Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অমরনাথ আখ্যান: এক মেঘভাঙার ইতিকথা

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

এ-বছর আবহাওয়ার মর্জি বোঝা ভার। কোথাও অতিবৃষ্টি-বন্যা, আবার কোথাও বৃষ্টিহীন খরা-প্রায় পরিস্থিতি। এমনই এক দোলাচলের মধ্যে হঠাৎই খবরের শিরোনামে উঠে এল অমরনাথের মেঘভাঙা বৃষ্টি ও পরবর্তী আকস্মিক বিপর্যয়ের কথা। হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষজনের কাছে তুষারতীর্থ অমরনাথের গুরুত্ব ও আকর্ষণ অপরিমেয়। আর তাই প্রতি বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বিপুল সংখ্যক পুণ্যলোভাতুর মানুষ তুষারলিঙ্গ সন্দর্শনে যাত্রা করেন দুর্গম পাহাড়ি পথে অমরনাথ গুহার উদ্দেশ্যে।

এই বছর গোড়া থেকেই নানান বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে তীর্থযাত্রীদের। বৃষ্টির প্রাবল্য আর ধসের কারণে বারংবার ব্যাহত হয়েছে পুণ্যার্থী মানুষদের যাত্রা। এসবের মাঝেই গত শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে অমরনাথ গুহা এবং কালীমাতার মাঝামাঝি অঞ্চলে নেমে আসে বিপর্যয়। ইন্দোটিবেটান পুলিশবাহিনির তরফে জানানো হয়েছে মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে অমরনাথের গুহার ওপর থেকে হঠাৎ প্রবল বেগে জল নেমে আসতে থাকে। প্রবল জলের তোড়ে ভেসে যায় প্রায় ২৫টি তাঁবু। প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গেছে যে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ জন মানুষের জীবনহানি হয়েছে এবং আহত হয়েছেন আরও বেশ কিছু মানুষ। নিখোঁজ মানুষজনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, আরও বাড়বে বলেই প্রশাসনিক মহলের আশঙ্কা।

এমনই সব মর্মন্তুদ সংবাদকে পাশে রেখেই দেখে নেওয়া যাক মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং হড়পা বানের পারস্পরিক সংযোগের বিষয়টিকে। আসলে ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘ ভাঙা এবং হড়পা বান পরস্পর কার্যকারণ সম্পর্কে অন্বিত। অর্থাৎ মেঘ ভাঙলে জল, আর জল গড়ালে বান— হড়পা বান। এমন আকস্মিক বন্যার তাণ্ডব যে এই প্রথম তা নয়, ২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়ের ভয়ালতা আজও আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। সেই কথাকেই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিল অমরনাথের ঘটনা।

 

কুম্যুলোনিম্বাসের কথা

মেঘ ভাঙা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের মেঘকুলের এক বিশেষ সদস্যের সঙ্গে পরিচয় করতে হবে। সেই সদস্যটির নাম কুম্যুলোনিম্বাস। কে এই কুম্যুলোনিম্বাস? কীভাবেই বা সৃষ্টি হয় তা?

বর্ষার শুরুতেই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর নিম্নচাপ অক্ষ ক্রমশই সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। দক্ষিণের জলভাগ থেকে আর্দ্র মৌসুমি বায়ুকে উপমহাদেশের বুকে টেনে আনার পেছনে এই নিম্নচাপ অক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। এই সুগভীর নিম্নচাপের টানে সাগরের সীমানা ছেড়ে জলীয় বাষ্পে ভরপুর মৌসুমি বায়ু প্রত্যয়ী পদক্ষেপে মূল ভূখণ্ডের দিকে বইতে থাকে। উপদ্বীপীয় মালভূমি পার হয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই বায়ু গাঙ্গেয় সমভূমির বিপুল বিস্তৃতি অতিক্রম করে এসে থমকে দাঁড়ায় হিমালয়ের প্রাকার পাদদেশে।

এর পর প্রবল উৎসাহে সেই আর্দ্র চঞ্চল বায়ু পর্বতের বায়ু-অভিমুখী ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। একটু অন্যভাবে বললে বলতে হয়, পর্বত আর্দ্রবায়ুকে ঠেলে ওপরে তুলে দেয়। আর্দ্রবায়ু ওপরে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে— সে পেরিয়ে যায় স্বাভাবিক ঘনীভবনের স্তর। আরও ওপরে ওঠার নেশায় পার হয়ে যায় হিমায়নের স্তরও। তখন তার এক টইটম্বুর অবস্থা। ফুলে ফেঁপে সে তখন এক সুবিশাল মেঘ-দৈত্য— এরই নাম কুম্যুলোনিম্বাস। মাটি থেকে তার নেহাই-সদৃশ মস্তকভাগ তখন পৌঁছে গিয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটারের এক অকল্পনীয় উচ্চতায়। এ হল মেঘেদের স্কাইস্ক্র্যাপার— বহুতলীয় মেঘ।

মেঘমুলুকে কুম্যুলোনিম্বাসের খ্যাতি (না কি অখ্যাতি?) তার সুবিশাল ব্যাপ্তি ও রাজসিক গড়নের জন্য। পাশাপাশি তার গঠনও সমান বৈচিত্রপূর্ণ। বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে যে কালবৈশাখীর প্রাদুর্ভাব ঘটে তার পেছনেও এই গম্বুজাকার মেঘের হাত রয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতা পর্যন্ত প্রসারিত থাকে বলে নানা উচ্চতায় এই মেঘের গঠনে ব্যাপক বৈচিত্র লক্ষ করা যায়।

মেঘের একেবারে নিচের ভূমিসংলগ্ন অংশ থেকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে, অর্থাৎ ঘনীভবনের স্তর পর্যন্ত অংশে থাকে চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ জলীয় বাষ্প। পরবর্তী অংশে অর্থাৎ একেবারে উচ্চতম স্তরে থাকে হিমকণারা, কারণ এই স্তরটি হিমায়ন স্তরের উর্ধ্বসীমায় অবস্থান করে।

মেঘ গঠনের এই বিপুল বৈচিত্রের কারণেই কুম্যুলোনিম্বাস মেঘ কখনও কখনও স্বল্পস্থায়ী প্রবল বর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়তলিতে বজ্রবিদ্যুৎ সহ এমন প্রবল বর্ষণই অনেক সময় বড় রকমের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে।

 

মেঘ বিস্ফোরণ বা ক্লাউড বার্স্ট

এবারে বিস্ফোরণের প্রসঙ্গে আসা যাক। ওপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় হয়তো খানিকটা পরিষ্কার হয়েছে যে, গম্বুজাকার কুম্যুলোনিম্বাস মেঘ থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে। অবশ্য এক্ষেত্রে বিস্ফোরণ কথাটার মধ্যে সাধারণভাবে অনেকগুলো ভাবনা জড়িয়ে থাকে— যেমন আকস্মিকতা, প্রাবল্য এবং ভয়ালতা।

মেঘ বর্ষণের সঙ্গে এই তিনটি বিষয়ই যুক্ত। অর্থাৎ মেঘ গঠনের পর্বটি বেশ কিছু সময় ধরে চলতে থাকলেও বৃষ্টির পর্বটি নিতান্তই আকস্মিক। প্রবল্যের বিষয়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কেননা মাত্র ঘন্টাখানেক সময়ের ব্যবধানে ১০০ মিলিমিটার থেকে ১৫০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত এক্ষেত্রে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আর এই অল্প সময়ের প্রবল বর্ষণ ভয়াল বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই, যেমন ঘটেছে উত্তরাখণ্ডে (২০১৩) কিংবা লাদাখের লে (২০১০)-তে।

তিনটে বিষয় কুম্যুলোনিম্বাস মেঘের সৃষ্টি তথা মেঘ-বিস্ফোরণের জন্য দায়ী— কোনও স্থানের উষ্ণতা তথা পৃষ্ঠীয় তাপনের পরিমাণ, মেঘের আয়তন তথা ঊর্ধ্বমুখী বিস্তৃতি এবং বায়ুর বেগ। ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে উঠতে থাকা বায়ুস্রোত অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকে। তাই উষ্ণ বায়ুস্রোত মেঘকে নিচে নেমে আসা থেকে বাধা দেয়, অথচ মেঘের ভেতরে থাকা সম্পৃক্ত জলকণা বা জলবিন্দুরা নেমে আসার জন্য ক্রমশ মরিয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ চলার ফলে বিপুল সংখ্যক জলকণা বা বৃষ্টিকণার চাপে মেঘ ক্রমশ ভারী হতে থাকে এবং এক সময়ে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুস্রোতের গতিকে হার মানিয়ে প্রবল বর্ষণের সূচনা করে। সুবিশাল গম্বুজাকার মেঘের ঊর্ধ্বতম অংশ থেকে নেমে আসা হিমকণা এবং বৃষ্টিকণার ভরবেগ এবং অভিঘাত খুব বেশি থাকে বলে মনে হয় মেঘের মধ্যে বুঝি-বা আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটছে।

 

বিস্ফোরণ-পরবর্তী অভিঘাত

সাম্প্রতিক কালে মেঘ-বিস্ফোরণ যতই হইচই হোক না কেন, আবহবিজ্ঞানীদের মতে মেঘ-বিস্ফোরণ হল একটি মাঝারি মাত্রার (Meso Scale) আবহিক বিপর্যয়। এমন ঘটনা অপেক্ষাকৃত অল্প-পরিসর স্থানে ঘটে বলে কখনও কখনও আকস্মিক প্রবল বর্ষণ ওই অঞ্চলের মানুষদের জীবনে বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনে। বলা বাহুল্য, সমতলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চলে বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয়, আর যেহেতু খাড়া পাহাড়ি ঢালে বাধা পেয়েই উষ্ণ-আর্দ্র বায়ু সটান ওপরে উঠে গিয়ে কুম্যুলোনিম্বাসের মতো বজ্রগর্ভ গম্বুজাকার মেঘের সৃষ্টি করে সেহেতু মেঘ-বিস্ফোরণজনিত অভিঘাতের মাত্রা পাহাড়ি অঞ্চলেই বেশি।

কী ধরনের বিপর্যয় ঘটে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে? পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা প্রবল জলস্রোত আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে যা হড়পা বান বা ফ্লাশ-ফ্লাড নামে পরিচিত। পাশাপাশি ভূমিধস বা অবস্কর প্রবাহের মতো বিপর্যয়ও ঘটতে থাকে। সমতল অঞ্চলে এমনতর বিপর্যয়ের আশঙ্কা অনেকটাই কম। ভারতের যেসব অঞ্চলে কুম্যুলোনিম্বাস মেঘ সৃষ্টির অনুকূল অবস্থা রয়েছে, যেমন হিমালয় পর্বতের উপমহাদেশ অভিমুখী দক্ষিণ ঢালে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পশ্চিমের খাড়া ঢালে— সেখানেই এমন অভিঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য সবসময় এমন ঘটনা দৈনিক সংবাদপত্রের শিরোনামে ঠাঁই পায় না। কারণ ব্যাপক প্রাণহানি বা সম্পদহানি না হলে খবরওয়ালাদের টনক নড়ে না।

 

মহা আশঙ্কা জপিব মন্দ্র মন্থরে…?

এখন যে প্রশ্নটি মনের মধ্যে উঁকি মারে সেটি হল মেঘ-বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নিয়ে আগাম পূর্বানুমান সম্ভব কি না? এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। অত্যাধুনিক জিআইএস প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং দূর-সংবেদন পর্যবেক্ষণব্যবস্থার সহায়তায় বিপর্যয়ের সম্ভাব্য দিনক্ষণ সম্পর্কে পূর্বানুমান করা সম্ভব না হলেও, এমনতর বিপর্যয়প্রবণ অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা চলছে জোরকদমে। এমনটা করতে পারা গেলে বিপর্যয় সামলে নেওয়া সম্ভব হবে অনেকটাই। হাত-পা ছেড়ে হাহুতাশ করার থেকে তেমন সুচেতনা সৃষ্টির গুরুত্বই বা কম কীসে!

শেষে আবার ফিরে আসা যাক অমরনাথে। এই নিবন্ধ লেখার পর্ব যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন খবর এল সেনাবাহিনি, ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ এবং এনডিআরএফ-এর আধিকারিকদের সমবেত উদ্যোগে জোরকদমে চলছে উদ্ধারকাজ। মৃত্যুর করাল ছায়া এসে পড়েছে আমাদের রাজ্যেও। নিখোঁজ পুণ্যার্থীদের তালিকা ক্রমশই লম্বা হচ্ছে। কিছুদিন আগেই মণিপুরের নোনে জেলার মারাংচিং গ্রামের কাছে প্রবল ধসের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৮০ জন জওয়ান। উত্তরাখণ্ড রাজ্যে প্রবল বৃষ্টিপাতের পর্ব চলছে। না-জানি আর কোন বিপর্যয় ওঁৎ পেতে আছে আমাদের জন্য। একদিকে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিতি, অন্যদিকে মানুষের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের দৌরাত্ম্যে পার্বত্য অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন এমন বিপর্যয়কে ক্রমশই যেন অনিবার্য করে তুলেছে। পার্বত্য অঞ্চলের ভঙ্গুর পরিমণ্ডলে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, পরিষেবা বিস্তারের নামে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবাঞ্ছিত রূপান্তর প্রকৃতিকেও যেন উসকে দিচ্ছে নানাভাবে। অমরনাথের সাম্প্রতিক বিপর্যয় হয়তো তারই ইঙ্গিতবাহী।


ঋণ স্বীকার: মেঘ সংখ্যা। ঋদ্ধি সাহিত্য পত্রিকা। সম্পাদনা: তন্ময় ভট্টাচার্য। জুন ২০১৪। যোগাযোগ: ৯৮৩৬৪৩৭৬৯৮।