সুমন কল্যাণ মৌলিক
প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
ভারতবর্ষে অধিকার-কর্মীদের উপর রাষ্ট্রের ধারাবাহিক আক্রমণের তালিকায় আরেকটি নাম যুক্ত হল— তিস্তা শীতলওয়াড়। মোদি-অমিত শাহের জমানায় বিরুদ্ধ মতের উপস্থিতি যেহেতু নিষিদ্ধ তাই তিস্তা একটি সংখ্যা মাত্র। কারণ তিস্তার গ্রেফতারির দুদিনের মধ্যেই অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক মহম্মদ জুবেইরকে তিন বছর পুরনো এক ফেসবুক পোস্টের কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। একথা সত্যি যে চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক, অধিকার আন্দোলনের কর্মী— এককথায় মুক্তমনা মেরুদণ্ডবিশিষ্ট যে কোনও মানুষ আজ সত্যের পক্ষ নেওয়ার কারণে রাষ্ট্রের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, তবুও আশার কথা হল হাজারো গ্রেফতারি, কুৎসা, শারীরিক নিগ্রহকে অস্বীকার করে আরও বহু মানুষ প্রতিবাদের পথে নামছেন, বিরুদ্ধতার চাবুক হাতে তুলে নিচ্ছেন।
তিস্তা শীতলওয়াড়ের উপর আক্রমণের কারণ বোঝা দুষ্কর নয়। তিস্তা ও তার সংগঠন ‘সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ নিরন্তরভাবে গুজরাট দাঙ্গায় আক্রান্তদের জন্য ন্যায়, ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০২ সাল থেকে কাজ করে চলেছে। ওই সংগঠনের মুখপত্র ‘কমব্যাট কমুনালিজম’ আজ সারা দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য পত্রিকা হিসাবে সমাদৃত। গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় সেখানকার শাসকদল বিজেপির ভূমিকা উন্মোচনের লড়াইতে তিস্তা প্রথম সারির মুখ এবং মূলত এদের চেষ্টার জন্য দাঙ্গার কুশীলব মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গী সহ অন্যান্যদের ভূমিকা জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে। একথা বহু-আলোচিত গুজরাটে যে নরমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা শাসক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। এমনকি তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রকাশ্যে রাজধর্ম পালন না করার দায়ে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বরখাস্ত করতে চেয়েছিলেন। কী ধরনের চক্রান্ত হয়েছিল, কারা সেই নীল নকশা প্রস্তুত করেছিল তা সাংবাদিক রানা আয়ুবের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘গুজরাট ফাইলস‘-এ সবিস্তারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে প্রশাসনের দু-একজন বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন যাঁদের মধ্যে অন্যতম গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন ডিজি আর বি শ্রীকুমার এবং আরেক আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট। আসলে যতই প্রশাসনকে ব্যবহার করে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি-শাহরা তাদের কলঙ্কিত ভূমিকাকে আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, এক দুঃসহ স্মৃতির মত এই গণহত্যা তাঁদের তাড়া করে বেড়াবে। তাই তিস্তা শীতলওয়াড়, শ্রীকুমারদের জেলে পোরা তাঁদের কাছে এক অনিবার্যতা।
মহম্মদ জুবেইরের ঘটনাটাও আলাদা কিছু নয়। সম্প্রতি বিজেপি মুখপাত্র নুপুর শর্মা হজরত মহম্মদ সম্পর্কে যে অবমাননাকর মন্তব্য করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরও উসকে দিতে চেয়েছিলেন তা সোসাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন জুবেইর। ফলে দেশে ও বিদেশে দল হিসাবে বিজেপি ও মোদি সরকারকে অশেষ বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। শুধু এই ঘটনাটি নয়, দীর্ঘ সময় ধরে বিজেপির আইটি সেলের পক্ষ থেকে সারা দেশে ঘৃণার রাজনীতি ফেরি করার যে ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তার স্বরূপ উন্মোচনে অল্ট নিউজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই চল্লিশ বছরের পুরনো এক হিন্দি সিনেমার দৃশ্যকে ব্যবহার করে দশ বছর আগের এক পোস্টকে প্রমাণ হিসাবে খাড়া করে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুরনো অভিজ্ঞতা যদি আমরা মাথায় রাখি তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় জুবেইর মামলায় আরও নতুন ধারা ও উপধারা যুক্ত করে নতুন নতুন অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে দীর্ঘ সময় জেলে আটকে রাখার ছক সাজানো হবে।
এবার যেভাবে তিস্তাকে গ্রেফতার করা হল তার পরিপ্রেক্ষিতটাও জেনে নেওয়া জরুরি। গোধরা পরবর্তী দাঙ্গা-পর্বে আমেদাবাদের চমনপুরা এলাকায় গুলবর্গা সোসাইটি আবাসনে ২০০২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে সন্ধ্যা মাত্র ছয় ঘন্টায় উন্মত্ত গেরুয়া বাহিনি যে তান্ডব চালিয়েছিল তাতে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। আবাসনের একের পর এক ঘরে ঢুকে সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের বার করে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে, আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, নৃশংসভাবে খুন করা হয় ৩৮ জনকে। ঘটনার পর খুঁজে পাওয়া যায়নি আরও ৩১ জনকে, যদিও পরে তাদের মৃতদেহ মেলে। এই ঘটনায় প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরিও খুন হন। ঘটনা চলাকালীন বার বার ফোন করেও প্রশাসনের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাননি এহসান জাফরি। এই ঘটনা ও সামগ্রিকভাবে গুজরাট গণহত্যা নিয়ে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় উঠলে রাজ্য সরকার বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে। দীর্ঘ তদন্তের পর কয়েকজনকে দোষী সাব্যস্ত করলেও সিট নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দেয়। সেই ‘ক্লিনচিট’কে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে মৃত সাংসদের স্ত্রী জাকিয়া জাফরি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। যদিও গুজরাট গণহত্যার দীর্ঘ দু দশক পরে সর্বোচ্চ আদালত বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও বিষয়টা শেষ হয় না। বিচারকরা জাকিয়া জাফরির এই অভিযোগকেই এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ সাব্যস্ত করে আবেদনকারীদের সমালোচনা করেছে ও পরোক্ষে তাদেরই শাস্তির দাবি করেছে। রায়ের পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সরাসরি তিস্তা শীতলওয়াড়ের নাম করে আক্রমণ শানান। এর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মুম্বাইয়ে পৌঁছে অপারেশনে নেমে পরে গুজরাট এটিএস, যার ফলশ্রুতিতে তিস্তা গ্রেফতার।
তিস্তার ঘটনায় অমিত শাহের ক্রোনোলজি, এটিএসের সন্ত্রাস, প্রশাসনের প্রতিহিংসা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই সমালোচনা ন্যায্য কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা ও অস্বস্তির হল সর্বোচ্চ আদালতের রায়। এই রায় শুধু জাফরির ‘বৃহত্তর চক্রান্তের’ মামলাটিকে খারিজ করেনি, একই সঙ্গে ওই নরমেধ যজ্ঞে স্বামী হারানো এক মহিলার আবেদনকে ‘চক্রান্ত’ বলে প্রতিপন্ন করেছে এবং জাকিয়ার সাহায্যকারীদের শাস্তির পক্ষে সওয়াল করেছে। ওই ঘটনায় ৫০ জন নৃশংসভাবে খুন হয়েছে, প্রশাসন ঘটনার সময় একাধিক ফোন পেয়েও নীরবতা অবলম্বন করেছে, কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই ঘটনায় আগেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাই ন্যায়বিচারের দাবি সঙ্গত। আদালত তা খারিজ করতেই পারে কিন্তু এই দাবি জানানোর জন্য তাদের চক্রান্তকারী ঘোষণা করা অভূতপূর্ব। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন সঠিকভাবেই এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছে। প্রাক্তন বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ, অমর শারন, আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং, কে এস চৌহান, ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ, সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা প্রমুখ ৩০০ জন নাগরিক প্রধান বিচারপতির কাছে এক খোলা চিঠিতে বলেছেন— “It appears that a petitioner or a witness, who diligently pursues a cause in the courts, runs a risk of being ‘put in the dock’ if the court deems the cause or devoids of merits.” এই রায় আসলে রাষ্ট্র পরিচালকদের বিরুদ্ধে নাগরিকরা যাতে মুখ না খোলে তার জন্য এক সতর্কবার্তা। এই রায় যে কতটা পরিকল্পিত তার প্রমাণ রায় বেরোনোর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ও এটিএসের সক্রিয়তা। অথচ নুপুর শর্মা মামলায় সমস্ত ঘটনার জন্য বিচারপতিরা তাকে দায়ী ও দোষী করলেও এখনও তার বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হল না।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই নগ্ন আক্রমণ, ন্যায়ের জন্য আদালতের কাছে বিচারপ্রার্থীকেই দোষী সাব্যস্ত করা বা সাংবাদিকদের কাজে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ অবশ্যই তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশটাকেই উন্মোচন করেছে। আশার কথা হল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, কর্পোরেটতন্ত্র ও প্রশাসনের অশুভ জোটবন্ধন এবং বিচারব্যবস্থার একটা অংশের এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া কিন্তু এখনও মুক্তচিন্তার সমর্থকদের হতোদ্যম করতে পারেনি। জেলে যতই তাদের সংখ্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে ততই নতুন প্রতিবাদীদের জন্ম হচ্ছে। এই প্রতিবাদীরাই আমাদের সময়ের প্রমিথিউস, এই নিকষ কালো অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।