সোনালী মুখোপাধ্যায়
লেখক পেশায় শিক্ষক। হন্সলো, লন্ডন
কমলা পেরসাদ বিশ্বেশ্বার। ত্রিনিদাদ এবং টোবাগোর সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান হিসেবে ভারত সফরে এসে গিয়েছিলেন বিহারের ভেলুপুরে। পিতৃপুরুষের ভিটে দর্শনে। আপামর ভেলুপুরবাসীর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আপনাদের মেয়ে আপনাদের কাছে এসেছে।” ইউ-টিউবে যতবারই ভিডিওটা দেখি, খুব আনন্দ হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় প্রবাসী হয়েই কেটে গেল জীবন। মনের মণিকোঠায় ভারত এবং বাংলা এখনও যেন দশমীর রাতে একলা নাটমন্দিরে প্রদীপের মতো জ্বলছে। নেহাত কৌতূহলী হয়ে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম, এমন অন্তত ৩০ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোনও না-কোনও সময় রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন। নাগাভরা রামারাও নারায়ণমূর্তি আর সুধা মূর্তির জামাই ঋষি সুনাক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলে সেই তালিকায় তাঁর নামও যুক্ত হবে। সংখ্যাটা ৩০ থেকে ৩১ হবে। সুনাকের সম্ভাব্য সাফল্য নিয়ে ভারতে এবং বিশ্বজুড়ে ভারতীয়দের মধ্যে যত উৎসাহের তাড়না, অন্য তিরিশজনকে নিয়ে অবিশ্যি তার ছিঁটেফোঁটাও হয়নি। এর অন্যতম কারণ যদি হয় সামাজিক মাধ্যম, তবে আরেকটা কারণ অবশ্যই ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটেনের ঐতিহাসিক যোগসূত্র। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হওয়ার পাল্টা দেওয়ার কথা ভেবে নিজেকে শক্তিশালী মনে করার এও বোধহয় এক মনস্তাত্ত্বিক কুচকাওয়াজ।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের জন্য নিজের দাবি পেশ করে একটা ভিডিও প্রকাশ করেছেন সুনাক। তাতে নিজের দিদার কথা বলেছেন। মহীয়সী ওই নারীর কঠোর পরিশ্রমের কথা। পরিশ্রমী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী, লক্ষ্যের প্রতি স্থিরদৃষ্টি। এগুলোই রক্ষণশীল দলের নীতির অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য। তা অবলম্বন করেই উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরে উঠেছেন সুনাকের পরিবার। সেটাই মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তরুণ সুনাককে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা। সমাজের উচ্চকোটির লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা। তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ধনী এবং সফল উদ্যোগপতির কন্যার সঙ্গে প্রণয় এবং পরিণয়। সবটাই যেন রূপকথার গল্পের এক ঝলক। ভারতীয়দের মতো দেখতে একজন যখন সাফল্যের শিখরে ওঠেন, তখন তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্বপ্ন দেখা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই স্বপ্নেই আপাততত বিভোর আপামর ভারতবাসী।
ঋষি সুনাককে বুঝতে হলে মার্গারেট থ্যাচারের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এর সূত্রপাত যুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভেঙে চৌচির হয়ে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছিলেন মহামতি জন মেইনার্ড কেইনস। ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল করতে চাহিদা-বৃদ্ধিতে সরকারের বাড়তি ভূমিকার কথা বলেছিলেন তিনি। তাতে কাজও হয়। পরে লাগামছাড়া সরকারি খরচে মুদ্রাস্ফীতি জাঁকিয়ে বসে। অন্তরালে যেতে থাকে কেইন্সীয় ধ্যানধারণা। অন্তরাল থেকে আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠেন ঘোর কেইন্স-বিরোধী ফ্রেডেরিক হায়েক। সরকারি বশ্যতা কাটিয়ে ওঠার কথা বলেন হায়েক। সেই মতকেই কর্মযোগীর মতো অনুসরণের অঙ্গীকার করেন থ্যাচার। মার্গারেট থ্যাচারের অনুসরণ করা পথই হয়ে ওঠে তরুণ সুনাকের রাজনৈতিক ধ্রুবতারা। ধ্রুপদী রক্ষণশীলদের সঙ্গে থ্যাচার-ইজমের মূল পার্থক্য হল প্রয়োজনে সংস্কারের পথ খোলা রাখা। সরকার ছোট হোক, ক্ষতি নেই। সরকারের বশ্যতা মেনে নেওয়ার প্রশ্নও নেই। কিন্তু দরকার বুঝলে সংস্কার করে ফেলার সুযোগ থাকা দরকার।
এখনও পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে, টোরি পার্টির নেতৃত্বের লড়াই শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে সুনাক আর বরিস জনসন মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস-এর মধ্যে। যদিও শেষ কথা বলা এখনও দূর অস্ত। প্রথমজন থ্যাচারের অনুরাগী, আর ট্রাস ধ্রুপদী টোরি। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি অনুযায়ী দলীয় সংসদ সদস্যরা দফায়-দফায় ভোট দিয়ে চূড়ান্ত দুজন নির্ধারণ করবেন। শেষ দুজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে জয়ী কে, তা ঠিক হবে তৃণমূল স্তরের দলীয় সদস্যদের ভোটে।
মাঠ-পর্যায়ের টোরিদের মধ্যে সুনাকের জনপ্রিয়তা তুলনায় কম। এক, উনি অশ্বেতাঙ্গ। দুই, উচ্চমধ্যবিত্ত সুনাকের সঙ্গে ইংরেজ শ্রমজীবী শ্রেণির যোগাযোগ কম। সম্প্রতি ঋষি সুনাকের স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির কর দেওয়া নিয়ে বিতর্ক সেই দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে অতিমারির সময় ‘ফারলো’ (furlough) ব্যবস্থার মাধ্যমে যেভাবে অর্থনীতির বিপর্যয় বিলম্বিত করতে পেরেছেন তাতে করে শিগগিরই নারায়ণমূর্তির জামাই ব্রিটিশ মধ্যবিত্তের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। পদ্ধতিগতভাবেও ওই পদক্ষেপ বেশ অভিনব। মজার ব্যাপার হল, এই ফারলো ব্যবস্থাকে অর্থনীতির নিরিখে কেইন্সীয় পদ্ধতির কাছাকাছি বলেই মনে করা হয়। সুনাকের রাজনৈতিক দ্রোণাচার্য থ্যাচার এই ধরনের পদক্ষেপের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
ঋষি সুনাক এবং লিজ ট্রাস ছাড়াও আরও ছজন প্রাথমিক লড়াইয়ে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে অভিজ্ঞ এবং প্রাক্তন স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যান্সেলর বা অর্থমন্ত্রী নাদিম যাওয়াহি। প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মর্ডান্ট, তুলনায় অপরিচিত কেমি ব্যাডেনক, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ভারতীয় বংশোদ্ভুত সুয়েলা ব্রেভারম্যান এবং সেনাবাহিনির সাবেক সদস্য টম টুগেনহান্ট। ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর রাজনীতিতে প্রবেশ টুগেনহান্টের। সোজা কথা, কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই বলা যায়, পারদর্শী টুগেনহান্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির প্রধান হিসেবে অনেকের নজর কেড়েছেন। আনকোরা কেউ জিতলে তার মধ্যে টম টুগেনহান্টের সম্ভাবনাই বেশি।
কেনিয়া থেকে ব্রিটেনে আসা কৃষ্টি এবং উমা ফার্নান্ডেজের কন্যা সুয়েলা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। একসময় সুয়েলা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধানও ছিলেন। সুয়েলার মা উমার জন্ম তামিল হিন্দু পরিবারে। আর সুয়েলায় স্বামী রায়েল ব্রেভারম্যান বৌদ্ধ। ধারে এবং ভারে অতএব সুয়েলা ব্রেভারম্যানের প্রতিপত্তিও কিছু কম নয়।
প্রাথমিকভাবে এগিয়ে থাকলেও সুনাক যে জিতবেনই, তা কিছুতেই এখনই হলফ করে বলা সম্ভব নয়। আর জিতলেও, তিনি হবেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় বংশোদ্ভুত ঋষি সুনাকের উত্তরোত্তর উত্থান এবং তাতে ভারতের তুলনামূলক সুবিধার সম্ভাবনার কথা ভেবে যাঁরা উদ্বাহু হচ্ছেন তাঁদের অবগত থাকা ভাল, ভারত সম্পর্কে সুনাকের বিরাট কোনও আবেগ বা অনুভূতির কথা জানা যায়নি। এছাড়া ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিয়ত আতসকাচের নীচে থাকতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয় ব্রিটিশ মূল্যবোধের এবং প্রমাণ করতে হয় ব্রিটিশ স্বার্থ সুরক্ষার। তাই, চাইলেও এর অন্যথা হওয়া সুনাকের রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবেই পরিগণিত হবে।