Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পরিবেশ ও পুঁজিতন্ত্র — ষষ্ঠ বর্ষ, তৃতীয় যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

একজন গৃহস্থ রবিবারের সকালে এলাকার বাজারে মাছ কিনতে গেছেন। তিনি বদভ্যাসবশত বাজারের থলে সঙ্গে আনেননি। তাই মাছ কেনার পর বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলেন— প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নেই, দাদা? বিক্রেতা হেসে উত্তর দিলেন— আছে তো! তারপর মাছটির দিকে আঙুল দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন— ওর পেটের মধ্যেই আছে।

এক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে যে মৎস্যসেবী বাঙালি-ই হতে হবে— এমন কোনও কথা নেই। বরং তারা মার্কিনি, আফ্রিকান বা বেলজিয়ানও হতে পারেন। বাজারটি পূর্বভারতের কোনও মফস্বল শহরের একটি আটপৌরে, পূতিগন্ধময় পুরবাজার হতেও পারে, আবার পশ্চিম ইউরোপের যেকোনও ছিমছাম ছোট শহরের ঝাঁ-চকচকে কোনও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও হতে পারে। অর্থাৎ যে নিতান্ত পরিহাসময় ঘটনাটির মধ্যে দিয়ে বর্তমান লেখাটি শুরু হচ্ছে, তার কোনও স্থানিক বিশেষত্ব নেই, তা বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে ঘটতে পারে। ঘটনাটি একটি বৈশ্বিক ঘটনা বা বলা ভালো, এক বৈশ্বিক দুর্ঘটনার ব্যাঙ্গাত্মক প্রকাশ, যে সুদূরপ্রসারী সঙ্কটের নাম— জলবায়ু পরিবর্তন।

একইসঙ্গে, এই কথাটিও বলা দরকার, উপরের গল্পটি যদি কোনও পাঠকের মনে প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে অনুশোচনার জন্ম দেয়, তার অবশ্যই অনুশোচনা হওয়া উচিত, কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে রাখার যে ব্যক্তিমানুষের ও ব্যক্তিসমষ্টির অভ্যাস ও ভুলত্রুটি পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর হলেও, সেগুলি সম্মিলিতভাবেও পৃথিবীকে এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের কিনারায় এনে দাঁড় করায়নি। এর প্রধান ও অনপনেয় দায় একমাত্র বৃহৎ পুঁজি ও রাষ্ট্রচালিত আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার, ফলে এই বিপুল সঙ্কটের দায়িত্ব শুধুমাত্র ব্যক্তিমানুষের অপরাধবোধের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাও একধরনের চতুর রাজনীতির অংশ৷

এতটুকু ভণিতা পার হয়ে এসে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম আবার, আরও একবার নিজেদের প্রচ্ছদকাহিনির নিশানা করতে চলেছে— দেশ ও বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন ও আসন্ন পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টিকে। সম্ভবত, এই নিয়ে চতুর্থবার ‘পরিবেশ’ আমাদের পত্রিকার আলোচনার প্রধান বিষয় হিসেবে গণ্য হল। এছাড়াও বিগত বেশ কয়েকবছর ধরেই পরিবেশ সংক্রান্ত প্রবন্ধ আমাদের প্রতিটি সংখ্যায় নিয়মিত বিভাগ ‘সবুজ স্লিপার’-এ প্রকাশ পাচ্ছে। এইভাবে নিরন্তর ফাটা রেকর্ডের মতো পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর নাছোড় ও নিরন্তর চর্চার কারণ একটিই। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বর্তমান পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কোনও সংস্কৃতিচর্চা, অথবা বৃহত্তর সমাজ বা রাজনীতি নিয়ে যেকোনও আলোচনা— আর পরিবেশকে বাদ সম্ভব নয় (প্রসঙ্গক্রমে, একটি দুর্ভাগ্যজনক তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে, বিগত কুড়ি বছরে আমাদের দেশে সংসদে যত প্রশ্ন ও বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে, সেই সমস্ত আলোচনাসমষ্টির মাত্র ০.০৩ শতাংশ ‘জলবায়ু সঙ্কট’ বিষয়ের জন্য ব্যয় করা হয়েছে।)। এই সহজ অথচ গুরুতর কথাটা আমরা বারবার, ন্যূনতম সুযোগে, নানাভাবে স্মরণ করে নিতে চাই, এবং একইসঙ্গে আমাদের প্রিয় পাঠকদেরও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

আরেকটা সহজ কথা সহজভাবে সরাসরি ঘোষণা করা সময় এসে গেছে, এমনকি ঘোষণার সময় বেশ কিছুটা অতিক্রান্ত৷ কথাটি হল— বিশ্বজোড়া এই পরিবেশ সঙ্কটের প্রধান ও একমাত্র কারণ, পুঁজি বা উদ্বৃত্ত শ্রম। পুঁজিবাদ এই চূড়ান্ত অসাম্যপীড়িত সমাজব্যবস্থায় একশ্রেণির মানুষের উদ্বৃত্ত শ্রমের ঘাড়ে চেপে দুনিয়াটাকে এমন এক উত্তুঙ্গ ভোগের পাহাড়ে ঠেলে তুলেছে, যেখান থেকে আমাদের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য। উচ্চারণটি শুচিবায়ুগ্রস্ত নীতিবাগীশের মতো শোনাতে পারে, কিন্তু আমাদের সামনে এই কথাটি বারবার উচ্চস্বরে ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। এই সত্যকে স্বীকার না করে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ সংক্রান্ত যেকোনও আলোচনা আজ আংশিক, খণ্ডিত ও অর্থহীন৷ এই পৃথিবীর সমস্ত নাগরিক চূড়ান্ত ভোগবিলাসিতার মধ্যে জীবন কাটাবে, এমন সম্পদ অবশ্যই এই গ্রহে নেই। অথচ এই পৃথিবীর সকল অধিবাসী সুস্থ, স্বচ্ছল, সম্মানজনক ও সৌহার্দপূর্ণ কৌমজীবন কাটাতে পারেন, এতখানি সম্পদ এই দুনিয়ায় অবশ্যই আছে৷ কিন্তু এই দুনিয়া এই মুহূর্তে মানুষের প্রয়োজন দ্বারা চালিত নয়, তা পুঁজিবাদের রাক্ষুসে ক্ষুধাতাড়িত অর্থাৎ মুনাফা-তাড়িত। একটি গাড়ি-প্রস্তুতকারী সংস্থার লক্ষ্য একটাই, গত বছরের গাড়ি বিক্রির পরিসংখ্যানকে বর্তমান বছরে আরও বেশি সংখ্যক গাড়ি বিক্রি করার মাধ্যমে অনেক পেছনে ফেলে দেওয়া। ব্যবসায়িক পরিভাষায়, সংস্থাটির একমাত্র বিচার্য— প্রফিট, মার্কেট শেয়ার এবং রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট, এই বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ এই মুহূর্তে কী, তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এই ব্যবহার দোষনীয় নয়, কারণ যে মুনাফাকেন্দ্রিক দর্শনে অন্যান্য গাড়িপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি চলছে, গোটা বিশ্ব চলছে, তার বিরোধিতা করে মুনাফার ইঁদুর দৌড়ে টিঁকে থাকা যাবে না, যে খেলার যা নিয়ম সেই নিয়মেই তাকে খেলতে হবে। নিয়ম-বহির্ভূত কোনও কিছু যা তার মুনাফাকে আঘাত করবে এমন কিছু নিয়ে তাই সে মাথা ঘামাবেও না, যতক্ষণ না রাষ্ট্র তাকে সে কাজে বাধ্য করছে। আর বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সে কাজে তাকে তীব্রভাবে বাধা দেবে— এমন ভাবা বাতুলতা, কারণ সংস্থাটির মুনাফায় সাদা ও কালো— নানা পথে রাষ্ট্রের অংশভাগ রয়েছে; পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও কর্পোরেট— একে অপরের শ্রেণি-সহোদর। অর্থাৎ মুনাফা, আরও বেশি মুনাফার জন্য এই পণ্যসভ্যতা এই পৃথিবীর বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের নিরন্তর ও হঠকারী ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীকেই অতি দ্রুত ছিবড়ে করে ফেলছে। পরিবর্তে প্রতিদিন উগড়ে দিচ্ছে রাশি রাশি পণ্য ও আমাদের চারিপাশে চোখ-ধাঁধানো ‘উন্নয়ন’ যা পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জীবজগৎ ও মানুষের উপর ধ্বংসাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য প্রভাব ফেলছে। এবং এই পুরো নষ্টামিটাই হচ্ছে, সমাজের উচ্চকোটির অতি ক্ষুদ্র একাংশের দায়দায়িত্বহীন ও মুনাফাখোর কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে, যার কুফল সর্বপ্রথম ভোগ করতে হচ্ছে বাকি বিপুল সংখ্যক কম সুবিধাযুক্ত অথবা সুবিধাহীন জনগোষ্ঠীকে, পক্ষান্তরে গোটা পৃথিবীকেই।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রতি বছর মানুষ-পিছু কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ যদি গড়ে দুই টনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায়, তাহলে এই পৃথিবীর বার্ষিক উষ্ণতাবৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তলায় আবদ্ধ রাখা যাবে। পৃথিবীর উষ্ণায়নের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকবে ও জলবায়ু সঙ্কট এড়ানো যাবে। অথচ সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষদের উপরদিককার অংশ গড়ে মাথাপিছু ৭০ টনেরও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন করে থাকেন। এবার এই ধনীদের মধ্যে মানুষটির নাম যদি বিল গেটস হয়, তাহলে তাঁর ক্ষেত্রে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদনের পরিমাণ ৭৫০০ টনেরও বেশি, কারণ তাঁকে সারা বছর ব্যক্তিগত বিমানে করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয়, নানা তথাকথিত জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে হয়, বক্তৃতা দিতে হয়, সেইসব বক্তৃতার মধ্যে নিশ্চয়ই জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় নানা করণীয় বিষয় নিয়ে গেটস সাহেবের মূল্যবান উপদেশাবলিও থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্র, বৃহৎ পুঁজি ও তার ঠিকাদারদের নানা ‘শুভকর্ম’-এর ফল গোটা বিশ্বের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে চোকাতে হচ্ছে, চোকাতে হবে শেষমেশ প্রাণের বিনিময়ে৷

পাশাপাশি, এই পণ্যসভ্যতা সারা পৃথিবী জুড়ে এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের জনবিস্ফোরণ ঘটাতে চায়৷ এই বিশেষ শ্রেণির পরিচয়— এরা একধরনের শিকড়হীন সমসত্ত্ব ‘সফল’ মানুষ, যার নাম কনজিউমার৷ এরা সমসত্ত্ব, কারণ গোটা বিশ্বজুড়ে একইরকম ছাঁচে-ঢালা জীবনসম্পর্কহীন শিক্ষাব্যবস্থায় ছোটবেলা থেকেই প্রায় একইরকম আত্মকেন্দ্রিকতা ও রাজনীতিহীনতার রাজনীতিতে এদের লালন করা হয়েছে, এবং বাজারের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। এরা সফল, কারণ ধ্রুপদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এদের সরাসরি যোগদান না থাকলেও, অথবা খুব কম যোগদান থাকলেও, তা থেকে প্রাপ্য মুনাফার একটা মোটা অংশে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত শ্রমে এদের পকেট ভর্তি। আর যার পকেটে উদ্বৃত্ত শ্রম উপচে পড়ছে, সে-ই তো যোগ্য ক্রেতা বা উপভোক্তা। কারণ শুধু পণ্য বানালেই তো চলবে না, উৎপন্ন পণ্য বা সেবাগুলি বিক্রি করে মুনাফা যথাসময়ে ঘরে তোলা চাই। তাই বাজারের কাছে একজন শিক্ষিত, সৎ, ও রুচিশীল কিন্তু ক্রয়ক্ষমতাহীন নাগরিকের চেয়ে একজন পোটেনশিয়াল কনজিউমারের মূল্য অনেক গুণ বেশি৷ মূলত, শাসক-পুঁজিবাদ আঁতাত, কতিপয় বহুজাতিক বিক্রেতা তথা ধনকুবের, এবং মধ্যসত্ত্বভোগী এক বিপুল সংখ্যক নাগরিক ক্রেতা— এরা সকলে মিলে এই গোটা পৃথিবীটাকে ভাগ করে নিতে চাইছে, দখল করে নিতে চাইছে এবং এই প্রক্রিয়ায় খুব দ্রুত পৃথিবীটাকেই ফুরিয়ে ফেলছে। এটাই আবিশ্ব জলবায়ু সঙ্কটের একমাত্র কারণ। আর এই উন্মত্ত দৌড়ে যাদের বিন্দুমাত্র ভাগিদারি নেই, জলবায়ু সঙ্কটের কুফল সবচেয়ে প্রথমে ভোগ করছে সেইসব প্রান্তিক ও সুবিধাহীন মানুষেরাই। প্রাচীন ঔপনিবেশিক লুটপাটের চেয়ে আরও ভয়াবহ, আরও বিধ্বংসী, আরও মহাকাব্যিক এই নতুন আগ্রাসন। সীমাহীন উৎপাদন ও ভোগ, এই পৃথিবীর কার্বন পদচ্ছাপ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে, একইসঙ্গে অনন্ত বৈষম্য ও আসন্ন ধ্বংসের দিকে আমাদের এই নীল গ্রহের নিয়তিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই চলমান বিশ্বব্যবস্থাকে অবিলম্বে থামাতে না পারলে ধ্বংসের গতিমুখ ‘রিভার্স’ করা যাবে না।

এই রূঢ় কথাগুলি আরও একবার মনে করিয়ে দিতে হাজির হয়েছে আমাদের আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনা— পরিবেশ ও পুঁজিতন্ত্র। প্রথমেই অনূদিত হয়েছে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত জর্জ মঁবিও-র এক মূল্যবান প্রবন্ধ, লেখকের অনুমতিক্রমে। উত্তর ভারতের সাম্প্রতিক দাবদাহ জলবায়ু সঙ্কটেরই ইঙ্গিত এবং এর প্রভাব কতখানি সুদূরপ্রসারী— তা নিয়ে ‘ডাউন টু আর্থ’ পত্রিকায় আলোচনা করেছেন পত্রিকা-সম্পাদক সুনীতা নারায়ণ। রইল সেই গুরুত্বপূর্ণ লেখার অনুবাদও। অন্যদিকে, অসমে ধ্বংসাত্মক বন্যার বার্ষিক আগমনের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের মর্মান্তিক ক্ষতির বর্ণনা দিয়েছেন অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরী। পরিবেশবিদ সৌম্য দত্ত বিচার করেছেন আমাদের দেশের প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্টের কার্যকারিতা৷ পরিবেশ বিষয়ক একটি বিশেষ মামলা নিয়ে লিখেছেন শুভাশিস ঘোষাল। জলবায়ু সঙ্কট সারা বিশ্বে জন্ম দিয়েছে এক নতুন প্রজাতির প্রান্তিক মানুষের, যাঁদের নাম ক্লাইমেট রিফিউজি বা জলবায়ু উদ্বাস্তু। তাঁদের কথা উঠে এসেছে অংশুমান দাশ-এর লেখায়।

পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে কক্ষচ্যুত এক বিরাট নক্ষত্র। সেই সঙ্কট নিয়ে বিশ্বের মানুষকে সচেতন করে দিতে চাইছেন মুষ্টিময় বিশেষজ্ঞ। অথচ রাষ্ট্র ও মিডিয়া সেই সঙ্কটকে প্রথমে আমল দিতে চায়নি, পরে চাপে পড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেও গোটা সঙ্কটকেই এক মুনাফাজনক ইভেন্টে পরিণত করতে চাইছে৷ সাম্প্রতিক ‘Don’t Look Up’ চলচ্চিত্রের বিষয় এটাই। ছবিটি জলবায়ু পরিবর্তন ও তার আসন্ন সঙ্কটের সামনে বহুধাবিভক্ত ও স্বার্থান্ধ বিশ্বব্যবস্থার এক সার্থক রূপক, যেখানে পুঁজি ও তার দালালেরা পৃথিবীর মানুষকে বোঝাতে চাইছে, Don’t look up, ওপরের দিকে তাকিও না। আমরা, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর জুলাই সংখ্যায় ওপরের দিকেই তাকাতে চাইছি, সকলকে তাকাতে বলছি, এমনকি চেয়ে দেখছি আমাদের নিজেদের দিকেও, কারণ আসন্ন সঙ্কটের সামনের দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সহনাগরিকদের সচেতন করে চলা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমাদের।

অন্যান্য বিভাগগুলির পাশাপাশি প্রতি সংখ্যায় শোকাবহ চিত্তে যে বিভাগটিকে আমাদের নির্মাণ করতে হয়, তা হল ‘স্মরণ’। এই সংখ্যাতেও রইল তিনজন গুণী মানুষের স্মৃতিলেখ।

সম্প্রতি চলে গেলেন বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের শেষতম প্রতিনিধি তরুণ মজুমদার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা হলেই জীবৎকালে তাঁর কাজ নিয়ে তেমন আলোচনা করেননি বাঙালি বুদ্ধিজীবীকুল। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে উঠে এল সেই প্রসঙ্গ।

ছাত্রানুরাগী শিক্ষক, বিশিষ্ট গবেষক স্যমন্তক দাসের আকস্মিক বিদায়ও তেমনই শোকাবহ। তাঁকে স্মরণ করলেন সহকর্মী আব্দুল কাফি এবং তাঁর ছাত্র গৌরব চট্টোপাধ্যায়।

অকালে চলে গেলেন কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর। অনুজ বন্ধুকে শোকে ও কবিতায় স্মরণ করলেন যশোধরা রায়চৌধুরী।

এছাড়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অন্যগদ্য, অনুবাদ সাহিত্য, অণুগল্প, ফটো ফিচার এবং ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনার মতো নিয়মিত বিভাগগুলি থাকল যথারীতি। থাকল স্টিম ইঞ্জিন, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-এর মতো বিশেষ বিভাগগুলিও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ড্রইংরুমের শান্ত নিরাপত্তায় আমাদের লেখাপত্রগুলি যদি কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিতে পারে, আপনাকে অসুরক্ষিত ও বিরক্ত বোধ করাতে পারে, সচেতন করাতে পারে ও তার সঙ্গে যদি যৎসামান্য আনন্দ দিতে পারে, তাহলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক। আপনাকে নমস্কার জানাই।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়