পার্থঙ্কর চৌধুরী
অধ্যাপক, বাস্তু ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর
কমবেশি প্রায় দু-মাস ধরে, পর পর দু-দফার বন্যায় অসম রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলচরকে আতঙ্ক আর বিভীষিকার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে বরাক উপত্যকায় ‘বাদল বাউল’ যে একতারা বাজানো শুরু করেছিল, নিরবচ্ছিন্নভাবে সেটা একটানা প্রায় দুমাস ধরে চলছিল। বলা চলে যে বরাকের পরিমণ্ডলে বৃষ্টিদেবতা ‘বরুণদেব’ যে ইন্সট্রুমেন্ট-খানা ওই কদিন বাজাচ্ছিলেন, তানসেনের বাদ্যযন্ত্রের চাইতে সেটা কোনও অংশেই কম শক্তিশালী নয়। মনে হচ্ছিল, কোথা থেকে হঠাৎ ছাড়া পেয়ে ‘ব্যাটা’ আষাঢ় দারুণ বেগে পুব হতে পশ্চিম আকাশের দিকে অস্থির হয়ে অনবরত ছোটাছুটি করছে জয়ধ্বজা হাতে নিয়ে। যদিও ক্যালেন্ডারের হিসেবে তখনও জ্যৈষ্ঠ মাস, তদসত্ত্বেও ‘বজ্রমানিক দিয়ে’ আষাঢ়কে অগ্রিম আবাহনের যে ‘মালা-গাঁথা’ এখানটায় শুরু হয়েছিল, সপ্তাহ-দশদিনের খানিক বিরতির পর সে তো ‘আবার পূর্ণদ্যোমে’ কখনও, ‘ঘন-গৌরবে’ ‘নবযৌবনা বরষা’ আবার কখনও ‘ভৈরব-বেশে’ এমন ‘ঝরঝর-বারিধারা’ শুরু করল যে জুনের দ্বিতীয়ার্ধে বেশিরভাগ শহরবাসীই ‘গৃহহীন’, ‘গৃহহারা’।
আতঙ্কের রেশ পুরোপুরি কেটে উঠতে পারেনি, এরই মধ্যে ‘সংজ্ঞা’ আর ‘চরিত্র’ পালটে নতুন নতুন বিপর্যয় এসে কলিংবেল বাজানো শুরু করে দিয়েছে। এগারো জুলাই থার্মোমিটারে পারদের মাত্রা ছিল সাঁইত্রিশ ডিগ্রি। রোজ এক ডিগ্রি করে চড়তে চড়তে চোদ্দ জুলাই বিকেলের দিকে শিলচরে সেটা চল্লিশে গিয়ে পৌঁছয়। ‘বাদল-মেঘে-মাদল-বাজে’ থেকে হঠাৎ করে কেন যে বরাক উপত্যকার আকাশ ‘প্রখর-তপন-তাপে, আকাশ-তৃষায়-কাঁপে’-তে রূপান্তরিত হয়ে গেল, প্রকৃতির এই হেঁয়ালি বোঝা দায়…!
বলছিলাম, কিছু লোক আজকের দিনেও ঘরছাড়া, বিষয়সম্পত্তি যা ছিল, সবই হয় জলের তলায় নতুবা বানের তোড়ে ভেসে গেছে, আর এটা কি না ‘কবিতা-আওড়ানোর’ মরশুম…? তাও আবার ‘রবীন্দ্র-কবিতা’? ধুত্তেরি…
অসমের দুটি প্রধান নদী, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক, দুটোরই অনেকগুলো উপনদী এবং অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এই সমস্ত প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো প্রকৃতির আশীর্বাদ— যা সুস্থ বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখা এবং জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধির সহায়ক। রাজ্যের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য এই জলজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল।
এ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বছরে গড়পড়তা ২৮০০ থেকে ৩০০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং এর শতকরা ৯৫ থেকে ৯৮ ভাগই এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মধ্যে হয়ে থাকে। বর্ষার মরশুমে এখানে প্রায়ই অল্প সময়ের ব্যবধানে অবিরাম বৃষ্টি হয়। যথারীতি, জল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উঁচু জায়গা থেকে ঢালু পথ ধরে নিচের দিকে ধাবিত হয়। আরেকটা বিষয় যেটা নিয়ে সবাই বলাবলি করলেও প্রতিরোধের নামে এযাবৎ ‘অষ্টরম্ভা’, তা হচ্ছে, চড়াই পাহাড়ি অঞ্চলে নির্মম বনধ্বংসের ফলে প্রতি বছরই নদী এবং তাদের উপনদীগুলিতে পলিমাটি জমা হচ্ছে, ফলে জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এবং তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের জন্য শহরগুলি স্থানীয়ভাবে প্লাবিত হয় এবং শহরের বাইরে, অর্থাৎ মফসসলের বেশিরভাগ জায়গায় বন্যাপরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকটি নদীরই বর্ষাকালে জলের উচ্চসীমা পরিমাপ করার জন্য একটা স্থান নির্ধারিত থাকে। বরাক নদীর জন্য সেটা হচ্ছে শিলচর শহর লাগোয়া অন্নপূর্ণাঘাট। এই ঘাটে নদীর বিপদসূচক চিহ্ন ১৯.৮৩ মিটার। ১৯৮৮ থেকে ২০২২ এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরে বর্ষার মরশুমে মোট চোদ্দবার বরাকের জল এই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ সীমা ২১.৮৪। দিনটা ছিল ১৯৮৯ সালের ১লা আগস্ট।
বরাক উপত্যকার দুর্যোগগুলির কথা যদি উল্লেখ করতে হয়, তাহলে, বন্যা সবগুলি দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম। অভিজ্ঞদের বয়ান মতে, ‘আষাঢ়-গগনে-যখন’ আর ‘তিল-ঠাঁই’ থাকে না, তখনই ধরে নিতে হয়, বর্ষা এসে যাচ্ছে; ‘ঝরঝর-ভরা-বাদরে’ ‘আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা’ এক্ষুনি ঝরে পড়বে এবং ‘শ্রাবণের আমন্ত্রণে’ ‘ক্ষণে ক্ষণে’ চালাঘরের দুয়ার কাঁপবে। আবার আবৃত্তি…? কবিতা কপচানো…? মাফ করবেন, পাঠক! হ্যাঁ, যেটা বলতে চাইছিলাম, বরাক উপত্যকার জন্য বন্যা ছাড়াও অন্য প্রধান দুর্যোগ হচ্ছে ভুমিকম্প, ভূমিস্খলন, প্রলয়ঙ্করী তুফান ইত্যাদি। ভূমিকম্প তো কোনও আগাম জানান দিয়ে আসে না, সেজন্যই আগাম প্রস্তুতি সম্ভব নয়, কিন্তু বাকিগুলোর ক্ষেত্রে কমবেশি একটা পূর্বাভাস সম্ভব।
ঘন ঘন এই বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে নদী তীরবর্তী বাঁধগুলির যথাযথ তদারকি এবং রক্ষণাবেক্ষণ অতি অবশ্যই প্রয়োজন। এছাড়াও গত এক-দেড়শো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে বর্ষাকালে যে নদীগুলির জল মাত্রাতিরিক্তভাবে উপচে পড়ে, সে-সব ক্ষেত্রে কৃত্রিম খাল কেটে সমস্যার নিরসন সম্ভব। এই বিষয়টা নিয়ে এর আগে আরও দু-এক জায়গায় লেখালেখি করেছি এবং বিভিন্ন মহল থেকে কমবেশি সমর্থন পেয়েছি বলেই এখানে আবারও উল্লেখ করার সাহস হচ্ছে। আসলে, প্রায় দেড়শো বছর আগে এরকম একটা কথা মাথায় রেখেই উপত্যকার হাইলাকান্দি জেলার ধলেশ্বরী নদীতে একটা খাল কেটে কাটাখাল নদী বানানো হয়েছিল। ঠিক একইভাবে পাশের রাজ্য ত্রিপুরার হাওরা নদীতে আরেকটা খাল কেটে ‘কাটাখাল’ সৃষ্টি হয়েছিল। এই দুটি কাটাখালই ব্রিটিশ জমানার। পশ্চিম ত্রিপুরার একটি প্রধান নদী হচ্ছে হাওরা। একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর প্রান্ত ধরে এই নদীটি বাংলাদেশের তিতাস নদীর সঙ্গে মিলিত হত। কিন্তু এখন সে রাজ্যের ‘পশ্চিম প্রান্ত’ ধরে তিতাস নদীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। ফলে, আগের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ঢোকার মুখে যে বন্যাপরিস্থিতির সৃষ্টি হত, সেটার থেকে চিরমুক্তি ঘটেছে। ওই একই ফর্মুলা বরাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কাছাড় জেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সোনাবাড়িঘাট নামক স্থান থেকে দক্ষিণ দিক ধরে একটা খাল কেটে যদি সেটাকে বদরপুরের পার্শ্ববর্তী কোনও এক জায়গায় (যেখানে বরাক দুভাগ হয়ে সুরমা আর কুশিয়ারা হয়ে গেছে, তার ঠিক আগে) মেলানো যায়, তাহলে প্রস্তাবিত এই নতুন কাটাখাল আগামী দিনগুলিতে শহর শিলচরকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তেমন একখানা পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার আগে সুদক্ষ টিম দিয়ে যথাযথ অধ্যয়ন অবশ্যই দরকার। সাম্প্রতিক বন্যায় রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর যে বিভীষিকা দেখল, এর স্থায়ী সমাধানের জন্য এটা যে নিতান্তই প্রয়োজন।
এবার একটু অফবিট-এ কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে। আমরা যারা মধ্যবিত্ত, তাদের তো আবার তিন-তিনটে ক্যাটেগরি। ‘উচ্চমধ্যবিত্ত’, ‘মধ্য-মধ্যবিত্ত’ আর ‘নিম্নমধ্যবিত্ত’। বন্যার এই কটা দিন ঘরে চাল-ডাল নেই, অথচ লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন নিতে গেলে সম্মানে যাদের বাঁধে তারা ‘নিম্নমধ্যবিত্ত’, ঘরে চাল-ডাল আছে, কিন্তু ফ্লাডের এই কটা দিন রান্নার মাসি আসতে পারছে না, তাই তেমন করে চর্বচোষ্য খাওয়া যাচ্ছে না, তারা ‘মধ্য-মধ্যবিত্ত’, আর বন্যা, খরা, ভূমিকম্প কিংবা এমনকি বজ্রপাত হলেও যাদের সামান্য বিচলিত হতে হয় না, অনায়াসে ‘আবৃত্তি করা’, ‘বেহালাবাদন’ গোছের কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তারা ‘উচ্চমধ্যবিত্ত’। বন্যার ভোগান্তির কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে ‘মধ্য-মধ্যবিত্ত’ আর ‘নিম্নমধ্যবিত্ত’ ক্যাটেগরির লোকেরা কম-বেশি হলেও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। আর ‘উচ্চমধ্যবিত্তের’ কথা তো এখানে আসছেই না। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই তিনটে ছাড়াও আরেকটি ক্যাটেগরির লোক রয়েছে। দিন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয়, তারা তো ‘শূন্যবিত্ত’। বন্যা এসে যখন চলে যায়, তাদের শোওয়ার ঘরে খাটের উপর দু ফুট পলিমাটি জমা থাকে। তাদেরই একজন সাধু দাস। সেদিন সাধু বলছিলেন, ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা, বাবু… পতথম ফ্লাডেই পথে বওয়াইয়া দিছিল… রোজগার-পাতি সবই বন্ধ… এক হপ্তা গেল না… আবার বইন্যা… পাচ-ডা পুলাপান লইয়া আবার যামু কৈ…? সমত্থ মেয়েছেলে… রিফুজি হইয়া ইস্কুলে গেলেও… হিকানদা রাইতে ঘুমান-টুমান যায় না…!’ এরকম আরেকটা চোদ্দ বছরের ছেলের সাহসী গল্প মুঠোফোনের দৌলতে সবার কাছেই পৌঁছে গেছে। ছেলেটার বাবা নেই। মা অসুস্থ হয়ে মামার বাড়িতে এসেছিলেন। বন্যায় দৌলতে ঐ বাড়িতে যাওয়া আসার পথটাও জলের তলায়। জলের উপর কচুরিপানায় মোড়া। অসুস্থ মাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাঁশের ভেলায় চাপিয়ে দুপাশের কচুরিপানা সরিয়ে নোংরা জলের মধ্যে ভেলা ঠেলে ঠেলে বাড়ি পর্যন্ত ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসেছিল বিশাল সূত্রধর নামের ঐ ছেলেটা।
সত্যিই তো। রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP-এর) বদান্যতায় ১৯৮০ সাল থেকে ‘পরিবেশ শরণার্থী’ (Environmental Refugee)-বলে একটা শব্দ ব্যবহারে চলে এসেছে। সাধারণত পরিবেশজনিত কারণে দীর্ঘদিনের বাস্তুভিটে ছেড়ে এক জায়গা থেকে যদি অন্য জায়গায় স্থায়ীভাবে চলে যেতে হয়, যেমনটা হচ্ছে, চট্টগ্রামের উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে, তাঁদেরকে এই পর্যায়ে রাখা যায়। কিন্তু সাময়িকভাবে যাঁরা সপ্তাহ-দশদিনের জন্য ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, এই সমস্ত সাধু দাস অথবা বিশাল সূত্রধররা কোন পর্যায়ের শরণার্থী? তিন, চার কিংবা পাঁচ হাজার নয়। এর চাইতে অনেক বেশি টাকাই যে এই মুহূর্তে তাদের দরকার! দোকানে অনেক বাকি… এখন তো আর দোকানদার বাকিও দিতে চাইছে না… সত্যিই, বাস্তবটা বড়ই রূঢ়…! ‘কবিতা পাঠ’ সেখানে একেবারেই বেমানান! ততোধিক বেমানান, পঁচাত্তর বছর বয়সি সাধু দাসের বাবা অথবা বিশাল সূত্রধরের দাদুমশাই এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মদের ‘অমৃত’ পান করার মতো আকাশকুসুম কল্পনা করাটাও…!