অশোক চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদক, ‘সাংস্কৃতিক সমসময়’
আগামী ২৮ জুলাই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নবরূপকার ও দিগদর্শী চারু মজুমদারের শহিদত্বের পঞ্চাশতম বার্ষিকীর উৎক্রান্তি। ভারতীয় শাসকশ্রেণির ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত এই চারু মজুমদারকে কলকাতার এন্টালি এলাকার এক গোপন আশ্রয় থেকে গ্রেফতারের পরই কলকাতার পুলিশ কমিশনার ফোন করে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে এই খুশির সংবাদ জানিয়েছিলেন, আর সিদ্ধার্থশঙ্করও সঙ্গে সঙ্গে এই ‘সুসংবাদ’ জানিয়েছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধিকে! তাঁর গ্রেফতারের সংবাদ সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। কেউ তাঁকে ‘হিংসার রঘুপতিপ্রতিম পুরোহিত’ বলে অভিহিত করে আত্মতৃপ্তির উদ্গার তুলেছিলেন, কেউ তাঁকে বলেছিলেন ‘হাফ পলিটিক্যাল হাফ অ্যান্টিসোশ্যাল’, ‘সিআইএ-র এজেন্ট’, কেউ বলেছিলেন তিনি নাকি সাতষট্টি বিঘা জমির মালিক! আর সিপিএম-এর ‘পিডিজি’ বলেছিলেন যে পার্টিনীতির বিরুদ্ধতা করার মতো নৈতিক সাহস নাকি চারু মজুমদারের ছিল না! এই ‘পিডিজি’র বোধহয় জানা ছিলনা যে পার্টি-অনুসৃত কৃষক আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দেই চারু মজুমদারের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ বেধেছিল। কৃষকদের উষ্ণ সান্নিধ্য থেকে দূরে থেকে কৃষক আন্দোলন করা যায় না বলে তিনি মনে করতেন।
চারু মজুমদার সম্পর্কে কুৎসা যেমন সিপিএম এবং বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমগুলিতে করা হয়েছিল, তেমনই উত্তরকালে তাঁর বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের তরফ থেকেও করা হয়েছিল। একজন মানুষের মধ্যে ভুল এবং ঠিক দুটি দিকই থাকে। তিনি যদি রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব হন, তবে তাঁকে তো রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গা থেকেই সমালোচনা করা উচিত। কোনও ব্যক্তিক আক্রমণ বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু চারু মজুমদার সম্পর্কে রাজনৈতিক সমালোচনা যতটুকু হয়েছে তার চাইতে বেশি হয়েছে ব্যক্তি আক্রমণ এবং কুৎসা-কষায়িত অপচর্চা।
দুই.
অতীতের সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারলে বর্তমানে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তোলা যায় না, আর এই কাজটি যথাযথভাবে সুসম্পন্ন না-করতে পারলে ভবিষ্যতের স্বপ্নদর্শন এবং তার বাস্তবায়নের সুসমঞ্জস রূপায়ণ অসম্ভবের শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অতীত কাজকর্মের মূল্যায়নের প্রয়াসী হয়েই আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চারু মজুমদার লিখেছিলেন:
শ্রমিক এবং কৃষক পার্টিসভ্য থাকা সত্ত্বেও পার্টি মূলত মধ্যবিত্তশ্রেণীর পার্টিতে পর্যবসিত হয়েছিল। তারই ফলে পার্টি একটি খাঁটি সংশোধনবাদী পার্টিতে পরিণত হয়েছে। একটি সংশোধনবাদী পার্টির মতোই আমাদের পার্টিও একটি নির্বাচন থেকে আর একটি নির্বাচন পর্যন্ত যে সব আন্দোলন পরিচালনা করত, তার লক্ষ্য থাকত পরবর্তী নির্বাচনে বেশি আসন দখল। পার্টি(র) প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল সমস্ত শহরে এবং শহরে আন্দোলন সৃষ্টি করাই পার্টির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি গ্রামের কৃষককেও শহরে আনা হত শহরের আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য।
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় যখন এই কথাগুলি চারু মজুমদার লিখছেন তখনও নতুন তথা তৃতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়নি। নতুন বিপ্লবী পার্টি গঠনের আগে এই কথাগুলি তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। মনে রাখা দরকার যে এরও দু বছর আগে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট আরও একটি লেখায় (প্রখ্যাত আটটি দলিলের ছয় নম্বর দলিলে) চারু মজুমদার লিখেছিলেন:
গণ-আন্দোলনের প্রশ্নগুলোকে এমনভাবে তাঁরা (অর্থাৎ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা) পেশ করলেন যা থেকে সহজ সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে যে আগামী নির্বাচনে আমাদের অকংগ্রেসী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য হবে। তাঁদের প্রস্তাবে এক জায়গাতেও এ’কথা বলা হলো না যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে গোপন করার জন্যই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনের মারফত ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার নিয়মতান্ত্রিক মোহ বিস্তার করতে চায় আর তারই আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে আমাদের দেশকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিবিপ্লবী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলতে চায় এবং জনসাধারণের বিপ্লবী অংশের উপর হিংস্র আক্রমণ করে জনগণের প্রতিরোধকে স্তব্ধ করে দিতে চায়।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল ভারতের তৃতীয় তথা নতুন কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই-এমএল) গঠিত হওয়ার দু বছর সাড়ে তিন মাসের মাথায় (আগস্ট ৫, ১৯৭১) ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের পুলিশের হাতে নিহত এবং ‘নিখোঁজ’ বলে ঘোষিত হন এই নবজাত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা ও কবি সরোজ দত্ত। আর পার্টি গঠনের তিন বছর তিন মাসের মাথায় (জুলাই ২৮, ১৯৭২) কলকাতা পুলিশের হেফাজতে শহিদ হন এই পার্টির অবিসম্বাদিত নেতা ও সংগঠক চারু মজুমদার। আজ তাঁরা নেই, কিন্তু তাঁদের সেই প্রিয় পার্টিটি আছে বহুধা বিভক্ত হয়েই।
তিন.
পুলিশের হেফাজতে চারু মজুমদারের শহিদ হওয়ার পর পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্তির পথে। তাঁকে নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। কেউ তাঁকে খলনায়ক বানিয়েছেন, পার্টির অনুসৃত ‘ভুল’ লাইন কার্যকরী করার জন্যে, পার্টির বিপর্যয়ের জন্যে তাঁকেই দায়ী করে নিজেরা নিজেদের দায় অস্বীকার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন; অন্যদিকে আবার অনেকে আজও তাঁকে ‘অভ্রান্ত’ এবং প্রশ্নাতীত হিসেবে মান্যতা দিয়ে তাঁর চিন্তাশ্রয়িতায় ভারতীয় বিপ্লবের সাফল্যের চাবিকাঠি অন্বেষণ করে থাকেন। আবার আরও কেউ কেউ আছেন যাঁরা মুখে চারু মজুমদারকে ‘অভ্রান্ত’ বলে মনে করলেও তাঁদের বাস্তব রাজনৈতিক অনুশীলনে তাঁর অনুশীলিত পথকে মান্যতা দিতে কার্পণ্য করে থাকেন। একদিকে চারু মজুমদারকে ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ‘নায়ক’ এবং অন্যদিকে তাঁকে এই বিপ্লবী আন্দোলনের ‘খলনায়ক’ বানানোর পরস্পরবিরোধী প্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তী অবস্থানে যাঁরা রয়ে গিয়েছেন তাঁদের সমস্যাটা অনেক বেশি বলেই মনে হয়। পুজো এবং বাতিলের বিপ্রতীপে একজন বিপ্লবীর যথার্থ মূল্যায়ন না-করতে পারলে সমস্যার শৈবাল ক্রমাগত চলনের গতিরুদ্ধ করে। আমরা ওপরে চারু মজুমদারের যে দুটি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করেছি, এই দুটি বক্তব্য আজকের দিনেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র বিজেপি নামক ফ্যাসিস্ট শক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে উৎখাত করতে জোট গঠনের রাজনীতি তথা নির্বাচনসর্বস্বতার রাজনৈতিক লাইন কতখানি চারু মজুমদারের উপরি-উদ্ধৃত বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে তা অনুপুঙ্খ বিবেচনার দাবি রাখে। পার্টির মধ্যবিত্তকরণের যে-কথা চারু মজুমদার বলেছিলেন আজও কি তা থেকে আমাদের ‘বিপ্লবী’ কমিউনিস্ট পার্টিগুলি মুক্ত হতে পেরেছে? শহরকেন্দ্রিক আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন চারু মজুমদার, সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে ‘নির্বাচনের মারফত ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার নিয়মতান্ত্রিক মোহ বিস্তার করতে চায়’। তাঁর এইসব বক্তব্যের যাথার্থ্য নিয়ে জীবন্ত চর্চা আজও প্রাসঙ্গিক। এইসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে বিপ্লবের সঠিক পথান্বেষণ সম্ভব কি?
গত শতকের সত্তরের দশকে আমরা দেখেছিলাম তারুণ্যের সাহসী স্পর্ধার রক্তপতাকা উত্তোলন, আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষার মোহ ত্যাগ করে, ক্যারিয়ারের স্বপ্ন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, এক নতুন দিনের সোনালি স্বপ্নের লক্ষ্যে পুলিশের বন্দুকের সামনে হাসিমুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর এক উজ্জ্বল ইতিহাস। তাঁদের যিনি এই সাহস যুগিয়েছিলেন, স্বপ্নদর্শী করে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে পথে নামতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই চারু মজুমদার কয়েক দশক আগে নিজেই ক্যারিয়ারের মোহ ত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টির ব্রতবদ্ধ সৈনিকবৃত্তি গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ‘আপনি আচরি ধর্ম’-এর পরিসূত্রে তিনি নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই অন্যদের উত্তরকালে দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে স্ব-কালের এবং স্ব-দেশের এক নতুন মানচিত্র নির্মাণের স্বপ্নে মশগুল হয়েছিলেন। পার্টির কাজে যুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেমে এসেছিল অনিশ্চয়তা। পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরপরই তাঁকে আত্মগোপন করতে হয় এবং এইভাবে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হয় দীর্ঘ ছয় বছর অর্থাৎ বাহাত্তর মাস। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি জলপাইগুড়িতে গ্রেফতার হয়ে যান। এটা ছিল বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়। দু বছর পর ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কারামুক্তির পর তিনি উত্তরবঙ্গের চা-বাগান শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। সেবছরই শিলিগুড়িতে বন্দিমুক্তির দাবিতে আন্দোলনে সামিল হন। এরপর তেভাগা আন্দোলনের সময় তিনি পচাগড়ে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং সেখানে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলেন। ১৯৪৮-এর ২৬ মার্চ তিনি ‘স্বাধীন’ ভারত সরকারের পুলিশের হাতে তিনি বন্দি হন! মুক্তি পান চার বছর পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ১৯৩৯ থেকে পরবর্তী তেরো বছরের মধ্যে চারু মজুমদারকে অজ্ঞাতবাস এবং বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে বারো বছর!
গ্রেফতার তাঁর পিছু ছাড়েনি। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ির কেষ্টপুরে চা-বাগিচার মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠন করার ‘অপরাধে’ আবার গ্রেফতার হন তিনি। আবার তাঁকে চারমাসের জেলজীবন অতিবাহিত করতে হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং এক বছর পর মুক্তি পান। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাক-ভারত সংঘর্ষের সময় তিনি আবারও গ্রেফতার হন এবং পরের বছর মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি পান। এই বছরই তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ‘আটটি দলিল’ রচনার কাজে হাত দেন।
চার.
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আক্ষরিক বিভাজনের প্রেক্ষিতে কলকাতায় সিপিআই(এম)-এর জন্মের পর চারু মজুমদার সিপিআই ছেড়ে বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা নিয়েই এই নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এই নবগঠিত পার্টির মধ্যে বিপ্লবী অবশেষ খুঁজে পেতে তিনি ব্যর্থ হন। সাতষট্টির নির্বাচনে জেতার পর সিপিএম যুক্তফ্রন্টে সামিল হয়ে সরকারে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে চারু মজুমদার তার তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু তাঁর বিরোধিতা অগ্রাহ্য হয়। সাতষট্টির ২ মে সিপিএম-এর অংশগ্রহণে নতুন ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকারের অভিষেকের পরপরই নকশালবাড়িতে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কানু সান্যাল। এরপর ২৪ এবং ২৫ মে ঘটে যায় ঐতিহাসিক ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এর ঘটনা। এই ঘটনায় দেখা গেল সিপিআই(এম)-এর তরফে যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘কমিউনিস্ট’ নেতা জ্যোতি বসুর নির্দেশে পুলিশ গুলি করে দুজন শিশু সহ এগারোজন কৃষককে হত্যা করে! এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষের বিপ্লবী জনতা। শুরু হয় আর এক নতুন ইতিহাসের পথচলা।
নকশালবাড়িতে এই কৃষক হত্যার একমাস পর ২৭ জুন গঠিত হয় ‘নকশালবাড়ি ও কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’। আর এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় ১৯৬৭-র ১৭ সেপ্টেম্বর চারু মজুমদার এবং সৌরেন বসু-কে সিপিআই(এম) থেকে বহিষ্কার করার কথা প্রচারিত হয় পার্টির মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে। এরপর ১৯৬৮-র মে মাসে গঠিত হয় ‘সারা ভারত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ বা এআইসিসিসিআর। ১৪ মে নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় এই এআইসিসিসিআর। পরের বছর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের শততম জন্মদিনে অর্থাৎ ২২ এপ্রিল গঠিত হয় ভারতের নতুন এবং তৃতীয় তথা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই(এম-এল)। এই নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন স্বয়ং চারু মজুমদার। এর কয়েকদিন পর পয়লা মে কলকাতার শহিদ মিনারে এক জনসভায় কানু সান্যাল এই নতুন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন।
পাঁচ.
বাস্তবিক নকশাল আন্দোলন শুরুর পর থেকেই, বিশেষত ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুন থেকে জীবনের অন্তিম গ্রেফতারের দিন পর্যন্ত, চারু মজুমদারকে প্রায় সব সময়েই আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। তাঁর মাথায় দাম ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’র শিরোপায় ভূষিত করা হয়েছিল। পুলিশ তাঁকে জীবিত কিংবা মৃত যে কোনও অবস্থায় ধরার জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই কলকাতার এক গোপন ডেরা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে যায় এবং জেলের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে তাঁকে অবধারিত মৃত্যুর অভিমুখে ঠেলে দেয়। অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় সাতাশে জুলাই রাত সাড়ে সাতটার সময় তাঁকে কলকাতার পিজি (এসএসকেএম) হসপিটালে ভর্তি করা হয় এবং ভোর চারটে পঞ্চাশ মিনিটে (২৮ জুলাই) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাস্তবিক পুলিশি হেফাজতে তাঁকে খুন করা হয়েছিল। তাঁর এই শহিদ হওয়ার সংবাদ শুনেই ওইদিনই বিশাখাপত্তনম জেলের নকশালপন্থী বন্দিরা আদালতে বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন, আর তাঁদের তরফে কানু সান্যাল বলেছিলেন: তাঁর শহিদত্বের মধ্যে দিয়েই চারু মজুমদার ভারতে ‘সশস্ত্র সংগ্রামের’ মাধ্যমে ‘সমাজ পরিবর্তনের…পথ’ দেখিয়ে দিলেন!
তাঁকে এভাবে পুলিশি হেফাজতে খুন করার প্রতিবাদে সমসময়ে সিপিআই সহ অবামপন্থী অনেক রাজনৈতিক দলের তরফ থেকেই প্রতিবাদ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনা ঘটলেও তাঁর এই হত্যার নিন্দা সিপিআই(এম) করেনি! সিপিআই-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে জানিয়েছিলেন যে চারু মজুমদারের সঙ্গে তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর মতো সাহসী এবং আত্মস্বার্থচরিতার্থতায় একান্তই উদাসীন এবং অনাগ্রহী এই বিপ্লবীর প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। বিহার সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা প্রণব চ্যাটার্জি চারু মজুমদারের এই আকস্মিক মৃত্যুর তদন্তের জন্য একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন সরকারের কাছে। কর্পূরি ঠাকুর তো সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন যে চারু মজুমদারকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ সিপিআই(এম)-এর নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার তখনই এব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি! ১৯৭৭ থেকে পরবর্তী দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় আসীন থাকা সত্ত্বেও সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭১ এবং ১৯৭২-এ সরোজ দত্তের রহস্যজনক ‘অন্তর্ধান’ কিংবা এবং চারু মজুমদারের পুলিশি হেফাজতে অস্বাভাবিক মৃত্যু তথা হত্যার কোনওরকম তদন্তে কোনওরকম উৎসাহ দেখায়নি। এর কারণ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।
ছয়.
চারু মজুমদারের জন্ম বারাণসীতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে (১৩২৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকেই)। সেবছরই ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা। সেবছরই প্রবর্তিত হয়েছিল কুখ্যাত রাওলাট আইন। এর দু বছর আগে ঘটেছিল ঐতিহাসিক রুশ বিপ্লব। রুশ বিপ্লবের প্রেরণায় আমাদের বিপ্লবীরা ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে নতুন প্রেরণা পেয়েছিলেন। এই আবহে চারু মজুমদারের জন্ম। তাঁর পিতার পাণ্ডিত্য তাঁকে পড়াশোনায় উৎসাহিত করেছিল সন্দেহ নেই, তবে নিছক কেতাবি বিদ্যাশিক্ষার বিপরীতে অন্য এক মহান শিক্ষার অসীম দিগন্তের হাতছানি তাঁকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে আর প্রথাগত শিক্ষালাভে উৎসাহিত করেনি। ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস-এ ভর্তি হয়েও তিনি শেষপর্যন্ত কলেজের প্রথাগত শিক্ষার হাতছানি উপেক্ষা করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর পিতা কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সে পথে তিনি হাঁটেননি। কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকার নিচে হাজার হাজার লড়াকু মানুষের নতুন ভারতের স্বপ্নের মিছিলে তিনি যোগ দিয়ে তার পতাকাবাহী হন।
একথা সত্য যে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার আগে এবং পরের অনুশীলিত রাজনীতির মধ্যে ফারাক তৈরি হয়েছিল। মনেপ্রাণে ‘চিনপন্থী’ চারু মজুমদার মাও-কে অনেকসময়ই দেবতা বানাতে গিয়ে একসময় নিজেই নিজের অজান্তে দেবতা হয়ে উঠেছিলেন! মাও-কে মানা না-মানার ওপর একদিকে যেমন প্রকৃত কমিউনিস্ট কিনা তার মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছিল, তেমনি চারু মজুমদার তথা সিএম-কে মানা না-মানার ওপর একজন প্রকৃত বিপ্লবী কিনা তা নির্ধারিত হতে শুরু হয়েছিল! তত্ত্ব এবং অনুশীলনের মধ্যে ফারাক দৃষ্টিকটুভাবে বর্ধমান থাকার কারণে একদিকে যেমন নৈরাজ্য প্রশ্রয় পেয়েছিল, তেমনই অন্যদিকে পার্টির মধ্যেই বিরোধ মাথা চাড়া দিতে শুরু করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট রাতে চারু মজুমদারের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সহযোদ্ধা সরোজ দত্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং নিহত হওয়ার পর চারু মজুমদার, সত্যি কথা বলতে, মানসিকভাবে অনেকখানি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। এসময় তিনি বুঝতে পারছিলেন যে বেশ কিছু মারাত্মক ভুল নীতি ও পদ্ধতি অনুশীলিত হয়েছে এবং তা অনতিবিলম্বে সংশোধিত হওয়া দরকার। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই স্ত্রীকে লেখা তাঁর ‘শেষ’ চিঠিতেও তার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু তিনি আর সময় পাননি। রাষ্ট্র তাঁকে সে সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাঁকে শেষবারের মতো গ্রেফতারের মাত্র বারোদিনের মাথায় পুলিশি হেফাজতে তাঁকে হত্যা করা হয়।
মাত্র পাঁচ বছর সময় পেয়েছিলেন চারু মজুমদার। সাতষট্টি থেকে বাহাত্তর। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর চিন্তা, তত্ত্ব এবং প্রয়োগ প্রথাগত নির্বাচনসর্বস্ব ‘মার্কসবাদী’ নামধারী ‘কমিউনিস্ট’ পার্টিটির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সাতচল্লিশের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের সামনে এমনভাবে চ্যালেঞ্জ আর কোনও কমিউনিস্ট পার্টি হাজির করতে পারেনি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ যেমন সমসময়ের ব্রিটিশ রাজশক্তির ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে সারাদেশে বিস্তারলাভ করেছিল, তেমনই তার ঠিক একশো দশ বছর পরে, ভারতের ‘স্বাধীনতা’ লাভের ঠিক কুড়ি বছরের মাথায়, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের এই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ ভারতের রাষ্ট্রশক্তির হৃদকম্পন উপস্থিত করেছিল। ফলে রাষ্ট্রশক্তিকে নামাতে হয়েছিল নির্মম দমনপীড়ন। দেখা গিয়েছে তাদের এই নকশালনিধন অভিযানে শাসক কংগ্রেসের ঘাতকবাহিনি সহ সরকারি ‘কমিউনিস্ট’ নামধারীদের অনেক নেতাকর্মীরাও সামিল হয়েছিলেন। নকশালপন্থীদের মোকাবিলায় তখনই এই যৌথবাহিনির আবির্ভাব ঘটেছিল।
সাত.
চারু মজুমদারের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। হাজার হাজার শহিদ বিপ্লবীদের স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলি নিঃশেষিত হয়নি। স্বপ্নেরা ঘুমোয় না, জেগে থাকে। অন্যকে জাগায়। চারু মজুমদারের জন্মের পর অতিক্রান্ত হয়েছে একশো তিনবছর। নকশালবাড়ির উত্থানের পর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে পঞ্চান্ন বছর। আজও ভারতবর্ষের দিকে দিকে অজস্র গ্রাম, শহরে, আদিবাসী মহল্লায়, জঙ্গলমহলে, পাহাড়ি অঞ্চলে এবং প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জেগে ওঠে নকশালবাড়ির মুখ, সেই পুরাতন অথচ চিরনতুন আহ্বান: “আজ অনুশোচনার দিন নয়, আগুনের মতো জ্বলে উঠবার দিন।” আজও সমস্ত রং-বেরঙের শাসকশ্রেণি সংগঠিত প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে নকশালপন্থী তথা মাওবাদের ভূত দেখে আঁতকে ওঠে। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের আন্দোলনের মধ্যে বারবার চারু মজুমদারের জীবন্ত প্রতিমূর্তির দুঃস্বপ্ন দেখে আতঙ্কিত হয়। ফলে সেই সমস্ত আন্দোলনকারীদের দমন করতে তারা নামায় র্যাফ, সিআরপিএফ সহ নানান নামের সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনি, লেলিয়ে দেয় সিবিআই-এনআইএ-র মতো কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় সংস্থা। প্রয়োগ করে ইউএপিএ, টাডা, আফস্পা সহ নির্মম সব আটক আইন, বিনা বিচারে কারারুদ্ধ রাখার শতাব্দীপ্রাচীন ঔপনিবেশিক আইন!
আজ সারাদেশ জুড়ে বিবিধ সরকারি নিষেধাজ্ঞার নিগড়ে বিপন্ন জনজীবনকে বিপন্নতর করে, নাগরিক অধিকার আরও সঙ্কুচিত করে দেশ জুড়ে বিভিন্ন স্থানে ভিন্নস্বর নির্মূলকরণের লক্ষ্যে প্রতিবাদী কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিকদের সরকার গ্রেফতার করে চলেছে। অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও পাদরি স্টান স্বামীকেও রাষ্ট্রীয় হেফাজতেই খুন করা হয়েছে। তাঁর এই হেফাজত-হত্যার ঘটনা প্রায় পাঁচ দশক আগে কলকাতা পুলিশের হেফাজতে চারু মজুমদারকে খুনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
আমাদের দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবী রাজনীতির তত্ত্ব এবং অনুশীলনের প্রেক্ষাপটে চারু মজুমদারের ভূমিকা একদিকে যেমন অত্যুজ্জ্বল, পথপ্রদর্শক এবং কর্মের নির্দেশিকা, তেমনই অন্যদিকে তাঁর হঠকারিতা অজস্র ভুল এবং বিভ্রান্তির জন্মকে অবধারিত করে ভারতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বিড়ম্বিত করেছে, সন্দেহ নেই। চারু মজুমদারই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল এক লেখায় বলেছিলেন প্রত্যেকটি সামগ্রিকতার মধ্যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক থাকে। নেতিবাচকতার দিকটি প্রাধান্যে থাকলে তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বিপরীত দিকে যদি দেখা যায় সেখানে ইতিবাচক দিকটি প্রাধান্যে আছে তবে অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতে হবে। ভালো-খারাপের বিষয়াবলিও এরই নিরিখে বিচার করতে হবে। এমনকি এই বিচারপ্রক্রিয়ায় সামগ্রিকতার মধ্যে যদি ৬০ শতাংশ ইতিবাচক উপাদান পাওয়া যায় তবে তাকেই গ্রহণ করার কথা বলেছেন তিনি। এবং বিপরীত দিক দিয়ে সামগ্রিকতার মধ্যে যদি ৬০ শতাংশ নেতিবাচক উপাদান পাওয়া যায় তবে তাকে বর্জন করার কথাও বলেছেন। ঠিক এই হিসেবেই চারু মজুমদারের রাজনৈতিক ভূমিকার সামগ্রিকতার বিচার করা উচিত। এবং এক্ষেত্রে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকার পরিমাণ নিঃসন্দেহে ৬০ শতাংশের অনেক বেশিই হবে। স্তালিনকে বিচার করতে গিয়ে মাও-ও এই পদ্ধতিকেই মান্যতা দিয়ে স্তালিনকে গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। চারু মজুমদার সম্ভবত মাওয়ের এই পদ্ধতিকেই অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন।
‘জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ’ চারু মজুমদারের এই শব্দচতুষ্টয় ‘বিপ্লবী’ বামপন্থীমহলে খুবই ব্যবহৃত এবং উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব অনুশীলনে দেখা দরকার যে এই শব্দচতুষ্টয়কে সামনে রেখে পার্টির ‘স্বার্থ’সেবাকেই জনগণের স্বার্থসেবা বলে চালানো হচ্ছে কি না। যেমন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা শব্দদুটি যতখানি মৌখিক চর্চার বিষয়, অনুশীলনগত ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতি ততখানি প্রকটভাবেই লক্ষ করা যায়। মার্কসবাদ কোনও আপ্তবাক্য নয়, তত্ত্ব এবং তার অনুশীলনের সুসামঞ্জস্যের মধ্যেই তার সার্থকতা নিহিত থাকে। স্বভাবতই ‘মার্কসবাদ সত্য কারণ ইহা বিজ্ঞান’— এ জাতীয় ক্লিশে দেওয়াল লিখনে যাতে তা রূপান্তরিত না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখা দরকার। চারু মজুমদারের বিপ্লবী আবেগ, তত্ত্বায়ন এবং বাস্তবের মাটিতে তার রূপায়ণের ক্ষেত্রে ঠিক-ভুলের বিচার অবশ্য করতে হবে, এবং তা করতে হবে মোহযুক্ত না হয়েই। মনে রাখা দরকার সাতচল্লিশ-উত্তর ভারতবর্ষে চারু মজুমদারই প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নেতা যিনি আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক হ্যাং-ওভার কাটিয়ে উঠে ভারতের এক নতুন ইতিহাসের দিগদর্শন হাজির করেছিলেন, নতুন এক স্বপ্নের আকাশকে উন্মুক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রের নগ্ন-আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে দেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীরা দুঃসাহসের নিশান তুলে অসম লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তাঁর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েই। উপনিবেশ-উত্তর ভারতে এ এক অদৃষ্টপূর্ব ইতিহাস। এই ইতিহাসের নির্মাতাকে বিচার করার ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা প্রয়োজন। তাঁর পূর্বোত্থাপিত প্রশ্নাবলির উত্তর দেওয়ার দায় যেমন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, তেমনই তাঁর অনুশীলিত ভুলের উপেক্ষাও মার্কসবাদসম্মত হবে না। তাঁকে শুধুমাত্র অপ্রশ্নেয় দেবতা বানিয়ে পুজো করে যেমন তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব নয়, তেমনই তাঁকে দানব বা খলনায়ক বানিয়ে নিজেদের দায় অস্বীকার করার মধ্যেও মার্কসবাদকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অপরদিকে তাঁকে মান্যতার আসনে বসিয়ে অনুশীলিত রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষার অঘোষিত বিরুদ্ধতাও কোনও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক হতে পারে না। পুলিশি হেফাজতে তাঁর নিহত হওয়ার এক মাস কুড়ি দিন আগে একটি লেখায় চারু মজুমদার বলেছিলেন:
আজ আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাপক মূল জনগণের মধ্যে পার্টি গঠন করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং লড়াইয়ের ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপকতম অংশের সাথে যুক্ত মোর্চা প্রতিষ্ঠা করা।
সমসময়ের কংগ্রেসি জমানার বিরুদ্ধে ‘ব্যাপকতম যুক্ত মোর্চা’ গঠনের বিষয়টিকেও তিনি অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন দেশের সাধারণ মানুষের ওপর কংগ্রেস সরকার যে অত্যাচার কায়েম করেছে, দেশের ‘বামপন্থী দলগুলো’ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ‘লড়াই করতে নেতৃত্ব দিচ্ছে না’। সেইসব দলের অন্তর্ভুক্ত ‘শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি’ জনসাধারণ তাঁদের দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। ‘ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ভিত্তিতে’ এইসব বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে ‘ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা’কেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আরও লিখেছিলেন এমন-কি, ‘যারা এক সময়ে আমাদের প্রতি শত্রুতাচরণ করেছে ‘পরিস্থিতি’ বিশেষে তাঁরা ‘আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে’ এগিয়ে আসবেন। এঁদের সঙ্গে ‘ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতো মনের প্রসারতা রাখতে হবে’ বলে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, কেননা ‘মনের প্রসারতা কমিউনিস্টদের গুণ’। জনগণের স্বার্থরক্ষার্থে সময় এই ‘ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দাবি’ করছে।— চারু মজুমদার তাঁর এই লেখায় সমসময়ের অত্যাচারী কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের মধ্যেকার ঐক্যের কথাই বলেছিলেন। তিনি একথাও বলেছিলেন দেশের সমসময়ের ‘বামপন্থী দলগুলো’ কংগ্রেস সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়নি। আর একারণেই তাদের সংগঠনের ক্ষুব্ধ সংগ্রামেচ্ছু জনতার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা তিনি বলেছিলেন। পাশাপাশি একথাও মনে রাখা দরকার যে ১৯৬৮-র ৩০ মে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন:
যুক্তফ্রন্টের নামে ভারতবর্ষ যা ঘটছে সেগুলি হল কতকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল পার্টির ক্ষমতার জন্য জোটবদ্ধ হওয়া। এই একজোট হওয়ার একটিই লক্ষ্য, তা হল, মন্ত্রিসভা দখল হবে কিনা।
আজ দেশজুড়ে আগ্রাসী ফ্যাসিবাদের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে ‘মন্ত্রিসভা দখল’ করার জন্যে যদি ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়, তবে তা আগ্রাসী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত বিপ্লবী লড়াইয়ের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণার সামিল হয়ে দাঁড়াবে। চারু মজুমদারের শহিদত্বের পঞ্চাশতম বর্ষের উৎক্রান্তির পর্যায়ে এই কথাগুলি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কেননা চারু মজুমদারই বলেছিলেন:
…বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রাম মারফত যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হবে, সেই বিপ্লবী পার্টিই বিভিন্ন জাতীয় অভ্যুত্থানগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। বিভিন্ন পেটি-বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে যে-সব জাতীয় সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলির বিজয় নির্ভর করে কতখানি এই সব জাতীয় আন্দোলনগুলি শ্রেণীসংগ্রামে পরিণত হচ্ছে এবং কতখানি শ্রেণীসংগ্রাম তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে তারই উপর।
এইসব প্রশ্নের জীবন্ত চর্চার মধ্যে দিয়েই চারু মজুমদারকে পুনরাবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় ব্রতবদ্ধ থাকা উচিত। ভুল এবং ঠিকের সমন্বয়ের মধ্যে দিয়েই কিন্তু নকশাল আন্দোলনের এই রূপকার এক অনতিক্রম্য জীবন্ত ইতিহাস হয়ে ক্রমাগত হাতছানি দিচ্ছেন।
জুন ১৭-১৯, ২০২২