Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সাধারণ, অ-সাধারণ

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 



চলচ্চিত্রবেত্তা, শিক্ষক, গদ্যকার, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার

 

 

 

 

স্বাধীনতার এই ‘প্ল্যাটিনাম’ জয়ন্তীতে পৌঁছে আমার মনে হয় যে ‘সাধারণ মানুষ’ কথাটা তার অর্থ হারিয়েছে৷ এই ‘সাধারণ’ মানুষ কারা? একসময় যুধিষ্ঠির বকরূপী ধর্মকে বলেছিলেন— যাদের কোনও ঋণ থাকে না এবং যারা শাকান্ন খেয়ে দিনাবসান ঘোষণা করে, তারাই সুখী। আমরা বুঝতে পারি, এই অতি সামান্যে সন্তুষ্ট, নিরুপদ্রব, সুখী জনগণই আসলে আবহমান কাল ধরে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। আজকের ভারতবর্ষে অবশ্য যুধিষ্ঠিরের মতো কোনও মানুষ স্বীকৃত নাগরিক হবেন না। তাই তাঁর মতেরও কোনও মূল্য নেই। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আজ আমাদের পকেটে একটি ক্রেডিট কার্ড আমাদের দেশের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার চেয়ে অনেক বেশি দামি ও গুরুত্বপূর্ণ। এই কথা আজ এতটাই সত্য যে এ নিয়ে আর তর্কেরও কোনও অবকাশ নেই। আমরা যারা নিজেদের অতি সাধারণ ভেবেছি, আমরা যারা চিরকাল ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে, আমরা যারা গ্রন্থকে বিশ্বাস করে পড়ে গেছি, জীবনের যৌন একাগ্রতা হারাইনি, যারা বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসের পাদানিতে কিংবা ডেলিপ্যাসেঞ্জার হয়ে ভেন্ডার কামরায় ঠাসাঠাসি করে প্রতিদিন যাতায়াত করেছি, সেইসব সাধারণ মানুষেরা আজ কোথায়?

 

লেনিনের একটি রচনায় ছিল, সম্রাজ্ঞী প্রসূতিসদন সফরে এলে অবিবাহিতা মায়েদের সরিয়ে দেওয়া হয়, কেননা কুমারী মাতৃত্ব মহীয়সীকে আঘাত করতে পারে। যেমন দিল্লিতে বিদেশি অতিথিরা এলে পথপার্শ্বে যে বসতি বা ঝুপড়িগুলো থাকত, তা রঙিন তেরপল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হত, যাতে বিদেশে আমাদের দেশের দারিদ্র্য প্রকাশিত না হয়। তবু সে সময় ‘দারিদ্র্য’ কথাটার একটা সম্মান ছিল, সাধারণের একটা সম্মান ছিল। লোকে আদর করে শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ পড়ত এবং অভাগীর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। লোকে ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরার কথা ভাবত। তাঁরা যদিও আমাদের পাড়ার থেকে অনেক দূরে থাকতেন, সে পাড়ায় যাওয়ার আমাদের সাধ্য ছিল না, তবুও আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মাঝে মাঝে এঁদের কথা বলতেন এবং নেহেরু বক্তৃতা দিলে, আর কে লক্ষ্মণ নামক কোনও কার্টুনিস্ট-এর দৌলতে আমরা দর্শকের ভিড়ে একজন অর্ধ-উলঙ্গ ভিখিরিকে দেখতে পেতাম। আজ সেরকম কার্টুন আঁকার কোনও সুযোগ নেই। সারা দেশ কার্টুনে পরিণত হয়েছে। অথবা কার্টুন আঁকলে বা কার্টুন ফরোয়ার্ড করলেও আজকাল দণ্ডাজ্ঞার ছায়া ঝোলে আমাদের মাথার ওপরে। এই অবস্থায় আমরা দণ্ডিত হয়ে জীবনের শোভা দেখে যাই আর মহাপুরুষের উক্তি কোলাহল করে।

 

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আরেকটি নতুন সমস্যা এসে জুটেছে। আমরা যারা অনামী মানুষ, আমরা যারা ভূতলবাসী হয়ে থাকতে পারতাম, নিজেদের অতি সাধারণ মনে করে লুকিয়ে পড়ার যে অবকাশ আমাদের ছিল, ঝুপড়িতে, মফস্বলের ভাড়াবাড়িতে, বা গ্রামে কোনও এক ক্ষেতের প্রান্তে, সে সুযোগটাও আজ আর আমাদের নেই। আমাদের বোঝানো হয়েছে, এবং আমরা তা অনেকখানি বুঝেও গেছি, আমাদের হাতে যে এক দশমিক পাঁচ জিবি ক্ষমতা রয়েছে, এবং এই ক্ষমতাবলেই আমরা দেশের ক্ষমতাবান কেউকেটা নাগরিকদের সঙ্গে একই পটভূমিতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই ডিজিটাল অসাধারণত্ব এত ছলনাময় চৈতন্যের কথা বলে যে আমার মুহূর্তের মধ্যে মনে হয় আমি যেহেতু দেশের সকল ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের সঙ্গে, মনস্বী অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে অথবা সফল লেখকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারি, অতএব আমরা তাদের সঙ্গে এক পাটাতনে বসেই সফর করছি। আমরা যারা ছোটলোক, নিতান্ত অনামী লোক, চেকভ-এর কেরানি ছিলাম, তারাই হঠাৎ মনে করছি যে আধার কার্ড ও কয়েক গিগাবাইট তথ্য সহসা এই সমাজে আমাদের সমসত্ত্বায়ন ঘটিয়েছে, গৌরবান্বিত করেছে। কিন্তু তা এক অলীক ভ্রম মাত্র। বস্তুত, তথ্যস্ফীতি ও বিত্তস্ফীতির মধ্যে যে অলঙ্ঘ্য  দেওয়াল রয়েছে, সেই দেওয়ালটাকে এমনভাবে আবছা করে দেওয়া হয়েছে, যে আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষদের, একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে আমাদের কিছু অসাধারণ ক্ষমতা আছে যার বলে আমরা নিজেদের মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে সত্যি সত্যিই প্রশাসন বা পরিবেশ বা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারি। কিন্তু আমরা যে কেউ-ই নই, আমরা যে এলেবেলে, আমরা যে আজীবন র‍্যামপার্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলছি, এই বোধটাই আমাদের থেকে সুকৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তথাকথিত ডিজিটাল বিপ্লবের সৌজন্যে। তার আগে অবধি আমরা অন্তত জানতাম, নেহেরু বা ইন্দিরা গান্ধি সংসদে বাজেট পেশ করবেন আর আমরা সিনেমা হলে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়তে পারব। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির নায়ক সিদ্ধার্থ ঠিক সেরকমই করেছিল। কিন্তু আজকে আর আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার অবকাশটুকু নেই। আজকে আমাদের করতলে আমলকীবৎ যে যন্ত্রটি উপস্থিত হয়েছে, তার সৌজন্যে আমাদের নিত্য জাগরণ, যার দ্বারা প্রতি মুহূর্তে আমাদের সতর্কতা জারি করা হচ্ছে, এবং আমরা নিয়ত সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে তাতে সাড়াও দিয়ে চলেছি।

 

এই সাধারণত্বের অবলুপ্তিই এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় বিপন্নতা বলে আমার মনে হয়। কেননা যত কথাই বলা হোক না কেন, এর পরেও তো ‘সাধারণ মানুষ’ বলে একটা কিছু থাকে, থেকেই যায়, কারণ ভারতবর্ষের ডিজিটাল ফাঁদ আর কতদূরই বা গেছে! এই একশো কুড়ি কোটি মানুষের মধ্যে কতজনের হাতেই বা মোবাইল বা ল্যাপটপ বা এই ধরনের অন্যান্য যন্ত্রপাতি আছে? ফলে যাদের হাতে সেসব নেই, তারা সেন্সাসের আওতায় থাকলেও আমাদের দৈনন্দিন বিবেচনার মধ্যে নেই। আমরা মনে করি যাঁরা মতামত দিতে পারলেন না তাঁরা অদৃশ্য কিছু ছায়ামানুষ। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয়’ গল্পের রাবেয়া বা অন্যান্য প্রায়-উলঙ্গিনীরা, যাদের পরণের কাপড় ছিল না বলেই তারা দিনের বেলা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতেন বা ঘরের মধ্যে প্রায় উলঙ্গ হয়েই থাকতেন। দেশের এইসব বিবসনা নারী ও বস্ত্রহীন পুরুষদের আজও এমন তথ্যবঞ্চিত আড়ালে আবডালে রেখে দেওয়া হয়েছে যে তাঁদের খবর আর আমরা সচরাচর পাই না। বস্তুত, ভারতবর্ষ এখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একটা তথ্যসমৃদ্ধ— ইনফরমেশন হ্যাভস, আর আরেকটা তথ্যবঞ্চিত— ইনফরমেশন হ্যাভ নটস। আমরা যদি এই ইনফরমেশন হ্যাভ নটস-দের কথা বলি, তাহলে দেখব, যাঁদের ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার নেই, যাঁদের মুখপুস্তক নেই, তাঁদের কোনও অস্তিত্বও নেই। আর তাই সেই সাধারণ মানুষের কথাও ভাবার কেউ নেই। এঁরা পরিত্যক্ত মানুষ৷ ঠিক যেমন ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ হয়, ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেই তাদের প্রয়োজন ফুরোয়, ঠিক তেমনিভাবে সামাজিক স্তরবিন্যাসে সাধারণ মানুষও আজ একটা ডিসপোজেবল মাস, ভোটদান পর্ব মিটে গেলেই তাঁদের আর কোনও দরকার থাকে না। শুধুমাত্র ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করারও নেই। অন্যদিকে, আমাদের ঘরে ঘরে এত স্বাধীনতার ডিজিটাল সেপাই! দুর্ভাগ্য যে সবাই প্রায় ডিজিটাল তালপাতার, রক্তমাংসের নয়। আমরা সাধারণ মানুষেরা তাই আজ এক সুউচ্চ প্রাচীরচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি যে প্রাচীরচিত্রটি হায়রোগ্লিফিক্সে লেখা। এইসব দুর্বোধ্য প্রতীকের অর্থ আমরা কেউ বুঝি না, বুঝতে পারবও না। তাই আকাশে সূর্যের আলো থাকুক বা না থাকুক, দণ্ডাজ্ঞার ছায়া চিরদিন ঝুলে আছে আমাদের মাথার উপরে। এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার সামনে আমরা আজীবন দাঁড়িয়ে থাকব শৃঙ্খলিত করজোড়ে।