Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্বাধীনতার অমৃত— এক মহা উৎসব

অশোক মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী, ‘সেস্টাস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক

 

 

 

 

 

 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অমৃত স্বরূপ মহা উৎসব। ৭৫ বছর পূর্তি। নিঃসন্দেহে বিরাট ব্যাপার।

ভারতের স্বাধীনতার উপলক্ষ সামনে এলেই মনে পড়ে যায় ১৮৫৭ সালের এক বছরের দেশব্যাপী সেই মহাসংগ্রামের রক্তরাঙা ইতিহাস। তাতিয়া তোপি লক্ষ্মীবাইয়ের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের কাহিনি। প্রফুল্ল চাকি ক্ষুদিরামের কথা। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বুড়িবালামের তীরে এক অসম যুদ্ধে বাঘা যতীনের আত্মদানের গা শিউড়ে ওঠা বর্ণনা। সিরিয়ালের এপিসোডের পর এপিসোডের মতো স্মৃতিতে জেগে ওঠে সভ্য(?) ইংরেজ শাসকের জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘেরা প্রাঙ্গনে নৃশংস গণহত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতা। সেই সঙ্গে মনে পড়ে সেই থমথমে সন্ধিক্ষণে ইংরাজের দিকে তাক করা অহিংসার পূজারী মোহনদাস গান্ধির প্রস্তরকঠিন উদাসীনতা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বড়” ইংরেজ অনুসন্ধান শেষে “নাইটহুড” প্রত্যার্পণ করে সভ্যদের দেশেই সভ্যতার সঙ্কট আবিষ্কারের বিস্ময়! তারপর স্মরণ করতে থাকি কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং ঠাকুর আর আসফাক্‌উল্লার ফাঁসির দড়িকে আবাহন কাহিনি! স্মৃতির ক্যানভাসে দেখতে পাই চন্দ্রশেখর আজাদ ভগৎ সিং-দের স্বপ্নিল সংগ্রাম, সূর্য সেনের নেতৃত্বে ইংরেজ শাসনকে জানানো চুনোতি, বাঘের ডেরায় প্রীতিলতার হানা, বিনয় বাদল দীনেশের প্রত্যক্ষ বিবাদী সঙ্ঘর্ষ।

অনেকদিন পার হয়ে গেলেও স্বাধীনতার বাৎসরিকীর মুখে “আমি সুভাষ বলছি”, “দিল্লি চলো”-র সেই “কদম কদম বঢ়ায়ে জা/খুশি কি গীত গায়ে জা” নগ্‌মা-এ-জঙ্গ মনের মধ্যে গুন্‌গুন করে ওঠে। নৌসেনাদের বিদ্রোহ, রশিদ খানের শহিদি, সারা দেশে টালমাটাল অবস্থা সৃজক ঘটনাবলি মনে পড়তে থাকে। ইংল্যান্ডের লোকসভাগৃহে সোচ্চার আলোচনা শুরু হয়, “আমাদের এবার ওদেশ ছেড়ে আসতেই হবে। লজ্জাজনকভাবে জাহাজ বোঝাই হয়ে পালিয়ে আসার চাইতে মুখরক্ষাসূচক একটা চুক্তিটুক্তি করে কেটে পড়াই ভালো হবে।”

তার পরই স্মৃতির ধূসর অঞ্চলগুলি উঁকি দিতে থাকে। ১৮৭০-এর দশকে যখন স্বদেশি মেলা একই সঙ্গে হিন্দু মেলা হতে থাকে। দেড় দশক আগেকার হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত আজাদির স্বপ্ন মিলিয়ে যেতে থাকে এক ব্রাহ্মণ্য হিন্দুর কল্পিত মনুরাজ আবেগাচ্ছন্নতায়। স্বাধীনতার কিশলয় এক হিন্দু ভারতের কর্ষণে বড় হতে শুরু করে। বা আকর্ষণে। বন্দেমাতরমের ঐকদেশিক মন্ত্রের বিহ্বলতায় সে দেখে নেয় “মা কী ছিলেন” আর “মা কী হইয়াছেন”; সেই আলোকেই সে রচনা করতে বসে “মা কী হইবেন”। আসলে বা সেই তমসায়। অজ্ঞতাপ্রসূত কল্পনার আঁধারে। মাতৃকল্পনা থেকে আসে দেবীকল্পনা। তার থেকে হিন্দুয়ানির বাকি সমস্ত উপকরণ উপচার একে একে এসে যায়। দেবীভক্তদের দ্বারা দেবীভক্তদের জন্য দেবীভক্তদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তারই পরিপূরক আয়োজন। দুঃখের বিহার তার প্রতিনামে রচিত কাহিনি হয়ে এক বিয়োগান্তক মুক্তির আবাহন গীত হয়ে ওঠে এবং সংগ্রামের মডেল রূপে অনুশীলিত হয়। বঙ্গভূমি থেকে আভারত।

অন্ধকারের এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে আরও অন্ধকার ডেকে আনার। আনেও। হিন্দুর দুর্দৈব সঙ্কীর্ণতা অচিরেই মুসলমান সমাজের মধ্যেও তার প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তোলে। জাতীয় স্বতন্ত্রতার দাবিতে আন্দোলন কিছুকালের মধ্যেই হিন্দু মুসলিম স্বতন্ত্রতার প্রথমে আধেয় পরে আধার হতে শুরু করে। হিন্দু ফোরামের বর্ণচোরা ব্রাহ্মণ্যবাদ অনতিবিলম্বে দলিতের দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিলে সেও চায় আনন্দবিহার থেকে স্বাতন্ত্র্য। আর তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ আরও উগ্র শক্তির আকারে আত্মপ্রকাশ করে সমগ্র ব্রিটিশরাজ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকেই আঘাত হানতে উদ্যত হয়। ব্রিটিশ শাসনের সমস্ত অত্যাচারকে তারা সামাজিক ডারউইনবাদের অনুস্বরে, যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলে “মাৎস্যন্যায়” হিসাবে সমর্থন করতে থাকে। এক সদাশিব মহোদয় হাস্য সহকারে ১৯৪৩-এর মহাদুর্ভিক্ষে ইংল্যান্ডেশ্বরীর পক্ষ নিয়ে বলেন, কাঁদো কেন বাঙালি? বড় মাছ যেমন ছোট মাছ খায়, শক্তিমান ইংরেজও তেমনই তোমাকে শক্তিহীন পেয়ে খেয়ে ফেলছে। এটাই তো বিজ্ঞানের নিয়ম! তার চেয়ে এসো, মুসলিম তাড়াই। ইউরোপের দিকে চেয়ে দেখো। ইতালি জার্মানিকে দেখো। ওরা কী সুন্দর করে ইহুদিদের তাড়াচ্ছে আর মারছে। হিটলার আর মুসোলিনি— আগামী দিনে এঁরাই আমাদের মডেল হবেন!!

দেশের ও দশের দুর্ভাগ্য, আজ সেই বৃহৎ মৎস্যপন্থীদের বংশধররাই দিল্লির মসনদে বসে জাতীয় পতাকাকে পর্যন্ত আম্বানির থলের কাছে বন্ধক রেখে স্বাধীনতার ৭৫তম জয়ন্তী পালনে দেশের নাগরিকদের আহ্বান করছে! আম্বানির পলিয়েস্টার মিলে তৈরি পতাকা বিক্রিতে জিএসটি মুক্ত করে দিয়ে। “মা শেষ পর্যন্ত এমন হইলেন? তার পরনের শোভিত বস্ত্রখণ্ডখানিও বাজারের পণ্য মতে বিক্রি হইয়া গেল??”

 

হবে নাই বা কেন?

এমনিতেই দেশজননীকে এখন মুখ লুকিয়ে চলতে হয়। ক্ষুধার সূচকে এই দেশ গত দুই দশকে ক্রমনিম্নাভিমুখী। আপাতত চিরক্ষুৎপীড়িত আফ্রিকার নাইজেরিয়ার নিচে স্থান জুটেছে। নারীসুরক্ষাহীনতায়, ধর্ষণে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণে, দুর্নীতিতে এই দেশ এখন উপযুক্ত হাতে পড়ে গ্যালিলেয়ান অবাধ পতনের আস্বাদন পাচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, জাতীয় ব্যাঙ্ক থেকে গত সাত বছর ধরে লুঠতরাজ চোরাকারবারে প্রতি দিন গড়ে ১০০,০০,০০,০০০ টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। সরকারেশ্বরের প্রচ্ছন্ন অনুমোদন না থাকলে যা কার্যত অসম্ভব। জিডিপি এখন স্বনামে কেবলই পতনোন্মুখ আর gross development of prices হয়ে দ্রুত ঊর্ধ্বগমনশীল। টাকাও আর কিছুদিনের মধ্যে ডলারকে ছেড়ে সেন্টকে দোস্ত বানিয়ে ফেলবে।

 

অমৃত মহোৎসবই বটে!

স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ন্যায়, ন্যায়বিচারের অধিকার, জমি জল জঙ্গলের অধিকার, বর্ণবৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক শাসন, আর সামান্য কিছু নাগরিক সম্মানের দাবি আর প্রত্যাশায় যারা গত দেড়শো বছর ধরে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন, জান কুরবানি দিয়েছেন, কারান্তরালে অত্যাচার সহ্য করেছেন, সাভারকরীয় মুচলেকা দিয়ে প্রাণ ও মুক্তি ভিক্ষার কথা যারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাঁদের কথা ভেবে, ক্ষুদিরাম ভগৎ সিং থেকে স্ট্যান স্বামী পর্যন্ত সংগ্রামী মানুষদের কথা স্মরণ করেই হয়ত ১৫ আগস্ট এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অমৃত তবু খানিক পান করা সম্ভব হবে।