শৈলেন সরকার
আমার দ্বারা যে কিছু হওয়ার নয়, তা এক মা-ই জানত। বাবা বরং ভুল করে ভেবে বসত অনেক কিছু। ভাবত, পড়াশোনা করব, বড় হব, চাকরি করব। স্কুলের রেজাল্ট বের হলে লোকটা একেবারে অসুর হয়ে অপেক্ষা করত। মার্কশিট দেখামাত্রই মার শুরু করত। বলত, এতগুলি পয়সা শুধু শুধু, সারাটা বছর ধরে দু-দুটো মাস্টার, গুচ্ছের বই খাতা—। মারতে মারতে লোকটা হাঁফিয়ে পড়ত এক সময়। মা অবশ্য বাধা দিতে আসত না। মা জানত, এই মারে আমার কিছু হবে না। মা বরং বাবার জন্য ভয় পেত। রাতে বিছানায় শুয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, তোকে মারতে মারতেই না কিছু একটা হয় লোকটার। হল। তবে আমাকে মারতে মারতে নয়। আচমকাই। একেবারে বলা নেই কওয়া নেই। আগে থেকে কিছু বুঝতেই দেয়নি লোকটা। এক রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বারান্দায় বসে বিড়ি ধরাবে, হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দ। কী হল, ‘কী হল গো—’ বলে কাছে গিয়ে মা দেখে আর সাড় নেই কোনও। অন্তত মা টের পায়নি কিছু। এর পর পাশের বাড়ির তমালদা, মন্টাদা করে ডাক্তার ডেকে এনে জানা গেল, মরে গেছে লোকটা। সত্যি কথা বলতে কী, সেই একটা দিনেও আমার ভূমিকা ছিল না কোনও। মা ভুল করেও আমার নাম ধরে ডেকে ওঠেনি একবারের জন্য। এমনকী সেই রাতেই উঠোনে নামানোর পর লোকটার দেহ ঘিরে মা যখন চিৎকার করে কাঁদছে, সেখানেও কোনও নাম নেই আমার। মা একবারের জন্যও বলেনি, ‘তোমার তারণকে তুমি কার কাছে রেখে গেলে গো—।’
একমাত্র মা-ই জানত, তারণ কারও কাছে কোনও দিন ছিল না। বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন আয়োজন চলছে, যখন, ‘খাটিয়া তৈরি কর রে, ধূপকাঠি আনো রে, দা লাগবে একটা’ চলছে, আমার কথা তখনও কিন্তু কারও মাথাতেই আসেনি। একেবারের জন্যও লম্বা-চওড়া জোয়ান ছেলেটার কথা মনেই পড়েনি কারও। মনে পড়ল সেই খাটিয়া তোলার পর। আগুন দিতে হবে মুখে। ‘তারণ কোথায় রে—’, ওই একবার। ব্যস, সবাই জানে, এটাই যথেষ্ট। সবাই জানে, তারণ থাকবে। সবাই জানে, বসতে বললে তারণ বসবে, হাঁটতে বললে থামতে না বলা পর্যন্ত তারণ ঠিকই হাঁটতে থাকবে।
আর সেই আমি নাকি মার দিয়েছি মানসদাকে। মার দিয়েছি মানে মেরেছি। তাও নাকি একেবারে রক্ত বের করে দেওয়ার মতো। হ্যাঁ, মানসদার। পার্টির একেবারে দুই না তিন। এই দুই-তিনের আমি অবশ্য বুঝি না কিছু, তবে অর্থ যে আছে একটা বুঝলাম মার খেয়ে। লোকের কথা শুনে। আমার সেই মার খাওয়া নিয়ে মায়ের অবশ্য তাপ-উত্তাপ ছিল না কোনও। মা জানে, একমাত্র মা-ই জানে, এই সব মারে আমার হয় না কিছু। মানসদা ছিটকে পড়ে যাওয়ার পরপরই কে হাত লাগায়নি ভাবো। সুরজ থেকে শুরু করে। শেষমেশ মানসদা লোকটাই থামাল সবাইকে। পাশের দোকান থেকে জলের বোতল নিয়ে ততক্ষণে মুখ ধুয়ে সেই মানসদাই সামনে এসে সরে দাঁড়াতে বলল সবাইকে। পরিচয় জানতে চাইল আমার। বিমল মাস্টারের ছেলে শুনে অবাক হল খুব। বাবার কাছে নাকি পড়ত এক সময়। কে যেন বলল, হাবা আছে একটু। ‘হাবা?’ মানসদা যেন অবাক হল খুব। ভাল করে দেখল। আমাকে। আমার মুখ। বলল, খেয়ে না খেয়ে চেহারা তো বানিয়েছে একটা। এর পর পাশে দাঁড়ানো ঝন্টুদাকে জিজ্ঞেস করল, করে কী? ঝন্টুদা ডাকল গোবিন্দদাকে। মানে গোবিন্দদার দোকানেই তো চায়ের অর্ডার দিল তখন লোকটা। অর্ডার দিয়ে বাইরে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলির উদ্দেশে কী সব যেন বলল। লোকটার মার খাওয়ার কথা শুনে অনেক দূরের কারা কারা সব যেন খবর জানতে চাইছে। মোবাইল বাজছে।
মানসদাকে নরম দেখে গোবিন্দদা যেন বাঁচাবার চেষ্টা করল আমাকে। বলল, সত্যিই হাবা আছে একটু। গোবিন্দদার কথা শুনে কী ভাবল লোকটা কে জানে? ভিড় হালকা করতে বলে, গোবিন্দদার দোকানে বসতে বলল আমাকে। বলল, বিমল মাস্টারমশায়ের ছেলে হয়ে এই অবস্থা তোমার? দেখে তো হাবা মনে হচ্ছে না। মোটেই। ‘মারলে কেন?’ আমার একেবারে চোখের উপর চোখ রাখল লোকটা। এই প্রথম একটা অন্যরকম চোখ দেখলাম আমি। একেবারে অন্যরকম। একেবারে চোখের উপর চোখ রেখে লোকটা ফের জানতে চাইল, মারলে কেন? বাবার মতো চিৎকার নয়, আবার মায়ের মতো অসহায় হয়েও নয়। একেবারে ঠান্ডা, যেন আমার গায়ে ওর শব্দগুলি ধাক্কা খাওয়ামাত্র শীত লাগল আমার। যেন এক্ষুনি কাঁপতে শুরু করব আমি। আর, ‘কী হল—’, বলামাত্র কাঁপুনি শুরু হল। শরীরের প্রত্যেকটা অংশ একেবারে যেন খসে পড়তে চাইছে তখন। দোকানভর্তি লোকের সামনে, সবার হো হো করা হাসির মধ্যেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললাম। হয়তো প্যান্ট ভেজানোর জন্যই আর সেই হাসির জন্যও হতে পারে, সেই লোক শেষ পর্যন্ত উত্তরের আশা না করেই ছেড়ে আমাকে। কী অদ্ভুত প্রশ্ন ভাবুন, মারলে কেন? কেন মারলাম আবার, ইচ্ছে হল। তাই। আমার এই ইচ্ছের কথা শুধু মা-ই জানে, মা জানে, হঠাৎ হঠাৎ এমনি একটা ইচ্ছে হয় আমার, দু-কানের মাঝখানে হাওয়া যাওয়ার পথ হঠাৎ আটকে গেলেই, হ্যাঁ, মা জানে সেই জন্ম থেকেই এক কান দিয়ে হাওয়া ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে আমার। একমাত্র মা-ই সেই হাওয়ানলের খবর জানে, মা জানে, সারাদিন এক মনে আমি এই হাওয়া যাওয়ার শব্দ শুনি। মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করা। ধ্বনির মধ্যে লুকিয়ে থাকা শব্দ। শব্দ, কথা, গান। মা জানে, সারাটা দিন ধরে আমি ওই সব কথা আর গানের অর্থ করি। শুধুমাত্র আটকে গেলেই, সেই হাওয়া নল আটকে গেলেই, মা জানে, মা তখন মাথাটাকে দু-হাতে ধরে ঝাঁকিয়ে দুবার নাম ধরে ডেকেই বলে উঠবে, ‘ঠিক আছিস তো?’ মা জানে শেষ পর্যন্ত আমি ভাল হব। মা জানে, শেষ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক হয়। এবারও ঠিক হয়ে যায় সব কিছু। সেই ভিড় সরে যায়, মানসদা এমনকী নিজের মার খাওয়ার কথা ভুলে দুপুরে খাওয়ার জন্য টাকাও দিয়ে যায় কিছু। কিন্তু কাজটা যায়। মাকে একেবারে বাড়ি এসে গোবিন্দদা বলে যায়, ‘কী করে রাখি বলুন বউদি।’ গোবিন্দদার কথায় স্টেশন চত্বরে দোকান করে খেতে হবে তো আমাকে, একবার না হয় হাবা বলে—।
আমার মায়ের জানেন তো তেমন কান্নাকাটি নেই। মায়ের কোনও দুঃখ-কষ্টও নেই। মাকে আমি কাঁদতেই দেখিনি কোনওদিন। বাবার সেই মরে যাওয়ার দিনও নয়। খারাপ লাগে খুব। একবার কি তারণের নামে কিছু বলা যেত না? একবার। অন্তত চিৎকার করে বলবে না, তারণ রে, তোর বাবাকে ওরা কোথায় নিয়ে যায় রে, তারণ—। বা, তোমার তারণকে তুমি কোথায় রেখে গেলে গো। মার খাওয়ার দুদিন পরেই মা একটা লোকের কথা বলল। বলল, একটা লোকের হাতে তোকে ছেড়ে দিচ্ছি তারণ, লোকটাকে মানবি। যা বলে শুনবি। বলল, আম চোখ বুজলে অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না।
লোকটা কে বলুন তো? মানসদা। এতদিন গোবিন্দদার দোকানে গ্লাস মেজেছি, প্লেট ধুয়েছি, বেঞ্চ পরিষ্কার করেছি। খদ্দেরদের অর্ডার শুনেছি। এই প্রথম অর্ডার করতে পারলাম। পারলাম মানে, আসলে মানসদার অর্ডারই। আমার কাজ হল গিয়ে বলা। বা, বলাও না, গিয়ে শুধুমাত্র কে পাঠিয়েছে জানানো। অনেক সময় বলার বাপারটাও আমার থাকে না। আমার শুধু সঙ্গে যাওয়া। মানসদার কথায়, একটা বিশ্বাসী লোক পাওয়া খুব শক্ত রে তারণ। আমাকে নাকি দেখেই বুঝতে পেরেছে মানসদা। আমাকে বিশ্বাস করা যায়। বলল, ওই চেহারা নিয়ে চায়ের দোকানে কাজ করে কেউ?
আমার বাড়ি, বললে চিনবেন, স্টেশন থেকে নেমে বাঁ দিকে। মেন রোড বরাবর গিয়ে ফের বাঁ দিকে। কলোনি। নতুন পল্লি। সেই কোন যুগে নাকি কারখানা ছিল একটা। এরপর বাবাদের আমলে দখল। তারপর থেকে এই এখন আছি যেমন। আমাদের কলোনির নাম আছে খুব। মানসদার আন্ডারেই আমাদের পাড়ার ঝন্টু, ঝুলন, পিন্টু। ওদের নাম আছে সবার। স্টেশনচত্বর মানে স্টেশন রোডের দুপাশের সব দোকান, সব অটো, সব রিকশা—। এমনকী থানার পুলিশরাও চেনে, সবাইকে। চেনে খাতির করে। ঝন্টুর কথায়, একটা মেজাজ নিয়ে চলবি তারণ, তুই শালা মানসদার লোক মনে রাখবি। মানসদার এখন অনেক কাজ। কাজ ঝন্টু ঝুলনদেরও। নাটাগড়ের কোন লোক জমি নেওয়ার চেষ্টা করছে ঘোলার মাঠে। ভাবো একবার, কোনও যোগাযোগই নেই মানসদার সঙ্গে? বা ড্রেস হাউসের গত মাসের পয়সা জমা পড়েনি। বা, রাস্তার দুপাশের ভেঙে যাওয়া দোকানগুলির কারা কারা ফ্লাইওভারের নিচে দোকান পেতে পারে। কে কে ধরছে মানসদাকে। বা, কোন বাড়ির মেয়ে ফুসলে নিয়ে গেল কোন বাড়ির বড় ছেলে— ধরো মানসদাকে।
মা জিজ্ঞেস করে রোজ, জানতে চায়, খুব খাটনি নাকি রে তারণ? মা জানে, কোনও কথার আমি উত্তর দিই না। মা, জানে, আমি শুধু শুনে যাই। আর, কথাগুলি শেষ হওয়ার পর মাথার ভিতর খেলা করতে থাকা বাতাসের শব্দ শুনতে থাকি। শব্দ, কথা। এমনকী গানও। একেক সময় এত চেনা সুর থাকে! কবে কোথায় যেন। শুনেছি? সুর মনে করতে গিয়ে আমি শুধুই পিছিয়ে যেতে থাকি। পিছিয়ে যেতে যেতে সেই মায়ের পেটে জমে থাকা জলের মধ্যে ঢুকে পড়ে খলবল করা শব্দের মধ্যে সেই সুর খুঁজতে থাকি। সুর, শব্দ, কথা।
মা একেক দিন বিয়ের কথা তোলে। বলে, বউ আনতে হবে একটা। বউ মানে মেয়ে। একটা নাকি ঘর হবে আমার। আলাদা। রান্নাঘরের পাশে যে একফালি জায়গা, সেখানেই। টিভি আনতে হবে। খাট, আলমারি। মা নাকি ঘরের ব্যাপারে কথা বলা শুরু করেছে কার সঙ্গে। এর পর মেয়ে দেখা। ‘কিন্তু ঘর কি তুই করতে পারবি?’ নিজের মনে বলা কথাগুলি বলতে বলতে এক সময় কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে মা! আর আমি এরপর ফের মাথার মধ্যে ঢুকে পড়তে থাকা হাওয়ার সঙ্গে কথা বলতে থাকি। কথা, গান, গল্প। একটা নীল চুড়িদার উড়তে থাকে। নীল। একেবারে আকাশের রঙের মতো নীল। গোবিন্দদা, গোবিন্দদার দোকান, একটি মেয়ে। মানসদার লোকের হাতে মার খাওয়ার দিনই সেটা। নীল রঙের একটা চুড়িদার। চুড়িদারের ওড়াওড়ি। খড়খড় শব্দ হচ্ছে তখন। সেই হাওয়ানল। কান যখন সেই শব্দ শোনার জন্য মগজে হামাগুড়ি দিচ্ছে, সম্ভবত মানসদাই, হ্যাঁ, মানসদাই ধাক্কা দিয়েছিল পিঠে, আর সেই থেকেই মেয়েটি চুড়িদার হয়ে ভাসতে ভাসতে হাওয়ার সঙ্গে কানের ফুটো দিয়ে আমার মাথায় ঢুকে পড়তে থাকে। কান খাড়া করে নতুন এই হাওয়ার কথা শোনার চেষ্টা করতেই টের পাই আটকে গেছে। আটকে গেছে কোথাও। আমি জানি, আমি জানি। ‘মা–।’ আমার আচমকা লাথির ধাক্কায়। ছিটকে গড়িয়ে পড়ে গিয়েও মা চিৎকার করে ওঠে না এতটুকু। বরং, ‘কী হল, কী হল রে তারণ’— বলে উঠে দাঁড়ায়। লাইট জ্বালে। আমার মা সব জানে। মা কী করবে এ বার আমি জানি। আমরা দুজনই সেই আমার জন্মের আগে থেকেই চিনি দুজনকে। মা এবার আমার মাথাটাকে জাপটে ধরবে। দু-কানের পাশে দুটো হাত রেখে খুব জোরে ঝাঁকাবে মাথাটাকে। ডাকবে আমার নাম ধরে। তারপর আস্তে আস্তে সেই নীল চুড়িদারটাকে আমার কানের ফুটো দিয়ে বের করে আনবে। তার পর আমি জানতাম মা অবাক হবে। অবাক হয়েই জানতে চায় মা, এটা কোত্থেকে পেলি তুই? নীল চুড়িদার? আমার মাকে বিশ্বাস করুন, আমি অবাক হতে আগে দেখিইনি কোনওদিন। এই প্রথম। আর অবাক আমিও। ‘কোত্থেকে এল এটা মা? কোত্থেকে?’ মায়ের হাত থেকে চুড়িদারটা নিয়ে উলটে-পালটে দেখি ভাল করে। কেমন অদ্ভুত এক গন্ধ না? কোথায় যেন পেয়েছি আগে। কোথায় যেন? আমার ফাঁকা হওয়া মাথার ভেতর ফের ঢুকিয়ে দিই কানটাকে। ঢুকিয়ে দিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকি। পিছিয়ে পিছিয়ে সেই মায়ের পেটের খলবল-খলবল করা ধ্বনি। মায়ের মুখের দিকে আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। তবে কি মা-ই লুকিয়ে রেখেছে এতদিন ধরে? মা?
ঝন্টু একদিন হঠাৎ দেখি আমার ঘরে। ঘরে মানে, দরজার বাইরে অবশ্য। আমি তখন সবে ঘুম থেকে জেগে শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে মগজের ভিতরে হতে থাকা শব্দটাকে ধরতে চাইছি। কানের মধ্য দিয়ে যে বাতাস ঢুকছে তার সবটুকু বেরোচ্ছে কি? মা উঠেছে অনেকক্ষণ। কোথায় গেছে কে জানে? আমাদের একটি মাত্রই বিছানা। মা আর আমি। বিছানা পাতবে মা-ই। বিছানা পাতা, মশারি টাঙানো। এমনকী শীতের দিনে লেপটাও মা নিজের হাতে খুলে দেয় আমাকে। আমার শোয়ার পর মা নিজের হাতে ছড়িয়ে দেয় আমার শরীরে। মা বোঝে সব। মা বোঝে আমার সময় নেই এত।
ঝন্টুর কাছে জানতে চাইনি কিছু, চাইবও না কিছু ঝন্টু জানে, বলল, তোর মাকে খুঁজছি। ঝন্টুকে এরপরও আমি বসতে বলিনি। বসতে বললে মা-ই বলুক। আর ওর বসার ইচ্ছে থাকলে বসুক। বসুক, কিন্তু বকবক না করে। মাথার মধ্যে এখন ছোট ছোট ধাক্কায় টুকরো টুকরো বাতাস ঢুকছে। আর এই ছোট ছোট ধাক্কার জন্যই দিনভর শোনা শব্দগুলির থেকে এ শব্দ অন্যরকম। অন্যরকম তো? আমি ফের কান ঢোকাই মাথার মধ্যে।
–তোর ঘুম পায় না তারণ?
কী বলল যেন ঝন্টু? যা খুশি বলুক। আমার চোখ এখন ছাদে। আর ছাদ অন্তত অবাক হবে না দেখে। ভাববে না, ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমি ওর কথা কানে নিচ্ছি না কেন। মা আসা পর্যন্ত আমাকেও তো শুয়ে থাকতে হয়। শুয়ে থাকতে হয় মানে, মা-ই বলে রেখেছে। বলে রেখেছে, উঠবি না তারণ। মায়ের ধারণায়, বুড়ো বয়সেও বিছানায় হিসি করার রোগ আছে আমার। আছে কিনা কে জানে? মায়ের বাতিকও হতে পারে। রোজ বিছানা থেকে নামিয়ে নিজের হাতে প্যান্ট খুলে নেবে আমার, নিজের হাতে প্যান্ট পরাবে একটা নতুন করে। এর পর চাদর পাল্টাবে বিছানার। মায়ের ধারণায় বুড়োধাড়ি কোনও ছেলের পেচ্ছাবে বিচ্ছিরি গন্ধ হয় বিছানায়। বিছানায়, ঘরে। আর তাই-ই হয়তো কিছুক্ষণ বসে থেকে থেকে ঝন্টু জানতে চাইল, কেমন বিশ্রী একটা গন্ধ না? কীসের গন্ধ রে?
মা এল ঝন্টু চলে যাওয়ার পরে। বেশ অনেকক্ষণ পরে। এসে অবশ্য জিজ্ঞেস করল না কিছু। উঠতে বলল আমাকে বিছানা ছেড়ে, তারপর বিছানায় কীসের দাগ দেখে বলল, আবার, উফ। আমি নাকি ফের হিসি করেছি। এর পর আমার সোজা হয়ে দাঁড়ানো, প্যান্ট খোলা, নতুন প্যান্ট পরানো। এর পর ঘরের কোণে আমার একেবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের বিছানা পাল্টানো দেখা। মায়ের কথায় আমি নাকি বিছানা ভেজাই ভোরে। ভোরের দিকে মা যখন বিছানা ছেড়ে বাইরে যায় আমি নাকি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করি এক এক করে। কীসের? কীসের স্বপ্ন গো মা? আমার এত জানতে ইচ্ছে করে। আমি প্রাণপণে হাতড়াতে থাকি। আমার দু-কানের ফুটো দিয়ে মগজের ভিতরে তাকাতে থাকি, দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কারা, কে কে? হাওয়া ছাড়া আর কী সেখানে খেলা করে? কী?
রাতে মা ফের বিয়ের কথা তুলল। বলল, সংসার করতে হবে রে তারণ। একজন অন্তত কেউ তো থাকুক। কার হাতে তোকে রেখে যাব, কার হাতে তুই থাকলে যে নিশ্চিন্ত হব আমি? আমার অবাক লাগে খুব। কেন, তুমি তো দিয়েছ একজনকে। মানসদাকে তুমি বলোনি? তুমি তো আমাকেও বললে, মানবি লোকটাকে, যখন যা বলে। কী হল আবার? কিছু বলা অবশ্য হয়ে ওঠে না আমার। শুধু তাকিয়ে থাকি। বাইরে। জানালা, জানালার বাইরে আকাশ। আর আকাশের গায়ে নাকি আকাশের গায়ে নয়, আমার মগজের কোথাও শোঁ শোঁ শব্দ। শব্দ হতে থাকে। মা তবু কথা বলতেই থাকে। একটা বউ, ঘর আলো করা একটা ছেলে থাকলে নাকি—। আর মা যখন থাকবে না, সেই ছেলে—। মা কি তবে আর কাউকে দেবে? আর কাউকে দিয়ে দেবে আমাকে? আরও ভাল, আরও ভাল খাওয়া-পরা, নাকি আমার বউ, আমার ঘর আলো করা ছেলে। অবশ্য শুধুমাত্র মা-ই আমাকে চেনে। সেই কোন যুগ ধরে আমি আর আমার মা, মায়ের সেই পেটের মধ্যেকার খলবল করা জলে।
ঝন্টু বলল, কাজ আছে একটা। বলল, মানসদারই। খুব বড় আর দরকারি কাজ নাকি। হয় এমন, মানসদা হয়তো বলে যায় ওকেই। ঝন্টু মানসদার এক নম্বর। ঝন্টু বলল, মানসদা বাড়ি নেই আজ, আর নাকি দিনের বেলা ওর বাড়ি না গেলেও হবে। গিয়ে কাজ নেই কোনও। তবে রাতে কাজ আছে। মানসদাই বলে গেছে। বলে গেছে, তারণ ছাড়া আর কেউ না।
ঘরের কোণে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রাতের প্যান্টটাকে খুলে মা ওই যে। বারান্দায় ফেলে রেখেছে। বিছানা রোদে না দেওয়ায় ঘরময় নাকি দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে খুব। আমার হিসিতেও নাকি ঘ্রাণ আগের চেয়ে আরও কদর্য আর জঘন্য। ঝন্টু নাকি আগের দিন কী সব ওষুধের কথা বলে গেছে। আমার জন্য নয়। ঘরের জন্য। আমাকে ঘরের বাইরে বের করে সেই ওষুধ দিয়ে ঘরটাকে পরিষ্কার করে যেন। আর ঝন্টু নাকি অশান্তির হাত থেকে মুক্তি দেবে মাকে। আমার সব ঝামেলা এ বার থেকে নাকি ওর। আমার কানে অবশ্য সব কথা যায় না। এমনকী কোনও সুগন্ধ বা দুর্গন্ধও। আমি শুধু মা কখন বাইরে যেতে বলবে আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করি।
কাল রাতে ঘরে ফেরার পর মা-ই পরিষ্কার করল নলটাকে। কানের ফুটো থেকে মগজের অনেকটা পর্যন্ত ঢুকে যাওয়া নীল সেই চুড়িদার বের হল। আমি আর অবাক হলাম না একটুও। মা বরং আগের বারের মতো চুড়িদারটাকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে না দিয়ে, বিছানার উপর রাখল ভাজ করে। বিছানা মানে অবশ্য পাল্টে দেওয়া বিছানা। পাল্টানো চাদর। মা বলল, দাঁড়িয়ে থাকবি চুপ করে, আমি ততক্ষণে—। তোষকটাকে রোদে দেওয়ার জন্য মায়ের তখন বাইরে যাওয়ার কথা।
ঝন্টুর কথামতো বের হতে হল কাল রাতে। মা-ই বলল। বলল, ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতেই হবে। শুধুমাত্র ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নাকি আমার তখন বাইরে যাওয়া। রাত আমার ভালই লাগে। ভাল লাগে একা থাকাও। একা একা কান পাতো মগজে। বাইরে আকাশ, আকাশ থেকে নেমে আসা আলো। আলো আর হালকা বাতাস। আমি তখন নিজের দুটো কান ধরে, আমি তখন একা একা—। ঝন্টু অবশ্য বলে দিয়েছিল, স্কুলের নাম। স্কুল, ঘরের নম্বর, একতালা না দোতলা। গেট দিয়ে ঢুকে কোন দিকে। এমনকী স্কুলে গেটে ওই রাতে আমাকে কেউ যে দেখবে না, বলেছিল তাও। গেটের দারোয়ান নাকি কীর্তন শুনতে যাবে কোথায়। যাবে একেবারে সারা রাত্তিরের জন্য। সে যেখানে খুশি যাক। আমার কাজ কথা রাখা। আমার কাজ যে আমাকে রেখেছে তার সুবিধা অসুবিধা দেখা। আমার কাজ, মানসদার অর্ডার ঠিকঠাক জায়গামতো গেল কিনা দেখা। ঝন্টু বলল, মানসদা নাকি বারবার আমার নাম—। আমাদের সুতরাং দেরি করা যাবে না। একেবারে টাইমমতো। টাইমমতো রাত বারোটায়।
কথা ছিল, স্কুল বিল্ডিং-এ ঢুকে বাঁ দিকে। একতলাতেই। আর পাশের পাড়ার যখন যাত্রাপালা, তখন কে আসবে এখানে। কেউ নয়। মানসদা জানে, ঝন্টু জানে, জানত গোবিন্দদাও। আর মা তো জানতই। জানত, তারণ কোনও প্রশ্ন করে না। তারণকে কেউ কথা বলতেই শোনেনি। তারণ সুতরাং কথা বলবে না। স্কুলবাড়ির কোথাও কোনও লাইট নেই তখন। থাকার কথাও নেই অবশ্য। অন্ধকার স্কুলবাড়ির একতলার বাঁ দিকে এসে একটা সন্দেহই কেমন দানা বাঁধছিল। সেই ঘরটা না তো? সেই যে, এই স্কুলে একটা মাত্র বছর পড়ার ক্লাস ফাইভের দিনগুলি। দিনের পর দিন, একেবারে একা একা মগজের মধ্যে শব্দের খুঁজে খুঁজে হাতড়ে বেড়ানোর সেই দিনগুলি।
দরজা খোলামাত্রই নতুন একটা হাওয়া। নীল ওড়নার সেই ওড়াওড়ি। দেখি রোজকার ভোররাতের স্বপ্নে আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরের মতো একটা শরীর। মোমের আলোয় কেঁপে কেঁপে ওঠা। আর আরও একটা, আরও একটা শরীর। শরীর আর শরীর। তখনও আমি ঠায় দাঁড়িয়ে। ঝন্টু আমাকে আসতে বলেছে। মানসদার কথায় একমাত্র আমিই নাকি—।
মানসদা ফিসফিস করে বলে উঠল, তুই। আর বলামাত্রই মেঝের উপর পড়ে থাক নীল ওড়নাটা আমার চোখে পড়ে। শুধু আমার মা-ই জানে, শুধুমাত্র আমার মা থাকলেই—। আমার কান আটকে যেতে থাকে, আমার দু-কানজোড়া হাওয়ানল আটকে যেতে থাকে। আমার মগজ, আমার শক্ত খুলির নীচে আমার মগজ, আরেকটা কান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে বলে একটা কান দিয়ে ঢোকা বাতাস।
আমি আসলে তখন মগজের ভেতরে আটকে পড়া বাতাসটাকেই—। ডান হাত-বাঁ হাত দিয়ে একেবারে প্রাণ বাঁচানোর জন্যই। মায়ের কাছে ফিরব বলে যখন ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছি, মানসদার ন্যাংটো আর ভেজা শরীর তখন একেবারে চুপ, মেঝের উপর আছড়ে পড়া শরীরে আর সাড় নেই কোনও।
সকালে জেগে ওঠে মা ফিরে না আসা অবধি আমি যেমন শুয়ে থাকার শুয়ে থাকি। মা আসে। আমি উঠে বসি। মা নামতে বললে বিছানা ছেড়ে নামি। এর পর মা নিজের হাতেই আমার প্যান্টের বোতাম, নিজের হাতেই আমার ভেজা প্যান্ট। বিছানা না পাল্টানো পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমাকে নিয়ে সত্যিই মায়ের চিন্তা থাকে খুব। আমার ভবিষ্যৎ জীবন। মা মারা গেলে আমার খাওয়া-পরা। আমি শুধু আমার ফাঁপা মগজে ঘুরে মরতে থাকা বাতাসের আকুলি-বিকুলি অনুভব করার চেষ্টা করি।
বিছানা পাল্টে, নতুন আর একটা প্যান্ট পরাবে বলে মা ডাকে আমাকে। যেমন ডাকে অন্যদিন। যেমন বলে, আমি চোখ বুজলে—। এর পর রোজ যেমন মা আমাকে বাইরে পাঠায়। রোজ যেমন কোথায় কোথায় যাব বলে দেয়, কোন পথ দিয়ে যাব, কার কথা শুনব বলে মা যেমন বাতাসের সঙ্গে কিছু কিছু কথা মিশিয়ে দেয়, আজও সেই একই ভাবে মা ‘রাস্তা চিনিস তো, হ্যাঁ, ডান দিকে সোজা গিয়ে বাঁ দিক, এর পর—’, বলে ‘তোর মানসদা বেঁচে নেই আর, কাল রাতে— ।’ বলল, ‘আজ থেকে—।’
একমাত্র মা-ই চেনে আমাকে। শুধু মা-ই জানে আমার সব কিছু। মায়ের পেটের খলবল খলবল করা দিনগুলি থেকে, মা জানে শুধুমাত্র মায়ের বলা কথাগুলিই। একটা বাঁদিক না আসা পর্যন্ত সোজা ডানদিক বরাবরই শুধু হাঁটতে থাকি আমি।