Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোথায় তোমার দেশ

অংশুমান দাশ

 


পরিবেশকর্মী, খাদ্য ও কৃষি-বিষয়ে দীর্ঘদিনের কর্মী

 

 

 

 

প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে ২ কোটিরও বেশি মানুষ ভিটেছাড়া হচ্ছেন। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিয়মিতভাবে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ছেন ঢাকার আত্মঘাতী বস্তিতে।

তীর বরাবর হাঁটতে থাকলে এপার বাংলার সুন্দরবনে গত কুড়ি বছরে আটবার ভিটেহীন হতে হয়েছে— এমন পরিবারও বিরল নন। এ-বছর, যখন এই লেখা লিখছি— তখনও অনেক জমিতে বীজতলা হয়নি। আমন চাষেই মাটির তলা থেকে জল তুলতে হবে। গত বছর নোনাজল ঢুকে যাওয়া ক্ষেতে এখন ভেড়ি। উপরে নোনাজল নোনামাটি, এদিকে মাটির তলায় জল নেই— বেঘর হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

তিন কোটি মানুষের জীবিকার উৎস চাড হ্রদ— প্রায় উধাও। চাড হ্রদ ছুঁয়ে আছে চারটি দেশের সীমানা— চাড, নাইজেরিয়া, নাইজার এবং ক্যামেরুন। কিন্তু তার অববাহিকা সাতটি দেশে ছড়িয়ে। অতিরিক্ত ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকে এটি প্রায় মরুভূমি হয়ে এসেছে। জীবিকা হারিয়ে যাওয়ায় পশুপালক এবং কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রবল সহিংস। তার আড়ালে হাত শক্ত হয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের। ৪০ লক্ষেরও বেশি লোক এখন শরণার্থী শিবিরে। এইসব দেশে এমনিতেই মৌলিক পরিষেবা দুর্বল, সেখানে জল শুকিয়ে যাওয়া মানে গোদের উপর বিষফোঁড়া।

হারিকেন ঝড়ে ভিটেছাড়া পোর্তোরিকার বহু পরিবার এখনও মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে। আলাস্কা এবং লুইজিয়ানার উপকূলের ছোট ছোট সম্প্রদায়কে স্থানান্তরিত করার জন্য বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা চলছে— এখনও তার সুরাহা হয়নি।

ভিটে যখন যায়, তখন কি শুধু পায়ের তলা থেকে সরে যায় মাটি? কেবল বদলে যায় ভূগোল— নাকি ভিটেহারা হলে হারিয়ে যায় ইতিহাস, মাটিকে ঘিরে কয়েক প্রজন্মের সঞ্চিত জ্ঞান ও দক্ষতা? ওই পরিবারের জীবিকার কাঠামোটাও তো যায় নড়ে। সুতরাং যত সহজে পুনর্বাসনের কথা ভাবা যায়— তত সহজে মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু কোথায় হবে পুনর্বাসন? ঝড়-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নাহয় উদ্বাস্তু বলে খাতায় নাম ওঠার সম্ভাবনা থাকে— মিললেও মিলে যেতে পারে সরকারি সান্ত্বনা। কিন্তু খরা ও সমুদ্রতল বেড়ে যাওয়ার চোরাবালিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকা মানুষদের জলবায়ু-উদ্বাস্তু বলে মেনে নেওয়ার মাপকাঠিও যে নেই! কোন পদ্ধতিতে আমরা পরিকল্পিত স্থানান্তর করব? সেই স্থানান্তর কি কেবল নিজের দেশেই হবে? যে দেশের সবটাই ধীরে ধীরে ডুবে যাবে, তার কী হবে? কোথায় উঠে আসবে সুন্দরবনের ৪৫ লক্ষ মানুষের সংসারযাপন?

ভ্রান্তিবিলাসে ভরে থাকা সভ্যতা আমাদের। সামান্য রঙিন কাগজের উপর মানুষের ছাপ মারা ছবির মিথে বিশ্বাস করতে থাকা গোটা পৃথিবী আরও অনেক অনেক ভ্রান্তিবিলাসে মজে আছে। তার মধ্যে সব থেকে বড় মিথ মানচিত্রের উপর কাটাকুটি দাগ। কাটা দাগ বরাবর কাঁটাতার। তার দুইপাশে আলাদা রঙের পোশাক পরা, কিন্তু আসলে একটাই মানুষের অসহায় আস্ফালন— যেরকম শিখিয়েছে সীমানায় ঘিরে রাখা কিছু গল্পকথার অহঙ্কার। নদী যখন ভাসায়, জল যখন মাটিকে ছেড়ে যায়, সমুদ্র যখন উঠে আসে ঘরে— তখন তারা কি আর এই কাটাকুটি দাগের মানে বোঝে? প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলি, যাদের পুরো দেশটাই তলিয়ে যাবে, তারা কীভাবে অন্য কোনও দেশে নতুন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হতে পারে তা নির্দেশ করার জন্য কোনও আইনি নজির নেই। বানিয়ে তোলা দেশের সীমানার অহঙ্কারে মগ্ন আমরা এখনও জলবায়ু-উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের বাইরে পুনর্বাসনের কথা ভাবতে পারিনি, বেঁচে থাকাটুকু ভাগ করে নেওয়ার কথা ভাবতে পারিনি— আমরা চিন্তিত ভিসা নিয়ে। ২১০০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয়ের জন্য আবেদন বাড়তে বাড়তে হয়ে যেতে পারে ৫ লক্ষ।

এই বানিয়ে তোলা মানচিত্রের মিথকে টিকিয়ে রাখতে আমরা বরং যুদ্ধ করি— মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এই মানচিত্রকে টিকিয়ে রাখার খরচ, মোট গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশনের ৬ শতাংশ। যদিও অধিকাংশ দেশ তার মিলিটারি রাখার জন্য কার্বন খরচের হিসাব দেয় না। যুদ্ধবিমানের গর্জনকে লুকিয়ে রাখে যাত্রিবাহী বিমানের হিসাবের আড়ালে, মিলিটারি বেসকে আড়াল করে সাধারণ ঘরবাড়ি বলে। একদিকে সম্পদের অসম বন্টন দেশের ভিতরের নানা শ্রেণির মধ্যে, দেশে দেশে— অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী হুঙ্কার, আরও মিলিটারি। সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকা— ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু বদলের প্রভাবে ১২০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। এঁরা কি আমাদের মানচিত্রের ফাঁক দিয়ে গলে যাবেন?