সত্য ভাদুড়ি
প্রাবন্ধিক, নাট্য আলোচক, নাট্যপত্র 'স্যাস'-এর সম্পাদক
শম্ভু মিত্র ভারতীয় নাটকে আধুনিকতার অগ্রপথিক। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটির মাধ্যমে সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রকে যেমন এক ধাক্কায় আধুনিক ও সাবালক করে তুলেছিলেন, ভারতীয় নাট্যমঞ্চের ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্রের অবদান সমমাত্রার৷ এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে শিশিরকুমার ভাদুড়ি-র নাটক কি আধুনিক ছিল না? উত্তরে বলতে হয়, শিশিরকুমার ভাদুড়ি একজন মহান নট ও নাট্যপরিচালক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নাটক নির্বাচনে কিছু সমস্যা ছিল। কোন সময়ে কোন নাটক করা দরকার, কেন করা দরকার, এবং তা কতটা শিল্পসম্মতভাবে করতে হবে— এই সচেতনতা সর্বপ্রথম শম্ভু মিত্র তাঁর গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনাগুলির মাধ্যমে হাতেকলমে করে দেখালেন। নাট্যজীবনের প্রথমে তিনি গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তার আগে পেশাদারি মঞ্চেও কিছুদিন অভিনয় করেছেন, কিন্তু তাঁর হাতে বহুরূপী-র প্রযোজনাগুলি প্রথমবার ভারতীয় থিয়েটারে আঞ্চলিকতা ও আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন ঘটাল, থিয়েটারকে সর্বার্থে আধুনিক করে তুলল। সে আলোচনায় আমরা পরে আসব।
শম্ভু মিত্রের অভিনয়বোধ তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক গভীর ও পরিশীলিত ছিল। শম্ভু মিত্রের অভিনয় প্রসঙ্গে একটি কথা অনেকে বলে থাকেন, তা হল, তাঁর উচ্চারণ কিছুটা সানুনাসিক ছিল। কিন্তু আমরা যদি সাধারণভাবে সেই সময়ের গায়কদের দিকে তাকাই, কে এল সায়গলই হোন অথবা শচীনকত্তা, আমরা দেখতে পাব তাঁদের প্রত্যেকের উচ্চারণেই একধরনের নাকি টান ছিল। তার কারণ নাকি বা সানুনাসিক উচ্চারণে স্বরের কম্পাঙ্ক অনেকটা বেশি থাকে। তখন তো পরবর্তীকালের মতো এত আধুনিক বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মাইক ইত্যাদি শব্দগ্রাহী যন্ত্রপাতি ছিল না, ফলে অনেক শিল্পীকেই কিছুটা নাকি উচ্চারণের সাহায্য নিতে হত যাতে তাঁর গান বা সংলাপ দূরতম দর্শকের কাছে পৌঁছয়। সে যুগের এই সাধারণ প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই শম্ভু মিত্রের মধ্যেও ছিল। এমনকি তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এছাড়াও আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গেই শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারকে দিয়েছেন পেশাদারিত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা। তিনি জীবনে কোনওদিন কোনও মহড়ায় এক মিনিট দেরি করে আসেননি। নাটকের প্রতি সেই একইরকম নিষ্ঠা তিনি তাঁর সহকর্মীদের থেকেও দাবি করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চূড়ান্ত সৎ। তৎকালীন সমাজের মধ্যেকার যাবতীয় পঙ্কিলতার মধ্যেও একজন ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে যতখানি সততা প্রত্যাশা করতে পারে, শম্ভু মিত্র ছিলেন তার চেয়েও বেশি সৎ। তিনি কোনওদিন তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসের জায়গা থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি। ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা তিনি জীবনে কোনওদিন একবারের জন্য বেঁকাননি। আজীবন যা বিশ্বাস করে এসেছেন, তাই-ই করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই শম্ভু মিত্রের কথায় ও কর্মে কোনও বিচ্যুতি ছিল না৷ জীবনের ক্ষেত্রেও না, নাটকের ক্ষেত্রেও নয়। আর এই নৈতিক দৃঢ়তার জন্য নানা সময়ে, নানাজনের কাছ থেকে তাঁকে অপমানিত হতে হয়েছে। এমনকি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেও তাঁকে অনেক অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি যা বিশ্বাস করেননি, তা শত প্ররোচনাতেও মেনে নেননি। শম্ভু মিত্রের এই চারিত্রিক বলিষ্ঠতার কথা শ্রীরাম লাগু থেকে শুরু করে ইব্রাহিম আলকাজি পর্যন্ত সকলে একবাক্যে স্বীকার করেছেন। ইব্রাহিম আলকাজি একবার নান্দীকারের উৎসবে সম্বর্ধিত হন, স্বয়ং শম্ভু মিত্র তাঁর হাতে মানপত্র তুলে দেন। এই অনুষ্ঠানে আলকাজি বলেছিলেন— “থিয়েটারে কোনও সন্ত নেই। ঐশী দৃষ্টি নিয়ে কোনও মানুষ আসেন না এখানে। থিয়েটারে আসেন শুধু কিছু পরিশ্রমী, প্রয়াসী মানুষ, যাঁরা আগুনে আহূতি দিয়েছেন তাঁদের আত্মা। তারপর সেই ছাইয়ের স্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন ফিনিক্স পাখির মতো। এমনই একজন মানুষ শম্ভুদা। এঁদের মতো দুর্লভ বা বিশিষ্ট প্রজাতির কেউ নই আমি। আমি কেবল ভয় পেয়েছি, দ্বিধা করেছি, অনিশ্চিতের মধ্যে পথ হারিয়েছি। আমার অজ্ঞতা, আমার অক্ষমতার জন্য আমি লজ্জিত।” (অনুবাদ— বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ)। শ্রীরাম লাগু বলেছিলেন, “আমি যে অভিনয়টা করি, শম্ভু মিত্রকে না দেখলে আমি সে অভিনয় করতে পারতাম না।” ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে একের পর এক দিকপাল নাট্যব্যক্তিত্ব স্বীকার করে গেছেন— শম্ভু মিত্রই ভারতীয় নাট্যমঞ্চে আধুনিকতার পথিকৃৎ।
শম্ভু মিত্রের নাট্যজীবনের শুরুর দিকে ফিরে দেখতে হলে একটা জরুরি কথা মনে রাখা দরকার। শম্ভু মিত্র যখন গণনাট্য সঙ্ঘে এলেন, তা কিন্তু তখন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না। যখন গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্যোগে ‘নবান্ন’ নাটকটি প্রযোজনা হচ্ছে তখন তার পরিচয় ছিল গণনাট্য সঙ্ঘের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের নাট্যবিভাগ। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে উদারতা দেখিয়েছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশি। পরবর্তীকালে যখন বি টি রনদিভে পার্টির ভার নেন, কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে আসে, এবং ঠিক এই সময়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে পার্টির হেজিমনি তৈরি করা শুরু হয়। এই পর্বে গণনাট্য সঙ্ঘের ও শম্ভু মিত্র এবং বিজন ভট্টাচার্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘নবান্ন’। শম্ভু মিত্র বিজন ভট্টাচার্যের নাটকটির অসামান্য সম্পাদনা করেছিলেন। যদিও ‘নবান্নে’র আগে গণনাট্যের সফল প্রযোজনা ছিল ‘জবানবন্দি’ (১৯৪৪) যার অনেকগুলি শো হয়েছিল। এই নাটকের মাধ্যমেই শম্ভু মিত্রের সঙ্গে গণনাট্য সঙ্ঘের সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। ‘জবানবন্দির’-র পর ‘হোমিওপ্যাথি’, এবং হিন্দি অনুবাদে ‘অন্তিম অভিলাষ’ ইত্যাদি নাটক তৈরি হল। এরপর এল গণনাট্য সঙ্ঘের সফলতম ও জনপ্রিয়তম নাটক- ‘নবান্ন’। নবান্ন’ নাটককে ‘জবানবন্দি’ নাটকের সুযোগ্য সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে। ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর সম্ভবত প্রথম শো-টি হয়েছিল, যদিও সঠিক তারিখটি নিয়ে মতভেদ আছে। ‘নবান্ন’ নাটক বিজন ভট্টাচার্য লিখলেও তার সামগ্রিক পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্রের অবদান সবচেয়ে বেশি, সেটা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া শিল্পে যে সোশাল রিয়েলিজম বা সমাজ-বাস্তবতা আনার কথা বলেছিল, ‘নবান্ন’ ছিল তার সবচেয়ে সার্থক উদাহরণ। এই নাটকে কোনও প্রথাগত নায়ক-নায়িকা ছিল না, জনগণই এখানে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তাদের সমবেত প্রতিরোধেই নাটকের উত্তরণ।
কিন্তু এই নাটকের টানা শো হওয়ার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখনকার দিনে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ বিশেষ ছিল না বললেই চলে, অথচ ‘নবান্নে’র সার্থক মঞ্চায়নের জন্য দরকার ছিল ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। সেই কারণে ‘নবান্ন’ এত জনপ্রিয় নাটক হওয়া সত্ত্বেও তার মাত্র ২১-২২-টার বেশি শো হয়নি৷ বরং ‘নবান্নে’র থেকে ‘জবানবন্দি’-র শো অনেক বেশি হয়েছিল। ‘নবান্নে’র শো নিয়ে ‘গণনাট্য কথা’য় সজল রায়চৌধুরী লিখছেন, “প্রথম সাতটি অনুষ্ঠানের পর পেশাদার রঙ্গমহল পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত রেলওয়ে ম্যানসন ইনস্টিটিউট (নেতাজি সুভাষ), শ্রী ও কালিকা থিয়েটার হলে সাতদিন করে নবান্ন অভিনীত হয়। এছাড়া বহরমপুরে দুদিন, মহম্মদ আলি পার্কে ছাত্র যুব উৎসবে একদিন নবান্ন অভিনীত হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে, বর্ধমানের মাহরামপুরে কৃষক সম্মেলনেই ‘নবান্ন’ নাটকের শেষ অভিনয়।” সাকুল্যে এই ছিল নাটকটির প্রদর্শনীর অবস্থা। সর্বত্র ঘূর্ণায়মান মঞ্চ যেহেতু পাওয়া যাচ্ছিল না, শম্ভু মিত্র বেঁকে বসলেন। তাঁর নাটকের জন্য যা দরকার, তা না পেলে প্রোডাকশন মার খাবে, ঠিকভাবে নাটকটি করা যাবে না— এই নিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘের একাংশের সঙ্গে তার সংঘাত তৈরি হল। এছাড়াও শম্ভু মিত্র তাঁর নির্দেশিত নাটকের প্রতিটি মহড়ায় কর্মীদের ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়ার কথা বলতেন, যা কখনওই পালিত হত না। অথচ ১৯৪৬ সালে চারুপ্রকাশ ঘোষ গণনাট্য সঙ্ঘের যে অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট পেশ করেন তাতে শম্ভু মিত্র ও তাঁর সমর্থকদের সঙ্ঘের ও পার্টির পক্ষে অযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়। চারুপ্রকাশ ঘোষের মতো অমন একজন বিশিষ্ট অভিনেতা, কিন্তু সেই সময়ে তাঁর শিল্পীসত্তা কাজ করল না, সঙ্কীর্ণ পার্টিসত্তা কাজ করল। শম্ভু মিত্র কিন্তু রাজনীতি করতে গণনাট্য সঙ্ঘে আসেননি, তিনি জীবনে কোনওদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণও করেননি, তিনি শুধু ‘ভাল করে ভাল নাটক করতে’ চেয়েছিলেন। তিনি আজীবন নিজেকে একজন ‘নোটো’ বলেছেন, তিনি সারাজীবন যা কিছু শিখেছেন, যা কিছু করেছেন, সমস্তটাই শুধুমাত্র নাটককে কেন্দ্র করে। সময়ের অপচয় হবে এই ভেবে তিনি কলেজের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি, কিন্তু এমন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে তাঁর পড়াশুনো ছিল না। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন voracious reader। মাত্র ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই বাংলা ও ইংরেজি ভাষার নাটক তিনি পড়ছেন। এই সময়েই তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর খারাপ লাগছে। অনেকদিন পরে অন্নদাশঙ্কর রায় আবার তাঁকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের কাছে ফিরতে বলবেন। যাই হোক, দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা অপমানিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে গান্ধিহত্যার ঠিক সাতদিনের মাথায় শম্ভু মিত্র গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, তারও বেশ কিছুদিন পরে ৪৯ সালে নানা গোলমালের জেরে গণনাট্য সঙ্ঘ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৪৮ সালে বহুরূপী তৈরি হল। যদিও তখন দলের নাম ‘বহুরূপী’ হয়নি। প্রথমে দলের নাম ছিল ‘অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়’। অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়ের প্রথম প্রযোজনা ‘নবান্ন’-ই। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রযোজনাটি তাঁরা বাণিজ্যিক ও পেশাদারি ব্যবস্থাতেই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। এই শুরুর দিনগুলিতে শম্ভু মিত্রের বাড়িতেই ছিল নাটকের কার্যালয় ও মহড়ার জায়গা। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৫০ সালে সেখানেই এক সভায় উপস্থিত সকলে দলের নাম ‘শম্ভু মিত্রের দল’ দিতে চান (সূত্র: শম্ভু মিত্র: ১৯১৫-১৯৯৫: বিচিত্র জীবন-পরিক্রমা; শাঁওলি মিত্র)। শম্ভু মিত্র স্বভাবতই তা স্বীকার করেননি। তিনি একটি নাম প্রস্তাব করেছিলেন, ‘শিল্পায়নিক’। কিন্তু তখন মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ‘বহুরূপী’ নাম প্রস্তাব করলে তা সকলের ভাল লেগে যায়। গ্রামের বহুরূপী সম্প্রদায়ের কথা মনে রেখেই এই নামকরণ। নোটোরাও তো এক অর্থে বহুরূপী, আজ সে রাজা সাজে, আবার কালই তার পরণে ফকিরের বেশ।
বহুরূপী-র একের পর এক প্রযোজনা বাংলা তথা গোটা ভারতের নাটকে এক নতুন যুগের সূচনা করে। বহুরূপী-র নাটকগুলির মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও চর্চিত নাটক ‘রক্তকরবী’। যাঁর নাটকগুলি প্রথম জীবনে শম্ভু মিত্রের ভালো লাগেনি, সেই রবীন্দ্রনাথের নাটকেই শম্ভু মিত্র ভারতবর্ষের আত্মাকে আবিষ্কার করলেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকের কিছু সীমাবদ্ধতার জন্যেই সম্ভবত পেশাদারি মঞ্চে সে অর্থে তাঁর নাটক খুব বেশি অভিনীত হয়নি। ‘ডাকঘর’ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আর কোনও নাটক সে অর্থে সফল বা জনপ্রিয়ও হয়নি। তবে শম্ভু মিত্র করার আগেও নয়টা ‘রক্তকরবী’-র প্রযোজনা হয়েছিল, বিদেশেও প্রযোজনা হয়েছিল, কিন্তু শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’ সবদিক থেকেই এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তিনি এই নাটককে যেভাবে ইন্টারপ্রেট করেছিলেন, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার কিছুটা হলেও ফারাক আছে। শম্ভু মিত্র তাঁর নাটকে প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্য, দেশজের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মিলন ঘটালেন। ‘রক্তকরবী’ বাদ দিলে শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নাটক প্রযোজনা করলেন, সে-ও এক অসামান্য নাটক, বাংলা থিয়েটারের আরেক শীর্ষবিন্দু বলা যেতে পারে।
এখানে বলা দরকার, বহুরূপী শুরু হওয়ার পাঁচ-ছ বছর পর, ততদিনে ‘রক্তকরবী’ হয়ে গেছে, শম্ভু মিত্র আরেকবার পেশাদারি থিয়েটারে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, মির্নাভা লিজে নিয়ে সেখানে ‘ছেঁড়া তার’, ‘রক্তকরবী’, ও ‘উলুখাগড়া’ প্রযোজনা করেছিলেন, কিন্তু তা সফল হয়নি। ঠিক এই সময় শম্ভু মিত্র পাকাপাকিভাবে পেশাদারি থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ বস্তুত, বাংলায় পেশাদারিভাবে সফল থিয়েটার দীর্ঘদিন ধরে একমাত্র উৎপল দত্ত ছাড়া আর কেউ চালাতে পারেননি, যদিও বছর দশেক চালানোর পর তাঁকেও ব্যর্থ হতে হয়েছিল। সেইসময় শম্ভু মিত্রের একটা উপলব্ধি হল যে তিনি যে থিয়েটার তৈরি করার চেষ্টা করছেন, সেই থিয়েটারের দর্শক এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি, অর্থাৎ পেশাদারি থিয়েটারে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে না। ফলে ওপথে আর না।
এছাড়াও শম্ভু মিত্রের নাটকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থানবিন্দু রয়েছে। ‘নবান্ন’ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল জনগণ, সেই অবস্থান থেকে সরে এসে পরবর্তীতে শম্ভু মিত্র তাঁর প্রায় সব নাটকে ব্যক্তিকে নাটকের কেন্দ্রে রাখলেন, ক্রমশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীও হয়ে উঠল তাঁর নাটক। ঠিক যেমন হেনরিক ইবসেনের ‘দ্য এনিমি অফ দ্য পিপল’ অবলম্বনে তাঁর নাটক ‘দশচক্র’, যেখানে তিনি বলছেন— সেই মানুষই সাহসী যে একা দাঁড়িয়ে থাকে। এই ‘দশচক্র’-ই কিন্তু আট বছর বা দশ বছর পরপর শম্ভু মিত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছেন। এমনকি নিজের নির্দেশনায় তাঁর জীবনের শেষ মঞ্চাভিনয়ও ১৯৮৫ সালে পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় ‘দশচক্র’। পাঠ-অভিনয় অবশ্য এর পরেও কয়েকবার করেছেন, কিন্তু তাঁর পূর্ণ শারীরিক অভিনয়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৮৫-তে ‘দশচক্রে’ অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই। আমরা যদি গভীরভাবে দেখি, দেখতে পাব, ‘দশচক্র’-ই কিন্তু তাঁর নাট্যজীবনের মূল সুর বা সেন্ট্রাল থিম হিসেবে বারবার ঘুরে ঘুরে আসছে। সমাজ ও সংসারের যাবতীয় অন্ধকার ও পঙ্কিলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একজন একক ও সৎ মানুষের লড়াই।
‘রাজা অয়দিপাউস’-এ আমরা দেখব সত্যকে জানবার জন্য একজন মানুষকে অন্ধ হতে হচ্ছে। অথচ অয়দিপাউসকে থিবস নগরীর রাজার আসনে বসানো হয়েছিল, রানিকে বিবাহ করে সে দিব্যি সুখে-শান্তিতে তার দিন কাটাতে পারত। অথচ সত্যকে জানার আকুল তাড়নায়, যে সত্য অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অভিশপ্ত, সে তার সমস্ত কিছু হারাল। যে কোনও মূল্যে সত্যকে জানার চেষ্টা বা সত্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকার প্রয়াস শম্ভু মিত্রের নাট্যচিন্তার ও যাপনের কেন্দ্রীয় ভাবনা হয়ে রয়ে গেছে আজীবন।
তার আরও একটি প্রমাণ আমরা পাই শম্ভু মিত্রের রচিত নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’-য়। হাজার প্ররোচনা ও প্রলোভনেও চাঁদ তার শিবাই, তার সত্যকে ছেড়ে রাজি নয়, তাতে শত দুর্ভোগ বা দুর্দশা তাকে গ্রাস করুক না কেন। ‘রাজা অয়দিপাউস’ আর ‘রাজা’— এই দুটো নাটককেই ‘অন্ধকারের নাটক’ নাম দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-তেও অন্ধকারের কাছেই ফিরে গেছেন তিনি। কারণ অন্ধকারের শক্তি আলোর থেকে বেশি। অন্ধকারকে না জানলে অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। কোনও আদর্শকেও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ‘চাঁদ বণিকের পালা’ও এই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যাত্রার কথা বলে। যেমন এই নাটকে এক জায়গায় রয়েছে—
সকলে। এ ভ্রম ভাঙাও মাগো, ভাঙো অহঙ্কার।
আলোতে আবিল চক্ষু করো অন্ধকার।।সনকা। (দণ্ডি দিয়ে উঠে ব’সে)
আন্ধারে জনম মাগো পুনঃ আন্ধারে বিলয়
তবু মানুষের মনে শুধু আলোতে প্রত্যয়।।…..
প্রদীপে আন্ধার মাঠে অন্ধ করে আরো
যদিও এই চার ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ এই নাটক এখনও কেউ মঞ্চে নিয়ে আসতে পারেননি, বাংলাদেশের একটি দল অবশ্য করেছেন। এপার বাংলায় বহুরূপী-ই এই নাটক মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষমেশ পিছিয়ে আসে। অতএব এ নাটক এখনও মঞ্চে পরীক্ষিত নয় বলা যায়। কিন্তু বাংলাভাষায় এই মাপের ও এই মানের নাটক আর খুব বেশি লেখা হয়নি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নাটকটির প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন—
… এই সময়ের মধ্যেই আমরা পেয়েছি শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’। এই এক নাটক আমাদের সামনে এসে পৌঁছল আজ, যা কেবল গত ১০ বছরের নয়, গত ৫০ বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা নাটক। বস্তুত, ‘রক্তকরবী’র প্রকাশের পর, এই প্রথম আমরা পেলাম সর্বাঙ্গীন কোনও নাট্যসৃষ্টি, যা একইসঙ্গে সাময়িক এবং চিরায়ত; যথার্থ অভিনয় আর যথার্থ আস্বাদনের জন্য ‘রক্তকরবী’কে অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেকদিন। অসম্ভব নয় যে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ও তার যোগ্য মর্যাদা পাবে অনেক পরে, ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট সাময়িকের আলোড়ন পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরে। কিন্তু সেই অনেক পরে কোনও পাঠক বা দর্শক এই নাটক থেকে আমাদের এই সময়ের নিহিত অভিযান আর আর্তনাদকে নিজের সময়ের মধ্যেও ধরতে পারবে হয়তো, সমস্ত পরাভবের মধ্যেও শুনতে পাবে: ‘আমি জানি, আমার এ দেশের অন্তর মরে নাই, সে আমাদেরে ডাকে।’
–রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে tussle?; নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম খণ্ড; সম্পাদনা ও ভূমিকা: সত্য ভাদুড়ি
শম্ভু মিত্র তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি নাটকে, রূপকার্থে, মানুষের ভেতরটাকে, ভেতরের অন্ধকারটাকে খুঁজতে চেয়েছেন। ‘পুতুলখেলা’ নাটক করতে গিয়ে উনি কখনও বলছেন না যে ‘পুতুলখেলা’ শুধুমাত্র একটি নারীবাদী নাটক। আমার সঙ্গে যে ঘর করে, সে কেন আমাকে মিথ্যে কথা বলছে? আবার উল্টোদিক থেকে ভাবলে, নোরা কিন্তু মিথ্যে কথা বলেছে তার স্বামীকেই বাঁচানোর জন্যে। তাই বলে কি ‘পুতুলখেলা’য় মেয়েদের কথা উঠে আসেনি? নোরা যখন দোর বন্ধ করছে, তখন গোটা ইউরোপে মেয়েদের দরজা খুলে যাচ্ছে। অর্থাৎ নাটকের নারীবাদী মাত্রাটি মেনে নিয়েও নাটকটি গভীরতর অর্থে দুটি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের কথা বলে, সত্য ও মিথ্যের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা বলে। আর এই সবকিছুর মধ্যে থেকে একটাই কথা শম্ভু মিত্র বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, তা হল ব্যক্তি যদি সৎ না হয়, তাহলে আমরা যতই আদর্শের বুলি কপচাই না কেন, তা জলের ওপর আলপনা আঁকার মতো নিস্ফল হবে৷ মানুষ সৎ না হলে কোনও নীতি, কোনও তন্ত্র, কোনও ডিসকোর্সই উন্নততর সমাজ গড়তে পারে না। সাঁর্ত্রেও একই কথায় বিশ্বাস করতেন৷
অভিনয়জীবনের সায়াহ্নে জার্মান নির্দেশক ফ্রিৎজ বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় শম্ভু মিত্র অভিনয় করেছিলেন ব্রেখট-এর ‘গ্যালিলেও-র জীবন’ নাটকে। মুখ্য চরিত্র অর্থাৎ গ্যালিলেও-র ভূমিকায় শম্ভু মিত্রের অভিনয় নাট্যানুরাগী দর্শকদের মনে আলোড়ন তুলেছিল। ৬৫ বছর বয়সে এই নাটকে অভিনয় করতে এসে শম্ভু মিত্র শারীরিক, বাচিক ও মুখজ অভিব্যক্তির যে প্রকাশ ঘটালেন, এর তুলনা বড় একটা পাওয়া যায় না। নাটকের শেষে ইনকুইজশন-এ গ্যালিলিও পোপের কাছে ভুল স্বীকার করে নেন, কারণ তিনি জিওর্দানো ব্রুনোর মতো পুড়ে মরতে চাননি। তিনি জানতেন আজ তিনি ভুল স্বীকার করে নিলেও যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছেন, তা একদিন না একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। কিন্তু এই দৃশ্যের পরে গ্যালিলেও-রূপী শম্ভু মিত্র যখন ভগ্নহৃদয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন, গ্যালিলেওর পালিত পুত্র তথা ছাত্র ঘৃণাভরে তাঁর কাছে এসে বলত— “দুর্ভাগা সেই দেশ, যে দেশে বীরের জন্ম হয় না।” এই বলে সে গ্যালিলেওর মুখে থুথু দিত। গ্যালিলেও চুপচাপ সেই থুথু সহ্য করে নিয়ে ধীরে ধীরে বিষণ্ণ, মন্দ্রস্বরে বলেন— “দুর্ভাগা সেই দেশ, যে দেশে বীরের জন্ম হয়।” সত্যি তো, আমরা সবসময় একজন বীরের প্রত্যাশা করব কেন? আমাদের তো একটা সিস্টেম আছে, গণতন্ত্র আছে, আমরা তাতে ভোট দিই, নানাভাবে অংশগ্রহণ করি, এগুলো সব ঠিকঠাক নিজের কাজ করলে তো সমস্ত প্রত্যাশার চাপ আলাদা করে একজন বীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ একজন বীর নায়কের জন্য অপেক্ষা আসলে সমাজের বৃহত্তর অসুখের দ্যোতক। দুঃখের কথা, যা হওয়ায় কথা ছিল, তা হয়নি। সমাজ, শিক্ষা, শিল্প সংস্কৃতি, রাজনীতি, কোনও ক্ষেত্রেই হয়নি। আমরা অর্থাৎ বঙ্গবাসী তথা ভারতবাসীরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের মধ্যে শম্ভু মিত্রের মতো একজন অবিস্মরণীয় মানুষ ও নটের জন্ম হয়েছিল। একইসঙ্গে, আমরা দুর্ভাগা যে শম্ভু মিত্রের চিন্তা ও যাপন আমরা আমাদের জীবনে বা সংস্কৃতিতে ধারণ করতে পারিনি।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাগরিকা শূর