Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রুশদি কাণ্ড: মৌলবাদ, বাক্‌স্বাধীনতা ও মেকি প্রগতিশীলতার আবর্তে

সুব্রত রায়

 



প্রাবন্ধিক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য

 

 

 

The demand to ‘respect’ religion is an attempt to push back the gains of the Enlightenment by forbidding the essential arguments that religious toleration allowed.

Nick Cohen (You Can’t Read This Book: Censorship in an Age of Freedom)

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। এ ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সলমন রুশদির চতুর্থ উপন্যাস। ততদিনে রুশদি লেখক হিসেবে ব্রিটেনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন। তাঁর লেখা ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ বুকারজয়ী হয়েছে, তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার-এর ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। সময়টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপে নবজাগরণের পর থেকে গোটা বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে সেক্যুলার আধুনিকতা পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠছিল, তাকে সহিংসভাবে প্রত্যাঘাত করার জন্য চোরাস্রোতের মতো প্রতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিও তৎপরতা শুরু করেছিল বিশ শতকের গোড়ায়, যা ইতিহাসে মৌলবাদ নামে পরিচিত; এ ছিল তার পেকে ওঠার সময়। ১৯৭৯ সালে ইরানে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থাকে হঠিয়ে ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে যার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়। মৌলবাদের এই নতুন আতসকাচের নিচে রুশদির উপন্যাস ধর্মদ্রোহী বলে গণ্য হয়, এবং ১৯৮৯ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বোচ্চ নেতা ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ খোমেইনি রুশদিকে হত্যার ফতোয়া জারি করেন।

ফতোয়ার বছরেই লন্ডনে রুশদিকে হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টা হয়। মৃত্যুভয়ে তিনি জনান্তরাল থেকে দু-দুবার ক্ষমা প্রার্থনা করে ফতোয়া তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু, তা ছিল নিষ্ফল আবেদন। সম্প্রতি, ২০২২ সালের অগস্ট মাসে, নিউইয়র্ক শহরে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চের উপরেই আচমকা হামলায় তিনি ছুরিকাহত হয়ে মারাত্মক জখম অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন। শোনা যাচ্ছে, এ যাত্রা বেঁচে গেলেও তাঁকে হারাতে হতে পারে একটি চোখ। এই ঘটনায়, রুশদি কাণ্ড আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

যাকে ঘিরে তিন-তিনটি দশক জুড়ে উত্তাল নানা ঘটনাপ্রবাহ চলছে, সেই উপন্যাসটিকে জাদু-বাস্তবতার এক উৎকৃষ্ট নমুনা বিবেচনা করে বুকার-জুরিরা পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। স্বয়ং রুশদি কাহিনিতে ধর্মকে প্রধান ফোকাস হিসেবে মানতেই অস্বীকার করেন, তাঁর মতে এটি ভিনদেশে পরিযান সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণার চিত্রায়ণ। অবশ্য, তথ্য জানাচ্ছে যে, বিতর্কিত বইটি এখনও পর্যন্ত ভারতসহ মোট ১৩টি দেশে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। ব্রিটেন ও আমেরিকায় তা বেচার দায়ে একাধিক বইয়ের দোকানে বোমা নিয়ে হামলা সংঘটিত হয়েছে, প্রকাশ্য রাস্তায় বইটি পুড়েছে একাধিকবার। প্রকাশককেও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য হিতোশি ইগারাশি খুন হয়েছেন। ইতালীয় অনুবাদকও ছুরিকাহত হয়েছেন। নরউইজীয় প্রকাশককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে মার্কিন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দশ হাজার উন্মত্ত জনতা আক্রমণ চালিয়েছে, যাতে ৬ জন মৃত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। এভাবে, রুশদি কাণ্ড কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসেই নয়, আধুনিকতা ও মুক্তচিন্তার ইতিহাসেও এক বিশিষ্ট জায়গা করে নিয়েছে।

ফতোয়া জারির পর থেকেই তা নিয়ে গোটা বিশ্ব তোলপাড় হয়ে ওঠে, কেবল সেক্যুলার মহল থেকেই নয়, মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও নির্বিচারে এই ফতোয়া সমর্থন করেননি। এটা স্বাভাবিক। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটা মানবাধিকারের এক মৌলিক প্রতিজ্ঞা, এবং এর এক ধাপ পরেই হয়তো বা আসবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ আশ্চর্যের হল এই যে, ফতোয়া সমর্থন না করলেও রুশদির রচনা নিয়ে লিবারেলদের একাংশ আপত্তি তোলেন। তাঁদের মতে, রুশদি বাক্‌স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন। এভাবে, নানান তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে, রুশদি কাণ্ড আমাদের সময়কার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এক মূর্ত প্রকাশ হিসেবে উঠে আসে। বস্তুত, বই নিষিদ্ধকরণ নতুন কিছু ঘটনা নয়। আধুনিক পৃথিবীতেও কোনও কোনও দেশ নিয়মিতভাবেই এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়। মুখে অশান্তি এড়ানোর কথা বললেও এর পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধিই মুখ্যত কাজ করে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের কথাই যদি ধরি, এ পর্যন্ত দেশে তিরিশটিরও অধিক গ্রন্থ কেন্দ্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে, রাজ্যের তালিকা স্বতন্ত্র। আদালতে মামলাও চলছে কয়েকটি বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবিকে ঘিরে। নিষিদ্ধ ফিল্মের তালিকা অবশ্য এর চেয়েও দীর্ঘ। ধর্মীয় বিষয়কে ঘিরে মতপ্রকাশ ও লেখালেখির কারণে ফতোয়া, দেশত্যাগ ও হত্যার ঘটনা গোটা বিশ্বজুড়েই উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশই বোধহয় সবচেয়ে অশান্ত। অভিজিৎ রায় সহ একাধিক ব্লগার-লেখক প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশে, তসলিমা দেশছাড়া, ভারতে খুন হয়েছেন দাভোলকর-লঙ্কেশ-কালবুর্গি-পানসারে। সরস্বতীর নগ্ন মূর্তি আঁকার দায়ে মকবুল ফিদা হোসেন ভারত থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সঙ্ঘ পরিবার এ দেশে শাসনক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্রনীতির বিপক্ষে মতপ্রকাশের জন্য একাধিক ব্যক্তিত্বকে জেলে বাস করতে হচ্ছে। পাকিস্তানের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে ১৯৬৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৩০০-রও অধিক ব্যক্তি ধর্মদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, এদের মধ্যে সিংহভাগই মুসলিম। নাস্তিকদের জেলে ভরে দেওয়া, অপহরণ ও গণপ্রহার করা সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কেবলমাত্র সোশাল মিডিয়ায় ধর্মদ্রোহী তথ্য ‘শেয়ার’ করার দায়ে পাকিস্তানে ২০২১ সালে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আদালত ৩ জন অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড ও চতুর্থ ব্যক্তিকে ১ লক্ষ টাকা জরিমানাসহ ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।

রুশদির উপন্যাস ঘিরে অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি কাহিনিতে সরাসরি নামোল্লেখ না করলেও মহম্মদ ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন, বিকৃতি ঘটিয়েছেন। এ নিয়ে রুশদির মতামত আগেই বলেছি। কিন্তু আধুনিক সমাজে আধুনিকতার স্তম্ভ হিসেবে যখন বাক্‌স্বাধীনতা ক্রমশই মূল্যবান হয়ে উঠছে, তখন লিবারেলদের একাংশ রুশদির ‘ফিকশন’-এ আপত্তিকর কী পেলেন? তাঁদের আপত্তিটা মূলত ওঠে সংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্যের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে। অর্থাৎ ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত ভাবাবেগ আহত হওয়ার প্রাচীন সেই দাবি, কিন্তু উপস্থাপিত হয় একটু অন্য কায়দায়। সাম্প্রতিককালে কর্নাটকে হিজাবকে ঘিরে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল, তাতে লিবারেলদের একাংশ যেভাবে সংস্কৃতিগত ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের যুক্তি দেখিয়ে নির্দিষ্ট পোশাকবিধি অমান্য করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, যুক্তির ধরনটা ওরকমই। আপত্তিটাকে ভাল করে বুঝতে গেলে মৌলবাদের উত্থানের সমসাময়িক কতকগুলি পরিঘটনাকে খেয়াল করা দরকার।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির মোকাবিলায় যেমন মৌলবাদের উত্থান হয়, তেমনি চিন্তাক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার বিপরীতে কতকগুলি বিকল্প তত্ত্ব উঠে আসে। তত্ত্বগুলির মধ্যে এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাপেক্ষবাদ ও উত্তরাধুনিকতা। সাংস্কৃতিক সাপেক্ষবাদে বলা হল, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন নৈতিক মানদণ্ড থাকে, যা দিয়ে কোনও সংস্কৃতির পক্ষে কোনটি ভালো ও কোনটি মন্দ তা নির্ধারিত হয়। এরকম কোনও নৈতিক মাপকাঠির অস্তিত্ব নেই, যা গোটা বিশ্বে প্রয়োগ করে সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের বিচার সম্ভব। অর্থাৎ নৈতিকতায় সর্বজনীন সত্য বলে কিছু হয় না এবং কোনও নৈতিক সত্যই সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না। সাংস্কৃতিক সাপেক্ষবাদের গোঁড়া ভাষ্য বলে যে, নৈতিকতা বা আইনের একমাত্র ভিত্তি হল গোষ্ঠীগত সংস্কৃতি। কাজেই, কোনও নৈতিকতা বা আইন কখনও সর্বজনীন হয়ে গোটা বিশ্বে প্রযুক্ত হতে পারে না। এই পথেই আরও কিছুদূর এগিয়ে, উত্তরাধুনিকতা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্বও মানতে অস্বীকার করে। বিভিন্ন তুল্যমূল্য পদ্ধতির মধ্যে ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্বে’ এগিয়ে আছে বলেই নাকি বিজ্ঞান চালকের আসনে বসে আছে, তার সত্যিকারের কোনও শ্রেষ্ঠত্বই নেই! উত্তরাধুনিকতা এভাবে বিজ্ঞানকে ‘বিশ্বাসে’ পর্যবসিত করে নৈর্ব্যক্তিক সত্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, যুক্তির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। এবং সত্যকে আপেক্ষিক বলে সাব্যস্ত করে সংস্কৃতি, লিঙ্গ, শ্রেণি, গোষ্ঠী, ধর্ম ইত্যাদির সাপেক্ষে তাকে বিচার করতে উদ্যোগী হয়। রুশদি বিতর্কে লিবারেলদের একাংশের যুক্তি প্রধানত এই দুটি মতবাদের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। একে খতিয়ে দেখা দরকার। সবিস্তার বিশ্লেষণের পরিসর যদিও এখানে নেই, তবুও যতটা পারা যায়।

লক্ষ করুন, ১৯৪৮ সালে গোটা বিশ্বের চিন্তানায়কদের ঐকমত্যের ভিত্তিকে নির্মিত মানবাধিকার সনদের বয়ানটি সাংস্কৃতিক সাপেক্ষবাদ ও উত্তরাধুনিকতার অভিঘাতে কীভাবে নড়বড়ে হয়ে উঠছে, যাতে কতকগুলি মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে বলা আছে: “Everyone is entitled to all the rights and freedoms set forth in this Declaration of any kind, such as race, colour, sex, language, religion, political or other opinion, national or social origin, property, birth or other status.” এই অধিকারগুলির মধ্যে বেঁচে থাকার অধিকার তো বটেই, বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারও স্বীকৃত। একথা অবশ্যই সত্য যে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকা ও কথা বলার অধিকারের ক্ষেত্রে সমস্ত মানবজাতির জন্য একটাই উত্তর দরকার। রুশদিকে দেওয়া মৃত্যুর ফতোয়া কিংবা রুশদির বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশ্বজনীন কোনও দৃষ্টিভঙ্গির কাছেই যেতে হবে, এখানে একটাই অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। সংস্কৃতিগত সত্যি-মিথ্যে, ঔচিত্য-অনৌচিত্যের জায়গা থেকে বিচার করলে সমাজের কোনও সংস্কার, কোনও অগ্রগতি কখনওই সম্ভব হবে না। সতীদাহ প্রথা চলবে, ‘অনার কিলিং’-ও চলবে, বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ, পর্দাপ্রথা, খৎনাপ্রথা— সব কিছুই বৈধ হয়ে যাবে। এভাবে, গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয়ভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোনও অন্যায় অযুক্তি অন্ধত্ব অবাধে চলার ছাড়পত্র অর্জিত হবে। আমরা যদি ব্যক্তিমানুষের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গোষ্ঠীগত অধিকারকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে সাব্যস্ত করি, তবে তা রক্ষণশীল ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’-এর রাস্তা সুগম করা ছাড়া আর কী-ই বা করবে? গোষ্ঠীগত অধিকারের প্রশ্ন কখনও কখনও সংখ্যালঘুদের আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে তোলে বটে, কিন্তু আসলে তা তাদের শক্তিশালী করে গড়ে তোলার বদলে দুর্বল করে তোলে। সাংস্কৃতিক সাপেক্ষবাদের জায়গা থেকে যখন আমেরিকায় বসবাসকারী কালো মানুষদের জন্য মূলধারার মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘আত্মঘাতী’ বলে ঘোষণা করা হয়, ওই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা নাকি সাদা চামড়ার মানুষদের সঙ্গে মানানসই, এবং সেইহেতু কালোদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, তা থেকে ওই গোষ্ঠীর কোনও দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা হচ্ছে কি? বরং ঠিক উলটো— তা ওই গোষ্ঠীকে দীর্ঘস্থায়ী অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার প্রকল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। উপরন্তু, গোষ্ঠীগত নৈতিক অবস্থানের প্রশ্নেও গোষ্ঠীর সীমানা নির্ধারণ এবং গোষ্ঠীর মতামত বলতে ঠিক কোন কোন ব্যক্তির মতামতকে গ্রাহ্য করা হবে সে প্রশ্নও বেশ জটিল। খোমেইনি শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা, গোটা বিশ্বের বড়জোর ১৫ শতাংশ মুসলিম এই গোষ্ঠীতে পড়বে। কাজেই, সকল মুসলিমের এই ফতোয়া সমর্থন করার কথা নয়, তা করেওনি। উপরন্তু, বিশ্বের সকল শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষও যে একে সমর্থন করেছে, তারও কোনও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। এমনকি, সকল ইরানি শিয়া মুসলিমের সমর্থনও খোমেইনি পেয়েছেন কিনা, তা বলা মুশকিল। গোষ্ঠী যত রক্ষণশীলই হোক না কেন, ব্যক্তিচেতনায় সর্বদা গোষ্ঠীচেতনা প্রতিফলিত হয় না। তবে এ ব্যাপারে কোনও সমীক্ষার রিপোর্ট আমাদের জানা নেই। সাপেক্ষতা তত্ত্বের আরেকটি বিপদ হচ্ছে এই যে, তা আধুনিকতা ও আধুনিকতার স্তম্ভ বলে প্রতীয়মান কিছু কিছু শব্দের অর্থ বদলে দিতে চাইছে। ‘সেক্যুলারিজ়ম’ শব্দটি এমনই একটি শব্দ। ভারতীয় অনুষঙ্গে এটি সহজেই বোধগম্য। নবজাগরণের মূল্যবান শিক্ষা হিসেবে যে ‘সেক্যুলারিজ়ম’ জন্ম নিয়েছিল, ভারতে তা সংবিধানে সংযুক্ত হয়ে সঠিক তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে ওঠার আগেই ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার’ নামক এক বিকৃত অর্থকে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে। ভাবুন তো, এভাবে, বিভিন্ন দেশে এক-একটি প্রামাণ্য শব্দ যদি পৃথক পৃথক অর্থ বহন করতে শুরু করে, তাহলে জ্ঞানের বিশ্বজনীনতার আর কোনও তাৎপর্য থাকে কি?

জঙ্গি মৌলবাদীদের হাতে নিহত বাংলাদেশি মুক্তচিন্তক ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, যাঁকে সে হত্যা করল তাঁর লেখাপত্র পড়ার সুযোগ তার হয়েছে কিনা। উত্তরে সে বলেছিল, কেবল নির্দেশমাফিক কাজ করা ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। খোমেইনির পুত্র বলেছেন যে, তাঁর পিতা রুশদির উপন্যাস পড়েননি। খুব সম্ভব, রুশদির ওপর ছুরি নিয়ে হামলাকারীও তা পড়েনি। সত্যিই তো, সাহিত্য সকলে পড়ে না। আর পড়লেও সাহিত্যের সমালোচনা করতে গেলে লাগে সাহিত্যতত্ত্বের জ্ঞান। ‘জাদু-বাস্তবতা’ নামক আধুনিক সাহিত্যের কেরামতি সকলের তো বোঝার কথা নয়! পড়ে কারও মন্দ লাগতেই পারে, মনে হতেই পারে যে, কঠোর-কঠিন সমালোচনা করা দরকার। কলম দিয়েই সে সমালোচনা করতে হবে। নচেৎ নীরবতাই শ্রেয়। রচনার মান যদি উঁচু না হয়, তাতে যদি কোনও সারবস্তু না থাকে, কালের নিয়মে তা এমনিই উপেক্ষিত হবে, কতকটা যা ঘটেছিল রুশদির প্রথম উপন্যাসের ক্ষেত্রে। এটাই আধুনিকতার নিয়ম। গ্যালিলিও-কে ‘ইনকুইজিশন’-এর মোকাবিলা করতে হয়েছিল, কোপারনিকাস কেবল মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কম্পিত কণ্ঠে বই ছাপার অনুমতি দিতে পেরেছিলেন বন্ধুকে। তবে কিনা, সেসব অন্ধকার যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি কবেই। আজকের আধুনিক সমাজে ফতোয়া নিতান্তই বেমানান।

ধর্মকে বাঁচানোর জন্য মৌলবাদ আধুনিকতাকে মরণ কামড় দিতে চাইবে, এটা হয়তো ততখানি অস্বাভাবিক নয়। সভ্যতার মোদ্দা গতিপথকে তা কখনওই উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে না, পথরেখায় সাময়িক বিচলন ঘটাবে মাত্র। কিন্তু অস্বাভাবিক হল প্রগতিশীলতার নাম করে নানাবিধ তত্ত্ব আউড়ে সত্যিটাকে ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটুকু। আমাদের আক্ষেপ, এ রাজ্যে তসলিমাকে আমরা আশ্রয় দিতে পারিনি, একটি বামপন্থী দল তখন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও। ওই সময়েও ভাবাবেগের দোহাই দেওয়া হয়েছিল। ভাবাবেগে আঘাতের যুক্তি দিয়ে বাক্‌স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা যায় না, যায়নি কখনও। ভাবাবেগ সকলেরই থাকতে পারে। সংবিধানগতভাবে একটি ‘সেক্যুলার’ দেশের সরকারি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে নারকেল ফাটিয়ে রকেট উৎক্ষেপণ করা হলে ওই দেশের একজন ‘সেক্যুলার’ নাগরিকের ‘সেক্যুলার’ ভাবাবেগেও আঘাত লাগে, কিন্তু তাকে সে অভিঘাত সয়ে ঠান্ডা মাথায় সুসভ্য প্রতিবাদের রাস্তায় নামতে হয় এইসব অনাচার বন্ধ করার লড়াইয়ে সামিল হওয়ার জন্য। সে লড়াই অস্ত্র হাতে নয়, সে লড়াই হবে বৌদ্ধিক হাতিয়ারে শান দিয়ে।

আপনি মানুন আর না-ই বা মানুন, পশ্চাদ্‌গামিতার সঙ্গে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব যত তীব্র হবে, ততই রুশদি কাণ্ডের মতো ঘটনা সামনে আসতে থাকবে। তাকে ঠেকানো যাবে না। বাক্‌স্বাধীনতা মানবসভ্যতার মূল্যবান অর্জন, কোনও মূল্যেই তাকে যেন আমরা না হারিয়ে ফেলি।