দেবকুমার সোম
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
পূর্ব প্রসঙ্গ: আঞ্চলিকতা ও বাংলা উপন্যাস
উপন্যাসের কাঠামোগত একটা স্থিরতা রয়েছে। আয়তনও মোটের ওপর একটা মাপা চলন মেনে চলে। তবে উপন্যাসকে ধরাবাঁধা কোনও সমীকরণে বেঁধে ফেলা যায় না। এর অন্যতম কারণ লিখিত সাহিত্যের বাকি শাখাগুলির চাইতে সে অপেক্ষাকৃত নবীন (নবীনতম ছোটগল্প)। কবিতায় যেমন ছন্দপ্রকরণ, স্তবক ইত্যাদিকে মান্যতা দিতে হয়— এমনকি যাঁরা টানা গদ্যে কবিতা লেখেন, তাঁদেরও ছন্দপ্রকরণের সামগ্রিক অবয়ব চোখের সামনে থাকা দস্তুর— উপন্যাস রচনা ঠিক তেমনটা নয়। কবিতা স্ফুলিঙ্গের মতো। তার ধরণটা তাৎক্ষণিক। মস্তিষ্ক তোলপাড় করে। এর দরুন কবিতা প্রায়শ সৃষ্ট হয়। নির্মিত কবিতার জোর চিরকালীন হয়ে উঠতে বিশেষ দেখা যায় না; পাঠ্যপুস্তক তাকে ধরে রাখলেও রাখতে পারে। কবিতায় বিস্তারের সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায় তার ধারণক্ষমতার কারণেই। সে ততটুকুই ধরে রাখতে চায়, যা তার পক্ষে বহনসক্ষম। বাড়তি কিছুর বোঝা সে বহন কেন করবে? কবিতার সঙ্গে তার পাঠকের সম্পর্ক আড়াল–আবডালে। কবি বলে থাকেন তিনি লেখেন না, কেউ তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। এর অর্থ কবিতা লেখার সময় কবি আত্মসচেতন আর সজ্ঞান তেমনটা নয়। সচেতনতার চাইতে কবিতায় অবচেতন মস্তিষ্কের প্রভাব বেশি থাকে। এ কারণে একটা কবিতা পাঠকভেদে যেমন ভিন্ন পাঠঅভিজ্ঞতা, তেমন একই পাঠকের কাছে বিভিন্ন সময়কালে একই কবিতা বিভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে আসতে পারে। আসেও। ইশারা, রহস্য, আড়াল এসব থাকার দরুন কবিতাকে ডিসেকশন টেবলে তুলে কাটাছেঁড়া খুঁচিয়ে ঘা করে দেওয়ার মতো মানসিক এক ব্যাধি এমনটা মনে হয়। নির্দিষ্ট কবিতাটা কেন ভালো লাগল? কেনই বা লাগল না? এ নিয়ে তক্ক চলতে পারে; তবে তা এঁড়েতক্ক হয়ে যায়— কারণ পাঠকের পাঠঅভিজ্ঞতা কবিতা বুঝে ওঠা কিংবা না-বুঝে ওঠার একমাত্র চাবিকাঠি। আমরা এই ‘পাঠঅভিজ্ঞতা’ শব্দটাকে নিয়ে পরে বিস্তারে আলোচনা করব, বুঝে নিতে চাইব কাকে বলে পাঠঅভিজ্ঞতা? পাঠ আর অধ্যয়নের মধ্যে কতখানি ফারাক। তবে এখন এই পর্যন্ত।
কবিতার মতো নাটকও সাহিত্যে সবচেয়ে পুরনো শাখা। কেউ-কেউ এই দুই শাখার প্রাচীনত্ব নিয়ে প্রশ্নও তোলেন। তুলতেই পারেন। নাটক আগে? না কবিতা? সেই বির্তকের চুলচেরা সমাধানের আজ আর কোনও জো নেই। তবুও কবিতার মতো নাটকেরও কাঠামোগত একটা স্থিরতা থাকে। নাট্যসাহিত্য পাঠের বাইরেও অনেক সময় অভিনয়কলা বা অভিনয়শাস্ত্রে পা রাখে; রাখার সার্থকতা দেখায়। তবে নাটক পাঠেও সাহিত্যগত মনোরঞ্জন থেকেই যায়। নাটক কবিতার মতো তাৎক্ষণিক, অবচেতনের প্রকাশ এমনটা নয় বটে, তবে নাটকে নাটকীয়তা সবচেয়ে বড় উপাদান। নাটকীয়তা বলতে চরিত্রের মধ্যে, ঘটনার মধ্যে সংঘাত। অন্তঃ আর আন্তঃ উভয়ত। সেটাই নাট্যসাহিত্যের মূল পদবাচ্য। কবিতার সঙ্গে তার পাঠকের যেমন আড়াআড়ি-লুকোচরি সম্পর্ক, নাটকের ক্ষেত্রে তেমন হওয়ার সম্ভাবনা হরহামেশাই নেই। কারণ নাটক কিছু বলতে চায়, বিবৃত করতে চায়। সাঁটে বলায় তার কাজ মেটে না। চোখের চাহনির মতো তাৎক্ষণিক বিমূর্ত কোনও প্রকাশভঙ্গিতে নাট্যসাহিত্যের কাজ চলে না। তাকে বিস্তারে বলতেই হয়। কবিতা আর নাটককে মিলিয়ে কাব্যনাট্য নামের এক ভিন্ন শাখা খোলা হয়েছে; সেখানে সংলাপ আছে, তবে সেসব সংলাপে কবিতার মাধুর্য, রহস্যময়তা এসব ধরা পড়লেও সামগ্রিকভাবে নাট্যশৈলী থেকে তার বিচ্যুতির আশঙ্কা থাকে না। সংলাপে নাটকীয়তা, ঘটনার নাটকীয়তা এসব তো থাকছেই, তার সঙ্গে পরিণতির দিকটাও গ্রাহ্যের মধ্যে আনতে হয়। কাব্যনাট্য এমন একটা মিশ্রশাখা, যা কবিতার মধ্যে সামান্য যে কাহিনির অংশটুকু থাকে, কিংবা কাহিনির অঙ্কুরোদ্গমের যেটুকু সম্ভাবনা, তাকে বাড়িয়ে-চড়িয়ে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়া। এখানেও কাঠামো, স্তর, বিন্যাস এসবের সুস্পষ্ট বিভাজন থাকে; তাকে এড়িয়ে কাব্যনাট্য নির্মিত হতে পারে না। অর্থাৎ বলার কথা এই, কবিতার রহস্যময়তা আর সাঁটে বলার কায়দা সংলাপে ঢুকে নাটককে অন্য এক প্রকাশভঙ্গিতে ব্যক্ত করে।
আমরা যদি প্রবন্ধসাহিত্যের দিকে তাকাই, তাহলে পাঠক-লেখক পারস্পরিক সমবায়িক সম্পর্কটা খানিক আঁচ করতে পারি। প্রবন্ধ নিকষ জ্ঞানবিতরণ এমনটা নয়। বরং বিশুদ্ধ তর্ক আর জ্ঞানের প্রসারণ। এভাবে দেখলে তাকে সৃজনশীল সাহিত্যের মধ্যে এনে ফেলা যায়। এখানে সৃজনশীল শব্দটার দিকে আমরা লক্ষ রাখতে চাইছি। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতেই পারে; হবেও হয়তো। মনের ভাব আদানপ্রদানের প্রয়োজন থেকেই সৃজনশীলতার সৃষ্টি; তবে নিছক তথ্য আদানপ্রদান সৃজনশীলতার ঘেরাটোপে আসতে পারে না। যে কারণে সব চিঠি পত্রসাহিত্য হয়ে ওঠে না। তার জন্য নিশ্চিত কিছু শর্ত কিংবা উপাদন জরুরি। পাঠঅভিজ্ঞতার মতো সৃজনশীল শব্দটাও পরে আমাদের যুক্তির পরীক্ষা নেবে; যাচাই করে নেবে আমাদের যুক্তির জোরটা কোথায়? কিংবা আদৌ তাকে যুক্তি হিসাবে মানা যায় কিনা? সে-সব পরে হবে; আপাতত আমরা হাতের কাজটা সেরে ফেলতে চাইছি।
অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধের সোজাসাপটা একটা উদ্দেশ্য থাকে। তার পাঠক সেই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে সেসব প্রবন্ধ পাঠ করেন। এর বাইরে প্রবন্ধের যে বিপুল সাম্রাজ্য, সেখানে আগেভাগে কোনও স্থিরীকৃত ধারণা যে থাকবে, তেমন কোনও শর্ত নেই। মোটের ওপর একটা আঁচ থাকে বিষয়কেন্দ্রিকতার কারণে। তবে সেখানে পাঠক আর লেখক মুখোমুখি। ফলে আড়ালের সুযোগ থাকে না। রহস্য করে, ধাঁধার মতো গুলিয়ে দেওয়া চলে না। সৃজনশীল প্রবন্ধ স্বভাবতই যুক্তি আর তথ্যকে জোরালো করে তার তত্ত্বকে তুলে ধরে কিংবা নির্মাণ করে। এখানেও সৃষ্টির শর্তগুলো অপ্রচলিত। অচল। সৃজনশীল প্রবন্ধের দায় পাঠককে তার তরফে সবটুকু বুঝিয়ে দেওয়া; কোথাও অস্পষ্টতা না রাখা। এমন পষ্টাপষ্টি সম্পর্ক সাহিত্যের আর কোনও শাখায় নেই। এখানে পাঠকও তৈরি থাকে তার দাবি কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিতে। ফলে আমরা ধরে নিতেই পারি প্রবন্ধসাহিত্যেরও একটা নির্দিষ্ট কাঠামো, চলন, পরিণতিতে পৌঁছানোর ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। পাঠক, আমরা সত্যিই নাচার। ফের একটা শব্দ এসে গেল আলোচনায়— পরিণতি। কাকে বলে পরিণতি? পরিণতির রকমফের কেমন? এ নিয়েও আমাদের বিস্তর কথা চালাচালি করতে হবে। এখনই তা নিয়ে কাহিনি ফেঁদে বসলে শুরুর অভিমুখটা পালটে যেতে পারে। তাই আপাতত পাঠঅভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতার মতো পরিণতি নিয়েও আমরা মৌনী রইলাম।
বোঝা যাচ্ছে কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ এসবের একটা কাঠামো রয়েছে; তার ওপর নির্ভর করেই সাহিত্য সৃজন। স্রষ্টা কিংবা নির্মাতার যেমন এর থেকে পরিত্রাণ নেই, পাঠকেরও। জিনিসটা আর একটু খুলে বলা যাক। কেউ যদি সনেট-নির্ভর কবিতা লিখতে চান, তাঁকে সনেটের বিধি মেনেই লিখতে হবে। সেই সনেট পেত্রার্ক হতে পারে, স্পেনসার অনুসারী হতে পারে কিংবা শেক্সপিয়র। তার চলন ওভাবেই হবে। কেউ নিশ্চিত সনেটের গায়ে ট্রিওলেটের পোশাক চাপিয়ে দেবেন না, কিংবা অক্ষরবৃত্তের বিস্তারকে স্বরবৃত্তের ক্রমিক শ্বাসাঘাতে ব্যবহার করার দুঃসাহস দেখাবেন না? কারণ ওটা হয় না। তার চেয়ে টানা গদ্যে লেখা অনেক বেশি কাব্যিক। নাট্যসাহিত্যেও তাই। শুরুতেই যদি যবনিকার পতন ঘটে; তবে নাটক মাঠে মারা যায়। প্রবন্ধকেও তেমন যুক্তিহীন আবেগসর্বস্ব এমনটা আমরা দেখতে চাই না; চাইলে সেটা আর প্রবন্ধ থাকে না। আর তার উপসংহারকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় শেষ চালে কিস্তি মাত করার জন্য।
উপন্যাসের সমস্যা এই, তাকে এমন কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোতে আমরা বাঁধতে পারি না। তার জন্য কোনও কঠিন-কঠোর অবয়ব আমরা বেঁধে দিতে পারি না। তার একটা কারণ সে বয়সে নবীন হওয়ার দরুন পরীক্ষানিরীক্ষার দাপট তার ওপর সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় কারণ বোধহয় আরও বড় এক বাস্তব; গুণগত কারণেই আমাদের পক্ষে তাকে কাঠামোয় মুড়ে ফেলা সম্ভব নয়। আমরা হয়তো চাইও না উপন্যাস এমন একটা বাঁধনে বাঁধা পড়ে তার স্বভাবজাত ধর্ম হারিয়ে ফেলুক। অথচ, উপন্যাসকে সৃষ্টি করা যায় না, নির্মাণ শব্দটাই ভাগ্য কিংবা বিধাতার মতো তার গায়ে সেঁটে আছে। এতক্ষণের আলোচনায় আমরা এক অদ্ভুত বৈপরীত্য যেন দেখতে পাচ্ছি। একদিকে আমরা বলছি কবিতাকে কাঠামো ছাড়া করা যায় না; অথচ সে স্বতঃসৃষ্ট; ক্বচিৎ নির্মিত। আবার বলছি উপন্যাসের কোনও মাপজোক করা কাঠামো নেই, তবু সে নির্মিত হয়, সৃষ্ট নয়। এই বৈপরীত্যকে তলিয়ে দেখলে আমাদের পাঠঅভিজ্ঞতার দৃষ্টিটা পালটাতে পারে।
কবিতার মতো উপন্যাসে তাৎক্ষণিক মুহূর্ত বড় একটা আসে না। উপন্যাসকারের সঙ্গে তার পাঠকের ভাসুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক নয়। তবুও উপন্যাসের গায়ে কবিতা থাকে। সেখানে যেমন অন্যের বা অন্য কবিতার চরণ সেঁটে দেওয়ার রেওয়াজ আছে, তেমন তার মধ্যেকার শব্দের অবস্থানগত সমীকরণের কারণে উপন্যাস কাব্যিক হয়ে ওঠে। এছাড়াও কাব্যোপন্যাস নামে আর একটা মিশ্রশাখা রয়েছে। যেখানে উপন্যাসকে ধরতে চাওয়া হয় কাব্যের আঙ্গিকে, তবে এমন পরীক্ষানিরীক্ষায় যাঁরা মগ্ন, তাঁরা প্রধানত কবি। কবিতার মধ্যে উপন্যাসের দানা ফেলে অঙ্কুরোদ্গমের চেষ্টা করেন তাঁরা। এমন উপন্যাস পাঠের তৃপ্তি কবিতা পাঠের মতো খানিক আপেক্ষিক। উপন্যাসে যাঁরা গপ্পের খোঁজ করেন, তাঁরা হতাশ হতেই পারেন।
অর্থাৎ আমরা বলতে চাইছি উপন্যাসের মধ্যে কবিতা থাকে। কবিতার রহস্যময়তা, ইশারা এসবও। বিশেষত বর্ণনায়। সংলাপে। যখন ঔপন্যাসিক একটা আড়াল খুঁজতে চান, কিংবা ছদ্ম রাখতে চান নিজের অভিসন্ধি। তখন অমন কাব্যময়তা তাঁর সহায়ক হয়ে ওঠে। তবে যাঁরা বানিয়ে তোলা সাহিত্যে অভ্যস্ত, তাঁদের হাতে ওইরকম কাব্যিক ঝোঁক যে থাকে, তাতে বানানো ব্যাপারটা আরও পেকে ওঠে। পাঠক এবার হয়তো ফের আপনি বিরক্ত হলেন। বানিয়ে তোলা সাহিত্য বলতে ঠিক কী সেটা নিয়ে একটা বিচারসভা আমাদের বসাতে হবেই। আগাম দিনক্ষণ জানাতে পারছি না (সেটা সম্ভবও নয়), তাৎক্ষণিক নোটিসে সেটা নিয়ে আমাদের বসতে হবে। তবে কথা এই, সৃজনশীলতা আর বানানো এই দুটো শব্দ খুব গায়ে-গায়ে লেগে থাকায় ঝামেলা দুটো একসঙ্গে মিটিয়ে নিতে হবে।
আমরা পত্রসাহিত্যের কথা বলছিলাম। উপন্যাসের মধ্যে চিঠিচাপাটি থাকে। এছাড়া চিঠির আদলে উপন্যাস লেখার চল কম দিনের নয়। বহু সফল উপন্যাস এমন আঙ্গিকে লেখা হয়েছে। হতে পারে। উপন্যাসে নাটকীয়তা থাকতে পারে। থাকেও। ফলে নাট্যসাহিত্যের কলাকৌশল উপন্যাসে হরহামেশাই দেখা যায়। মেলোড্রামা, নাটকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব, উত্তরণ আর পতন উপন্যাসের শরীরে সেঁটে থাকে। যায়। সার্থক নাটকীয়তা বহু সময় উপন্যাসকে এক নতুন উচ্চতা দেয়, যা বহু পৃষ্ঠার অলৌকিক বর্ণনাও হয়তো দিতে পারবে না। একজন ঔপন্যাসিককে সংলাপ রচনায় তাই মনোযোগী হতে হয়। নাটকের মতো উপন্যাসেও সামান্য স্থূল বা বাড়তি বাচনভঙ্গি পরিস্থিতিকে নষ্ট করে দিতে পারে।
গান বা সঙ্গীতে অন্তরা-সঞ্চারী এসব পর্ব থাকলেও মোটের ওপর তার একটা তাল, লয় থাকে; যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সুরের কাঠামো বা চেহারা। সেটা মৌলিক হতে পারে। আবার মিশ্রও। তবে মিশ্রণ এমনটা হতে হয়, যাতে কানে না-লাগে। উপন্যাসকে সঙ্গীতের এই ধর্ম মেনে নিতে হয়। উপন্যাস তার রহস্যময়তা, কাব্যিক প্রয়োগ, পত্রসাহিত্যের ঘনিষ্ঠতা, নাটকের নাটকীয়তার সফল প্রয়োগের পরেও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হতেই পারে, যদি তা সঙ্গীতের সুরের মতো একটা সামগ্রিকতায় পূর্ণ না হয়। উপন্যাসকে এখানে খানিকটা নদীর উপমায় আমরা নিতে পারি। পাহাড়ি ঝর্ণা মালভূমি-সমভূমি বেয়ে নীচের দিকে ধেয়ে যায়— সে তার পথ খুঁজে নেয় নিজের গরজে, তবে ওই যে প্রথম জলবিন্দু, যেটা পাহাড় থেকে প্রথম মাটিতে পড়েছিল, তার প্রবহমানতা কখনওই নষ্ট হয় না। এই প্রবহমানতা ছাড়া উপন্যাসের কোনও গতি নেই। জিনিসটা ছাড়া মাঝখানে হারিয়ে যাওয়া, বুজে যাওয়া নদীর মতো দশা হয় তার।
এবার আসতে হয় প্রবন্ধের কথায়। শুরুতেই বলেছি কবিতায় সাঁটে সেরে দেওয়া যায়। আসলে বলতে চেয়েছি উপন্যাসে ওরকমটা করা যায় না। উপন্যাসে তার রচয়িতাকে স্পষ্ট করতে হয় তাঁর অভিপ্রায়। উদ্দেশ্যবিহীন উপন্যাস হতে পারে না (কবিতা যেহেতু সৃষ্টি, তাই সেখানে প্রকৃতির খেয়াল থাকে; যাকে আপাত উদ্দেশ্যবিহীন বলতে চাইছি; মনের ভালমন্দের সঙ্গেই তখন তার নিবিড়তা)। সাহিত্যপাঠে মনোরঞ্জন হয় ঠিক, তবে সেই মনোরঞ্জন আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো নয়। জ্ঞানচর্চায় যে মনোরঞ্জন, মানসিক বিনোদন আমরা পাই, তার সবচেয়ে সদর্থক দিক হল চিন্তার প্রসার; কল্পনার প্রসার্যতা। সাহিত্যপাঠ আমাদের জ্ঞানের খিদে বাড়ায়; চিন্তার পরিধিও। এর দরুন আমাদের কাছে কবিতা যেমন আদরণীয়, প্রবন্ধপাঠও (সৃজনশীল শব্দটা আমরা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিচ্ছি)। উপন্যাসে অনেক সময় বিস্তারে আমাদের কথা বলতে হয়। খানিকটা আড্ডার ঢঙে যুক্তিতর্কে, খানিকটা আবার প্রবন্ধসাহিত্যের মতো তথ্য আর যুক্তির মিশেলে। এ না হলে উপন্যাসের পটভূমি, তার কার্যকারণ এসব স্পষ্ট হয় না। তাই উপন্যাসে ঢুকে পড়ে প্রবন্ধের আদল। ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই তখন ঔপন্যাসিকের উপাদান হয়ে ওঠে। জল অচল ব্যাপারটা থাকে না। তবে এসব উপদান কীভাবে, কতটা ব্যবহার হবে তা নির্ভর করে যিনি রচনাকার তাঁর অভিপ্রায়, মুনশিয়ানা, অভিজ্ঞতা এসবের ওপর।
তার মানে উপন্যাসে সাহিত্যের প্রায় সবকটা দিকই ধরা পড়ে। প্রায় লিখছি এ কারণে— উপন্যাসে যে ধারণক্ষমতা, সক্ষমতা, আমার ব্যক্তিগত মত তার সামান্য ভগ্নাংশ আমরা এখনও ধরতে পেরেছি। সম্ভাব্য বহুকিছুই আমাদের নাগালের বাইরে থেকে গেছে। যেমন দার্শনিক তত্ত্ব। দর্শনের বহু তত্ত্ব যেমন উপন্যাস থেকে উঠে এসেছে, তেমন বহু দার্শনিক মতবাদও উপন্যাসে সফলভাবে প্রয়োগ করা গেছে। আমরা আর একটু এগিয়ে বলতে চাই সাহিত্যিকও একজন দার্শনিক। চলতি শব্দে যাঁকে দার্শনিক বলা হবে, তাঁর মতো ঠিক নন। যেমন চলতি মতে যাঁকে কবি বলা হয়, তাঁর মতোও তিনি নন; তেমনটা। এর দরুণ ঔপন্যাসিকের কাঁধে ভুবনের ভারটা সত্যিই চেপে বসে। অথচ, একজন ঔপন্যাসিক সবটা জেনেই তাঁর সাহিত্য নির্মাণ করবেন তা নয়। আবার জ্ঞানী হলেই যে তিনি একজন সার্থক সাহিত্যিক হবেন সেটাও ভাবনার বাড়াবাড়ি। অনেককিছুই না-জেনে একজন সাহিত্যিক তাঁর সংবেদনশীলতা দিয়েই তাঁর উপন্যাস রচনা করেন। পরে তাঁর ওপর জ্ঞানলোকের আলোক পড়ে; পণ্ডিত আলোচকেরা বহু কিছু খুঁজে পান। এর জন্য একজন ঔপন্যাসিককে সবসময় সচেতন থাকতে হয়; তাঁকে নিয়োজিত থাকতে হয় শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি আরও বহুকিছু পাঠে। সম্পৃক্ততায়।
যেমন চিত্রকলা। উপন্যাসের প্রয়োজনেই ঔপন্যাসিককে ছবি দেখতে হয়; ছবির কদর জানতে হয়। যেমন তাঁকে নাট্যসাহিত্য পাঠের বাইরে গিয়ে নাট্য-অভিনয় দেখতে হয়, ঠিক তেমনই ছবিও দেখতে হয় অবিরত। মূর্ত-বিমূর্ত। জলরং থেকে তেলরং। টেম্পেরা, অ্যাক্রেলিক। ভাস্কর্য। ধাতু। টেরেকোটা। ল্যান্ডস্কেপ। পোর্ট্রেইট। হিন্দুদর্শনে তিন নম্বর চোখের কথা বলা আছে। দেবদেবীর কপালের মাঝখানে দেখা যায়, অনেকটা ওই তিসরি আঁখের মতো এসব সাহিত্যের বাইরের উপকরণ উপন্যাসকে পুষ্ট করে। এসব মিলেমিশেই একটা বিরাট (আয়তনে নয়, গভীরতায়) ক্যানভাস নির্মিত হয়। কিংবা এঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার। যার মূল ভিতটা মজবুত না হলে নির্মাণ তাসের ঘর হয়ে যায়।
এতটা এগিয়ে আসার পরে পাঠক আশাকরি আপনি অনুধাবন করতে পারছেন যে, উপন্যাসের স্বাধীনতা সাহিত্যের অন্য যেকোনও শাখার চাইতে ঢের বেশি। আমরা সচেতনভাবেই ঢের শব্দটা রাখতে চাইছি। উপন্যাসের ধার আর ভার তাকে এমন গুরুদায়িত্ব দিতে চায় যা স্বাধীনতার মতো। ফলে স্বাধীনতা উদ্যাপনে দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে চেয়ে উপন্যাস সাহিত্যের শাখাগুলির বাইরে আরও বড় এক প্রেক্ষিতকে জড়িয়ে নেয়। যাকে সময় কিংবা ইতিহাসচেতনার মতো বোধশব্দে ব্যাখ্যা করা চলে। আর তখন ক্যানভাসটা নিছক ক্যানভাস না হয়ে, কালের প্রবাহ এমনটা হয়ে ওঠে। যেখানে মানুষের বিবর্তনগুলি, সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বিভিন্ন চিহ্নরেখগুলোর ভাঁজ খুলে যায়। আবরণ সরে গিয়ে মানুষের সার্বিক বেঁচেবর্তে থাকার ইতিকথা হয়ে পড়ে। ঠিক এই কারণে বয়সে নবীন হয়েও উপন্যাস সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখা হিসাবে আজ তার দাবি জানাতেই পারে।
পাঠক আপনি হয়তো বলবেন আমরা মিথ্যেই ঔপন্যাসিকদের দিকে ঝোল টানছি। তবে আমাদের সামান্য পর্যবেক্ষণটুকু এই, কবি কিংবা নাটককারকে যদি আমরা মহামানব, ঋষিগোছের ভেবে নিই; প্রাবন্ধিকের পাণ্ডিত্যকে যদি কুর্নিশ জানাই; তবে ঔপন্যাসিককে অথরের জায়গা দিতে বাধা কীসের? আমরা বলতে চাইছি একজন অথর হলেন সেইজন, যাঁর হাতে আছে প্রভূত স্বাধীনতা। কী সেই স্বাধীনতা? সেই স্বাধীনতা হল গান, কবিতা, চিত্রকলা, নাটক, প্রবন্ধ, দর্শনচিন্তা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এসব থেকে নিজের কাজের জিনিসগুলি ছেঁকে নেওয়া। তবে এর মধ্যেও কথা আছে। কথাটা হল সারাজীবন ধারদেনা করে যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক সংসার চলে না, ঠিক তেমন নিজের স্বতন্ত্র আইডিয়া (পড়ুন দর্শনচিন্তা) না থাকলে উপন্যাস নির্মিত হতে পারে না। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যেমন সৎ পথে উপার্জন একমাত্র উপায়, তেমন স্বোপার্জিত মতাদর্শ ছাড়া উপন্যাস রচনা করা যায় না। যাঁরা সেটা পারেন, তাঁরাই অথর। এই পারাটা সমগ্রজীবন ধরে ব্যাধির মতো একজন অথরকে পিষে মারে। তাঁকে ছিবড়ে করে দেয়। তাই এই গ্রহে এখনও পর্যন্ত খুব কম অথরের দেখা পাওয়া গেছে যাঁরা উন্মাদ, ছন্নছাড়া, ভবঘুরে, আত্মহত্যাপ্রবণ কিংবা নেশাড়ু নন। এমন বহু অথর আছেন যাঁরা জীবনে একটামাত্র উপন্যাস লিখতে পেরেছেন। দুটো কিংবা তিনটে উপন্যাস সারাজীবনের উপার্জন এমন উদাহরণ দুনিয়ার প্রায় সব প্রধান ভাষাসাহিত্যে ভুরিভুরি। কিন্তু একটি কিংবা দুটি কবিতা-প্রবন্ধ লিখে সাহিত্যের ইতিহাসে মহিমান্বিত হওয়ার নজির নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ, ওই ক্যানভাস। বড় ক্যানভাসে সার্থক কাজ একটা হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে চলে। এখানে তাই বলে নেওয়া ভাল নভেল সংখ্যায় নয়, গুণমানে বিশিষ্ট হয়। ইদানিংকালের বাংলাভাষায় বহু লেখক দিস্তে-দিস্তে উপন্যাস লিখে খ্যাত। বলাবাহুল্য সেগুলির একটাও নভেল নয়। বড় জোর টেনেটুনে গপ্পো বলা যেতে পারে। আর খ্যাতি জিনিসটা খানিকটা বুদবুদের মতো। লেখকের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই শূন্যে মিলিয়ে যায়। সাহিত্যচর্চায় ভিড় বাড়ানোর দলে থাকা ছাড়া ভিন্ন কোনও অবদান তাঁদের থাকে না। আমরা যে পাঠঅভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম, তা যদি এমন দিস্তে-দিস্তে বানিয়ে তোলা মিথ্যে সাহিত্য থেকে গড়ে ওঠে, তবে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নভেল পাঠ অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। হয়ও।
আমাদের উপন্যাস নির্মাণে দর্শনের অভাব চিরকালের মতো আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে রেখেছে। আমাদের বিদগ্ধ সারস্বত সমাজের কাছে টেনেটুনে লম্বা করে লেখা গপ্পো বা একরৈখিক বড়গপ্পো উপন্যাস হিসাবে এমন স্থির স্থান নিয়ে রেখেছে যে, আমরা রবীন্দ্রনাথের মতো অথরের উপন্যাসকে ভুল পাঠ করেছি। আমাদের পাঠঅভিজ্ঞতার অসম্পূর্ণতার কারণে তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ কিংবা ‘চার অধ্যায়’কে আমরা পাঠ, পুনঃপাঠের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক উপন্যাসের পরিসরে ছুঁতে পারিনি। একইভাবে আমাদের পাঠের লঘুতায় আখ্যান আর কথাসাহিত্যের পার্থক্য না-চেনার কারণে জগদীশ গুপ্তের ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ কিংবা ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘অন্তঃশীলা’র ট্রিলজি, গোপাল হালদারের ‘একদা’— এমন বহু সার্থকনাম উপন্যাস আমাদের পাঠের আড়ালে চলে গেছে। আজও আমাদের উপন্যাস পাঠ ‘বিষবৃক্ষ’ কিংবা ‘শ্রীকান্ত’কে ছাড়িয়ে যেতে পারল না। এর ফলে সমাজের আর বাকি ক্ষেত্রের মতো বাংলা উপন্যাসও সর্বনাশের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। শক্তিশালী মেধার অংশগ্রহণ না থাকায় বাংলার ঔপন্যাসিকেরা বাঙালি অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, পদার্থবিদ কিংবা তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারলেন না। ওই পুজো কিংবা ইদ সংখ্যায় বাজারজাত উপন্যাস রচনা আর কিছু পুরস্কারের মধ্যের সীমায়িত রয়ে গেল তাঁদের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা। অথচ, শুরুটা এমন হতাশজনক ছিল না।
পাঠক ভেবে দেখুন আমাদের ভাষায় যখন উপন্যাস লেখা হচ্ছে, তখন ভারত কেন, এশিয়ার বহু ভাষায় গদ্যের আড় ভাঙেনি। সেদিন বাকি দেশের কাছে বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র ছিলেন উপন্যাসের মডেল। আজ প্রায় পৌনে দুশো বছর পার করে বিচারে বসলে দেখা যাবে বাকি ভারতীয় ভাষার (তামিল, কন্নড, মালায়লাম, ওড়িয়া, হিন্দি, সিন্ধ্রি) উপন্যাস সাহিত্য ভারতীয় সাহিত্যের প্রথমসারিতে চলে গেছে। আর আমরা ক্রমশ পিছিয়ে চলেছি। এর কারণ নিশ্চয় বহুবিধ। কিন্তু অন্যতম প্রধান আমাদের পাঠঅভিজ্ঞতা। আমরা যতদিন না উপন্যাসকে গল্পের খাঁচাছাড়া করতে পারি, ততদিন এই অবিমৃষ্যকারিতা নিয়েই আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে।
পাঠঅভিজ্ঞতা আর অধ্যয়ন নিয়ে শুরুতেই কৌতূহলী পাঠকের জন্য একটা প্রশ্নচিহ্ন রেখেছিলাম; এখন সেই প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ার সময়। অভিজ্ঞতা হল মনোজগতে থেকে যাওয়া পুরনো স্মৃতি; যা সামাজিক এবং ব্যক্তিক। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সাহিত্যের যে উপাদান থাকে তা রাষ্ট্রনির্মিত এবং সমাজের ক্ষমতাশীল অংশের প্রতিভূ। এর দরুন পাঠ্যপুস্তকে নীতিকথা বা ওই জাতীয় কিংবা উৎপাদনশীলতার বাইরে থাকা বানানো সাহিত্যই মুখ্য হয়ে ওঠে। যাঁরা কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাসাহিত্য নিয়ে পড়েন, তাঁদেরকেও ওই একই পথে যাত্রা করতে হয়। এর কারণে আমাদের সাহিত্যপাঠ অধ্যয়ন না হয়ে কেবল পাঠে থেকে যায়। আমরা যারা সাহিত্য পড়তে ভালোবাসি, পড়তে চাই, তারা পাঠপুস্তক-নির্ধারিত সাহিত্যের আদল মেনেই উপন্যাস পড়তে চাই; ভালবাসি। আমরা ধরে নিই, মেনে নিই উপন্যাস প্রকৃত প্রস্তাবে বিভিন্ন ঘটনা কিংবা কাহিনি আর চরিত্রের নির্যাস। এমন গোল-গোল ধারণা সেই শুরুর সময়ে থাকলেও আমরা ভুলে গেছি সময় পালটেছে। এখন আর সেই একইরকম সমাজ নেই; অর্থনীতি আর রাজনীতিও তার ভোল পালটেছে। উপন্যাসকে যদি আমরা সময়ের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস এমনটা ভেবে নিই, তবে আমাদের এই জায়গাটা বুঝতে হবে যে, এখন আর কেবল কাহিনি-নির্ভরতায় উপন্যাস চলবে না। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাই, তবে গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে দুনিয়ার মোড় ফেরানো উপন্যাসগুলিতে দেখতে পাব কাহিনির চেয়েও আরও মহৎ হয়ে উঠেছে জীবনবোধ। জীবনের হুবহু ছবি এঁকে ‘মাদাম বেভারি’ লেখার দিন আজ শেষ। বরং ‘ব্লাইন্ডনেস’, ‘মাই নেম ইজ রেড’, ‘গড অফ স্মল থিংস’ থেকে আমরা পাই জীবনযাপনের বহুকৌণিক অবয়ব। ‘বিষবৃক্ষ’ যেকালে লেখা হয়েছিল, সেকালে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল; আজ সেই নৈতিকতার (বিশেষত ভিক্তোরিয়ান নৈতিকতা) স্খলন নিয়ে উপন্যাস লেখা আর যাইহোক যুগোপযোগী নয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যের নিদারুণ দুর্ভাগ্য আমরা পাঠ আর অধ্যয়নকে গুলিয়ে ফেলেছি। সহজ-সরল ছন্দে জীবন চলে না, অথচ আমরা উপন্যাসের কাছে দাবি জানাচ্ছি জমজমাট একটা সহজ-সরল কাহিনি। অর্থাৎ যা জীবনবোধ থেকে উৎসারিত নয়, বরং জীবনবিমুখ।
আমাদের এমন পাঠঅভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে পণ্ডিতেরা ভাগ করে দিয়েছেন— প্রেমের উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস এবংবিধ। অর্থাৎ কোনও একটা খোপের মধ্যে আলোচিত উপন্যাসকে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কীসের নিশ্চিন্তি? তা হল ভাবনার নিশ্চয়তা, অর্থাৎ স্থবিরতা। যদি ‘জাগরী’কে রাজনৈতিক উপন্যাস আর ‘মহিষকুড়ার উপকথা’কে সামাজিক উপন্যাসের খোপে আমরা ঢুকিয়ে দিতে পারি, তাহলে বেয়াড়া প্রশ্নগুলো ওঠে না। পাঠ তখন অধ্যয়ন হওয়ার দাবিও জানাবে না। তবে কথা এই, গপ্পোকে টেনেহিঁচড়ে বাড়িয়ে-চড়িয়ে একরৈখিক যে আখ্যান রচিত হয়, তাকে উপন্যাস নামে বাজারজাত করে হাটে বিকোনোও যায়, সাহিত্য হয় না। কথা, কাহিনি, আখ্যান এসব শব্দগুলোর গোলকধাঁধায় উপন্যাস হারিয়ে যায়।
ইংরাজি মান্য অভিধানগুলো নভেল বলতে নতুন ধারণা এমন গোছের সাহিত্যকর্মকে বোঝায়। আর ফিকশন হল কল্পিত কাহিনি। অভিধান স্পষ্টতই ফিকশনে বানিয়ে তোলা এমন একটা সাহিত্যকীর্তি বলতে চায়। আমাদের উপন্যাসকথার অভিমুখ যে কারণে আমরা নভেলের সাযুজ্যে রাখতে চাইছি। আজকাল নামী প্রকাশকেরাও নভেলের বদলে ফিকশন শব্দটা ব্যবহার করেন। আর নভেল বলতে ক্লাসিক এমন আলাদা দূর অতীতের ব্যাপার বোঝাতে চান। আজ দরকারে আমাদের পাঠাভ্যাসে বদল আনতে হবে; নভেলকে অমন কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা যাবে না। প্রাজ্ঞজন যাঁরা নভেলকে শিকেয় তুলে রাখতে চাইছেন, তাঁদের বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে বাজারজাত সাহিত্যের মধ্যেই নভেল, কবিতা কিংবা নাট্যসাহিত্য তার মেধা নিয়েই থেকে যাবে, তাদের গায়ে পুরনো, বাতিল স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া যাবে না। যায় না।
[ক্রমশ]