ঘরের সঙ্গে বাথরুম আছে দেখে উত্তেজনায় টগবগ। কল খুলতেই মাথার উপর থেকে ঝরঝর করে জল। শাওয়ারের মুখটা ভেঙে গেছে, কলের মত হুড়হুড়িয়ে জল পড়ল। দেখো বৌদি, কেমন মাথার উপর কল রেখেছে সিনেমার মতন।

–ওরে মুখপুড়ি, সকাল সকাল ঠান্ডা জল লাগালি মাথায়। জ্বর হবে না? যা একবারে স্নান করে বেরো।

দুর্গাপুরের থেকে নাগপুরের শীত কম, তবু সকালবেলায় হিম-হিম ভাব আছে। শিউলি তার মধ্যেই ঠান্ডা জলে গা ধুয়ে বিছানায় পটাং করে এসে পড়ল। রাত্তিরে ট্রেনে একদম ঘুম হয় না বৌদি, এখন একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়।

এতক্ষণে রাগটা টপাত করে বেরিয়ে এল মল্লিকার। ঘুম হবে কী করে? পিরিত করতে পাছা দুলিয়ে উপরে চলে গেলে, তোরা একেকটা হাড়ে বদমাশ।

শিউলি এবার মল্লিকার গলা জড়িয়ে ধরল। এত রাগ কোরো না গো বৌদি, জোয়ান বয়সে তুমি কালীদার সঙ্গে সোহাগপিরিত করোনি বুঝি?

এবার নরম হয়ে ফিক করে হাসল মল্লিকা। তোদের কালীদার একেবারে মিলিটারি মেজাজ ছিল, অত সহজে বাগে আসে নাকি?

–এই ছোঁড়াটাও কিছু কম ভেবেছ তুমি? শিউলি ঘন হয়ে আসল আধশোয়া মল্লিকার কাছে। চোখে চোখে না রাখলেই পিতলা পিরিতে জুটে যাবে। শুনেছি অনেক মেয়েছেলেও ছুটতে আসে, তাই নাকি গো বৌদি?
–তোর কালীদা সঙ্গে আছে তো, আন্টসান্ট কিছু করতে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে একেবারে। ওর কাছে এসব খাতির নেই। চল বরং আমরা দুটিতে একটু ঘুরে দেখি। একটা কমলার গাছ যদি দেখতে পাই…

দুদিন কালীপদরা সত্যিই এল না। শুধু রেসের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা স্বপন আর হরেনকে নিয়ে উপস্থিত। দেখতে এলাম তোমরা কেমন আছ। কালকে দশটার সময় স্বপনের হিট, তারপর ফাইনাল। মাঝখানে হরেনের। এরকম চলতেই থাকবে। আমি তো আসতে পারব না, তোমরাই অটো নিয়ে সকাল সকাল চলে এসো।

কালীপদ যাই যাই করছিল। তাড়তাড়ি শুতে হবে, সারাদিন অনেক প্র্যাকটিস হয়েছে। ছেলেদুটোর বিশ্রাম দরকার। শিউলির খুব ইচ্ছে স্বপনের সঙ্গে আলু বোন্ডা খাবে। এটা নাকি নাগপুরের এক নম্বর খাবার।

–সেটা আবার কী?
–ওই আর কি ফুলুরির মতন, মধ্যিখানে আলুর পুর। মল্লিকা বুঝিয়ে বলল। কিন্তু শিউলি ওসব আজ ছাড়ান দে। কী সব তেলে ভাজে, আজ বাদে কাল রেসে নামবে, ছেলেগুলোর পেট ছাড়লেই মুশকিল।

শুনেই কালী এক কথায় নাকচ করে দিল। কাল বাদে পরশু সব হবে। আজ শুধু চোখের দেখা দেখাতে আনা। হেড কোচ আমার চেনা লোক বলে পারলাম, নাহলে হস্টেলের বাইরে ওদের ঘুরতে বেরোনো বারণ।

–একটা কথা শুনলাম, এখানকার গণেশ মন্দির খুব জাগ্রত, কালকের জন্য একটা পূজা দিলে হয় না? মল্লিকা কালীপদকে জিজ্ঞেস করতেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। গণেশ কি ওদের হয়ে দৌড়ে দেবে নাকি? তোমাদের সাধ হলে তোমরা পেন্নাম ঠুকে এসো। আমাদের এখুনি ফিরতে হবে, বলে স্বপন আর হরেনকে প্রায় গরুতাড়া করে ফেরত নিয়ে গেল।

মল্লিকা শিউলিকে বলল, চল আমরাই দর্শন সেরে আসি গে। ঠাকুরদেবতার দয়া না পেলে বড় কিছু হয় না। শিউলিরও সেই মত। দৌড়াবে স্বপন, কিন্তু কী হবে সেই ভেবে তার মুখ আমসি। সেটা মল্লিকার নজর এড়ায়নি। বুকের কাছে টেনে বলল, অত ভয় করিস না। প্রসাদ চড়িয়ে দেব এখন। কাল সকালে ছেলেদুটোর মাথায় ঠেকিয়ে দিলেই হবে।

যদিও পরদিন সেই সুযোগ সকালে হল না। এরা সব মাঠের মধ্যে। সামনে যাবে কী করে? না মল্লিকা, না শিউলি কোনওদিন স্টেডিয়ামে গেছে। এক টাকার টিকেট কেটেছিল, বেশ উপরের দিকে বসেছে। ওখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ফুল ছোঁয়ানো যায় না। শেষে কালীপদ ওদের দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে নিচের সারিতে আসতে বলল। জায়গা আছে অনেক, সেরকম ভিড় কোথায়। কিন্তু ওরা নিচে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কালীপদ ডাকায় তড়বড় করে নেবে নিচের সারিতে চলে এল। তারের বেড়া দেওয়া আছে, যে কেউ মাঠে ঢুকে যেতে পারবে না। শিউলি ওই বেড়ার ফাঁক দিয়ে কালীপদর হাতে প্রসাদি ফুলের মালসা ধরিয়ে দিতে নিশ্চিন্তি।

সারা মাঠ জুড়ে নানারকমের সাদা লাইন কাটা। বিভিন্নরকমের কমপিটিশান হয়েই চলেছে। শিউলি তাও আসানসোলে গিয়ে কয়েকটা জিনিস শিখেছে। মল্লিকা এতসব দেখেনি কখনও। পাক খেয়ে খেয়ে যখন শট পাট থ্রো করছে সেটা দেখে মল্লিকা হেসেই অস্থির। পোল ভল্ট দেখে তো হাততালি দিয়ে উঠল। হঠাৎ শিউলি মল্লিকার হাতটা চেপে ধরল। স্বপন!

মাঠের ধার দিয়ে সারি সারি লাল সাদা বারগুলো পেতে দেওয়া হয়েছে। শিউলি গুনে বলল দশটা। পুরো এক পাক মারতে হবে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল এক ছুটে মাঠের মধ্যে ঢুকে যায়। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। স্বপন কোনওদিকে তাকাচ্ছিল না। ওদের আগে আরও একদল হার্ডলস দৌড়ে নিল। তারপর স্বপনরা এক এক করে নিজেদের জায়গা নিচ্ছিল।

–হ্যাঁ রে শিউলি, ওরা সবাই এক লাইনে কেন দাঁড়ায়নি রে? দ্যাখ ভিতরের লোকটাকে কত পিছনে দাঁড় করিয়েছে।

শিউলি সেটা জানে না। স্বপন জায়গা পেয়েছে চার নম্বরে। স্বপনের বাঁদিকে তিনজন আর ডানদিকে চার। শিউলি ঠিক করেছিল রেস শুরু হলেই চোখ বুজে কালীর নাম করবে শুধু। তারপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু যেই না বন্দুক ছুটল আর স্বপন আর তার সঙ্গে আরও সাতজন ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত ছিটকে বেরিয়ে একটার পর একটা হার্ডলস পার করতে থাকল শিউলি দু হাত তুলে স্বপন স্বপন করে চেঁচাতে শুরু করল নিজের অজান্তেই। এমনকি মল্লিকাও। পরে অবশ্য মল্লিকা এই নিয়ে একটু লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু স্বপন যখন একের পর এক বাধা টপকে সবার আগে শেষের ফিতে ছুঁয়ে ফেলল শিউলি কি মল্লিকা কারুরই কে দেখছে তাই নিয়ে হুঁশ ছিল না। একটু বাদেই কালীপদ লাফাতে লাফাতে তারের বেড়ার কাছে এসে উপস্থিত। চোখমুখ উত্তেজনায় বড় বড়। স্বপন দুটো হিট মিলে শুধু ফার্স্ট আসেনি, স্টেট মিটে করা নিজের ন্যাশানাল রেকর্ড নিজেই ভেঙে দিয়েছে।

–ফাইনাল কখন হবে কালীদা?
–দু ঘণ্টা বাদে। একটু পরে হরেনের একশো মিটার আসছে।

কালীপদ উত্তজনায় থরথর করে কাঁপছিল। স্বপনকে গিয়ে একবার জড়িয়ে ধরল। স্বপন জিজ্ঞেস করল শিউলিরা এসেছে কিনা। কাজের কথা হল ছেলেটার মধ্যে তাপ-উত্তাপ কম। নিশ্চিন্ত মনে তোয়ালে জড়িয়ে বেঞ্চে বসে রয়েছে। এর মধ্যে শিউলি মাঠের ধার ধরে ধরে এসে পৌঁছে গেছে স্বপন যেদিকে বেঞ্চে বসে আছে ঠিক তার পিছনটায়। মাঝখানে লোহার তারের বেড়া। সেই বেড়া আঁকড়ে শিউলি ফিসফিস করে ডাকল স্বপন! স্বপন!

চমকে ফিরে শিউলিকে দেখেই স্বপনের দাঁত বেরিয়ে গেল। দৌড়ে এল বেড়ার ধারে। আজকে কী পাব সেটা বল রে শিউলি? শুধু চুমাতে হচ্ছে না আর।

বেড়ার ফাঁক দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে স্বপনের ঠোঁট ছুঁল শিউলি। সব পাবি, স্বপন। তোর জন্য আমার সব কিছু। সোনার মেডেল জিতে আন শুধু।

জোরে একটা নিশ্বাস নিল স্বপন। সত্যিই তাহলে জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। বড় ইলেক্ট্রনিক বোর্ডে ও নিজের নাম আর টাইমিং দেখেছে। হিটে সবার চেয়ে ভালো হয়েছে। এটা চালিয়ে যেতে পারলেই সোনার পদক। ভাবতেই গা শিরশির করছিল স্বপনের। গত দুই বছরে কোথার থেকে কোথায় উঠে এসেছে তার জীবন। এই সবের কাছে তাদের দরমার বেড়ার বাড়ি, বস্তির খেউর, আধপেটা খেয়ে বড় হওয়া সব মিথ্যে হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে যেন। জীবনটাই বদলে যাচ্ছে। এরপর শুধু একটা চাকরি আর শিউলি। আর কী চাই জীবনে? স্বপন তোয়ালে জড়িয়ে সেই স্বপ্নের মধ্যে ডুবে রইল।

হরেন সেরকম ভালো করতে পারল না। হিটে ছয় নম্বরে এল। একশো মিটারে হিটের পর সেমিফাইনাল হয়। কিন্তু সেমিফাইনাল যেতে পারল না। কালীপদ এবার ওকে নিয়ে সেরকম আশা করেনি। বয়স কম, এর পরেরবারের জন্য অভিজ্ঞতা হল তো একটা।

দু ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে গেল। মাঝে শুধু কালীপদ একবার এসেছিল বলতে যে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ান রবীন চাড্ডা হিটে থার্ড এসেছে। কিন্তু একটা নতুন ছেলে বিহারের মনিরুল ইসলাম খুব ভালো করেছে, স্বপনের ঠিক পরেই ওর টাইমিং। স্বপনকেও বলে দিল খেয়াল রাখতে।

ফাইনালের জন্য আবার সবাই সারি দিয়ে দাঁড়াল। স্বপনের এবার একটু টেনশান হচ্ছিল। কিন্তু বন্দুকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে গোলার মতো ছিটকে বেরোনোর পর আর কোনও টেনশন ছিল না। এখন শুধু  দৌড়ে যাওয়া। স্বপন ছিল তিন নম্বর লেনে, সাতে মনিরুল, আটে চাড্ডা। একটার পর একটা হার্ডল টপকে যেন উড়ে যাচ্ছিল স্বপন। সামনে কেউ নেই, কানে আসছিল কালীদা, হরেন, শিউলিদের চিৎকার, ‘স্বপন! স্বপন!’ আর হাওয়া কেটে কেটে স্বপ্নের সীমানায় পৌঁছে যাচ্ছিল ও একটু একটু করে। ঠিক তখনই চোখের কোনায় দেখতে পেল দুই নম্বর লেনে যেন কেউ এগিয়ে আসছে। সাত নম্বর হার্ডলসে ঠিক তারই সঙ্গে হার্ডলস ক্রস করল। জোরে নিশ্বাস নিয়ে শেষ একশো মিটারের স্প্রিন্টে চলে যেতে চাইল স্বপন। ঠিক তখনই টাইমিং-এ সামান্য গোলযোগ আর হার্ডলসে পা ছুঁয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল স্বপন। আট নম্বর হার্ডলসের বেড়া আর টপকানো হল না।

মাটিতে পড়ে ডান গোড়ালিতে অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে স্বপন দেখতে পেল দুই নম্বর লেনের শেখর সম্মুগম সবার আগে শেষ হার্ডলস ক্রস করে সোনা জিতে নিল। মনিরুল আর রবীন নিয়ে নিল পরের দুটো পজিশান। স্বপনের আর পোডিয়ামে ওঠা হল না।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]