বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চড়ুইবেলা
৩.
হীরক বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে আনন্দের গন্ধ পেল। খুব বেশি হইচই— সেরকম নয়। কিন্তু বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে বেশ দূর থেকে। দিদির পড়ার আওয়াজ আসছে না। তার বদলে চিনুর আহ্লাদি চিৎকার। রান্নাঘর থেকে অনেকরকম রান্নার গন্ধের মিশেল হলে যেমন ভালবাসার সুবাস ছড়ায়, আজ তেমনি। বাইরের লোক আসেনি, তেমন হলে আরও গলা পাওয়া যেত নিশ্চয়। তবে? খুব অবাক লাগছিল, কিছুর আভাস পাওয়া যায়নি তো। আজ কারও জন্মদিন যে, সেরকমটাও নয়। হলে সকাল থেকেই মার রান্নার ধুম পড়ে যেত। যার যেটা বেশি ভাল লাগে কিন্তু এমনি সময় খাওয়ানো মুশকিল, নীলিমা সেসব জন্মদিনের জন্য জমিয়ে রাখে। হীরকের জন্য কাছুয়ার মাংস, রূপার জন্য মাংসের পোলাও, চিনুর জন্য বাদাম দেওয়া কেক এইসব। আর ক্ষীরের মত জমাট এক জামবাটি লাল পায়েস। কিন্তু সেসব দিন আজ নয়। তাহলে কী ব্যাপার হয়েছে ভেবেই ওর মন লক্কা পায়রার মত ডানা ঝটপটাল।
বেশি দেরি করতে হল না। বাড়ির দরজা পেরোনো মাত্রই চিনু ল্যাজকাটা হনুমানের মত লাফাতে লাফাতে হাজির। চোখমুখ উত্তেজনায় ফুটন্ত জলের মত টগবগ করছে। দাদা, শুনেছিস? বাবা জার্মানি যাচ্ছে।
সত্যিকারের জার্মানি? পশ্চিম না পূর্ব? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল হীরকের। একেবারে এতদূর?
এটা অবশ্যই বড় খবর। দুর্গাপুর থেকে তারা বারুইপাড়া পিসির বাড়ি গেলেই কত হইচই চলে। আর এ যে একেবারে জার্মানি! প্লেনে করে? ওদের বাড়িতে কিংবা আত্মীয়-পরিচিতদের মধ্যে কেউ কখনও প্লেনে চড়েনি।
মা রান্নাঘরের থেকে মুখ বাড়াল, তা না হলে কি তোর ওই হাম্বার সাইকেল চালিয়ে? মায়ের মুখ হাসিতে এমন দীপ্ত হতে বহুদিন দেখেনি হীরক। গর্ব আর প্রাপ্তির এক সুখব্রীঢ়ায় ঝলমলে চোখমুখ। মার মুখের অমন হাসি দেখলে কদিন আগেও হীরক গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে গায়ের গন্ধ নিত। আজ লজ্জা পেল। বড় হয়ে যাচ্ছে না! কিন্তু চাইছিল মা তক্ষুনি তক্ষুনি আবার রান্নাঘরে ফিরে না যাক। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, বাবা টিকিট এনেছে? প্লেনের টিকিট?
দূরে কোথাও যাওয়ার টিকিট কেমন হয় জানতে ছটফট করে হীরকের মন। প্লেনে যাওয়া দূর অস্ত, তেমন দূরেও তো কখনও যায়নি ও। ওর ক্লাসের ছেলেরা এদিকওদিক বেড়াতে যায় পূজোর কিংবা গরমের ছুটিতে। ছুটির পরে অমল একদিন হরিণের চামড়ার জুতো পরে এল, পুরী থেকে এনেছে। শানু তো ফি ছুটিতে বেড়াতে যায়। ওর দার্জিলিং থেকে আনা উলের গ্লাভস দেখিয়েছিল। এটা কোথায় পরবি রে? দুর্গাপুরে অত ঠান্ডা পড়ে? জিজ্ঞেস করতে শানু বলল সামনের বছর কাশ্মির যাব, তখন। কিংবা সিমলা। পরার জায়গার অভাব আছে? কেন তোরা কোথাও বেড়াতে যাস না?
শুধু একবার শিলিগুড়ি গেছিল, ভালদাদুর মেয়ের বিয়েতে। দু বছর আগে। বাবা জীবনকাকুকে রিজার্ভেশন করতে দিয়েছিল হাওড়া থেকে। রোজ বিমলকে জিজ্ঞেস করত হীরক। টিকিট এল বাবা?
বিমল প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছে। আসবে বাবু, জীবন তো সোমবার আর বেস্পতিবার ছাড়া কলকাতা যায় না। কেটে রেখেছে, কিন্তু এবার আনতে ভুলে গেসল। আসছে সপ্তাহে আনবেখন।
শিলিগুড়ির টিকিট কি বর্ধমান যাওয়ার টিকিটের মত হবে বাবা? নাকি আরও বড়? হীরকের আশা ছিল দূরের যাত্রার টিকিট— তাই বড় হতে হবে। বর্ধমানে যাওয়ার মত ওই হলদে টিকিট নয়।
বিমল নিজেও তেমন দূরে আর কোথায় বা গেছে। দূরের টিকিট কাটতে কেমন ভয়ভয় লাগে বরং। কী জানি কী না কী করতে হবে। তাই তো জীবনকে কাটতে দিয়েছিল। বিমল চোখ কুঁচকে ভেবে বলল, তাই তো মনে হয়। এলে দেখিস।
যেদিন টিকিট এল হীরক খেলার মাঠে বল পেটাপেটি করছিল। হঠাত সেখানে চিনু এসে হাজির। মা ডাকতে পাঠিয়েছে। খুব বিরক্ত হয়েছিল হীরক। এত তাড়াতাড়ি কেন? এখনও তো সন্ধে হতে অনেক দেরি। চিনু একছুটে মাঠের মধ্যে এসে পড়ল, টিকিট দাদা টিকিট। শিলিগুড়ির।
শুনেই চিনুর হাত ধরে হীরক ছুট। পিছন থেকে বীরু ঝন্টুরা হাউমাউ করে উঠেছিল। হীরক চলে গেলে এক দলে ছেলে কমে যাবে, সেটা ঠিক করতে করতে দিনের আলো আরও নিভে আসবে। কিন্তু সেসব ভাবনায় সাড়া দেওয়ার সময় কোথায় হীরকের। ও তখন চিনুর হাত ধরে বড় রাস্তায়। হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করল, তুই দেখেছিস?
–না রে দাদা। বাবা বলেছে তুই বাড়িতে না ফেরা অবধি কাউকে দেখাবে না।
উত্তেজনায় হীরকের বুকটা তখন ফুটবলের মতই লাফাচ্ছিল। ওরাও তবে বেড়াতে যাচ্ছে! শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবে, বাবা বলেছে। শানুর মত গ্লাভস কিনবে না যদিও, কারণ আবার কবে শীতের জায়গায় যাবে তার ঠিকানা নেই। দুর্গাপুরের শীতে গ্লাভস দিয়ে হাতি হবে। সে আরও ভাল কিছু কিনবে, এমন যেটা কারও কাছে থাকবে না।
সেবার টিকিট দেখে বেশ হতাশ হয়েছিল। দেখতে প্রায় বর্ধমানের টিকিটের মতই। শুধু রিজার্ভেশনের জন্য আলাদা একটা হাতে লেখা কাগজ, সেখানে ওদের সবার নাম আর বয়স লিখে দেওয়া আছে। আর পাশে পাশে সিটনাম্বার। শিলিগুড়ির টিকিট এইরকম? হাওড়া যাওয়ার টিকিট আর শিলিগুড়িরর টিকিটে কোনও ফারাক থাকবে না? অনেক কষ্টে চোখের জল চেপেছিল সেদিন হীরক। তবে নিজের নামের পাশে আপার বার্থ দেখে টিকিটের সাধারণত্বের দুঃখ একটু কমেছিল সেবার।
হীরকের গলা পেয়ে বিমল হাসিমুখে শোওয়ার ঘর থেকে বাইরে। আজ সেকেন্ড শিফট থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে এমন খবরটা দেওয়ার জন্য। তার কাছেও সংবাদটা আচমকাই এসেছিল। নতুন মেশিন আসবে, তার ইন্সপেকশনে যেতে হবে। সাধরণত অফিসাররা যান, সঙ্গে কোনও প্রবীণ মেশিনচালক। ইউনিয়নেরও চাপ থাকে কাকে নিয়ে যাওয়া হবে তাই নিয়ে। এরকম সুযোগ কালেভদ্রে আসে, সুতরাং এত লোকের মধ্যে থেকে বিমলের ডাক পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু বিমল চ্যাটার্জিবাবুর সুনজরে পড়ে গেছে। এটাও নীলিমার কাছে খুব গর্বের কারণ। রাতে খাওয়ার পাতে শুকনো থালায় ছবি আঁকতে আঁকতে এই গল্পটা হীরক মাঝেমাঝেই শোনে। বিমল লজ্জা লজ্জা মুখে না না করে, একই গল্প কতবার করবে বলো তো? কিন্তু নীলিমা বলবেই। ওরাও এমন ভান করে যেন ঠিকঠাক মনে নেই, আবার শুনতে হবেই। প্রতিবার শুরুর থেকে বলতে বলতে নতুন কোনও তথ্য জুড়ে যাবে। রূপা এমন কি হীরকও একটা কি দুটো কথা ধরিয়ে দেবে মাকে। দেখেছে ওরা ধরিয়ে দিলে বাবার মুখটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে যায়। মা স্টিলের থালার উঁচু কানায় হাত কাচাতে কাচাতে বলে তোদের বাবা যখন কাজ করে, কোনওদিকে হুঁশ থাকে তার? সংসারধর্ম একদিকে আর ওনার কাজ একদিকে। কথায় একটা ঠেস থাকে, কিন্তু ভালবাসা আর গর্বের মোড়কে মুড়ে। ওইদিন কী হল জানিস— আপিসে দুপুরের খাওয়ার সময়— নীলিমা আপিসই বলে যদিও বিমল ধরিয়ে দেয়, অফিস কোথায়, শপফ্লোর বল। নীলিমা এটাতে পাত্তা দেয় না। ওই হল, চাকরিতে যাচ্ছ মানেই আপিস। হ্যাঁ তারপর শোন তোরা, কী হল— সবাই তো নিজের নিজের মেশিন বন্ধ করে খেতে চলে গেছে, কিন্তু এই বাবুটির কোনও হুঁশ নেই। হীরক চোখ গোলগোল করে নীলিমার কথা শুনছিল। নীলিমা খুব মজা করে গল্প বলে, যতবার শোনে তাই নতুন লাগে ওদের। বিমল লজ্জা পায়। এইসময় প্রতিবার বাধা দেবে, আহা আমি কী করব? কাজটা সেদিনই তুলে দিতে হবে, কোল্ড রোলিং মেশিন সারানো না হলে প্ল্যান্টের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল। যেমন তেমন মেশিন করে দিলেই তো হবে না, সূক্ষ্ম কাজ, মাইক্রনের এদিকওদিক হলে—
রূপা বলবে, মাইক্রন মানে যেন কত বাবা?
নীলিমা অতসব কচকচির মধ্যে গল্পটা হারিয়ে যেতে দেয় না মোটেই। লগি ঠেলে পানা সরানোর মত গল্পের নৌকা আনসান কথার আগাছামুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অমন দরকারি কাজ তো কতজনের থাকে রোজ, কেউ তা বলে খেতে ভুলে যায়? আমার সব জানা আছে। আর কী হল জানিস, ওই সময়েই চ্যাটার্জিবাবু ওখান দিয়ে রাউন্ডে যাচ্ছেন। দেখলেন কেউ কোথাও নেই, একটা লোক একা একা কাজ করে যাচ্ছে। এরকম ব্যাপার সচরাচর তো হয় না। তাই পিছনে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলেন, তোদের বাবার তাতেও হুঁশ নেই। এত বড় অফিসার, দেখলে সবাই সেলাম ঠুকে তটস্থ হয়, আর উনি থোড়াই কেয়ার করে কাজ করে চলেছেন।
–আচ্ছা নীলিমা, আমার কি মাথার পিছনে দুটো চোখে আছে নাকি যে দেখব, কে আসছে আর কে যাচ্ছে? নেহাত জীবন ওই সময়ে খেয়েদেয়ে ফিরছিল আর সাহেবকে দেখে হইহই করে উঠল।
–তারপর উনি কী বললেন সেটা বলো আগে।
ততদিনে ওদের সবার এটা মুখস্থ হয়ে গেছে। হীরকও গড়গড় করে বলে দিতে পারে। এগিয়ে এসে বাবার পিঠ চাপড়ে উনি বললেন, আপনার মত একনিষ্ঠ লোক আমি আর দেখিনি দেবাবু। চিনু টপ করে বলে উঠবে, একনিষ্ঠ মানে কী বাবা? বিমল সোৎসাহে নিষ্ঠা শব্দ থেকে বোঝাতে শুরু করলেও নীলিমা আসল কথাটা আগে হয়ে যাক বলে থামিয়ে দেবে ঠিক। তারপর চ্যাটার্জিবাবু তোদের বাবাকে বলল, আপনার কাজেও যেমন দক্ষতা, তেমনই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন আপনি। আমাদের স্টিল প্ল্যান্টে আপনার মত লোক যদি আর কিছু থাকত, তাহলে অনেক উন্নতি করতে পারতাম আমরা। আচ্ছা উনি তোমাকে কী একটা প্রাইজ দিলেন না? জানে নীলিমা, কিন্তু বারবার শুনতে ভাল লাগে। বিমল ব্যাপারটা হালকা করতে চায় এখানে, ওই আর কী— আমাদের ওটাকে বলে ম্যান অব দ্য মান্থ, মানে ওই মাসে সারা প্ল্যান্টে যে সবচেয়ে ভাল কাজ করেছে।
–কতজনের মধ্যে বাবা?
ওরা জিজ্ঞেস করতে ছাড়ে না। এইরকম প্রশ্ন বিমলও যে করে ওদের। হাফইয়ার্লির নম্বরওলা খাতাগুলো বাড়িতে এলে বিমল প্রশ্ন করে, তুই কত নম্বরে আছিস? যদি শোনে এক বা দুই নম্বরে, জানতে চায় কতজনের মধ্যে। ওদেরও এইভাবে ভাবার অভ্যাস হয়ে গেছে। যখন শুনল কুড়ি হাজার লোকের মধ্যে, ওদের চোখ গোলগোল হয়ে ওঠে। বিমল ওদের চোখের সামনে যেন মাটির থেকে দুই ইঞ্চি উপরে উঠে যায়। আর বিমলের চ্যাটার্জি সাহেবও এইভাবে ওদের মনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়েন।
ইতিহাস পড়তে গিয়ে সাহেব কথাটার সঙ্গে একটা লালমুখোপনা জুড়ে গিয়েছিল হীরুর মনে। কিন্তু এই চ্যাটার্জিবাবু নেহাতই বাঙালি। সেবার যখন বাবার হাত ভেঙে গেছিল, বাড়ি অবধি চলে এসেছিলেন দেখতে। সে আবার আর এক বিপদ। নীলিমা রোগী দেখবে না ঘর পরিষ্কার করবে? তার ওপর এক কাপ চা যে খাওয়াবে, বাড়িতে দুটো ভাল কাপ নেই। দৌড়াল পাশের বাড়ির শুভ্রার কাছে। নতুন বিয়ে হয়ে এসেছে, বিয়েতে অনেক কাপডিশ উপহার পেয়েছিল। শুনে শুভ্রা আবার ছোট ছোট দুটো প্লেটও দিল। সেই প্লেটে করে কী দেওয়া যায়? সেই নিয়ে দুজনে কত জল্পনাকল্পনা। কিন্তু সময় বেশি ছিল না। তাই নীলিমা দুটো পিঠে বানিয়ে দিল আর চায়ের সঙ্গে একটু ঝাল না হলে চলে না বলে মামলেট। চ্যাটার্জিসাহেব আবার মামলেটকে অমলেট বললেন কেন কে জানে। কিন্তু সেদিন থেকেই ওদের বাড়িতে অমলেট বলার চল।
হীরক আর চিনু পর্দা ধরে দাঁড়িয়েছিল। ওদের ধারণা ছিল বাবার চ্যাটার্জিসাহেব দেখতেশুনতে হোমড়াচোমড়া চেহারার কেউ হবেন। লালমুখো না হন, অন্তত ঠোঁটজোড়া পাকানো গোঁফ তো থাকবে। কিন্তু মোটা চশমার নিখুঁত করে কামানো মুখে কোটপ্যান্ট না পড়া এই ভদ্রলোককে দেখে একটু হলেও আশাভঙ্গ হয়েছিল। ওদের দেখে উনি আবার ডাকলেন। প্লেট থেকে অমলেট কেটে তুলে ওদের হাতে দিয়ে বললেন, তোমার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বুঝলে? কাজে এত একাগ্রতা খুব কম মানুষেরই থাকে। এই জিনিসটা যদি বাবার কাছ থেকে শিখে নিতে পারো, তাহলে জীবনে তোমাদের সফল হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। বিমলের মুখটা দেখার মত ছিল সেদিন। আনন্দে তৃপ্তিতে হাতভাঙার ব্যথা উধাও। ওদিকে হীরু ভাবছিল চ্যাটার্জিসাহেবের বয়স তো বেশ কম, সে কী করে বাবার উপরে যায়?
উনি চলে গেলে এই কথাটা তুলতেই হীরকের মাথায় ভাঙাহাত রেখেছিল বিমল। উনি যে ইঞ্জিনিয়ারবাবু, তাই না এই বয়সেই এত উঁচু পদে যেতে পেরেছেন। সেজন্যেই তো বলি, ভাল করে পড়াশোনা কর। তাহলে আর বাবার মত ছেনিহাতুড়ি নিয়ে ঘুরতে হবে না। আমি কেন, আমার থেকেও বড় বড় লোকেরা আসতে যেতে আপনি আজ্ঞে করবে।
ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটা যে জীবনে বড় হওয়ার পাথেয় সেটা হীরু-চিনুদের বোঝার শুরু তখন থেকেই।
এবার নতুন মেশিনের ইন্সপেকশনে বার্লিন যাবেন চ্যাটার্জিবাবু, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বিমলকে। তার জন্য খুব দৌড়ঝাঁপ চলল কমাস। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে কার আর পাসপোর্ট থাকে? ওই একটি জিনিস বানানোর হ্যাপা কি কম? তারপর কী সঙ্গে নেবে কিংবা নেবে না; ওখানে গেলে কী খাবে; সবচেয়ে বড় কথা কী পরবে? বিমল একদিন কলকাতা গিয়ে একটা কোট কিনে নিয়ে এল। নীলের উপরে ছাইরঙের চেক চেক। পরে তাকে এত অন্যরকম লাগছিল। চিনুর তো ঘুরে ঘুরে দেখে আশ মেটে না। রূপা বলল, বাবা, তুমি রোজ কেন এমন পরো না, কী সুন্দর লাগছে। নীলিমা আঁচলটাকে দাঁতে চেপে ধরে হাসি চাপছিল। এবার বলল, মেয়েরা কি বিয়ের বেনারসি রোজ রোজ পড়ে নাকি? এও মনে কর তোদের বাবার বিয়ের বেনারসি। চিনুটা এখনও বাচ্চা, তাই বোকার মত বাবার আবার বিয়ে হবে নাকি বলায় কী হাসির রোল! বিমল তাড়াতাড়ি বাজে কথা চাপা দিতে দিতে বলল, দূর পাগলি, মেশিনপত্র নিয়ে কাজ, কালিঝুলির একশা। ওখানে কি এমন কিছু পরলে চলে? তারপর নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী গো তুমি বললে না তো, আমায় কেমন লাগছে?
–একেবারে পটের বাবুটি, দেখো ওখানে গিয়ে আবার কোনও মেমের দিকে বেশি তাকিও না, তাহলে একদম ভাল হবে না কিন্তু বলে দিলাম।
ছেলেমেয়ের সামনে এমন করে বলায় বিমল বিব্রত হয়ে একেবারে লজ্জায় লাল।
কিন্তু মজাও পাচ্ছিল। যাওয়ার দুদিন আগে নীলিমার মা, বাবা, বোন সবাই হাজির। জামাই বিলেত যাচ্ছে পনেরো দিনের জন্য, কোথায় কী খাবে কী না-খাবে, এক ঝুড়ি রান্না করে নিয়ে এসেছেন শাশুড়ি। চারদিকে উৎসবের ভাব।
ততদিনে প্লেনের টিকিট এসে গেছে। পাসপোর্টের ছবিতে কোট পরা বিমল। ঘন নীল রঙের পাসপোর্টটা দেখতে এত সুন্দর! তেমনি প্লেনের টিকিট দেওয়ার কায়দা। চকচকে কাগজের একটা তিনভাঁজের খাম, তার ভিতরে চারটে আলাদা আলাদা কাগজ, একেকবারের প্লেনের টিকিট। হীরু সেই পাসপোর্ট আর টিকিট নিয়ে কতবার যে হাত বুলিয়েছে আর মনে মনে প্লেনে করে জার্মানি উড়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
৪.
পরমেশ হাঁকডাক করতে করতে শানুর হাত ধরে বাড়ি ঢুকলেন। খুশির আওয়াজ বুঝে সুতপা হাঁফ ছাড়ল।
আজ সকাল থেকে ত্রাসেই ছিল সুতপা। কারণ আজ শানুর স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোবার দিন। ছেলের চেয়ে বাবার টেনশন বেশি। সেই কোন সকালবেলা ছেলের হাত ধরে স্টেশনে গিয়ে বসে আছে, কখন গেজেট আসবে। অত তাড়াতাড়ি আসে নাকি? সকালের প্রথম ট্রেন তো ব্ল্যাক ডায়মন্ড, ধুঁকতে ধুঁকতে সেই নটায়। তবু বাড়িতে সারাঘর পায়চারি করার চাইতে সেও ভাল। অন্তত সুতপার মাথার উপর দাপাদাপিটা কমে। তাছাড়া ওকে চোখের সামনে দেখে নিজের ভয়টা আরও বেড়ে যায়। শানু খারাপ রেজাল্ট করলে কী হবে? ফল মনোমত না হলে আজ বাড়িতে তুলকালাম হত নির্ঘাত। ছেলেটার কপালেও দুর্ভোগ বাঁধা। সেই ভয়েই সকাল থেকে কাঁটা হয়েছিল সুতপা।
এখন রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে খুশিতে ঝলমলিয়ে দৌড়ে বেরোল। পরমেশ যখন রাগ করে, বাড়িতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা না থাকলে রাগ আরও বেড়ে যায়। তেমনি খুশির সময় সকলকে নিয়ে আনন্দ করতে না পারলে তার শান্তি নেই।
–যা ভেবেছি তাই। মিষ্টির দোকানে আর কিছু কী বাকি রেখেছ?
সত্যিই পরমেশের হাতে রকমারি সাইজের মিষ্টির প্যাকেট, রসগোল্লার হাঁড়ি। কিছুই বাকি নেই।
–নতুন গুড়ের রসগোল্লা উঠেছে সবে সবে, শানুটা বড় ভালবাসে। ইচ্ছে তো করছিল সব নিয়ে আসি, ছেলেটা টেক্কা মেরে দিয়েছে আজ।
–বাবা, আজকে কিন্তু আমাকে ক্রিকেটের সেট কিনে দেবে, সেদিন বলেছিলে। সত্যিকারের ক্রিকেট গিয়ার।
শানু আন্দাজ বুঝে আব্দারটা মনে করাতে ভোলে না। গত এক বছর ধরে বলেছে, কিন্তু পরমেশ দেয়নি। এখন পড়ার চাপ খেলবি কী করে, ক্লাস টেনের রেজাল্টের পর দেব। মানে রেজাল্ট মনোমত হলে দেব।
–হবে, হবে— পরমেশের মুখে আজ প্রশ্রয়ের হাসি— কিন্তু এখন কী আর খেলার সময় পাবি?
–স্টার পেয়েছে?
পরমেশ খুব অবাক হয়ে তাকাল। মানে? স্টার তো সবাই পায় আজকাল। ৭৬০ পেয়েছে, বুঝতে পেরেছ? গতবারে দুর্গাপুরের হাইয়েস্ট ছিল ৭২৭। দুর্গাপুরের মধ্যে ফার্স্ট, সব স্কুল মিলিয়ে। সে তো হওয়ার কথাই ছিল। ও ফার্স্ট ছাড়া আবার কী হবে? তুমি কি ভাবছ আমি সেই জন্যে এত খুশি হয়েছি? ফার্স্ট হওয়াটা বড় কথা নয়, কীভাবে ফার্স্ট হয়েছে সেটা আসল কথা। পুরো দুর্গাপুরের এটা একটা রেকর্ড, স্কুল ফাইনাল চালু হবার পর কেউ এখান থেকে এত নম্বর পায়নি। সেকেন্ড যে হয়েছে সে শানুর ত্রিসীমানায় নেই। এখন দেখতে হবে স্টেট জুড়ে কী খবর। শুনছি বর্ধমান জেলায় ওই প্রথম, মনে হয় স্টেটেও প্রথম দশের মধ্যে এসে যেতে পারে। হাসি টগবগ করছিল পরমেশের সারা শরীরে।
–বা, এ তো দারুণ কথা। দেখেছ শুধু শুধু তুমি ছেলেটাকে এত বকো।
–বকি আমি এমনি এমনি নয়, ওর ভালর জন্যেই। হি হ্যাজ টু স্কেল দ্য হাইটস দ্যাট আই কুডন্ট। পারবে, পারবে ও। হি ইজ আ জিনিয়াস। আজ পরমেশের মুখে খই ফুটবে।
–এতসব ভেবে কী কাজ, ভগবানের কৃপা থাকলে সে-সবই হবে। এখন থেকে স্বপ্ন আকাশে তুলো না।
পরমেশ সেসব কথায় পাত্তাও দিল না। বরং সোৎসাহে যোগ করল, স্কুলের টিচারদের নাকেও কেমন ঝামা ঘষে দিয়েছে বলো। চার বছর আগে একটা ক্লাস উপরে করে দেওয়া হয়েছিল, কত আপত্তি ছিল তাতে? এখন, এখন কী হল? শানু প্রমাণ করে দিল তো সেই ডিশিসানটা কারেক্ট। এবার মুখে চাবি এঁটে বসে থাকুক ওরা।
আজকে সারাদিন পরমেশ খুব আনন্দে থাকবে। এখন ঘুরেঘুরে টুকটাক মুখ চালাবে, পুরনো দিনের গান শুনবে, চাই কি রান্নাঘরে ঢুকে সুতপাকে কোলে নিয়ে দুপাক দিলেও আশ্চর্য নয়। অনেকগুলো বছর তো হল বিয়ের, ওর সমস্ত নাড়ীনক্ষত্রই সুতপার নখদর্পণে। তাই জানে রাগ হলে কীভাবে সামলাতে হয়, আবার আনন্দের আতিশয্যের সময়েও বাড়াবাড়ির সীমারেখা তাকেই টানতে হয়। আনন্দের সময়টা পারলেও, রাগের সময় ওই দশাসই চেহারার মানুষটাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় সুতপাকে। রাগলে ও একটা দানব, দুহাতে সংসারটাকে তছনছ করতেও পেছপা হয় না। পরমেশের তুলানায় সুতপা অনেক শীর্ণ, তার ওপর অ্যাজমা থাকায় একটু উত্তেজনাতেই হাঁফ ধরে। যখন ওর রাগ সামলাতে পারে না, সুতপা ওই অসুখটাকেই হাতিয়ার করে। বেশি বেশি করে বুক চেপে শ্বাস নিতে থাকে। সংসারটাকে আগলে রাখার জন্য মেয়েদের যে কত কিছুই করতে হয়!
কিন্তু আজ শুধুই খুশির দিন। পাঁচ বছর আগে যখন পরমেশকে তার ইউএস ড্রিম ছেড়ে চলে আসতে হয়, তারপর এই প্রথম ওকে এত বেশি উচ্ছসিত হতে দেখল সুতপা। বিদেশে এতদিন পড়াল, কিন্তু টেনিওর পেল না। এদিকওদিক দিয়ে ওর বন্ধুদের একজন একজন করে পেয়ে গেল। কপাল! সেই সময়ে ভিতরে ভিতরে গুমড়াতে গুমড়াতে লোকটা যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই যখন বলল, আর না এবার দেশ ডাকছে, দেশে ফিরে কাজ করার মধ্যে যে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে তা পরের দেশে কোনওদিন হয় না ইত্যাদি, সুতপা আর দুবার ভাবেনি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তার নিজের জীবন ওখানে অনেক সুবিধের ছিল, একলা অনেক কিছু সহজে করে নেওয়া যেত। কিন্তু ঘরের মানুষটা আগে, নাকি ওই জীবনের বহিরঙ্গ আর ঘটাপটা? এককথায় নিজেকে উপড়ে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে সুতপা। কষ্ট যে হয়নি তা নয়। বিদেশে থাকতে যদি পরমেশের মাথা কোথাও নিচু হয়েছে, অন্তত দেশের চেনা-পরিজনদের কাছে সেটা আড়াল ছিল। এখন দেশে ফেরার পর তার নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে তাকেই ঠারঠোরে শুনতে হয়। বাইরের লোক কেন, নিজের ছোট বোন সুচিত্রা সেও কি বলতে ছাড়ে? বলে দিদি, দেশে ফিরে যদি ওই দু কামরার ঘরেই থাকবি তাহলে বিদেশ পড়ে ছিলি কেন এতদিন? এদেশে থেকে পরমেশদা নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারত। সুচিত্রার বরের আজ বিশাল কন্সালটেন্সি, গড়িয়াহাটের উপর বিশাল বাড়ি। তার ছেলে অংশু শানুর থেকে বড়, কানপুর আইআইটিতে পড়ছে। ঘুরিয়ে সেইসবই শোনায় আর কী। সুতপাও ছেড়ে থাকার পাত্র নাকি? বোনকে বলেছে জীবনটা তো দাঁড়িপাল্লা দিয়ে চাল-ডাল কেনাবেচা নয় রে। ওর নামে বেরোনো পেপার যখন বিদেশের জার্নালে ছাপতে দেখি, ওকে কনফারেন্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, তখন আমার মনে থাকে না এসব করে কত টাকা পেল। সম্মানটাই আমার কাছে বড় থাকে। এসবগুলো অবশ্য লুকিয়ে বলতে হয়, কেননা এর অনেক কথাই বাড়িয়ে বলা। যদি এত কাড়াকাড়ি পড়ে যেত, তাহলে কি আর টেনিওরটা পেত না? কিন্তু সুতপা বলতে ভালবাসে, ভাবতেও। তার দৃঢ় বিশ্বাস যদি পলিটিক্স করে সবাই ওকে পিছনে টেনে না রাখত, তাহলে পরমেশকে নিয়ে সত্যি টানাটানি হত। শানুর এই রেজাল্টটা অবশ্য কোনও রাখঢাক না রেখেই বলা যাবে। অংশুর থেকেও অনেক ভাল করেছে তার ছেলে।
এখানে কলেজে পরমেশ নাম করেছে। কিন্তু পরমেশের এক চিন্তা কীভাবে ছেলেকে সেইখানে পৌঁছে দেবে যেখানে সে শেষের দরজায় ঠোকর খেয়ে ফেরত এসেছে। শানুর মধ্যে সে ক্ষমতা আছে, আরও বেশি আছে। এখন শুধু তাতে ঠিকভাবে শান দেওয়ার কাজ।
–আচ্ছা তোদের শেষাদ্রি কত পেয়েছে মাকে বলে দে। আর অর্ণব।
ওরা শানুর ক্লাসের প্রথমদিককার ছেলে।
–শেষু অত ভাল করতে পারেনি, ৬৯৫। অর্ণব ৭১২।
–আর সেখানে শানু ৭৬০।
বারবার বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিল পরমেশ। রেজাল্ট শুনেই মহীতোষের মুখটা যদি দেখতে সুতপা। এই এতটুকু। আবার বলে কিনা এটা তো বোর্ডের পরীক্ষা দেওয়ার একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় শুধু, আসল পরীক্ষা তো পরেরটা। বুঝতে পারছ ওর বাতেলাটা?
মহীতোষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙের প্রফেসর, শেষাদ্রি ওর ছেলে। শানুর খারাপ লাগছিল শেষুর জন্য। ক্লাসে ওর সঙ্গেই একটু কাছাকাছি সে।
–বাবা, বন্ধুরা বলছিল টিচারদের সঙ্গে দেখা করতে স্কুলে যাবে। আমি যাই?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ যাবি তো। আজকে তো তোর দিন।
সুতপা রেগে গেল। যেখানেই যাও মুখে কিছু দিয়ে যাও। তাছাড়া এখন তো সবে দশটা, একটু বাদে গেলে ক্ষতি কী?
–না মা, সবাই বলেছে সাড়ে দশটায় স্কুলে পৌঁছাবে, আমি দেরি করে যাব না, খেতে দাও আমি চট করে খেয়ে নিচ্ছি না হয়।
স্কুলে পৌঁছে দেখল শানু দেখল ওর নিকনেম হয়ে গেছে সাতশোষাট শান্তায়ন। নিজের ক্লাসের ছেলেরা জনাকয়েক এসেছে। শেষাদ্রিকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যেতেই টেনথের ছেলেরা ঘিরে ধরল। সবার আগে অবশ্য হীরক। দারুন শানু, ফাটাফাটি। কয়েক দিনের জন্যে হলেও এদের অনেকের সঙ্গে এক ক্লাসে ছিল শানু। হীরকের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব রয়ে গেছে, অন্য সবার সঙ্গে সেটা নয়। তারা শানুদা শানুদা করে অস্থির এখন। শানু যে সেরকম পপুলার ছিল স্কুলে সেরকম তো নয়। কিন্তু সাফল্যের ছোঁয়া একটা আলাদা ব্যাপার। সে কতক্ষণ পড়ত, কিসের উপর নোটস বানিয়েছিল, স্কুলের বইয়ের বাইরে আর কোন বই পড়েছে এইসব প্রশ্নের ফুলঝুরি চলল কিছুক্ষণ।
নাইনের একটা ছেলে জিজ্ঞেশ করল, শানুদা, তুমি কি এবার স্ট্যান্ড করলে?
–মানে স্টেট র্যাঙ্ক? হাত উল্টাল শানু। কালকে পেপার এলে বুঝতে পারব।
–তুমি আমাদের স্কুলেই পড়বে তো?
–সেইরকমই তো ভাবছি।
শানু জানে ক্লাসের কেউ কেউ কলকাতায় চলে যাবে এবার। শেষাদ্রি নরেন্দ্রপুরে যাওয়ার কথা ভাবছিল। কিন্তু তাকে বাবা কোথাও যেতে দেবে না। সেটা জানা আছে। তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ধুর! ভাল রেজাল্ট করার জন্য কলকাতা কেন যেতে হবে, দুর্গাপুর কম কিসে?
এখন এরকম বলা যায়। চারপাশে ঘিরে থাকা ছেলেরা ওর সব কথা গিলছে এখন। আজকে শানু স্টার। বুক টানটান করে ঘোরার দিন। ঘুরতে ঘুরতে হীরকের সঙ্গে ওর পাড়ায় পৌঁছে গেছিল। এইরকম একটা দিনে শানুর চোখ খুঁজছিল রেখাকে। যদি নিজের বাড়ি থেকে উঁকি মারে!
শানুর স্বপ্নে এরকম একটা দিনের ছবি মাঝে মাঝে আঁকা হত। সেখানে চারদিকের ভিড়ের মধ্যে থেকে রেখা আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসত। রেখা যেন উদগ্রীব চোখে শানুকে এমনি নানান প্রশ্ন করছে, দেখতে দেখতে শুধু শানু এবং রেখা। আর কেউ কোথাও যেন নেই। শানু রেখার হাত ধরে চলে যাচ্ছে কোথাও, সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো মাথায় তৈরি করে কত সন্ধ্যা কেটে গেছে।
কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। ওদের পাড়ায় অনেকে দাঁড় করিয়ে রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করেছে। তার ভাল রেজাল্টের খবরটা সারা দুর্গাপুরে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু রেখার কাছে পৌঁছালেও তার কোনও আভাস নেই। রেখাকে দেখতে না পেয়ে একটু হতাশ হল শানু। জিজ্ঞেস করে ফেলল হীরককে। তোদের ওই রেখা মেয়েটাকে দেখছি না তো?
ফিক করে হাসল হীরক, কেন ভেবেছিলি তোর সব গুণমুগ্ধদের সঙ্গে এখানে ভিড় বাড়াবে?
–কোই পরোয়া নেই, মহম্মদ পর্বতের কাছে না এলে, পর্বত মহম্মদের কাছে যাবে। কোনও সঙ্কোচ না রেখেই ঘোষণা করল শানু।
–মানে?
চোখ টিপল শানু। ঠিক করেছি এবার রেখার বাবার কাছে ইংরাজি পড়তে যাব।
–শুধু রেখার সঙ্গে কথা বলার জন্য?
শানুর এরকম পরিকল্পনায় খুব অবাক লাগছিল হীরকের। মাঝে মাঝে দেখা হলে রেখার বিষয়ে জিজ্ঞেস করত টুকটাক, কিন্তু সেই টান যে এতটা গভীর কক্ষনও বুঝতে পারেনি তো। বুঝে যে তেমন ভাল লাগল সেটাও নয়।
–না, শুধু সেজন্য কেন? রতনবাবু তো গভর্নমেন্ট কলেজের ইংরাজির প্রফেসর। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। শানুর মুখে বেপরোয়া হাসি।
–তুই কেন মনে করছিস রেখা তোকে পাত্তা দেবে? হীরক শানুকে দমানোর চেষ্টা করল। ভাল রেজাল্ট করেছে মানেই তো কোনও খাঞ্জা খাঁ হয়ে যায়নি।
–এতদিন দেয়নি, এবার দিতে পারে।
খুকখুক করে হাসল শানু। নিজেকে একটু বড় বড় লাগছে এখন। হীরককে বাচ্চা। স্বপনের ট্রেনিঙে শানু এখন মেয়েদের নাড়িনক্ষত্র অনেক কিছু জানে। আগেকার মুখচোরা শানু আর নেই। স্বপন কথায় কথায় বলে, নিজের দাপে থাকবি, ঝিনচ্যাক মাল পেলে কোনও চাঁইচুকুর নেই। রোয়াব নিয়ে কথা বলবি, লাট্টু হয়ে যাবে।
হীরকের কাঁধে হাত রাখল শানু। শানুর হাতের চাপে আজ অনেক বেশি জোর, এক্ষুনি রেসে জিতে আসা ঘোড়ার মত পা ঠোকা তেজ। দরকার হলে তুই হেল্প করবি না?
সফল হওয়াটা খুব দরকার। শানুকে দেখে মনে হল হীরকের। ওর স্কুল ফাইনাল আর ন-মাস বাদে। জোরতোড় করে লাগতে হবে। জীবনের অনেক পাওনা আদায়ের জন্য এইসব দৌড়ে জেতা খুব দরকার।
[আবার আগামী সংখ্যায়]