Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বো-ক্যি-সেম-ম্যে-ঢুং-তাম: তিব্বতের আহত হৃদয়ের কাহিনি

পার্থপ্রতিম মণ্ডল  

 



ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

ঠিক কী কারণে তিব্বতি ভাষা শেখা শুরু করেছিলাম জানি না। বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ থেকে ইচ্ছেটার জন্ম হয়েছিল, তবে সে কথা এখন জোর দিয়ে বলা উচিত হবে না। কেননা, এসব নিয়ে যতটুকু জেনেছি তা প্রায় সবই পাশ্চাত্য পণ্ডিত আর লেখকদের বই পড়ে। প্রধানত, ইংরেজিতে। সেসব বই এখনও যা পড়া বাকি আছে তা এই জীবনে শেষ করতে পারব কি না, জানি না। কাজেই বিশেষ গবেষণা-সংক্রান্ত কোনও প্রয়োজন না-থাকলে নতুন করে কোনও মূল ভাষা শিখতে শুরু করার তেমন কারণ নেই। এবং বলাই বাহুল্য আমি গবেষক নই, খুব বেশি পড়াশোনাও করি না। নিজের মাতৃভাষা ও ইংরেজি বাদ দিলে আর যে ভাষাটা অল্পবিস্তর জানি তা হল ফরাসি। ফরাসি শেখার শুরু অনেক বছর আগে, ছাত্রাবস্থায়। সেই শেখাটাকেই এত বছর ধরে টেনে নিয়ে চলেছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, হঠাৎ তিব্বতি কেন?

প্রশ্নটা নিয়ে এত ভণিতার একটাই কারণ। তা হল, পরিচিত মহলে যখনই কেউ শোনেন, আমি তিব্বতি শিখছি তখন এই একটাই প্রশ্ন সবাই ছুড়ে দেন। কেন? তিব্বতি শিখছি কেন? তাই বলে রাখা, এ প্রশ্নের সদুত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু শিখতে গিয়ে অপার বিস্ময়ে যা খুঁজে পেলাম, সেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কথাগুলো বলাই এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।

ব্যাপারটা এই রকম: তিব্বতি ভাষার দুটো স্পষ্ট আলাদা ধারা আছে। এক তো হল, তিব্বতি ধর্মীয় বইপত্র যে ভাষায় লেখা— সেই ক্লাসিকাল তিব্বতি ভাষা। আর হল, তিব্বতের ভিন্ন প্রদেশে কিংবা অন্য দেশে নির্বাসিত তিব্বতি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। খুব সম্প্রতি তিব্বতি শেখার ও শেখানোর যেটুকু বন্দোবস্ত ইন্টারনেটে বা ব্যক্তিগত শিক্ষকের সহযোগিতায় পাওয়া যায়, তা প্রধানত ওই আধুনিক কথ্য ভাষাটিরই। তা ছাড়া ধর্মীয় বইপত্র পড়ার জন্যে যে ভাষা জানা দরকার তা দীর্ঘ অধ্যবসায় ও যথাযথ পরিমণ্ডল দাবি করে। বিষয়টা তাই আজকের ব্যবহৃত তিব্বতি ভাষাকে নিয়ে।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় কি যে, পঞ্চাশের দশকের পর থেকে সাম্প্রতিক তিব্বতের ইতিহাস তো অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পথ পার হয়ে এসেছে। তা হলে এই ভাষার আধুনিক সাহিত্যের ছবিটা ঠিক কী রকম! ‘টিবেটান লিটরেচার’ বলতে এতদিন তো শুধু ‘রিলিজিয়াস লিটরেচার’-এর কথাই বুঝে এসেছি। এর বাইরে এত ঐতিহাসিক ঘটনাসমৃদ্ধ একটা ভূখণ্ডে লেখালেখি বলতে কি আর কিছুই হয়নি? এসব নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে যা দৃষ্টিগোচর হল তা এক অজানা, অনাবিষ্কৃত অঞ্চল। অন্তত আমাদের এই এপার বাংলায়। বাংলা অনুবাদসাহিত্য আজ অনেকখানি সমৃদ্ধ বলে যদি ধরেও নিই, সেখানে এই তিব্বতি সাহিত্যের যে কোনও স্থান নেই তা বলাই বাহুল্য। অথচ ১৯৫১-য় সাবেক তিব্বতের বিলুপ্তি, চিনের সামরিক দখল, বিশেষ করে ১৯৫৯-এ অভ্যুত্থানের পর থেকে যে আধুনিক তিব্বতি সাহিত্যের জন্ম হয়েছে, সমসাময়িক লেখকদের কলমে লেখা হয়েছে যে গল্প, কবিতা তা কিন্তু কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। কেন যে আমরা এই জায়গাটি নিয়ে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করিনি, জানি না।

অবশ্য আমি এখানে যে লেখালেখির কথা বলছি তাকে কেবলমাত্র তিব্বতি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিলে কিছুটা ভুল হবে। কেননা দৃশ্যতই এইসব লেখালেখি চলছে তিনটি পৃথক ধারায়। আধুনিক তিব্বতি সাহিত্য বললে আমাদের বুঝতে হবে— এক, তিব্বতি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সাহিত্য; দুই, যেসব তিব্বতি লেখক চিনা ভাষায সাহিত্য রচনা করছেন তাঁদের সাহিত্য; ও তিন, দেশের বাইরে বসবাসকারী টিবেটান ডায়াসপোরা-র কলমে উঠে আসা তিব্বতি সাহিত্য। তৃতীয় এই ধারাটি, বুঝতে হবে, তিব্বতি ছাড়াও ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় লেখা তিব্বতি মানুষজন ও ভূখণ্ডের কথা। তিব্বতি ভাষা প্রতিবন্ধক বলে যদি ধরেও নিই, বাকি দুই ধারার বাংলা অনুবাদ কেন কোথাও চোখে পড়ে না তার কারণ বুঝতে পারি না।

তৃতীয় এই ধারাটি, অর্থাৎ তিব্বতি ডায়াসপোরা সম্পর্কে দু-একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। অনেক আলোচনাতেই চোখে পড়ে যে এই ডায়াসপোরা সাহিত্যের শুরু ১৯৫৯-এর পর থেকে, অর্থাৎ তিব্বত থেকে উদ্বাস্তুরা যখন থেকে বিশাল সংখ্যায় এদেশে বসবাস করা শুরু করল সেই সময় থেকে। কিন্তু না, প্রকৃত অর্থে ডায়াসপোরা সাহিত্যের শুরু তার অনেক পরে। উদ্বাস্তুরা যখন ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণ শুরু করে তখন তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় আশি হাজার। তারা ছড়িয়ে ছিল ভারতের নানা প্রান্তে, মূলত দুর্গম অরণ্য ও পার্বত্য প্রদেশে। ভেবে দেখুন, একে তো বিশ্বের অন্যতম শীতলতম দেশ থেকে এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে আশ্রয়গ্রহণ, তার উপরে বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপকরণগুলিও নেই। এমনকি, এই গরম দেশে সুস্থ থাকার স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কেও তাদের কোনও ধারণা নেই। স্বাভাবিকভাবেই রোগভোগ আর মৃত্যু ছিল তাদের জীবনের অঙ্গ। এমন অবস্থায় তারা সাহিত্য রচনার কাজে মনোনিবেশ করবেন একথা ভাবা বাতুলতা। তাছাড়া আগত উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত, নিরক্ষর। হাতেগোনা কয়েকজন লামা ও অভিজাত শ্রেণির লোক বাদ দিলে বাকিরা কেউ লিখতে বা পড়তে জানত না।

প্রথমদিককার ডায়াসপোরা সাহিত্য তাই ছিল ধর্মীয় চরিত্রের। উদ্বাস্তু জীবন একটুখানি স্থিতিশীল হলে তারা প্রথম যে কাজটি শুরু করেন তা হল ধর্মীয় লেখালেখির কাজে নতুন করে হাত দেওয়া। সেকুলার লিটেরেচার বলতে আমরা যা বুঝি তার শুরু আরও বেশ কয়েক দশক পরে, মোটামুটিভাবে আটের দশকে। এই নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই মাতৃভাষার জ্ঞান ছিল আবার অত্যন্ত সীমিত। এর একটা মস্ত বড় কারণ এই যে, পরবর্তীকালে যে এক লক্ষ চল্লিশ হাজারের মতো তিব্বতি উদ্বাস্তু এদেশে বাস করা শুরু করে তারা ছড়িয়ে ছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। তিব্বতি শেখার তেমন কোনও সুযোগই তাদের ছিল না। মাতৃভাষার পরিবর্তে তারা ভারতীয় কোনও ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের দেশভূমি থেকে বহিস্কৃত এই মানুষজনের কাছে জীবিকার প্রয়োজনে মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজি শেখা অনেক দরকারি বলে মনে হয়েছে। এই ছবিটা শুধু ভারতেই। আমেরিকা, যেখানে নয়ের দশকে প্রায় দশ হাজার তিব্বতি পাড়ি দিয়েছেন তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। উদ্বাস্তুদের ছবিটা কাজেই চিন-অধিগৃহীত তিব্বতের অধিবাসীদের ছবির মতোই। সেখানেও কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে তিব্বতি নয়, চিনা ভাষা শেখাটাই এখন জরুরি।

ভারতের মাটিতে জন্মানো তিব্বতি নতুন প্রজন্মের কাছে  স্বদেশের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই তাই নেই। ধ্রুপদী তিব্বতি সাহিত্যে বা তিব্বতি লোককথায় বর্ণিত বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, বন্ধুর পাহাড়পর্বত, তুষারঢাকা চূড়া তাদের অভিজ্ঞতার বাইরে। সাম্প্রতিককালের লেখকদের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম বোধহয় পেমা সেওয়াং শাস্ত্রি। ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘নুব-ক্যি-ডাং-রে-দং-শার-গ্যি-ডো-যাম’ (ནུབ་ཀྱི་གྲང་ཪེག་དང་ཤཪ་གྱི་དྲོད་འཇམ།) অর্থাৎ ‘হিমেল পশ্চিম ও তপ্ত পূর্ব’ এক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বইটি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিব্বতি উদ্বাস্তু জীবনের মূল্যবান দলিল। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস “মি-ৎছ্য-ডোওয়া-ঞার-ক্যুর” (མི་ཚེའི་བྲོ་བ་མངར་སྐྱུར།) বা ‘অম্ল মধুর জীবনের স্বাদ’-এর কাহিনি লোঝাং নামে এক চরিত্রকে নিয়ে যার জন্ম তিব্বতে কালচারাল রেভল্যুশনের সময়। চিনাদের হাতে যার মা-বাবা নিহত হয়। অনাথ অবস্থায় চোরাপথে একদিন সে ভারতে এসে হাজির হয়। কালিম্পং-এর এক তিব্বতি স্কুলে ভর্তি হয়। লোঝাং-এর শৈশব, স্কুলজীবন, লুকিয়ে তিব্বতে তার আত্মীয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, এইসব নিয়েই কাহিনি আবর্তিত হয়। পেমা সেওয়াং কবিতাও লেখেন। খুব সম্প্রতি তিব্বতি ডায়াসপোরায় যে নতুন সাহিত্যধারার জন্ম হয়েছে পেমা তার উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি।

শুধু পেমা সেওয়াং নন, সম্প্রতি তাঁর মতো আরও অনেকেই এই ধারাকে সমৃদ্ধ করতে উঠে এসেছেন। বেশ কিছু পত্রপত্রিকারও জন্ম হয়েছে। আটের দশকের গোড়ার দিকে নতুন একদল তরুণ তরুণী ভারতের মাটিতে পা দেন। চিন অধিগৃহীত তিব্বতের পরাধীন জীবনের চেয়ে ভারত বা নেপালে আশ্রিত জীবন তাদের কাছে অধিকতর কাম্য বলে মনে হয়। নতুন এই উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ তাদের ফেলে আসা বাসভূমিতে ইতিমধ্যেই এক নতুন সাহিত্যের উন্মেষ দেখে এসেছে। তারা ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছে ধোনডুব গ্যেল (དོན་གྲུབ་རྒྱལ།)-র মতো লেখকের রচনার আঙ্গিকের সঙ্গে, ডাং-ছার (སྦྲང་ཆར།)-এর মতো পত্রিকার সঙ্গে। এখানে এসে তারা প্রথম যেটার অভাব বোধ করল তা হল এই নতুন ঘরানার সাহিত্যের। কেননা এখানে তখনও তিব্বতি সাহিত্য বলতে, ধরমশালার ‘লাইব্ররি অফ টিবেটান ওয়ার্কস অ্যান্ড আর্কাইভ’ ও ‘কালচারাল প্রিন্টিং প্রেস’-এর কিছু হাতে লেখা পুথি কিংবা বেনারসের ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ হায়ার টিবেটান স্টাডিজ’-এর ধর্ম ও ইতিহাসের বইপত্রগুলিকেই বোঝানো হয়ে থাকে। অথচ, নব্য এই প্রজন্মের অনেকেই এদেশে এসে হাজির হয়েছিল স্বাধীন লেখালেখির ইচ্ছেকে বুকে নিয়ে, তাদের হারিয়ে যাওয়া বাকস্বাধীনতাকে ফিরে পেতে। এদেরই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে প্রকাশিত হয় ‘মাং-ৎসো’ (དམངས་གཙོ), অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র’ বা ‘যাং-সোন’ (ལྗང་གཞོན།) বা বাংলায় বললে ‘নবাঙ্কুর’। বিদেশের মাটিতে আধুনিক তিব্বতি সাহিত্যের এটাকেই সূচনাপর্ব বলা যেতে পারে।

তবে ডায়াসপোরা সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি। ইংরেজি বইপত্রের বেশকিছু খুবই সহজলভ্য। পাঠকরা চাইলে পড়ে দেখতেই পারেন। সম্প্রতি হাতে এসেছে স্রিং ওয়াংমো ধোম্পার ‘আ হোম ইন টিবেট’। ‘রুলস অফ দ্য হাউস’ তার বিখ্যাত কবিতার বই। ইংরজি ভাষার আরও এক উল্লেখযোগ্য তিব্বতি লেখক তেনজিন সুনদ্যু। তেনজিন শুধু কবিই নন, অ্যাক্টিভিস্টও। স্রিং ওয়াংমো, তেনজিনের মতো লেখকের লেখা থেকেও স্বদেশভূমি থেকে নির্বাসিত মানুষের যন্ত্রণার কথা সমভাবে প্রকাশিত।

কিন্তু এ তো গেল ডায়াসপোরা সাহিত্যের কথা। তিব্বতের মূল ভূখণ্ডের ছবিটা তাহলে এখন কেমন? সাধারণভাবে মনে করে নেওয়া হয় যে তিব্বতি আধুনিক সাহিত্যের সূচনা চিনের কম্যুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। অর্থাৎ গনপ্রজাতন্ত্রী চিনের অধীনস্থ তিব্বতি ভাষাপ্রধান অঞ্চলগুলি থেকেই এর সূত্রপাত। তিব্বতি আধুনিক সাহিত্য নিয়ে সম্প্রতি যেসব লেখাজোকা পড়েছি তাতে এমনটাই লক্ষ করেছি। একথা অনস্বীকার্য যে তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তিব্বতের পরিচয় চিনের অধিগ্রহণের হাত ধরেই। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, বস্তুবাদী মতাদর্শ, বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে তার মেলবন্ধন, এসবের পিছনে চিনের অবদান প্রধান। ঠিক যেমনটা সমস্ত ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রেই বলা হয় আর কি! চিনই প্রথম তিব্বতকে সভ্যতার আলোকে আলোকিত করে! যদিও ‘অনুন্নত’— তিব্বতি ভাষায় যাকে বলে ‘যে-লু’ (རྗེས་ལུས་)— বলতে ঠিক কী বোঝায় সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে তিব্বত কতখানি চিনের অংশ ছিল সেই অত্যন্ত বিতর্কিত প্রশ্নে না গিয়েও এটা বলা যায় যে, চিন তিব্বতে শুধু তাদের ভূখণ্ড কায়েম করতেই আসেনি। সেইসঙ্গে তারা এসেছিল এখানকার অধিবাসীদের মানসিক গঠনকেই আমূল বদলে দিতে। অন্যান্য ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষেত্রে যেটা হয়নি, তা হল তাদের কিন্তু অধীনস্থ দেশগুলোর ঐতিহ্যগত বা চিরাচরিত মতাদর্শকে বদলে দেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তিব্বতের ক্ষেত্রে কম্যুনিস্টরা কিন্তু সেটাই করেছিল। সেখানকার পরম্পরাগত সামাজিক ও মতাদর্শগত সিস্টেমটাকেই তারা বদলে দিতে চেয়েছিল।

রাজনৈতিক আলোচনা এ রচনার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তিব্বতি ভাষায় যেসব লেখালেখি হয়েছে বা হচ্ছে তা বুঝতে গেলে এটুকু জানা প্রয়োজন। নতুন মতাদর্শ প্রচারের জন্য চিনকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে তিব্বতি ভাষার আর নির্ভর করতে হয়েছে সেখানকার শিক্ষিত, তথাকথিত ‘অভিজাত’ শ্রেণিভুক্ত মানুষের উপর। সাবেক ভাষায় তাদের রদবদলও আনতে হয়েছে অনেক। প্রাচীন তিব্বতি শব্দভাণ্ডারে ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ ‘শোষন’, ‘গণমুক্তি’, ‘গণতন্ত্র’ এসব শব্দের কস্মিনকালে কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এইসব শব্দের তিব্বতি পরিভাষা তৈরি করার দায়িত্ব বর্তেছে ওই শিক্ষিত, অভিজাত লেখককুলের উপর। বলাই বাহুল্য চিনের শাসন কায়েম হওয়ার পর প্রথমদিকে তিব্বতে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে তা ছিল মূলত প্রচারমূলক, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রোপাগান্ডা লিটেরেচার’, ঠিক তাই। আর এইসব লেখালেখির অনেকটাই ছিল পার্টির প্রচারপুস্তিকার অনুবাদ বা এইধরনের বইপত্র। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬, কালচারাল রেভল্যুশনের এই সময়ে স্বতন্ত্র তিব্বতি সত্তার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ‘Destruction of the Four Olds’-এই স্লোগানের আওতায় তিব্বতের চিরাচরিত সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আক্রমণ হানা হয়েছিল।

পরিস্থিতি কিছুটা বদলায় মাও-র মৃত্যুর পর, দেং জিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে নতুন শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার পর। নতুন শাসনে লেখক-সাহিত্যিকদের প্রতি পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন ঘটে। সরাসরি আত্মীকরণের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক স্বশাসনের একটা নীতি গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৮-এ একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্লেনাম-এ তিব্বতের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তার বিষয়টি অনেকাংশে মেনে নেওয়া হয়। এই ১৯৭৮-কেই আমরা বলতে পারি আধুনিক তিব্বতি সাহিত্যের জন্মসাল। প্রায় কুড়ি বছর নিরুদ্ধ থাকার পর তিব্বতি বৌদ্ধধর্মও কিছুটা মাথা তুলে দাঁড়ায়।

এই সময়কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ঠিক এক পরের বছর। লাসার একদল তরুণ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে একখানি পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি চেয়ে। অনুমতি মিলেও যায়। প্রকাশিত হয় ‘বো-ক্যি-ৎচোম-রি-গ্যু-ৎচাল’ (བོད་ཀྱི་རྩོམ་རིག་སྒྱུ་རྩལ།) বা ‘তিব্বতি শিল্প ও সাহিত্য’ নামের পত্রিকাটি। এই ‘তিব্বতি শিল্প ও সাহিত্য’ এবং তিব্বতের আমদো প্রদেশ থেকে প্রকাশিত ‘ডাং-ছার’ (སྦྲང་ཆར་), বাংলায় ‘কোমল ধারাপাত’ পত্রিকাদুটির প্রকাশ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয় এই পত্রিকাটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

এমন নয় যে পত্রিকাদুটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিব্বতি লেখকরা রাতারাতি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলল। মতপ্রকাশের বিষয়ে আংশিক স্বাধীনতা কর্তৃপক্ষের কৌশলেরই অঙ্গ ছিল। প্রথমত, পূর্বতন জমানার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভুলকে স্বীকার করে নিয়ে উদারিকরণের নীতিকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করা। দ্বিতীয়ত, তিব্বতি জনগনের আস্থা অর্জন করা। কিন্তু চিনের অধিগ্রহণের ফলে তিব্বত যে এক মধ্যযুগীয়, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে সেকথা প্রচার করা হতেই থাকল। ‘তিব্বতি শিল্প ও সাহিত্য’-র প্রথম ইস্যুতে প্রকাশিত হয় তিনটি গল্প। আর এক উপন্যাসের অংশ। সবকটি লেখাই আগে প্রকাশিত, সবকটি লেখাই লেখা হয়েছিল চিনা ভাষায় এবং সবকটি লেখাই তিব্বতিদের রচনা। সবকটি লেখারই মূল প্রতিপাদ্য এক অন্ধকার যুগের হাত থেকে মুক্তিফৌজের হাতে তিব্বতের মুক্তি। প্রথম ইস্যুতেই ‘তিব্বতি শিল্প ও সাহিত্য’ আমাদের এক জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তা হল: তিব্বতি সাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝব? কেবলমাত্র তিব্বতি ভাষায় লেখা যে সাহিত্য সেটি, নাকি যে সাহিত্যের লেখক জন্মগতভাবে তিব্বতি সেটি, নাকি যে সাহিত্যের বিষয়বস্তু তিব্বতি সেটি? ‘ডাং-ছার (སྦྲང་ཆར་) যদিও প্রথম থেকেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিল। তিব্বতি সাহিত্য বলতে তারা বুঝবে শুধুমাত্র সেই সাহিত্যকে যা তিব্বতি ভাষায় লেখা। ‘রা-মা-লুগ’ (ར་མ་ལུག་) ‘না ছাগল, না ভেড়া’। ‘ডাং ছার’ যদি চিনা গল্পের তিব্বতি অনুবাদ প্রকাশ করে তাহলে তা হবে তাই। এটাই ছিল এক পাঠকের প্রতিক্রিয়া।

তবে মূলত যে কারণে এই পত্রিকাদুটির প্রকাশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এক নতুন ধারার সাহিত্য, যে সাহিত্যের সঙ্গে তিব্বতের এর আগে কোনও পরিচয়ই ছিল না, তার জন্ম হল এই দুই পত্রিকার হাত ধরে। বড় ব্যাপার যেটা ঘটল তা হল, এক নতুন তিব্বতি লেখ্য ভাষার জন্ম। আধুনিক সময়কে নিয়ে, আধুনিক বিষয়কে নিয়ে লেখার মতো এক উপযোগী ভাষা। কিছুদিন আগেও যে ভাষার অস্তিত্ব ছিল না।

সাম্প্রতিক অনেক গল্পের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা এ আলোচনার দৈর্ঘ্য আরও বাড়িয়ে তুলবে। শুধু এটুকুই বলার, বাংলায় এসব গল্প অনূদিত হওয়া খুব জরুরি। বাঙালি পাঠক এক সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত লেখার স্বাদ পাবেন হলফ করে বলা যায়। নতুন ভাষার জন্মের এই বিষয়টিকে বোঝার জন্যে এখানে শুধু দুটি উপন্যাসের কথা বলব।  এর মধ্যে প্রথমটিকে উপন্যাস বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। আঠারো শতকে লেখা, লেখক দোখার স্রিং ওয়াংগ্যেল। ‘শোন-নু-ডা-মে-ক্যি-তাম-গ্যু’ (གཞོན་ནུ་ཟླ་མེད་ཀྱི་གཏམ་རྒྱུད།), বাংলায় বললে ‘অপ্রতিম যুবকের কাহিনি’-কে অভিহিত করা হয় তিব্বতি ভাষার প্রথম উপন্যাস বলে। দ্বিতীয় বইটি ‘ইয়েসে-লামো-দং-গারওয়া-তোগ্যাল’ (ཡེ་ཤེས་ལྷ་མོ་དང་མགར་བ་སྟོབས་རྒྱལ།) বা বাংলায় ‘ইয়েসে লামো ও কর্মকার তোগ্যাল’। প্রথম বইটি লেখা হয়েছে, ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি রোমান্স, সেই ঢঙে, কবিতা ও গদ্য দুই-ই ব্যবহৃত হয়েছে কাহিনির বর্ণনে। দ্বিতীয় উপন্যাসটি লেখা হয়েছে বিশ শতকে অধিগ্রহণ পরবর্তী সময়ে। লেখক দোর্জে গ্যেলপো। নতুন মতাদর্শ, নতুন সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বিষয়বস্তু সামঞ্জস্যপূর্ণ  হওয়ার এই উপন্যাস অনেক বেশি সমাদৃত। তবু প্রথম কাহিনির মতোই এই উপন্যাসও তিব্বতের প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদিও গেসার-এর মতো মহাকাব্য নয়, ‘ইয়েসে লামো ও কর্মকার তোগ্যাল’-র পিছনে মূল অনুপ্রেরণা সুপ্রাচীন তিব্বতি লোককথা। আমরা যাকে নতুন ভাষা বলছি, তাকে জানতে হলে আমাদের এই দ্বিতীয় বইটি বেছে নিতে হবে।

১৯৮৫-র পর থেকে তিব্বতি ছোটগল্পে এক নতুন বিষয় লক্ষণীয় হল। তবে সেটাও যে নয়া উদারিকরণের নীতিরই ফলশ্রুতি তা একপ্রকার বোঝাই যায়। পার্টির নতুন নেতৃত্বের লক্ষ্যই ছিল, ‘গ্যাং অফ ফোর’-এর যাবতীয় অপরাধকে প্রকাশ্যে আনা, আর সেই সঙ্গে নয়া উদারিকরণের সুফলকে তুলে ধরা। আধুনিক গল্পকাররা এই প্রথম তাদের গল্পে চিনের তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ অধিগ্রহণ’-এর যন্ত্রণার কথা প্রকাশ্যে বলার সুযোগ পেলেন। ‘বো-ক্যি-সেম-ম্যে-ঢুং-তাম’ (བོད་ཀྱི་སེམས་རྨའི་སྒྲུང་གཏམ།), ‘তিব্বতের আহত হৃদয়ের কাহিনি’— এই ভাষাতেই চিহ্নিত করা হয় এই নতুন ধারাটিকে।

দীর্ঘদিনের চেপে রাখা ব্যথা, যন্ত্রণা, অনুভূতি স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করার ছাড়পত্র যখন মিলল তখন লেখকদের মধ্যে আরেক বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিল। নতুন এই মুক্ত পরিস্থিতিতে তাদের সর্বপ্রথম করণীয় কী? যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকে পুনরুদ্ধার করাটাই কি এই মুহূর্তের প্রথম কাজ? লেখকদের মধ্যে যারা ঐতিহ্যবাদী তাদের মনে হল, যে সমস্ত পুঁথিপত্র, মূল্যবান দার্শনিক গ্রন্থ বিগত বছরগুলিতে নষ্ট হয়ে গেছে, যেসব কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে সেগুলি উদ্ধার করাই এমুহূর্তের প্রধান কাজ। বস্তুতপক্ষে, ১৯৮৫-র পর আমরা তিব্বতি প্রকাশনা জগতে এধরনের বেশ কিছু কাজ দেখলাম। কিন্তু অন্যদিকে যারা বয়সে তরুণ তাদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছিল। তা হল, তিব্বতকে যে চিন এত সহজেই পদানত করতে পেরেছে তার পিছনে চিনের সামরিক শক্তিই একমাত্র কারণ নয়। তিব্বতের অনুন্নত সমাজ, পরিবর্তনকে গ্রহণ করার তার অক্ষমতা এর পিছনে এক মস্ত বড় কারণ। তাই দরকার নতুন সাহিত্যের।

প্রসঙ্গত, খ্যতনামা তিব্বতি লেখক পেমা ভুম ১৯৯১ সালে ইতালিতে ‘তিব্বতি ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা স্মরণযোগ্য। আমি Ronald Schwartz কৃত সে আলোচনার ইংরেজি অনুবাদ, “Heartbeat of a New Generation: A Discussion of the New Poetry” প্রবন্ধটি পড়েছি। পেমা ভুম দুটি কথা বলেছেন। প্রথমত, সমস্ত তিব্বতি, তা সে তিব্বতের অভ্যন্তরেই হোক বা বাইরে, একটি সাধারণ আবেগের অংশীদার। তা হল, তাদের মাতৃভূমির লুণ্ঠনকারীদের প্রতি আর তাদের পিতামাতাদের হত্যাকারীদের প্রতি এক তীব্র জাতক্রোধ। তিব্বতের অভ্যন্তরে বসবাসকারী মানুষের কাছে এই ক্রোধের তীব্রতা আরও বেশি। বাইরে যারা আছেন তারা তবু এই ক্রোধের কথা চিৎকার করে বলতে পারেন, কিন্তু তিব্বতের অভ্যন্তরে যারা রয়েছেন তাদের এই ক্রোধ নিঃশব্দে পুষে রাখতে হয়। উপরন্তু আনুগত্য দেখাতে হয় সেই অত্যাচারীদের প্রতিই। দ্বিতীয় বিষয়টি হল, তিব্বতিদের উপর যে দুটি মতবাদ সবচেয়ে প্রবলভাবে কাজ করেছে তার স্বরূপ। এই দুই মতবাদের একটি হল বৌদ্ধধর্ম, অন্যটি কম্যুনিজম।

কম্যুনিজম ভালো কি মন্দ প্রশ্ন সেটা নয়। যে প্রশ্ন তারা তুলে ধরল তা হল, এই কম্যুনিজমকে কিন্তু তিব্বতের মাটিতে নিয়ে এসেছিল মিলিটারি শক্তি। কম্যুনিজমের মতাদর্শকে তিব্বতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেই মিলিটারি শক্তিকে অনেক রক্তপাত করতে হয়েছে। মৃতদেহের পাহাড় জমিয়ে তুলতে হয়েছে। সমসাময়িক লেখকরা মনে রেখেছেন কীভাবে সুপ্রাচীন তিব্বতি সংস্কৃতির উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। তিব্বতি পণ্ডিতদের হত্যা করা হয়েছে। মূল্যবান পুঁথিপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তিব্বতিদের মননে, কম্যুনিজমের মতাদর্শ তাই যাবতীয় ধ্বংস, হত্যা আর অবিচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

অন্যদিকে, যে বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাস ও দর্শন তাদের এতকাল একমাত্র অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে তার ভিতও তাদের মননে অনেকখানি টলে গেল। এই টলে যাওয়ার কারণটিও যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। তিব্বতের মানুষ এতকাল বিশ্বাস করে এসেছে বৌদ্ধধর্মই তাদের একমাত্র রক্ষাকর্তা। তাদের ভাগ্যাকাশে যে বিপদই নেমে আসুক না কেন, বৌদ্ধধর্ম তাদের ঠিক নিরাপত্তা দেবে। সম্প্রতি মধু গুরুং-এর Tibet With My Eyes Closed গল্পসঙ্কলনে Sixty Three নামের একটি গল্পে পড়েছি, সশস্ত্র চিনা সৈন্যদের প্রতিরোধ করতে তিব্বতের সাধারণ মানুষ কীভাবে শুধুমাত্র এই বিশ্বাসকে ভরসা করে পথে নেমেছিল।

পাশাপাশি তারা এতকাল এটাও বিশ্বাস করে এসেছে যে, তাদের বেঁচে থাকার উপরে নির্ভর করছে বৌদ্ধধর্মের টিকে থাকাও। চিনের সফল অধিগ্রহণের পর তাদের মনে হল, বৌদ্ধধর্ম শুধু তাদের নয়, নিজেকে রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কম্যুনিস্ট বা বৌদ্ধ কোনও মতাদর্শই নয়, তারা মনে করল, তিব্বতকে বেঁচে থাকতে হলে খুঁজে নিতে হবে নতুন পথ, নতুন ভাষা। তিব্বতের নতুন লেখকদের কাছে এটাই হয়ে উঠল প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তাদের মনে যেমন একদিকে এক শূন্যতার সৃষ্টি করল, অন্যদিকে তেমনি তাদের এতদিনের খাঁচায় বন্দি মনকে মুক্তও করল।

নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে যাঁর লেখায় এই চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল তিনি তিব্বতি ভাষার এই সময়কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক ধোনডুপ গ্যেল (དོན་གྲུབ་རྒྱལ་) (১৯৫৩-১৯৮৫)। আধুনিক তিব্বতি সাহিত্য নিয়ে কোনও আলোচনাই ধোনডুপ গ্যেলকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হবে না। এই ধোনডুপ গ্যেলকে বলা হয় আধুনিক তিব্বতি সাহিত্যের জনক। তার এক বিখ্যাত কবিতার নাম তিব্বতিতে ལང་ཚོའི་རྦབ་ཆུ, ইংরেজিতে Waterfall of Youth। যারা কবিতাটি পড়তে চান তারা এই নামে গুগলে সার্চ করলে সহজেই কবিতাটি পেয়ে যাবেন। কবিতায় ধোনডুপ তিব্বতের নতুন প্রজন্মকে তুলনা করেছেন জলপ্রপাতের সঙ্গে। বলেছেন:

এই প্রাকৃতিক জলপ্রপাত শুধু তো জলপ্রপাত নয় এক

মহিমান্বিত

শঙ্কাহীন হৃদয়ের মতো,

দুর্বার সাহস,

যা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের ভেতর

সুন্দর শোভাপ্রদ অলঙ্কারের মতো

এক তানমধুর সঙ্গীতের মতো

আসলে
এই হল তুষারে ঢাকা তিব্বত আর তিব্বতের যৌবন যার
উচ্ছ্বাস প্রবল এই জলপ্রপাতের মতো…

আবার এক জায়গায় বলছেন, “অতীতের উজ্জলতা, গৌরব/ কী কাজে লাগবে আজ,/ গতকালের লবণাক্ত জল পারে কি আজকের তৃষ্ণা মেটাতে,/ ইতিহাসের ক্ষয়িত দেহ প্রাণহীন/ আজকের আত্মা যদি বাস না করে তাতে…”। পুরো কবিতাটি বড়, তাই সম্পূর্ণ অনুবাদ এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এই কবিতাটিকে আধুনিক তিব্বতি সাহিত্যের মাইলফলক ধরা হয়। ধোনডুপ গ্যেল শুধু কবিতাই লেখেননি। অনেক উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধও লিখেছেন। তার এক বিখ্যাত প্রবন্ধের নাম ‘কাং-লাম-ঠা-মো’— ‘সঙ্কীর্ণ হাঁটাপথ’ (རྐང་ལམ་ཕྲ་མོ་)। গল্পের ঢঙে লেখা এই প্রবন্ধে একটি ছোট্ট ছেলে রোজ একটি সরু হাঁটাপথ দিয়ে স্কুলে যায়। গ্রামের সবাই তাই করে। সে মনে মনে ভাবে, কেন, তারা গ্রামের নিচ দিয়ে নতুন তৈরি হওয়া বড় পথ কোনওদিন ব্যবহার করে না!

অনেকের কথাই এ আলোচনায় বলা হল না। তিব্বতি ভাষা ও সাহিত্যকে জানার কিঞ্চিৎ ইচ্ছেটা যখন পেয়ে বসল তখন আরও অনেক লেখা চোখে পড়েছে যার উল্লেখ করা উচিত ছিল। বিশেষ করে সম্প্রতি পড়া ৎসে-রিঙ্-ধোন-ডুক (ཚེ་རིང་དོན་གྲུབ)-র গল্পের কথা তো বলাই উচিত। আটের দশকের তিব্বতি সাহিত্য আন্দোলনে ৎসে-রিঙ্-ধোন-ডুক নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য নাম। ইংরেজি, ফরাসি অনেক ভাষাতেই অনুদিত হয়েছে তার গল্প। ২০১৯-এ প্রকাশিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত তার The Handsome Monk and Other Stories-এর গল্পগুলি তো আমি সকলকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আরেকজন যার গল্প পড়ে অভিভূত হলাম তিনি টাসি ডাওয়া (བཀྲ་ཤིས་ཟླ་བ་)। টাসি ডাওয়া-র শেকড় তিব্বতে হলেও লেখেন চিনা ভাষায়। A Soul in Bondage গল্পসঙ্কলনের গল্পগুলি তো এককথায় অনন্য। এসব লেখাপত্তর যত পড়ছি ততই মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষার পাঠকের সঙ্গে এই লেখকদের পরিচয় ঘটাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলা অনুবাদসাহিত্য এখন অনেকটাই সমৃদ্ধ। তিব্বতি ভাষা, সাহিত্যের সঙ্গে সেতুবন্ধন যে তাকে সমৃদ্ধতর করবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।