মোজাফ্ফর হোসেন
পার্কের পূর্বদিকের ঘন ঝোপকে আড়াল করে বসে আছি। বিকালের চিকন আলো হালকা আঁচ নিয়ে কপালে এসে বাড়ি খেয়ে গলে পড়ছে শরীর বেয়ে। মাঘ মাসের এই উত্তাপ বেশ স্বস্তিদায়ক। আমার এখন আরাম লাগার কথা…
অধ্যাপনার পাশাপাশি আমার আরও একটা পরিচয় আছে, চলতি সময়ের প্রভাবশালী কবিদের একজন আমি। কবিতার পাঠক-অপাঠক সবার মুখে মুখেই এখন চর্চিত হচ্ছে আমার নাম। প্রতিটা কাগজের পাতাজুড়ে আলোচনা হচ্ছে আমার কবিতার, কিংবা ব্যক্তি আমির। দেশের মানুষ রাতারাতি কবিতাপ্রেমী হয়ে উঠেছে বা আমি খুব জনপ্রিয় কবি হয়ে গেছি, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এখানে কারণটা হল— দুই দিন আগে ঢাকাগামী এক বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছি আমি। খবরের কাগজ ও টেলিভিশন-নিউজ এমনটিই বলছে।
ওই বাসে আমার ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল ঠিকই, টিকিটও কেটেছিলাম, বাসে উঠেও বসেছিলাম কিন্তু দুর্ঘটনার পূর্বেই আগের এক স্টপেজে নেমে পড়ি। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গিয়েছিল, কবিতার খাতাটা ফেলে এসেছি। কবিতার খাতা ছাড়া আমি একপাও এদিকওদিক হই না। আমাদের সময়ের অনেকে কিবোর্ড-কম্পিউটার শিখে নিয়েছে। খাতা না হলে আমার শব্দ আসে না। কবিতা হল কৃষিকাজের মতোই, জমিন ছাড়া শব্দফসল ফলে না। অন্তত আমি পারি না ফলাতে। পথেঘাটে অনেক শব্দ পড়ে থাকে, খাতাটা থাকলে কুড়িয়ে নেওয়া যায়।
আমি যখন বাস থেকে নেমে পড়ি তখন যে লোকটি আমার পাশের সিটে ছিল সেও মারা গেছে দুর্ঘটনায়। আমি বহু কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে লোকটির বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বাড়িতে শোকের মাতম। একমাত্র সাক্ষীটিও মৃত। সাক্ষী আরেকজন ছিল বটে। কবিতার খাতা নিতে যখন বাড়িতে ঢুকেছিলাম তখন পোষা কুকুরটি আমাকে দেখে। একবার ঘেউ ঘেউও করেছিল। আমি যদি তখন ভেতরে কাউকে জানিয়ে আসতাম, আমি যাইনি। ফিরে এসেছি। তাও কথা ছিল। কিন্তু তা না করে ট্রেন ধরে চলে এলাম ঢাকায়। দুর্ঘটনার ঘটনাটা তখনও আমি জানতাম না।
পরদিন দুপুরে চিন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের কবি-সম্মেলন। আমি হোটেল থেকে পোশাকটা বদলে রওনা হলাম। ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দৈনিকের হেডলাইনে বোল্ড অক্ষরে ছাপা হয়েছে— ‘ঢাকাগামী বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত কবি আফছার আজম’। টেলিভিশনেও ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে খবরটি। আমি নিজে জানতে পারলাম কবি সম্মেলনে গিয়ে। সবার মুখে আমার কথা। যেমন আমার কবিতার প্রশংসা, তেমন আমার ব্যক্তিমানসের। শত্রুদের মুখেও ফুলচন্দন পড়েছে দেখছি। নিজের এত কদর দেখে রীতিমত অভিভূত আমি। আরও অভিভূত হলাম যখন জানতে পারলাম: আজকের অনুষ্ঠানটি সদ্য অকাল প্রয়াত কবি আফছার আজম মানে আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
অর্থাৎ আমি আর দুনিয়াতে নেই! রীতিমতো আহাম্মকি ব্যাপার। জীবিত থেকে নিজের এই অন্তর্ধান কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। নিশ্চয় এসব কোনও মহল থেকে চক্রান্ত করে করা হয়েছে। এমনিতেই আমার শত্রুর অভাব নেই। আসল ঘটনাটা জানতে পেরে এত কষ্টের মাঝেও এক চোট না হেসে পারলাম না। মানলাম ঘটনার সূত্রপাত আমি নিজেই করেছি। ওইভাবে নেমে আসাটা ঠিক হয়নি আমার। আবার না নামলেও যে সত্যি সত্যিই এতক্ষণে উঠে যেতাম! ভাগ্য সহায় ছিল বলেই খাতাটা বাসায় ফেলে গিয়েছিলাম এবং দুর্ঘটনার আগে সেটা মনেও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এতগুলো লোককে একসঙ্গে সেটা কী করে বোঝাব আমি? তারপর আবার সারাদেশের মানুষ! কী মুশকিলে পড়ে গেলাম!
প্রাথমিক উদ্যোগস্বরূপ কয়েকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করি। অতি নিকটতম কয়েকজন বন্ধুর কাছে যাই আগে। ফল শূন্য। কেউ মন দিয়ে শুনল না আমার কথা। যারা খানিকটা শুনল বলে মনে হল তারা হেসে উড়িয়ে দিল।
–বাহ! আপনি ভাল মজা করতে পারেন তো! একজন বললেন।
–মানুষটা কেবল মরল। এসব মশকরা পরে করুন মশাই। কলকাতার পরিচিত এক কবি বললেন। ব্যাটা গত বছরই আমার বাসায় থেকে গেলেন, আর আজ চিনতেই পারলেন না!
সবগুলো পেপারের ফ্রন্ট পেজে গোটা গোটা অক্ষরে ছাপা হয়েছে। চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ঝুলে আছে সকাল থেকে। কিঞ্চিৎ হতাশার সঙ্গে গোটা অনুষ্ঠানজুড়ে চেষ্টা চালিয়েও কোনও ফল হলো না। এখানে মনে হচ্ছে জীবিতের চেয়ে মৃতের কদর বেশি। নিজের কদর দেখে যেমন ভাল লাগছে, তেমন জীবিত আমিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে তাতে কষ্টও কম হচ্ছে না। আশ্চর্য, পেপার আর চ্যানেল বলল আর আমি নিমেষে নেই হয়ে গেলাম! এখন উপায় কিছু একটা বের করতেই হবে। ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করি। ওইদিকে বাড়িতে কী হচ্ছে তার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। মেয়েটা নিশ্চয় কাঁদতে কাঁদতে এতক্ষণে চারপাশ ভাসিয়ে দিল! বৌটারও না জানি কেঁদে কেঁদে কী দশা! আত্মীয়স্বজন কত কাজকর্ম ফেলে ভিড় জমাচ্ছে বাড়িতে। ওখানেই আগে জানানো দরকার যে আমি বেঁচে আছি। তারপর ওরাই না হয় একে একে সবাইকে জানিয়ে দেবে।
মেয়ের নম্বরে কল করি। কেউ ধরছে না। অনেকক্ষণ পরে একজন ধরল, কান্নাকণ্ঠে, চেনার উপায় নেই, বলল, বাবার ফোন আপনার কাছে? কে আপনি? আপনার ইচ্ছে হলে ফোনটা দিয়ে যেয়েন, বলে কিছু না শুনেই রেখে দিল। আর কেউ ধরে না। আপাতত সশরীরে বাড়িতে হাজির হওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না। দুপুরের বাসে রওনা হলাম রাজশাহী অভিমুখে। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যারাত হয়ে গেল।
যা ধারণা করেছিলাম তাই হল— সমস্ত বাড়ি এখন মানুষে গিজগিজ করছে। কেউ কাঁদছে, কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে। নিজের চোখে নিজের মৃত্যুকে এভাবে দেখে যেতে পারব তা কোনও দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। পৃথিবীর কেউই ভাবে না। শুধু সামান্য একটা ভুলবোঝাবুঝির কারণে আজ এই বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্ঘটনার জন্যে কি ওই বাসটাই জুটেছিল কপালে! বুঝলাম অধিকাংশ লাশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মাথা না হয় থেঁতলে গেল, পোশাকের কি কোনও মূল্য নেই? আমার সাদা শার্ট কিংবা আমার জুতাজোড়াও কি পরিবারের কেউ চিনত না? মেয়েটা কত পালিশ করে দিয়েছে; ভুলে গেল?
এখন কি সকলকে একসঙ্গে ডেকে বলব ঘটনাটা? সেটা কি ঠিক হবে? কত দূর থেকে, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এতগুলো মানুষ বাড়িতে সমবেত হয়েছে, এত শোক, কান্নাকাটি করছে, হঠাৎ করে এদের বেঁচে আছি এই খবরটা দেওয়া কি ঠিক হবে? কত মানুষকে দেখছি যারা নিয়মিত এ বাড়িতে আসেন না। অনেক দূরের আত্মীয়ও এসেছেন, আমার বেঁচে থাকার সংবাদটা কি আদৌ কাম্য ওদের কাছে! খবরটা কি তাহলে কাল দেব? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমি মেয়েটার একেবারে টিকির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমার বামপাশে বড় বোন, ডানপাশে ছোট ভাইয়ের বউ। কেউ আমাকে চিনছে না! একবার কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না আমার দিকে। এভাবে মরাবাড়িতে একটা মানুষ ছ্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে দেখছে, চোখে কান্নার ছিটেফোঁটাও নেই— এটা দেখেও তো একবার তাকানো উচিত! মেয়েটার কান্না আমার কখনওই সহ্য হয় না। পাশে গিয়ে বসলাম। কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি মাথায় হাত দিয়ে আদর করতেই আমার বুকে এলিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল— বাবা নেই! বাবা গো! ওর কান্নায় আমি আর থির থাকতে পারলাম না। আমিও কাঁদলাম। নিজের মৃত্যুতে পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম বোধহয় কেউ কাঁদল।
সারারাত আমি সবাইকে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সান্ত্বনা দিলাম। কেউ আমাকে চিনল না! ওদেরকেই বা দোষ দিই কেমন করে— এতগুলো চ্যানেল, পেপার— একসঙ্গে সবাই তো আর মিথ্যা বলবে না! আমি একা একটা মানুষ বললেই তো আর সব মিথ্যা হয়ে যাবে না। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। এখন ছাত্রদেরকে এক জায়গায় করে যদি একটা র্যালি বের করতে পারি ‘প্রিয় আফছার স্যার মরে নাই’ এই শিরোনামে, তারপর একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারলেই কাজ ফতে। তখন সব টিভি চ্যানেল-পত্রিকা ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্যে বাপ বাপ করে দুঃখপ্রকাশ করবে। আমি চাইলে মানহানির মামলা ঠুকে কয়েক লক্ষ টাকা কামিয়ে নিতে পারি। এক্ষেত্রে কি কোর্ট কোনও মানহানির মামলা নেবে? কী জানি!
ছাত্ররা ইতোমধ্যে র্যালি বের করে ফেলেছে। শোক র্যালি। আমার সহকর্মীরা আছেন সামনের সারিতে। যে সহকর্মীর সঙ্গে কখনওই বনিবনা হয়নি তার হাতের প্ল্যাকার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা— ‘আফছার ভাই, আপনার শোকে আমি মর্মাহত!’ হাতের লেখাও তার। এই ডিপার্টমেন্টে এত বাজে লেখা আর কারও হতে পারে না। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম র্যালির সামনে। নিজের শোকর্যালির আগে আগে হাঁটছি অথচ কেউ আমাকে আমলে নিচ্ছে না।
ওরা কি তবে আমাকে হ্যালুসিনেশন ভাবছে? নিজেকেই প্রশ্ন করি। হকারের কাছ থেকে পেপার কিনি। যার মৃত্যুসংবাদে তার পেপারের কাটতি বেড়ে গেছে দ্বিগুণ তাকে সামনে পেয়েও খেয়াল করল না সে। চায়ের দোকানে বসে পেপারটা খুলি। প্রথম পাতায় লেখা হয়েছে আমার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেত্রী পৃথক পৃথক বার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিরোধীদলের নেত্রী এই দুর্ঘটনার জন্যে সরকারকে দুষতেও ভোলেননি। একটা বিশেষ পাতা ছাপা হয়েছে। ভালই লাগছে কিন্তু। প্রথমেই তরুণ বয়সের একটি ফটো। নিচে বোল্ড অক্ষরে লেখা ‘অসময়ে চলে যেতে হল কবি আফছার আজমকে।’ সত্তর বছর মৃত্যুর জন্য কম না, তবুও অকালপ্রয়াত বলছে সকলে।
এমন করে প্রচারিত খবর কোনওদিন মিথ্যে হয়েছে? নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার। একটি পেপারে এ সময়ের একজন বড় কবি আমাকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। আরও কয়েকজন কবি লিখেছেন আমার কবিতা নিয়ে। নিজেকে নিয়ে স্মৃতিকথা পড়ার সৌভাগ্য কারও হয় না। যে কারণেই হোক আমার হল। একে একে সবগুলো লেখা পড়ে শেষ করলাম। বেশিরভাগই বানিয়ে বানিয়ে লেখা। যার সঙ্গে কোনওদিনই দেখা হয়নি সেও কেমন সুন্দর করে তার সঙ্গে চা খাওয়ার গল্প ফেঁদেছে। শুধু চা খাওয়া হলে না হয় মানা যেত! আমি নাকি বলেছি, দাম্পত্যজীবনে সুখী নই! ডাহা মিথ্যা কথা। ব্যাটাকে হাতের কাছে পেলে টুঁটি চেপে ধরতাম। আমি মরে গেছি ভেবে যা-তা লিখবা তা তো হতে দেওয়া যায় না! একজন লিখেছে, আমার কবিতা বিশ্বমানের। আমার নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। অথচ মাসকতক আগেই আমি ওকে বলতে শুনেছি আমার কবিতা নাকি হয় না।
তবে এতক্ষণে মজা পেলাম অন্য একটা খবরে। কবিজীবনের প্রথম দিকে আমার একটি কবিতা ছিল ‘তোমাকে দেখি সবসময়’ এই শিরোনামে। একজন বীরের স্তুতিগাঁথা। বিরোধীদলের ধারণা কবিতাটি আমি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছি। ওদের এক কবি ওদের কাগজে লিখেছে। একইসঙ্গে সরকারি দলের এক কবি সরকারি কাগজে আমার কবিতায় রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছে যে কবিতাটি নাকি আমি তাদের নেতাকে নিয়ে লিখেছি। কবিতাটি এখন উভয় দলের রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মজা লাগছে এজন্যে যে আসলে কবিতাটি লিখেছিলাম আমাদের মহল্লার এক বৃদ্ধ নাইটগার্ডকে স্মরণ করে। চোর-বাটপারদের অসহযোগিতা করার কারণে এক মধ্যরাতে তাকে মেরে চৌরাস্তার বটগাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
পেপার পড়তে পড়তেই একটা আইডিয়া পেলাম। এছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। পাশেই ছিল বিজ্ঞাপন অফিস, ঢুকে গেলাম ভিতরে। যারা আমার মৃত্যুসংবাদ বিনে পয়সায় ফলাও করে প্রচার করেছে তাদের কাগজেই এখন না-মরার বিজ্ঞাপন দিতে চাই। বিজ্ঞাপনে আমি আমার শরীরের বর্ণনা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পিতৃপরিচয় সবকিছু বিস্তারিত উপস্থাপন করব যাতে কারও সন্দেহ না হয়। প্রয়োজন হলে সঙ্গে আধখানা ফটোও জুড়ে দেব।
পত্রিকা অফিসের ভেতরে ঢুকে দেখি বিশাল সাইজের একটা টেবিলে মাঝবয়স্ক খাটো একটা লোক বসে কিছু কাগজ নাড়াচাড়া করছেন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে টেবিলের উপর বসা একটা বাচ্চা ছেলে কাগজ নিয়ে খেলা খেলছে। সোজা লোকটির কাছে চলে গেলাম। লোকটি ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে সামনের চেয়ারটি টেনে বসি। কাগজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে মুখ খুললেন তিনি— সমস্যা বলুন। ভাবখানা এমন যেন তিনি ডাক্তার আর সামনে রোগী বসা।
–এখানে বিজ্ঞাপনের বিষয়টা কে দেখে? জানতে চাইলাম।
–আমিই। কোনও কাগজপাতি হারিয়ে গেছে নাকি?
–না।
–বলেন কিসের বিজ্ঞাপন দিতে চান?
–আমার।
–আপনার মানে কী? প্রাইভেট পড়াতে চান নাকি বিয়ের বিজ্ঞাপন? দুটোর কোনওটাই তো আপনার বয়সের সাথে যায় না!
–আমি আসলে বলতে চাই— আমি ফিরে এসেছি।
–ওহ। হারিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি? আপনার নাম কী?
–আফছার আজম।
–তা আফছার সাহেব, বিজ্ঞাপনের ভাষা কী হবে আমাকে একটু খোলাসা করে বলুন তো? ডিজাইন কি আপনি দিবেন, না আমাদের লোক করে দেবে? ওটার আবার আলাদা চার্জ আছে।
–আমি কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম।
–বুঝলেন মফিজ সাহেব, কিছুক্ষণ আগে লটকা করে যে লোকটি এসেছিল, তার আমেরিকা প্রবাসী ডিভোর্সি বোনের বিয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন দিতে চায়। ভাবছি আপনার ভাবীর নামে ‘খাঁটি বাংলাদেশি ডিভোর্সি নারীর জন্যে পাত্র চাই, যেমন তেমন পাত্র’ লিখে আমিই ওই মহিলাকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যাব। সাদা চামড়ার দেশে, বুঝলেন না? লোকটি আমার কথায় গা না করে পাশের টেবিলের ভদ্রলোকের সাথে অকাজের কথা বলা শুরু করলেন।
–ও হ্যাঁ। বিজ্ঞাপনের রেট জানেন তো? এবার আমার দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে জানতে চাইলেন। যেন বিজ্ঞাপন না, টাকাটা নেওয়ার জন্যেই তাকে রাখা হয়েছে।
–প্রয়োজন নেই। যা লাগে তাই পাবেন।
–গুড। কালার না সাদা কালো? কোন পৃষ্ঠায় দিতে চান?
–সাদা কালো হলেও চলবে। প্রথম পৃষ্ঠায় হলে ভাল হয়।
–তাও গুড। ঠিক আছে। বলুন কী লিখব?
–লিখবেন। কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে যে…!
–দাঁড়ান। একটু থামেন। বকতে বকতে গলাটা একদম গ্যাছে। এত বকতে হয় আজকাল! এই শফিক আমার টেবিলে দুইটা আদা চা লাগা তো। দেখিস পানি গরম থাকে যেনো। আদা চা চলবে তো? আমার আবার কৌটার দুধে জমে না। হা হা।
–চলবে। চিনিটা একটু কম হলে ভালো হয়। আমি বলি।
–আমাদের অফিসে চিনির বাজেট খুব কম। কম দিতে বললে আর খেতে পারবেন না। বুঝলেন না! তারপর বলুন!
–কবি ও অধ্যাপক আফছার আজম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে যে খবর দেশজুড়ে প্রচারিত হয়েছে সেটা আসলে একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।
–থামেন থামেন। কী যা-তা বকছেন আপনি! আপনি কি এটাই বিজ্ঞাপন দিতে চান নাকি?
–হ্যাঁ। আসলে ছোট একটা ভুলবোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আফছার, মানে আমি মরিনি।
–ধুর ছাই। এ খবর আমি নিতে পারব না। আফছার আজম মরেনি তার প্রমাণ কী? আপনি বললেই তো আর হল না।
–আপনি কী প্রমাণ চান বলেন? আফছার আজম নিজে এসে যদি বলে?
–সে ভিন্ন কথা।
–আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। এখন বিজ্ঞাপন নিতে কোনও সমস্যা আছে আপনার?
–দেখুন, সকাল থেকে আমার মেজাজটা এমনিতে বিগড়ে আছে। বৌ আমার বড়লোকের বেটি; বুঝলেন না! আর বিগড়ানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।
–আমি সত্যি বলছি; আমিই অধ্যাপক আফছার আজম। ওইদিন ওই বাসে ছিলাম না আমি। মানে ছিলাম ঠিকই কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ছিলাম না। কিছুদূর আগেই নেমে পড়েছিলাম।
–তো ভালো কথা, বিজ্ঞাপন দেওয়ার কী আছে? আপনি আপনার পরিবারে ফিরে যান। বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে জানিয়ে দিন সুখবরটা। আমাদেরও মিষ্টিমুখ করান। লোকটি হাসতে হাসতে বলে। বোঝা যায়, বিষয়টি সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না তিনি।
–সমস্যা তো ওখানেই। মিডিয়াতে খবরটি প্রচার হওয়ার পর থেকে কাউকে বোঝাতে পারছি না। কেউ আমার কথা শুনছে না। দেখেও না দেখার ভান করছে সকলেই। আমি ধীরকণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করি।
–মহা মুশকিল তো! দেখেন, সমস্যা যদি কিছু হয়েই থাকে আপনি পুলিশের কাছে যান। এটা নরমাল কেস বলে মনে হচ্ছে না। আমি বিজ্ঞাপন নিতে পারব না। এটা আমাদের পেপারের মান-ইজ্জতের ব্যাপার। আজ আপনি এসে বললেন আমি মরিনি। কাল আর-একজন এসে বলবে তার বাপ মরেনি। এটা তো হয় না; বুঝলেন না?
–মানে? ফাজলামো করেন আপনারা? একটা মানুষকে নিশ্চিত না হয়েই মেরে ফেললেন। এখন সেই মানুষটা পকেটের টাকা খরচ করে আপনাদের প্রচার করতে বলছে যে সে মরেনি। আর আপনারা বলছেন মান-ইজ্জতের ব্যাপার! আপনারা খবরের লোকেরাই আমাকে ডুবিয়েছেন। এখন আপনারাই আমাকে উঠাবেন।
–আপনি আসুন তো। আমার হাতে অনেক কাজ। আর আপনি সম্ভব হলে পুলিশে যাওয়ার আগে একজন মানসিক ডাক্তারের চেম্বার হয়ে যান। গন্ডগোল অন্য কোথাও মনে হচ্ছে।
আপাতত বিরক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন অফিস থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামিয়ে থানার দিকে যেতে বলি। থানায় ইন্সপেক্টর সবে ডিউটিতে এসেছেন। তিনি আমার পূর্ব-পরিচিত।
–কেমন আছেন ফিরোজ সাহেব। ইনস্পেক্টরের দিকে এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলি।
–চোর-বাটপারের সাথে আবার থাকা না থাকা! কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…!
–আমাকে চিনলেন না? আমি আফছার আজম!
–হ্যাঁ, চেনা চেনা লাগছে। দুঃখিত, কোন আফছার আজম বলেন তো?
–অধ্যাপক আফছার আজম।
–কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। আপনি কি তবে আরেক অধ্যাপক?
–না। আমিই সেই আফছার আজম।
–তার মানে বলতে চান আমি দিনেদুপুরে ভূতের সামনে বসে আছি। তাও থানায়?
–আমি আসলে মরিনি। বলি আমি।
–বুঝেছি। সম্পত্তির মামলা মনে হচ্ছে। আপনার যমজ ভাইটাই নাকি?
–আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি সত্যিই মরিনি। এটা একটা ভুলবোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু না।
–বেশ শক্ত কেস বলে মনে হচ্ছে। আপনি যে মরেননি সেটা আমাকে প্রমাণ করে দিতে হবে; এই তো?
–ঠিক তাই।
–পারি কিন্তু এক শর্তে— ভাগ ফিফটি ফিফটি। রিস্ক আপনার।
–আপনি বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছেন। আমি বোধহয় বোঝাতে পারছি না আপনাকে।
–খুব বুঝেছি। চেহারা দেখেই আপনার ভেতরে কু-মতলব আমি টের পেয়েছি। এই লাইনে চৌত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা মিয়া!
থানার ইন্সপেক্টরকে কোনওরকমে বুঝিয়ে এ যাত্রা তার হাত থেকে বেরিয়ে আসি। তিনি তো পারলে আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেন। ভাগ্যিস পকেটে বড় কয়েকটি নোট ছিল!
থানা থেকে পার্কে এসে বসি। আপাতত আর যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। মাথাতেও আর বুদ্ধি আসছে না। সমস্ত বিকালটা এখানেই কেটে যায়। খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে চারপাশ। কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না।
তবে কি আমারই ভুল হচ্ছে? এতগুলো মানুষ কেউ আমাকে চিনবে না তা কি করে হয়! নিশ্চয় কোথাও কোনও গন্ডগোল আছে। তাহলে কি আমি অন্য কেউ? তবে কি কোনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে গিয়ে খুলে বলব সব কথা— বলব যে নিজেকে অধ্যাপক আফছার আজমের মতো মনে হচ্ছে। তার সব স্মৃতি আমার ওপরে ভর করেছে। এমনকি তার কবিতাগুলোও মনে হচ্ছে আমিই রচনা করেছি। বিশ্বাস না হলে গড়গড় করে বলে দিতে পারি কয়েকশো কবিতা, সঙ্গে তাদের জন্মকথাও। ডাক্তার না হয় মেনে নিলেন আমার সমস্যাটা। উপযুক্ত চিকিৎসাও দিলেন। ঠিক আছে আমিও না হয় মানলাম। কিন্তু আমার পরিচয়টা কি দাঁড়াল শেষমেশ? কে আমি? স্রেফ নোবডি? ডাজ এ নোবডি এক্সিস্ট? ডু আই এক্সিস্ট?
সূর্যটা পশ্চিমের আকাশ বেয়ে নামতে নামতে কখন যেন নেই হয়ে গেছে। সকালে সে আবার আসবে অন্য রাস্তা ধরে। অন্ধকারে ঝোপের সামনে আমার উপস্থিতি আর বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে কয়েকটি জোনাকিপোকা টর্চ মেরে এদিকওদিক কি যেন খুঁজে ফেরে। এত কিছু চোখে পড়ে, আমাকে কারও চোখে পড়ে বলে মনে হয় না। একটি শেয়াল ক্লান্ত হয়ে আমার পাশের বেঞ্চে পা তুলে বসে, আমি শব্দ করে ভয় দেখাই, সে বসে থাকে নির্বিকার। একটা নিশাচর পাখি আমার কাঁধে এসে বসে, মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে ডেকে ওঠে, পাল্লা দিয়ে চিৎকার করি আমিও। পাখিটি টের পায় না কিছুই।