অনির্বাণ ভট্টাচার্য
কবি, গদ্যকার
চিত্রসাংবাদিক সানা ইরশাদ মাট্টুর ছবিগুলো আছে? বার্বড ওয়্যার, জানলায় ত্রস্ত কাশ্মিরি নারী, ভাঙা দেওয়াল, নিঃসঙ্গ এক অন্ধকার ঘরে একলা এক তরুণী অথবা পুলিৎজার-জয়ী সেই ছবি যেখানে কাশ্মিরের অনন্তনাগ জেলায় কোভিড ভ্যাক্সিন দিতে ব্যস্ত চিকিৎসাকর্মী এবং সাধারণ কিছু কাশ্মিরি যুবক।
নিজের ছবি সম্পর্কে সানা বলেন—
I believe objects have memories, they are witnesses. When I photograph people I try to capture emotions. The same is true for things, there lies a belonging-ness.
যে বিলঙ্গিং-নেসের গল্প সানার ছবি জুড়ে বারবার আসে, তাঁর নিজের উপত্যকায় তাঁর নিজের স্বাভাবিক জীবনেই সেই বিলঙ্গিং-নেসের বিরুদ্ধে এক অসম্ভব উদাসীনতা, জুলুমবাজি প্রত্যক্ষ করেন সানা, উপত্যকার গণ্ডি পেরিয়ে একটু বাইরে গেলেই। যার সাম্প্রতিকতম প্রতিফলন দিল্লি বিমানবন্দরে সানাকে ফ্রান্সের উদ্দেশে বিমান ধরা থেকে প্রতিহত করা। সম্প্রতি ফ্রান্সের Serendipity Arles Grant 2020-র শ্রেষ্ঠ দশ পুরস্কারজয়ীর একজন সানা। এই পুরস্কার উপলক্ষে এবং একটি বই প্রকাশনীর জন্য প্যারিসের বিমান ধরার জন্য শ্রীনগর থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছে থমকে যান অভিবাসন দপ্তরের কর্মীদের সামনে। বৈধ ভিসা থাকলেও তাঁকে নাকি দেশের গণ্ডি পেরোতে না দেওয়ার নির্দেশ আছে তাঁদের কাছে। কার নির্দেশ? কোন সরকারের? রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অবশ্য জম্মু ও কাশ্মির পুলিশ থেকে নাম না করে বলা হয়েছে, সানা সেইসমস্ত সাংবাদিকদের মধ্যে পড়েন, যাঁদের নাম সরকার নো-ফ্লাই লিস্টে ঢুকিয়ে দিয়েছে। নো-ফ্লাই লিস্ট, ভাবুন…
অবশ্য সানা একা নন, প্রথমও নন। ২০১৯ সালে কাশ্মিরি সাংবাদিক গওহর গিলানি দিল্লি এয়ারপোর্টে জার্মানি যেতে গেলে নিষেধাজ্ঞা পান। ২০২১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াতে যাওয়া কাশ্মিরি সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ জাহিদ রফিককেও একইভাবে বাধা দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এরকম নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন সাংবাদিক রুয়া শাহ এবং সম্প্রতি সাময়িকভাবে বাধার মুখে পড়েও দক্ষিণ কাশ্মিরের আরও এক শিক্ষাবিদকে টালবাহানার পর বিমানযাত্রায় ছাড় দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হল, এই নিষেধাজ্ঞা কেন? সম্প্রতি ‘Rising Kashmir’ পত্রিকায় একটি উত্তর সম্পাদকীয়তে ‘Vultures of Single Narrative Feasting on Misery’-শীর্ষক আর্টিকলে সানা ইরশাদ মাট্টুসহ ১১ জন কাশ্মিরি সাংবাদিককে টেরর সিমপ্যাথাইজার বলে দাগ মারা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদীরা পালিয়ে পালিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং সানারা প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদত দিয়ে যাচ্ছেন, এঁদের ভাষায় নাকি সন্ত্রাসী কাজকর্মের প্রতি সহমর্মিতা দেখা দিচ্ছে। প্রসঙ্গত মাজিদ মাহমুদ নামে ওই বিশেষ কলামটির লেখক, যাঁর কোনও পরিচয় বা ঠিকানার হদিশ দিতে পারেননি কেউই, গত মাসে ‘Greater Kashmir’ কাগজে ‘Labeling the People and Getting Them Killed’-শীর্ষক একটি কলামে তিনিই ‘ক্যারাভান’ পত্রিকাকে ‘র্যাগ ম্যাগাজিন’ এবং কাশ্মিরি উপত্যকায় সেনা তাণ্ডব সম্পর্কে শাহিদ তান্ত্রের একটি বিখ্যাত লেখাকে ‘বান্ডল অফ লাইজ অ্যান্ড ডিসিট’ বলে গালমন্দ করেছিলেন। বোঝা যায়, এই মাজিদ মাহমুদ বা সেই নামের আড়ালে হয়ত অন্য কোনও রাঘব বোয়াল পরোক্ষে দিল্লি মসনদের হীরক রাজার তাঁবেদারির পেশা নিয়েছেন, এবং তা যথেষ্ট আনুগত্যের সঙ্গেই পালন করে চলেছেন। এবং বেছে বেছে নিশানা করছেন উদয়ন পণ্ডিতদের।
এবার আসি ‘Rising Kashmir’-এ খোদ সানা ইরশাদ মাট্টুর নাম ধরে কী কী লেখা হয়েছে? কলামটি বলছে— One well-known narrative builder is Ms. Sana Irshad Mattoo. Born in downtown Srinagar, Mrs. Mattoo is a typical Anti-State, Pro-Pakistan narrative builder. She speaks the same language that finds sanction in lexicon of proscribed Lashkar-e-Taiba (leT) or any other Pakistan-supported terror outfits operating in Kashmir valley. But unlike terrorists, she is not on the run or hiding in a jungle. She lives in a society and carries more potent weapons of mass indoctrination.
ন্যারেটিভ বিল্ডার? বেশ। তো এই শাসক প্ররোচিত দাগী ‘ন্যারেটিভ বিল্ডার’ সানা ইরশাদের জীবনের গল্পে একটু আসি। কাশ্মির উপত্যকায় জন্মানো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সানার ছিল ছোটবেলা থেকেই এক অনুসন্ধিৎসু মন। সেই মন থেকেই সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মির থেকে ‘কনভার্জেন্ট জার্নালিজম’ নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করা সানা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের পত্রপত্রিকায় কাজের সুযোগ পান। আল-জাজিরা, টাইম, টিআরটি ওয়ার্ল্ডের মতো প্ল্যাটফর্মে তাঁর ছবি জায়গা পায়। ক্রমশ চিত্রসাংবাদিক নিজস্ব নিশে তৈরি করেন। ২০২১ সালে ম্যাগনাম ফাউন্ডেশনের ফটোগ্রাফি অ্যান্ড সোশ্যাল জাস্টিস ফেলোশিপ-এর জন্য নির্বাচিত সানার মুকুটে এখনও অবধি শেষ পালক ২০২২ সালে পুলিৎজার পুরস্কার। অতিমারির সময়ে ভারতের ছবি তুলে ধরে এই পুরস্কার-প্রাপকদের অন্যতম সানা। আর কে কে ছিলেন এই তালিকায়? অমিত দান্ডে, আদনান আবিদি এবং নিহত চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। প্রত্যেকেই সানার মতোই রয়টার্সের কর্মী। পুলিৎজারের কমিটি থেকে বলা হয়েছিল, ছবি দিয়ে গল্প তৈরি করতে পারেন সানা। জীবনযন্ত্রণার গল্প, অবিচারের গল্প, নারীত্বের গল্প।
তো এহেন সানা ইরশাদ এবং তাঁর বন্ধুরা শাসকের কাছে বিপজ্জনক সন্দেহ নেই। খুবই স্বাভাবিক যে, শাসকপন্থী পুতুল মিডিয়া দিল্লি বিমানবন্দরের ঘটনাটিকে হয় চাপা দিচ্ছে নাহয় টেরর সিমপ্যাথাইজার বলে ‘রেইজিং কাশ্মির’-এর সেই কলামকে, ওরফে খোদ শাসকের ডিক্টামকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে। হীরক রাজার কথায় ওঠবোস সাম্প্রতিক ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রে নতুন খবর কী?
আঘা শাহিদ আলির ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস’-এর সেই কথাগুলো মনে আছে?
So there is revolution each day in the heart
Let sorrow’s resplendent autocracy remain.
রাষ্ট্রযন্ত্রের তুমুল পরিবর্তন এবং তীব্র এক প্রতিবাদ ও প্রত্যাঘাত ছাড়া এই ‘বিষাদের বীভৎস স্বৈরাচার’ আটকানো সম্ভব না।
*সবকটি ছবির চিত্রগ্রাহক সানা ইরশাদ মাট্টু