সুনীতা নারায়ন
সুনীতা নারায়ণ সিএসই-র ডিরেক্টর জেনারেল এবং ডাউন টু আর্থ পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমান নিবন্ধটি গত ৬ জুন ডাউন টু আর্থ ওয়েব পোর্টালে ইংরাজিতে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষান্তর: সত্যব্রত ঘোষ
যথেষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে এটি আমি লিখছি। বিশ্ব আবহাওয়া সচেতনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে জুন মাসে আমরা স্টকহোমে এসেছিলাম। সবার স্বাধীনতা এবং পৃথিবী নামের গ্রহটির জন্য যে বৈশ্বিক এক নিবিড়তা প্রয়োজন তা নিয়েই এবারের সম্মেলন।
তবে আগে যতটা ঘটত, এবারের অনুষ্ঠানে দেখা গেল যে তার চেয়েও বেশি করে এটি কার্যত এক বধিরদের সংলাপে পরিণত হয়েছে। মনে হল এই পৃথিবীতেই রয়েছে দুটি ভিন্ন গ্রহ। বিভাজন এখানে অনেকটাই গভীর— দুটি মেরুর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবটা অত্যন্ত বেশি।
এবারে আপনাদের বলি, কী কারণে আমি এত বিক্ষুব্ধ এবং কেন আরেকবার এই সম্মেলনের পর আবার আমার মনে হয়েছে যে পরস্পরকে শুনতে শেখাটা আমাদের কতটা প্রয়োজন।
আপনারা জানেন, ভারতবর্ষের কিছু অঞ্চলে এখন প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। আমার শহর দিল্লির তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। যেন একটা জ্বলন্ত নরক। আমি জানি কথাটি অনেকেরই ভাল লাগবে না, বিশেষ করে যাঁরা অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক তাপমাত্রায় দিন কাটিয়ে থাকেন।
যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাইরে রোদে পুড়তে পুড়তে কাজ করেন— সেইসব কৃষক এবং নির্মাণকর্মী থেকে সবাই যাঁদের ঘরেতে পাখা চালানোর জন্য বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য নেই— তাঁদের ভোগান্তিই সবচেয়ে বেশি। এই জ্বলন্ত নরকের তাপে সরাসরি ঝলসে যাচ্ছেন তাঁরাই। এতে শ্রমজগতের ক্ষতি হয়েছে, অসুস্থতা বেড়েছে, জীবনহানি ঘটিয়েছে এবং গমের মতো শস্যের একটি অংশকে ঝলসিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।
বৈজ্ঞানিকরা আগাম বলে দিয়েছিলেন যে এবারে তাপমাত্রা মে মাসের পরিবর্তে মার্চ মাস থেকেই বাড়তে শুরু করবে। তাপমাত্রার প্রভাব তাই হবে আরও বিধ্বংসী। এই তাপপ্রবাহের সৃষ্টি, তাঁদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোতধারা লা নিনা-র জন্য, যা এবারে অস্বাভাবিকভাবে প্রলম্বিত।
এমনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে ভূমধ্যসাগরে উৎপন্ন বায়ু থেকে সৃষ্ট পশ্চিমি ঝঞ্ঝায় বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে। যা আবার উত্তরমেরুর জেট স্ট্রিমের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের ফলে প্রভাবগ্রস্ত।
গ্রীষ্মকালের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে যে বৃষ্টিপাত ঘটে, তা এই পশ্চিমের ঝঞ্ঝাই এনে থাকে। এতে তাপপ্রবাহ কিছুটা কম হত। কিন্তু এই বছরে পশ্চিমের ঝঞ্ঝা বেশ দুর্বল। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এটি পরিষ্কার বোঝা গেছে যে এই দাবদাহের সঙ্গে বিশ্ব আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ এবং নির্দেশযোগ্য যোগসূত্র রয়েছে।
পরিস্থিতি তাই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এবং এটিও নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতকে অন্যভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার উপায় আয়ত্ত করতে হবে। কারণ, এই দাবদাহ বাড়বে বই কমবে না। ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন-এর ‘দ্য স্টেট অফ দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট ২০২১’ রিপোর্ট, যা এই মে ২০২২-এ প্রকাশিত হয়েছে, গম্ভীর ভাষায় জানিয়েছে যে আবহাওয়া পরিবর্তনের যে চারটি প্রধান সূচক— গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG)-এর ঘনীভবন, সমুদ্রতলের উত্থান, সমুদ্রের তাপ এবং সমুদ্রজলের অম্লতা বৃদ্ধি (acidification)— ২০২১ সালে রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
তাহলে আমাদের হাতে গ্রহণযোগ্য উপায় কী রইল?
এক, সবার কাছে কম দামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে যাতে মানুষ এই বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সঙ্গে যুঝতে পারে;
দুই, উন্নত তাপরোধক এবং অবাধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা সমন্বিত বাড়ি বানাতে হবে;
তিন, বৃক্ষরোপণ বাড়িয়ে রোদ থেকে বাঁচতে হবে এবং
চার, সেচ ও পানীয় জলের সংরক্ষণ বাড়াতে হবে।
এতে আমাদের শহরগুলির আবহাওয়াও শীতল হবে। কিন্তু এই উপায়গুলি গ্রহণ করলেও অনেকটা সীমাবদ্ধতা রয়ে যাবে। ইদানিং যে হারে তাপমাত্রা বাড়তে দেখছি আমরা, তার সঙ্গে মানিয়েও নিতে পারব না, বাঁচতেও পারব না। এটাও স্পষ্ট যে আমাদের মধ্যে দরিদ্র যারা, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমার যন্ত্রণা শুধু এই কারণেই নয় যে আমি চারপাশে এই দুঃসহ পরিস্থিতি দেখছি। আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধের এক কর্মী এবং পরিবেশবিদ হওয়ার সূত্রে আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে পরিস্থিতি শুধরানোর কাজে আমি ব্যর্থ হয়েছি— আমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছি।
ক্ষতস্থানে নুন ঘষে দেওয়া হয় তখন, যখন পশ্চিমের মিডিয়া আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে এই বিধ্বংসী দাবদাহের বিষয় আরও কিছু তথ্য জানতে চায়। ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যু নিয়ে প্রথম কয়েকটি প্রশ্নের পরেই অবধারিতভাবে ওরা জানতে চায় ভারতবর্ষ কীভাবে এই আবহাওয়া পরিবর্তন প্রতিরোধ করছে। তারপরে জানতে চাওয়া হয় ভারত কেন এখনও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা ব্যবহার করছে। এবং শেষ এবং মোক্ষম প্রশ্নটি হল তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুৎ চাহিদা আরও বাড়বে— যার পরিণামে আরও বেশি কয়লা পোড়াতে হবে। সেই বিষয় আমার কী বক্তব্য?
আমি কী বলতে পারি?
কী করে আমি ওদের বোঝাব যে GHG নিঃসরণের যে কোনও নিরিখে ভারতের অবদান অতি তুচ্ছ? কী করে আমি ওদের বোঝাব যে পরিমাণ নিঃসরণ বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে উপচে উঠে এই তাপপ্রবাহ ঘটাচ্ছে তা ভারতে তৈরি হয়নি? ভারতের শুধু গরিবদের এবং এমনকি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষদের দিকেই আঙুল না তুলে বরং এই বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণের দিকগুলি নিয়ে আলোচনা কতটা প্রয়োজন, তা আমি ওদের বোঝাব কী করে? ভারতের মতো—আমার দেশের মতো— দেশ আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষময় ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে সম্বন্ধে প্রকৃত সত্যগুলি উদ্ঘাটন করাটা যে বিশ্বের শক্তিশালী মিডিয়া হাউসগুলির জন্যেও অনেক বেশি জরুরি— তাই বা আমি বোঝাব কী করে?
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই GHG নিঃসরণ কমাতে আমাদের অতি অবশ্যই আরও সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু আজ আমাদের আলোচনা করতে হবে সবচেয়ে বিত্তশালী দেশগুলিই— ওদের দেশগুলিই— কীভাবে এই সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে। শুধু এই নিয়ে আলোচনাই যথেষ্ট নয় যে, ওদের নিঃসরণ কমাতে হবে— বিশ্বের অন্যত্র যে বিশাল ক্ষতি এবং বিপদ লাগাতার ঘটে চলেছে, তার ক্ষতিপূরণও যে ওদেরই দিতে হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করাও একইরকম জরুরি।
অস্বস্তিকর এইসব সত্যি কথা শোনা হয় না। আমরা চেঁচাতে পারি, কিন্তু ওই অংশের পৃথিবী তা শুনছে না। যদি আমরা উন্নততর একটি পৃথিবী চাই, তাহলে এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে— যদি আমরা আমাদের পৃথিবীর অস্তিত্বরক্ষা করতে চাই।