বামা
বামা ফৌসতিনা সুসৈরাজ (১৯৫৭-) অন্যতম স্বনামধন্য দলিত মহিলা সাহিত্যিক, নারীবাদী ও শিক্ষিকা। তিনি দলিত সাহিত্য সক্রিয়তার অন্যতম পথিকৃৎ এবং দলিত সাহিত্যকে একটি অন্য মাত্রা দেন। তাঁর আত্মজীবনী 'কারুক্কু' (১৯৯২)-র পাশাপাশি তিনি তামিল ভাষায় সঙ্গতি (১৯৯৪), কিসুমবুক্করণ (১৯৯৬), ভানমম (২০০২), অরু ঠাটভুম ইরুমায়ুম (২০০৪), কনদাত্তম (২০০৯) এবং মানুষী (২০১১) ইত্যাদি বইও প্রকাশ করেন। তাঁর লেখার বিবিধ অনুবাদ হয়েছে। ২০০০ সালে লক্ষ্মী হমস্ট্রম কৃত 'কারুক্কু'-র অনুবাদটি ক্রসওয়ার্ড সম্মানে ভূষিত হয়, যা বামাকে দলিত সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বর হিসেবে চিহ্নিত করে। পন্নুথায়ী গল্পটি 'দ্য গ্রেটেস্ট তামিল শর্ট স্টোরিজ এভার টোল্ড' গ্রন্থ থেকে নেওয়া; নির্বাচন ও সম্পাদনা— সুজাতা বিজয়রাঘবন এবং মিনি কৃষ্ণণ। মূল তামিল থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন সি টি ইন্দ্র। ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাগরিকা শূর।
পন্নুথায়ীর বয়স বছর তিরিশ। বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা, সাত-আট বছরের বিবাহিত জীবনে চার-চারটে সন্তানের মা হয়েছে ও। পন্নুথায়ী বেজায় কালো আর যথেষ্ট সুন্দরী, তার শরীরও মনোরম। অথচ ওর ছেলেদের দেখে দাঁড়কাক ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না— ওদের প্রত্যেকের গায়ের রংই ওদের মায়ের মতো— এতই কালো যে মনে হয় আঙুল ডুবিয়ে ওই রং এক চিলতে তুলে টিপ হিসেবে পরা যায়।
যথেষ্ট লম্বা পন্নুথায়ী, ওর উচ্চতার সাথে পাল্লা দেওয়া কঠিন। ও রাস্তা দিয়ে হাঁটলে প্রতি পদক্ষেপে যেন মাটি কেঁপে উঠত।
–ওর পা দাপানো দেখে কেউ বলবে যে ও মেয়ে?— অন্যান্য মহিলারা আড়ালে বলত। ও কথা বললেও একইরকম মনে হত। যখন রাস্তার কল থেকে জল আনতে যেত, রাস্তার শেষ মাথা থেকে শোনা যেত ওর গলার স্বর— যাকে বলে কাংসবিনিন্দিত। একেবারেই অভদ্রের মতো। এইজন্যই অধিকাংশ লোকজন ওকে বিশেষ পছন্দ করত না।
খুব কম লোকই ওকে পন্নুথায়ী নামে জানত। কিন্তু সবাই ওই চামড়ার মতো ঠোঁটওলা মহিলাকে চিনত— ওর ঠোঁটগুলো একটু বেশিই পুরু ছিল।
–শুধু ওর ঠোঁটই মোটা নাকি? অন্যরা বলত।
–ওর মুখটা তো আরও বড়…
ও যে অন্য মহিলাদের মতো ভাগচাষ করত না, বরং নিজের ব্যবসা নিজে চালাত, সেটাও অনেকে পছন্দ করত না।
পড়াশুনা না জানলেও পন্নুথায়ী জানত কীভাবে একটা বাস চালিয়ে পাশের মহল্লায় নিয়ে যেতে হয়, কীভাবে সবজি-ফল কিনে আবার অন্য জায়গায় বিক্রি করতে হয়। অন্য কোনও মহিলাই এভাবে উপার্জন করতে পারত না। অন্যদের কথায় পাত্তা না দিয়ে পন্নুথায়ী ওর ব্যবসা চালিয়ে যেত।
পন্নুথায়ী একদিন এক ঝুড়ি নারকেল নিয়ে এসে— নারকেল চাই… নারকেল… তিনটে দশ টাকা… দেখে যাও, দেখে যাও— বলে চিৎকার করতে করতে ফেরি করছিল। অন্য এক মহিলা আর থাকতে না পেরে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনল— বাগান থেকে কিনলে তো দু টাকায় একটা নারকেল পাওয়া যায়। কীরম বেহায়ার মতো ও এখানে এসেছে দেখো, নিজেকে কত বড় ব্যবসাদার ভাবে!
–আমার ঝগড়া করার কোনও ইচ্ছে নেই, কিন্তু আমার পায়ে পা বাধালে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলব না। ইচ্ছে হলে কিনবে, নাহলে চুপ করে থাকবে। আমি আমার ব্যবসা কীভাবে চালাব সেই নিয়ে তুমি জ্ঞান দেওয়ার কে হে? পন্নুথায়ী চিৎকার করতে করতে সাউথ স্ট্রিটের দিকে চলে যায়।
সাউথ স্ট্রিটে পৌঁছেও ওর জ্বালা জুড়োয়নি। নারকেল বেচার বদলে পুরো মহল্লাকে চমকে দিয়ে পন্নুথায়ী তারস্বরে চেঁচাতে লাগল— আমি কাজ করব কিনা, আমি বুঝব। সেটা আমার ইচ্ছে। ওই মাগী আমায় ওভাবে বলার কে? আমি কী করছি তাতে ওদের কী? আর একবার কেউ আলটপকা কথা বলুক, আমি তার জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব। পন্নুথায়ীকে ওভাবে চিৎকার করতে দেখে আর কারও ওর ধারেকাছে যাওয়ার বা ওর জিনিস কেনার সাহস হল না। ও শুনতে না পাওয়ার মতো দূরে চলে যাওয়ার পর একমাত্র অন্য মহিলারা কথা বলতে শুরু করল। কেমন ডাঁটিয়ে কথা বলল দেখলি! ও আমাদের মতো মাঠে কাজ করতে পারে না? নিজেকে মেকালাকুডির দোকানদারদের মতো কী না কী ভাবে! আমি বলছি ওর প্রচুর দেমাক— মুনিইয়াম্মা যখন এসব বলছিল, পন্নুথায়ী হঠাৎই রাস্তার পশ্চিমদিক থেকে আবার পুবদিকে ঘুরে গেল। মুনিইয়াম্মাও মুখে কুলুপ আঁটল।
যেখানে বাকি মহিলারা এসে জড়ো হয়েছিল, পন্নুথায়ী আবার চিৎকার করতে করতে সেদিকে এগোল— আগেরদিনও… শুধু আমি ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মেজেছি বলে এই মাগীর দল একেবারে ভিরমি খাচ্ছিল, আবার নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছিল। আমার টাকা৷ আমি কী কিনব, কীভাবে খরচ করব আমি বুঝব। ওদের কীসে জ্বলছে আমার তো ঘটে ঢুকছে না…
পন্নুথায়ী সরে গেলে, আকাশামপত্তির মহিলাটি বলে উঠল— ওই মোটা ঠোঁট কী বলে গেল শুনলি? ও নাকি এতই বড়লোক যে ওর আঙুল দিয়ে দাঁত মাজতে গায়ে লাগে! দেমাকটা ভাব! কথায় বলে না, ছাল নেই কুকুরের, তার বাঘা নাম!
আথাইয়াম্মা সতর্ক করে— দেখিস, ও শুনতে পায় এমনভাবে আবার বলিস না যেন, শুনতে পেলে তোকে ছিঁড়ে খাবে। ওকে হালকাভাবে নিস না। ভুলে যাস না ও কিন্তু ওর বরকেও পুলিশকে দিয়ে মার খাইয়েছে, ও কিন্তু গুণ্ডা।
গ্রামে এমন কেউ ছিল না যে পুলিশকে জড়ানোর ব্যাপারে কথা বলেনি। বরকে ছেড়ে যাওয়ার পর গত দু বছর ধরে পন্নুথায়ী একাই থাকে। ও ওর মায়ের সঙ্গে থাকে আর ওর ব্যবসা থেকে যা উপার্জন হয় তাতে ওদের চলে যায়।
মুক্কান্দিকে বিয়ে করার পর ও তার সঙ্গেই ঘর তুলেছিল, আশায় বুক বেঁধেছিল যে আর পাঁচটা দম্পতির মতোই ওরা ভালো থাকবে। মুক্কান্দির গায়ের রং ঘন কালো, ধারালো গোঁফ। ওর গোঁফে তা দেওয়ার অভ্যাস ছিল। বারবার এভাবে গোঁফে তা দেওয়ার জন্য গোঁফের মাথা দুটো এমন ছুঁচলো হয়ে থাকত যেন এক্ষুণি কাউকে বিঁধিয়ে দেবে।
সে সপ্তাহে দুদিন কাজ করত এবং সপ্তাহের বাকি দিন বাড়িতেই থাকত। কিন্তু একটি দিনও তার ক্লাবে না কাটিয়ে দিন গুজরান হত না। সন্ধেবেলা এইসব খাবারের জায়গাগুলোয় ঘুরে সে ইডলি, ধোসা, বড়া, আরও কত কীই না খেত, আবার বাড়ি ফিরে রাতেও ভাত খাওয়া বন্ধ রাখত না। এই সমস্ত ‘ওটেল’-এ না খেলে তার দিন সম্পূর্ণই হত না। যেটুকুই সে রোজগার করত, পুরোটাই নিজের পেছনেই খরচ করত। যে দিনগুলো সে কাজে যেতে পারত না সেদিনগুলোতে মুক্কান্দি পন্নুথায়ীর ওপর চড়াও হত, আর তার পারিশ্রমিক কেড়ে নিত। রোববার করে সে গরুর মাংস খাবেই, আবার সেটা হজম করবার জন্য মারিয়াপ্পা থেভার থেকে দিশি মদ আনত, অথবা পন্নুথায়ীর জীবন নরক করে তুলত।
পন্নুথায়ী মুক্কান্দির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, নিজের অনুভূতিকে যথেষ্ট সংযত রেখে। জীবনের প্রথমদিকে সে কোনওক্রমে সংসার সামলে নিত। পরে যখন পরপর চার ছেলে জন্মাল, তখন যবও মহার্ঘ্য মনে হত। তবুও সে কোনওমতে দিন গুজরান করার চেষ্টা করত। অবশেষে সে একটা দুধেল গরু পায়, কিন্তু তার লালনপালন, ছেলেদের দেখাশুনা, মাঠে আবার বাড়িতে উদয়াস্ত পরিশ্রম, এ সমস্ত কিছুতে তার নাভিশ্বাস উঠছিল।
তারপর একদিন, মুক্কান্দি শুধু ওই গরুই বেচে দেয়নি, সে পন্নুথায়ীকে একটি কানাকড়িও না দিয়ে পুরোটাই নিজের পকেটস্থ করেছিল। এইসব নিয়ে ঝগড়ার কারণেই, মারধর খাওয়ার পরেই পন্নুথায়ী মুক্কান্দির কাছে থেকে পালিয়ে যায়।
যখন ও ওর স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে আসে তখনও ওর ছোটছেলে দুধ ছাড়েনি। ও শুধুমাত্র এই ছেলেটিকেই সঙ্গে নিয়ে আসে। চার-পাঁচ মাস পরে ও দুধ ছাড়লে তাকেও স্বামীর বাড়িতে রেখে আসে।
–ওকে মা বলছিস? মায়ের ছিটেফোঁটা নেই ওর মধ্যে! ও তো ব্যাটাছেলের মতো দাপিয়ে বেড়ায়! এর আগে কখনও কোনও মেয়েকে দেখেছিস নিজের বাচ্চাদের বরের কাছে রেখে নিজে ছেনালি করে বেড়াচ্ছে? মহল্লায় এক-একজন এক-একরকম মশলাদার গল্প করলেও পন্নুথায়ী নিজের রাস্তাতেই হেঁটেছে বরাবর।
-তো কী? ওরা কি ওর ছেলে না? ওর আনন্দের জন্য আমায় বছরের পর বছর বাচ্চা পেটে ধরতে হয়েছে। দুটো বাচ্চার পর আমি নসবন্দি করতে গেছিলাম, ও জোর করে আমায় ফিরিয়ে এনেছে— পন্নুথায়ী এভাবেই নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়।
মুক্কান্দি ওর চার ছেলেকে নিয়ে হিমশিম খেতে থাকে, সবাই হাড়জিরজিরে হয়ে যায়, হতাশা চরমে ওঠে। বেশ খানিকটা সময় পন্নুথায়ীর ফিরে আসার অপেক্ষা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর সে একদিন পন্নুথায়ীর রাস্তা আটকায়, ওই মাগি! বাড়ি চল!
–তোমার-আমার মধ্যে আর কিছু নেই, যা ছিল দুবছর আগে চুকেবুকে গেছে। আমি আর তোমার সঙ্গে থাকব না, পন্নুথায়ী হনহন করে এগিয়ে যায়।
–খানকি মাগি, তোর এত সাহস কী করে হয় যে নিজের বরকে বলিস থাকবি না? কুত্তি… তুই কি সত্যিই মেয়েছেলে? সারাদিন তো কুকুরের মতো এদিকওদিক ঘুরে বেড়াস নিজের বাচ্চাদের ফেলে… মুক্কান্দি চেঁচিয়ে ওঠে।
–আমার যেমন খুশি তেমন ঘুরব। তুই বলার কে? বাচ্চাগুলো কি তোকে ছাড়া পয়দা হয়েছিল? ওদের বড় কর। তাহলেই বুঝতে পারবি! রাগে ফুঁসতে থাকে পন্নুথায়ী।
মুক্কান্দির রাগের কোনও সীমা পরিসীমা ছিল না। সে রাগে চিৎকার করে ওঠে। চুপ কর! শালা, মাগি! তোর ঠোঁটগুলো দেখেছিস, তোর চেহারাটা! অন্য কোনও মরদ হলে না তোর ঠোঁট দেখে তোকে বিয়েই করত না! আমি তোকে দয়া করেছি, তোকে বিয়ে করেছি, তাই আমার কপালে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমার জুতোর বাড়িই খাওয়া উচিত।
পন্নুথায়ীও চিৎকার করে ওঠে— হ্যাঁ হ্যাঁ, শুধু জুতো কেন, ঝাঁটার বাড়িও খাওয়া উচিত। থুঃ! অকম্মার ঢেঁকি… তারপরেও তোর শিক্ষা হবে না। মুক্কান্দির দিকে থুথু দিয়ে ও চলে যায়। মুক্কান্দি ওর চুলের মুঠি ধরে টানে, মুখ আর হাতে মারতে থাকে। হিঁচড়ে টেনে আরও মারধোর করে। পন্নুথায়ী গোঙাতে থাকে, নিজেকে মুক্ত করতে চায়। ও মুক্কান্দির হাত থেকে ছাড়া পেতে তার হাতে কামড়ে দেয়। কামড় খেয়ে মুক্কান্দি ওর তলপেটে লাথি মারে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে পুন্নথায়ী পড়ে যায়, চিৎকার করে ওঠে, ওর মাথা ঠুকে যায় দেওয়ালে। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে, ভিজে যায় কাপড়জামা। এরপর ও একবারের জন্যও চেঁচায়নি, একটি অপশব্দও উচ্চারণ করেনি। ওই রক্তঝরা অবস্থাতেই ও দক্ষিণমুখে ছুটতে থাকে।
ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে ওঠে— আরে, ওকে থামাও। ও তো মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়চ্ছে। ও কিন্তু কুয়োয় ঝাঁপ দিতে পারে। দেখো, ও কী জোরে দৌড়চ্ছে… ও কিন্তু এরকম কিছু করে ফেলবে।
–জাহান্নামে যাক! বদমাইশ মেয়েছেলে! আমি ওকে পুঁতে দেব, আবার বিয়ে করব আমি। যেন ও ছাড়া জগতে আর কোনও মেয়েছেলে নেই! মুক্কান্দি চিৎকার করে ওঠে।
আলুথালু বেশে পন্নুথায়ীর মা-ও ওর পেছনে চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকে। ততক্ষণে পুরো মহল্লা জড়ো হয়ে গেছে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে পন্নুথায়ীর পেছনে দৌড়চ্ছে৷ কয়েকজন কিছুটা দৌড়ে হাল ছেড়ে দেয়।
পন্নুথায়ী কিন্তু কোনও কুয়োতে ঝাঁপ দেয়নি, বরং সে মাঠ পেরিয়ে সোজা সদর শহরের থানায় হাজির হয়। পন্নুথায়ীকে ওই অবস্থায় দেখে থানায় ভিড় জমে যায়। পুলিশ তাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
–বাবু, গত দু বছর ধরে আমি নিজের খরচ নিজেই চালাই, কারও সাতেপাঁচে থাকি না, আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছি, কারণ ও আমায় খুব মারত। আজ ও এল, কোথাও কিছু নেই, আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল, তারপর মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিল। বাবু! আপনাকে কিন্তু ওকে শিক্ষা দিতেই হবে, বলতে বলতে পন্নুথায়ী শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথার রক্ত মুছতে শুরু করল। নিচের মেঝেতেও রক্ত পড়েছিল। পুলিশরা ওর মহল্লা, রাস্তার নাম, অন্যান্য তথ্যাদি জানতে চাইল, তারপর ওকে সরকারি হাসপাতালে যেতে বলল। এরমধ্যে ওর মা-ও এসে গেছে, আর পন্নুথায়ীকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। অবশ্য কপাল ভালো যে ওখানকার দারোগার মানবতা তখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। তিনি তক্ষুণি মুক্কান্দিকে ধরে আনতে দুজন হাবিলদারকে পাঠালেন। পন্নুথায়ী ব্যান্ডেজ করে ফিরে আসে। থানায় মুক্কান্দিকে প্রচণ্ড মারা হয়। তারপর তাকে লকআপে বন্দি করে দারোগা পন্নুথায়ীকে বলেন— তুমি কী বলো? ওকে চার-পাঁচদিন আটকে রাখি, একটু সহবৎ শেখাই, তারপর না হয় ফেরত পাঠিয়ে দেব। তুমি কি ওর সঙ্গে থাকবে? আবার ঝামেলা করলে, আমায় সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।
–বাবু, আপনি যা ভালো বোঝেন করেন! আমি ওর সঙ্গে থাকব না। যথেষ্ট হয়েছে। আমি বাকি জীবনটা আমার মতো থাকতে চাই, এই বলে ও ওর মায়ের সাথে চলে যায়।
পরের দিন মুক্কান্দিকে ভালো করে সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে পুরো মহল্লা জেনে গেছে যে পন্নুথায়ী থানায় গেছিল আর অভিযোগ দায়ের করে ওর বরকে মার খাইয়েছে। মহল্লায় যতজন লোক ছিল ততগুলো রটনা ঘুরতে লাগল।
আথাইয়াম্মা বলল— যাই হয়ে থাকুক, নিজের বরের বিরুদ্ধে থানায় জানিয়ে মার খাওয়ানোটা কি ঠিক? আ্হাম্মক মেয়েছেলে!
কুরুভাম্মা বলল— এটা বলিস না। ওই মেয়েটাই বা আর কত সহ্য করত? ও কি এতদিন পড়ে পড়ে মার খায়নি? এরকম মরদকে পুলিশেই দেওয়া উচিত। অন্য ব্যাটাছেলেরাও এবার থেকে বউ পেটানোর আগে দুবার ভাববে তাহলে।
–তাহলে তুই বলছিস বর বৌকে মারলে বৌয়ের উচিত বরকে মার খাওয়ানো? ভালো রে ভালো! তোর কি মনে হয়, কতক্ষণ এইসব থানার লোকেরা ওর পাশে থাকবে? আজকালকার দিনে এসব বিশ্বাস করা যায় না, বুঝলি? যাই হয়ে যাক, শেষমেশ তো বরের কাছেই ফিরতে হবে, তখন ও মজা বার করে দেবে! আথাইয়াম্মা বলে।
কন্নিয়াম্মা এতক্ষণ চুপচাপ দুজনের কথা শুনছিল, এবার সে বলে ওঠে— দেখ, গেল দু বছর তো নিজের টাকাতেই চলছিল, ওর বরকে ছেড়ে দিয়ে। ওর বরের উচিত ছিল চুপচাপ থাকা, তা না, সে আবার ওকে বাড়িতে ডাকতে গেল। তো ও না করল। এবার তো ওর বরই ঝামেলা পাকিয়েছে। ও যখন ফিরতে চাইছিল না, তখন ওকে জোর করার কী ছিল?
–তোর কি মনে হয় ওর বরটা ওকে আবার ডেকেছিল ওর সঙ্গে থাকবে বলে? আসল কথা হল, ও একা চার-চারটে ছেলেকে সামলাতে পারছিল না। সেজন্যই ও ঝগড়া বাধাতে চেয়েছিল যাতে ছেলেগুলোকে ওর কাছে রেখে যেতে পারে— কুরুভাম্মা বলে ওঠে, ওদিকে আবার কন্যায়াম্মা বলে— ওই বা কতদিন একা থাকবে? মেয়েমানুষ যদি বা পারে, ব্যাটাছেলে কোনওদিনই পারবে না।
মেয়েরা যখন নিজেদের মধ্যে এসব আলোচনা করছে, ছেলেরাও তখন নিজেদের মধ্যে গালগল্পে মশগুল— ও আবার ব্যাটাছেলে নাকি? ও মেয়েছেলেদের থেকে বেশি কিছু না। যার বৌ থানায় যাওয়ার দেমাক দেখায়, তারপর বরকে মার খাওয়ায়, সে আবার তার বৌকে ছেড়ে দেয়। ছিঃ! অকম্মা! আমি ওর জায়গায় হলে ওকে থানাতেই গলা টিপে মেরে ফেলতাম, কুপ্পুস্বামী উত্তেজিত হয়ে বলে।
–তুই একটা পাঁঠা। একটা মেয়েছেলেকে মারা এমন কিছু নয়। মুক্কান্দি শুরু থেকেই ওকে ওর জায়গাটা বোঝাতে পারেনি। এবার ফল ভুগছে। একটা ব্যাটাছেলে যদি নিজের বৌকে বাগেই না আনতে পারে তাহলে সে কেমন ব্যাটাছেলে? ও আবার কী গোঁফে তা দেয়? গোভিন্দন হাসতে হাসতে বলল।
পুরুষেরা যখন এভাবে মুক্কান্দিকে উপহাস করছিল, মুক্কান্দির আপাদমস্তক জ্বলে যাচ্ছিল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। তারপর মনস্থির করে সে পন্নুথায়ীর বাড়ির দিকে রওনা দেয়। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে— আমি আপনার মেয়েকে আর আমার সঙ্গে থাকতে ডাকব না। বাচ্চারাও ওর সঙ্গেই থাকুক। আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে আমার মতো থাকব। ওর জন্য অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে আমায়।
পন্নুথায়ীর বাবা মৃদুস্বরে বলল— একটু মানিয়ে নাও, বাপ আমার। মেয়েছেলেদের বুদ্ধি, বোঝোই তো। ও বোকার মতো আগের দিন থানায় গেছে। আমায় একটু সময় দাও। আমি ওকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ওর ভূত ঝাড়াব।
–ওসবে কাজ হবে না। আমার ওকে আর দরকার নেই। আমি এসে বাচ্চাগুলোকে রেখে যাব, ব্যস্— মুক্কান্দি ফেরার পথে পা বাড়ায়। পন্নুথায়ী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, হঠাৎ বলে উঠল— কেন রেখে যাবে? তোমার বাচ্চা, তুমি সামলাও। আমার তুমি বা তোমার বাচ্চা কাউকেই দরকার নেই। কোথায় লেখা আছে যে শুধু মাকেই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হবে? ওদেরকে এখানে আনবে না, নিজেও আসবে না, আমি কিন্তু বারণ করে দিলাম।
কথাগুলো মুক্কান্দির গায়ে লাগে। পন্নুথায়ীর মা সশব্দে কাঁদতে থাকে— ও কিন্তু আবার বিয়ে করবে। সেই বৌ কিন্তু ছেলেগুলোর ওপরই অত্যাচার করবে। আমার কথা শোন। বর কিন্তু বরই হয়, সে পাথরই হোক আর ঘাসই হোক। সে লাথি মারুক, ঝাঁটা মারুক, তার সঙ্গেই থাকতে হবে। তা না করে তুই এখানে এসে যে কী পাপ করলি মাগি! অন্তত এবার বাচ্চাগুলোকে এখানে এনে রাখতে দে।
–কান্নাকাটি বন্ধ করো তো, মা। যেন বাপের কোনও দায়িত্ব নেই! ওকে বুঝতে দাও, আমার অনেক পাথর, ঘাস দেখা হয়েছে— বলে পন্নুথায়ী বাড়ির ভেতর থেকে একটা ব্লেড নিয়ে এল। বাড়ির সামনের মুরগির খাঁচাটার ওপর বসে ও গলার ঠালি সুতোটা কাটতে শুরু করল।
এটা দেখেই ওর মা রে রে করে এল— ওরে হতচ্ছাড়ি! তুই এটা কী করছিস? তুই কি ভাবছিস তোর সাথে যা হয়েছে আর কারও সঙ্গে হয় না? তাই বলে কেউ বরের বেঁধে দেওয়া ঠালি কেটে ফেলে? তোর বদলে তো একটা শিলনোড়া জন্ম দিলেও ভাল করতাম রে! ওর মা কাঁদতে কাঁদতে ঠালিটা তুলে নেয়।
তার কান্না শুনে আর পন্নুথায়ীকে গালিগালাজ করতে শুনে কিছু মহিলারা ভিড় জমিয়েছিল। পন্নুথায়ীর কিছুই এসে যায়নি। ও উলটে ওর মাকে ধমক দেয়— মা, তুমি কি কান্নাকাটি বন্ধ করবে? এমন কি হল যে তুমি কেঁদে সারা পাড়া জড়ো করলে? আমি শহরে গিয়েই চলে আসব। তুমি বাঁধের পাশ থেকে ছাগলটার জন্য একটু কচিপাতা নিয়ে এসো, আহা রে বেচারা, কতক্ষণ খায়নি! পন্নুথায়ী সোনার ঠালিটা মাটি থেকে তুলে শাড়ির ভাঁজে গুঁজে নেয়, তারপর একটা ঝুড়ি নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে এগোয়। পরদিন সকালে সে গ্রামের মাঝখানে একটা নতুন দোকান দেয়, আর ব্যবসা শুরু করে। যে ঠালিটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে তার গলায় দশ বছর চেপে বসে ছিল সেই ঠালিটাই আজ তার ব্যবসার সমস্ত জিনিস কিনতে সহায় হল।