Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বৃষ্টি

বৃষ্টি | সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

 

নীল তেরপলের এলোমেলো ভাঁজে অল্প একটু বৃষ্টির জল জমে আছে। সে জল একটু বাড়লেই একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। তারপর  আবার কিছুক্ষণ জমতে থাকে… আবার গড়িয়ে পড়ে। তেরপলের উপর দীর্ঘ গ্রীষ্মের জমে থাকা ধুলো। বৃষ্টির নাচনে তার কিছু কিছু ধুয়ে গিয়ে এক অদ্ভূত নকশা তৈরি করেছে। শিমুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

পঞ্চাননতলা বাজারের ঠিক পেছনে শিমুলদের ঘর। নীল তেরপলের ছাউনি, পেছনে পাওয়ারবোর্ডের ময়লাটে হলুদ দেয়াল। তারও পেছনে দরমা। মা-মেয়ে মিলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু এখানেই। বৃষ্টির দিনে একটু কষ্ট হয়। এই যেমন আজকে।

শিমুলের কথা জানি না, সামিমা… তার মা… কিন্তু আমাদের চেনা। বড়রাস্তা পার হয়ে, সাউথ এন্ড পার্কের কোণায় হলুদ-খয়েরি লম্বা বাড়িগুলো একফালি জমির মধ্যে ঘোঁট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারই একটার তিনতলা-সাততলা-দশতলায় কাজ করে সে। আমার বাড়িতেও আসে… দৌড়ে, হাঁফিয়ে, ময়লা শাড়ি আর আধছেঁড়া প্লাস্টিকের চটি ফটফটিয়ে এবং অবশ্যই দেরি করে…।

হাতে সময় থাকলে প্রচুর কথা বলে। ঘরের কথা, বরের কথা… শান্ত জলঙ্গি নদীর মতো দিনযাপনের বুকে জেগে ওঠা দুঃখের চরের কথা।

মতিউরের বউ সামিমা। করিমপুরের ধানক্ষেত, সরষেফুল ভরা মাঠ উজিয়ে যখন ছোট হাসপাতালের মেজো উঠোনে পৌঁছেছিল, ততক্ষণে ‘বাচ্চার মাথা পেরায় পেরায় মায়ের মালাইচাকি ছুঁইছুঁই।’

–মাইয়ার নাম দিলাম— শিমুল। আর তুই হইলি শিমুলের মা!
–শিমুল? ক্যামন য্যান পোলা পোলা নাম! আইচ্ছা, ‘লিলি’ নাম রাখলে কেমন হয়…? আসলে, আমার না লিলিবিস্কুট খুব পসন্দ। রাখো না ওই নাম।
–আরে নাহ! শিমুল… শিমুল। এরপর তো পোলা হইব… তার নাম রাখুম— পলাশ!
–উহ, শখ কত! চারা না বসাইয়াই বোড়োইয়ের টক!

***

 

সেই শিমুল। দু-বছর বয়স থেকেই জ্বর-জ্বারি লেগেই আছে। খেতেও চায় না ঠিকমতো। শরীরের বাড় নেই।

আর একটু বড় হলে কেবলই হাঁফিয়ে পড়ে… শুয়ে থাকতে চায়। কেউ বলে সদর হাসপাতালে দেখাতে, তো কেউ বলে— কলকেতায় নে যাও।

তো, কলকাতাই সাব্যস্ত হল।

 

বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছেই লেভেল ক্রসিং— ল্যাংড়া গেট। সেখানেই মতি মিঁয়ার বোনাই আসিফের ঘর। সানতারাসের কাজ। সে নিজে একদিন কামাই করে শিমুলদের নিয়ে গেল চার নম্বর লোহাপুলের কাছে বাচ্চাদের হাসপাতালে। চশমাওয়ালা ছোট ডাক্তার, টাকমাথাওয়ালা বড় ডাক্তার সবাই দেখে শুনে… শিমুল আর সামিমাকে দুদিন ভর্তি করে রেখে… এমনকি মতি মিঁয়ার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তার রক্ত পরীক্ষা করে— একতাড়া কাগজপত্র হাতে নিয়ে টেবিল ঘিরে বসল একদিন।

শিমুলের হাতে একটা আপেল  দিয়ে বড় ডাক্তারবাবু বললেন—

–জন্ম থেকেই ওর একটা ভারী অসুখ আছে। আসলে তোমাদের দুজনেরই সেই অসুখটা আছে— অনেকটা করেই আছে। তাই মেয়েটাও পেয়েছে। এখন তোমাদের যেন আর বেশ কিছুদিন বাচ্চা টাচ্চা না হয়। দুজনেরই তাতে বড় ক্ষতি হতে পারে। এই বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝেই রক্ত দিতে হবে… যতদিন বাঁচবে ততদিন। আর… মেয়েটা কিন্তু খুব বেশিদিন বাঁচবে না।

শিমুল তখন চোখ বুজে আপেলটা কামড়াচ্ছে।

ওকে দেখে সে মুহূর্তে সামিমার হঠাৎ বকর-ইদের রোগাপানা কচি ছাগলটার কথা মনে হয়েছিল।

কানিশাইল দু-নম্বর ব্লকের সামিমা বিবি হদ্দগাঁইয়ার মতো সেদিন ডাক্তারের চেম্বারে বমি করে দিয়েছিল।

***

 

আসিফ বোনাই কয়েকজন ভদ্রলোকের ঠিকানা জোগাড় করেছিল যারা এই বড় অসুখের (কী যেন নাম?— কী মিঁয়া যেন?) রুগীদের একটু সাহায্য করেন। রক্ত চালানোর দিন গাড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছা-আনা করেন… কিছু ওষুধ এনে দেন।

বোনাই এই ঘরটাও খুঁজে দিয়েছিল। তিনশো টাকা ভাড়া। এমনকি বুদ্ধি দিয়েছিল কয়েকটা বাড়িতে বাসনমাজা-রান্না করার কাজ ধরার।

জব্বর বুদ্ধিটা এসেছিল মতি মিঁয়ার মাথায়।

–তুই যখন লোকের বাড়ি কাজ করবি, নামডা বদলাইয়া নিবি অবশ্যই। আমাগো দ্যাশ-গাঁওয়ের কেউ যদি দ্যাখে বা নাম শোনে— বদনাম করব… একঘরও করতে পারে। কারণ সবই তো বোঝোস তুই…।

কারণ সবই বুঝেছিল সামিমা। ফ্ল্যাট ফাইভ-বি, সেভেন-ডি-তে তাই প্ল্যাস্টিকের চটি ফটফটিয়ে ঢুকত— মঙ্গলা।

আর মাসকাবারে বোতল ধুয়ে কারণ পান করত মতি মিঁয়া!

কতটুকুই বা একার রোজগার! কলকাতায় থাকার খরচ আর শিমুলের চিকিৎসা— তহবিলে টান পড়তেই, মতিউর দেশের ট্রেন ধরল। কিছু জমি বিক্রি করে টাকা আনতে হবে।

–বড়জোর তিন হপ্তা! কাটাইয়া দে মা-বেটিতে। হালার কপাল আমার… ভাবলাম পোলার নাম রাখুম পলাশ…! যাউকগা।

সামিমা এরপর স্পষ্টভাবে কাজের বাড়িতে বলত, সে স্বামীপরিত্যক্তা।

মতি যাওয়ার আগে অবশ্য একটা বড় কাজ করে গিয়েছিল। বস্তিশুদ্ধু প্রায় ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে গিয়েছিল যে— তার বউয়ের রক্তের অসুখ আছে।

অন্তত নিকটদূর প্রতিবেশীদের অযাচিত শারীরিক উদ্দীপনার কেন্দ্রবিন্দু আর হতে হয়নি তাকে।

***

 

সামিমা বিবি সবে কাজে বের হয়েছিল। এমন সময় আকাশ আঁধার করে বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি! এক হাত দূরের সব ঝাপসা হয়ে গিয়েছে যেন। দ্রুতপায়ে  ঘরে ফেরত এল। মেয়েটার জ্বর বেশ কয়েকদিন ধরে। তার মধ্যে এরকম বৃষ্টি।

তেরপলের এদিকে সেদিকে ফুটো। ফুটো বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। বিছানা ভিজে যাচ্ছিল, তবে সেদিকে শিমুলের যেন খেয়ালই নেই… মুগ্ধ হয়ে সে বৃষ্টি দেখছিল। মনে মনে কবিতা আওড়াচ্ছিল—

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে,
লেবুর পাতা করমচা
যা বৃষ্টি ঝরে যা…

বৃষ্টি ঝরে যা… বলতে না বলতেই ত্রস্তপায়ে মা ফেরত এল।

–হায় রে মরা, বৃষ্টিতে পুরা ঘর ভাইসা গেল আর তুই শুইয়া শুইয়া তামশা দেখতাছস? একটু ডেকচিটা পাইতা পানিটা ধরলে কি হাত ক্ষয় হইয়া যাইত নি তোর? হাড়-কইলজা কালা করলি আমার— হড়বড় করে শিমুলকে বকতে বকতেই হাড়ি-পাতিল বের করে বৃষ্টির জল ধরতে লাগল সে। তারপরে নিজের অদৃষ্টকেই গাল দিতে বসল রোজকার মতো। শিমুল বড় বড় চোখ মেলে চুপ করে শুয়ে রইল। আস্তে আস্তে সামিমার গলার তেজ কমে এল। নিজের মনে খানিক বিড়বিড় করে চলল। বৃষ্টির তেজ তখনও কমেনি।

এমন সময় শিমুল বলে উঠল— মা, ভাত খামু।

সামিমা মেয়ের দিকে পিঠ দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল… কখন বৃষ্টি কমবে। আজও যদি কাজে যেতে দেরি হয়, তাহলে তিনতলার বৌদির হাউকাউয়ে টেঁকা যাবে না।

মনে মনে গাল পাড়ে— বেটি এক্কেরে খাইসটা!

তিন তিনটে বাসায় দৌড়ের ওপর ছোটা! কাজ করতে করতে হাড়-কইলজা এক হয়ে গেল। কত আশা করছিল, মা-মেয়ে মিলে বাসায় বাসায় কাজ করে ঘর-দোরটা একটু ঠিক করবে, তা না!

–মাইয়াটা সারাদিন জ্বর-জ্বারি বাঁধাইয়া বইসা থাকে। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন নিজের অদৃষ্টকেই জব্বর গাল দিচ্ছে, তখনই শিমুল বলে উঠল, মা, ভাত খামু।

সামিমা ঘুরে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল— তোরে য্যান ভাত খাওয়াই না?

আস্তে আস্তে মেয়ে জবাব দিল, আরেকজনের আইডা ভাত না… গরম গন্ধ চালের ভাত খামু।

হঠাৎ রাগে যেন কাণ্ডজ্ঞান হারাল শিমুলের মা… ছুটে এসে অসুস্থ মেয়ের পিঠে ধুরুম ধারুম কিল বসিয়ে দিল।

–ইহহ… নবাবের বেটি আইসে গরম ভাত খাইব। কামে যাইব না, ঘরে শুইয়া শুইয়া চান-তারা দেখব আর হের লইগ্যা আমি আসমান থিকা গরম ভাত পাইড়া আনুম। বাপে চম্পট দিসে, তাও সাধ মেটে নাই। কপালও আমার… এমুন মাইয়া জুটাইছে…, বলতে বলতে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সামিমা। বৃষ্টির তোড় পাত্তা না দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল।

শিমুলের শান্ত ডাগর চোখে… নাহ, জল ঝরেনি আর।

***

 

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল। তার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে সামিমার হঠাৎ ওঠা রাগটা আস্তে আস্তে পড়ে গেল। হু হু করে কাঁদতে লাগল আঁচলে মুখে চেপে। নির্জন পথটা বেয়ে হেঁটে চলল আরও দ্রুতবেগে। অসুস্থ মেয়েটা অনেকদিন ধরে ভাত খেতে চাইছে। ভালো আতপ চালের যা দাম… এই বাজারে গরম ভাত কি সোজা কথা? বাসায় বাসায় কাজ করে এঁটো-ঝুটো যা পারে নিয়ে আসে, আরেকবার জলে ফুটিয়ে নেয়। তাই দিয়েই চালাতে হয়। মাস শেষের মাইনে তো ঘরভাড়া আর পাড়ার ছোকরাদের চান্দা দিতেই বারো আনা চলে যায়। দুটো ভালোমন্দ খাওয়ার সুযোগ কই? মেয়েটা এখনও এইসব বুঝতে চায় না… আর কবে বুঝবে?

–নয় বছর বয়স হইসে… এখনও বোকার মতো গরম ভাতের আব্দার করে।

বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সামিমা বিবির কান্নার বেগও বাড়তে লাগল। আর কেমন করে যেন ভুখা মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হল।

***

 

খুব খিদে পেলে আগে খুব কষ্ট হত শিমুলের। এখন খিদে ভুলে থাকার বুদ্ধি বের করেছে। কখনও কখনও আকাশের মেঘ গোনে। একেকটা মেঘ দেখতে একেকরকম। কোনওটা দেখতে যেন তিন ঠ্যাংওয়ালা মানুষের মতো, কোনওটা আবার যেন চারচাকার গাড়ি। মাঝে মাঝে তেরপলের ফুটো দিয়ে উঁকি দেওয়া আলোর নকশা দেখে। দেশের স্কুলে ছোটবেলা বেশ কয়েকটা ছড়া শিখেছিল… তার অল্প কিছু মনে পড়ে যায় ইদানিং। ভুলে যাওয়া আরও ছড়া মনে করার চেষ্টা করে। এমনি করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধে হলে মা ঝুটা-বাসি খাবার নিয়ে আসে…।

কিছুদিন অন্তর হাসপাতালে যেতে হয় রক্ত নিতে।

রক্তের ফোঁটাগুলোকে পড়তে দেখে শিমুলের একটা কথা মনে পড়ে যায়। একবার কালীপুজোর সময় খুব খুউব বৃষ্টি হয়েছিল। গ্রামের পুজোমণ্ডপের কালীঠাকুরের মূর্তি ভিজে একসা! তার সেই বিরাট লাল জিভের রং গলে গলে পড়ছিল টপটপ করে। ঠিক যেন রক্তের ফোঁটা! তেমনি বোতল থেকে রক্ত তার হাতে ঝরে পড়ে যেন।

মাকে এসব বলেনি সে। শুনলেই তো ঠিক কাঁদতে বসবে।

আজ কতদিন হল… গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত চোখেই দেখে না শিমুল! সেই সুগন্ধী চাল— যা দিয়ে পুজোর পায়েস বানায় গো!

দুপুরের এ ঝুপ্পুস বৃষ্টিতে বেশ ঘুম ঘুম ভাব হতে লাগল তার… কল্পনাতে ভাতের ঘ্রাণ নিতে নিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

***

 

বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে শাড়ি। ঠিক করতে করতে কলিংবেল চাপল মঙ্গলা। বৃষ্টির জন্য আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। উকিলগিন্নি চিল্লাচিল্লি শুরু না করলেই হয় এখন। মেজাজমর্জি ভাল থাকলে গরম ভাত হয়তো চাওয়া যেত… রান্নাঘরে বাবু-বিবিদের জন্য ভাত রান্না করতে গেলেই তার নিজের আউলাঝাউলা মাইয়াটার কথা মনে পড়ে।

দরজা খুলল বৌদি। ভেজা কাপড় মাথায় দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ছুটে এল তাদের একমাত্র মেয়ে। পুণা না কোথায় যেন থাকে।

–কি মঙ্গলামাসি, কেমন আছ? আমি একদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি কিন্তু। কালই আবার ভ্যানিশ!

এবার কথা বলার সুযোগ পেল তার মা—

–রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখো, মঙ্গলা। মেয়ে রান্না করবে বলে ভাত চাপিয়ে ভুলে গিয়েছে… তলায় লেগে গেছে। ওই ধরে যাওয়া ভাত খেতে নেই। তুমি হাঁড়ি ধরে নিয়ে যেও। ইশ, অত দামি বাসমতি চাল!
–আমি এক্ষণি নূতন ভাত কইরা দিতাসি আপনাগো। কতটুকু সময় লাগব?
–আরে, তোমার দেরি দেখে বড়লোক মেয়ে খাবার অর্ডার দিয়েছে— খিচুড়ি, ডিমের ডেভিল আর মাছভাজা। এসে যাবে। তুমি বরং ঘরগুলো মুছে দাও ভাল করে। আর… লালশাক আছে ফ্রিজে। একটু ভেজে নিয়ে নাও তোমার ভাতের ওপরে। খাবে কী দিয়ে?
–হাউ রিডিকুলাস, মা! She is fully drenched… প্রায় কাঁপছে… আর ওকে তুমি ঘর মুছতে বলছ?

মাকে রীতিমতো পর্যুদস্ত করে মেয়ে আলমারি ঘেঁটে একখানা শাড়ি নিয়ে এল—

–মঙ্গলামাসি, এটা তোমার। পড়ে নাও এক্ষুনি।
–আরে, এটা আমার মায়ের আমলের শাড়ি। রেখে দিয়েছি তোর বিয়ের সময় antique piece করে সাজাব! ওটা দিস না।
–তোমার মাথাটা গেছে মা। বাপি ট্যুর থেকে ফিরলে বলবে Neuropsychiatrist-এর কাছে নিয়ে যেতে। তুমি তো জানো যে আমি বিয়েই করব না… তবুও! আর শোনো মাসি, আমার এই ফ্রকটা, তোমার মেয়ের জন্য নিয়ে যাও। মা, Now don’t tell, এটা আমার মেয়ের জন্য রেখে দিয়েছ!

মা আর মাসি দুজনকেই হতভম্ব করে মেয়ে ফরমান জারি করে বসল।

***

 

বৃষ্টি ধরেছে। ভাত-লালশাকভাজা-শাড়ি-ফ্রকের বড়সড় দুটি প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে সামিমার মনে হল চারটে বকফুলভাজা হলে বড্ড ভাল হত। বাজারের রাস্তা ঘুরেই এল… নাহ, এই বাদলায় কেউ বসেইনি। হঠাৎই মনে পড়ল ঘরে একটু চিনেবাদাম আছে। শাকের মধ্যে দিলে ভাল লাগে। মনে মনে বলল— কবে আনছিলাম। ফাগুন্দা পইড়্যা গ্যাসে কিনা কে জানে!

***

 

শিমুল খেতে বসেছে। নতুন ফ্রক পরে, সুগন্ধি গরম ভাত আর ভাজাবাদাম ছড়ানো লালশাক! তাকে যেন আজ কথার ভূতে পেয়েছে।

–আইচ্ছা মা, লালশাক খাইলে কি শরীলে রক্ত হয়? আমার তাইলে তো কাল রক্ত না নিলেও চলব… তাই না?
–বাপের কিন্তু লালশাকের মইধ্যে বাদাম খাইতে খুব ভাল লাগত… মনে আসে তোমার? এক-একটা বাদাম খুঁইজ্যা নিয়া খাইত। আর এত্তখানি ভাত!
–বাপে এখন কই থাকে মা? আসিফচাচা একদিন কইল— বোম্বাইতে। সেইটা কই গো মা?
–ইসস গো মা, আমার একডা ভাই থাকলে খুব মজা হইত। তুমি অগো বাড়ি কাজে গেলে, আমরা খুব খেলতাম। এমনভাবে ভাত আর লালশাক খাইতাম!
–একডা কথা কমু, মা? আজ অবধি তোমারে কই নাই। তুমি যখন কামকাজ করতে যাইতা,  জানো তো, বাপে না আমারে বুকে জড়াইয়া খুব কান্দত। তোমারে লুকাইয়া আমায় লিলি কইয়া ডাকত। এক্কেরে পোলাপাইনদের মতো ছিল বাপ। আমারে দেখতে ঠিক ফিরত আইব সে— দেইখো তুমি।

***

 

আজকের দিনটা সামিমাকে এত কিছু দিয়ে গেল…!

কাল লিলির রক্ত নেওয়ার দিন। সে আর সঙ্গে যায় না আজকাল। তবুও ভেবেছিল কাল কাজের বাড়িতে কামাই করবে।

নাহ, কাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কাজগুলো সেরে নেবে। মেয়ে রওয়ানা হওয়ার আগেই ফিরবে।

বলা তো যায় না, কালকের দিনও যদি আজকের মতো হয়।