Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য: জনৈক অযোগ্যের শোক-স্মরণ

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য | দার্শনিক

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী

 

 

 

 

এ মাসের প্রথম রবিবারের (০২/১০/২০২২) সকালবেলায় চিরতরে চলে গেলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদী চিন্তা ও নাস্তিকতা বিষয়ক গবেষণার অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিকভাবে মান্য। আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে ওই বিষয়ের গবেষণা যিনিই করুন, শ্রীভট্টাচার্যের কাজের উল্লেখ না করে তা সুসম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব— এতটাই গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাজ। আর, যেহেতু কোনও নির্দিষ্ট সমাজে বস্তুবাদী চিন্তার বিকাশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে তার বৈজ্ঞানিক চিন্তা, অতএব তাঁর অনুসন্ধানকর্মের মধ্যে বিজ্ঞানের ইতিহাস এসে পড়াটা প্রায় অনিবার্য। এ ধরনের গবেষণাতে তাঁর পূর্বসূরি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল একই ঘটনা— প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদী চিন্তার অনুসন্ধানই তাঁকে করে তুলেছিল সমসময়ে ভারতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশের অন্যতম প্রধান ইতিহাসকারও। এ অনিবার্যতা মূর্ত হয়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থে (The Origin of Geometry in India) তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেছেন বৈদিক যুগের গণিতচর্চার কথা— পণ্ডিত বৌধায়নের সুবিখ্যাত ‘শুল্বসূত্র’ গ্রন্থে প্রকাশিত নানা জ্যামিতিক ধারণা ও হিসেব-নিকেশের বিশ্লেষণ। দশক খানেক আগে প্রকাশিত এই বইটিই বোধহয় তাঁর লেখা শেষ ইংরেজি বই। তার আগে ছিল আরও গোটা তিনেক, এবং তার মধ্যে দুটিই ছিল প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদী নাস্তিক চিন্তাধারা ‘চার্বাক দর্শন’ বিষয়ক। ‘Studies on the Carvaka/Lokayata’, এবং, ‘More Studies on the Carvaka/Lokayata’। আর, বাংলায় ‘চার্বাকচর্চা’ তো আছেই! বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার ইতিহাসের চর্চায় বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসঙ্গ এসে পড়ে যে অনিবার্যতায়, সে অনিবার্যতার এক মূর্ত দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করছে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের গবেষণাকর্ম।

তবে, এখানে এতক্ষণ ঠিক যেভাবে তাঁর কথা বলছি, তার মধ্যে একটা বিপদের সম্ভাবনা আছে— ভুল বোঝার বিপদ। যাঁরা শ্রীভট্টাচার্যের লেখালেখি সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত তাঁদের ক্ষেত্রে হয়ত সে বিপদের সম্ভাবনা ততটা নয়, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী (এবং, শিক্ষিত বাঙালির অন্তত নব্বই শতাংশ তাঁর নামই শোনেনি, আমি নিশ্চিত)। ওপরে যা বলেছি তাতে মনে হতে পারে, তিনি বুঝি বইয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকা এক কঠিন বিশেষজ্ঞ মাত্র, যিনি তাঁর সঙ্কীর্ণ অধ্যয়নের বাইরে আর তেমন কিছু নিয়েই ভাবিত নন। যদি কোনও পাঠকের সত্যিই এমনটা মনে হয়ে থাকে তো পরিষ্কার করে বলা দরকার, এ মনে হওয়াটা যারপরনাই ভুল, এবং প্রকৃত সত্যিটা তার ঠিক উল্টো। বাঙালির দৈনন্দিন যাপন, সংস্কৃতি, ধর্ম, যুক্তি-অযুক্তি, রাজনীতি— এইসব বিষয়ে এক অতিশয় চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন তিনি। পেশায় ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, এবং মার্ক্সীয় চিন্তার সংস্পর্শে এসেছিলেন অল্প বয়েসেই। ফলত, মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, ভাববাদ ও বস্তুবাদের মধ্যেকার দার্শনিক লড়াই, এই সব কিছুই ছিল তাঁর আলোচ্য বিষয়। মার্ক্সীয় ভাবনায় আকৃষ্ট বহু ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মী তাঁর লেখাপত্র পছন্দ করেন, স্বপ্রশিক্ষণের কাজে সেগুলোকে ব্যবহার করতে চান।

এবং, তিনি আন্তরিকভাবে ভাবিত ছিলেন এই আমাদের মত লোকজনের জন্যও। মানে, এই আমরা যারা মোটেই পণ্ডিত বা গবেষক বা ওই জাতীয় কিছু নই, অনেক পড়াশোনা করা বা নানা কঠিন বিষয় নিয়ে নিয়মিত চর্চা করা বা কোনও নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রচুর তথ্য এবং দীর্ঘ ও জটিল যুক্তিশৃঙ্খলা সহযোগে চিন্তার অভ্যেস যাদের পেশাগত বাধ্যবাধকতা নয়, অথচ আমরা যারা ধর্মান্ধতা অযুক্তি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করি, যুক্তিবাদী চিন্তা ও মনোভাবের প্রচার ও প্রসার চাই, মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে জাগিয়ে তুলতে চাই, সেইরকম লোকেদের কথা বলছি। তিনি বহু শ্রম ব্যয় করেছেন আমাদের মতন এই রকম সব লোকজনের মনের খাদ্য জোগাতে, আমাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে, আমাদের চিন্তাকে স্বচ্ছ ও যুক্তিকে ধারালো করে তুলতে। আমরা যাতে অযুক্তি, অন্ধত্ব আর ধূর্ত মস্তিষ্ক-প্রক্ষালনের বিরুদ্ধে ঠিকঠাক তর্ক করতে পারি, সেজন্য তিনি দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের মৌলিক ধারণাগুলো আমাদেরকে শেখাবার চেষ্টা করেছেন। ভাববাদী ও বস্তুবাদী চিন্তার তফাতটা কোথায়, যুক্তিবাদ কাকে বলে, কেন এসব এত জরুরি, এইসব। খুবই সহজ ভাষা ও ভঙ্গিতে এইসব লিখেছেন তিনি, এবং এমনকি, প্রায়শই, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কথোপকথনের আকারেও! আবার, এমনও নয় যে, তাঁর এ ধরনের লেখা সবই শুধু উচ্চমার্গের নানা তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে, দর্শনশাস্ত্র-ঘেঁষা। তিনি অনায়াসে লিখতেন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মীদের একেবারে খুঁটিনাটি নানা বিচিত্র বাস্তব সমস্যা নিয়েও। শহরতলির কোনও এক কোণে হয়তো আছে এক বিজ্ঞান ক্লাব, ছোট্ট। তার অল্প কয়েকজন সদস্য হয়ত প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে প্রতি বছরে একটি ছোট বিজ্ঞানমেলা বা প্রদর্শনী আয়োজন করে স্থানীয়ভাবে, তাদের তত্ত্বাবধানে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা সেখানে বিজ্ঞানের নানা বিষয় মডেল ও ছবি সহযোগে মেলায় আগত দর্শকদের কাছে ব্যাখ্যা করে। এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক দর্শক উভয়ের কাছেই বিজ্ঞানের মূল বার্তাটা মরমে পশিবে, এই যৎসামান্য মাত্র প্রত্যাশা এত পরিশ্রমের পেছনে। প্রতি বছরই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে মেলা উতরে যায়, আর তারপর শ্রান্ত ক্লান্ত উদ্যোক্তারা ভাবতে বসে, এই যে মুখে রক্ত তুলে এত সব করে যাই, আদৌ কি ফল কিছু হয় ছাই? হ্যাঁ, এই সমস্ত লোককে মানসিক ও নৈতিক শক্তি জোগানো এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্যেও সময় বার করেছেন এই সদাব্যস্ত পণ্ডিত গবেষক।

শ্রীভট্টাচার্য ছিলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও এক তন্নিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য গবেষক। বাঙালি মননে যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আজ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস-চর্চার এক অপরিহার্য উপাদান। এক আধুনিক জাতি হিসেবে বাঙালিকে গড়ে তোলার দুই মহত্তম কারিগর বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্ত নিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি, কিন্তু বহুসংখ্যক মৌলিক চিন্তাশীল প্রবন্ধ ও অন্যান্য খ্যাতিমান গবেষকদের কাজকর্মের অকাট্য সমালোচনার মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট চর্চার ক্ষেত্রে যে তীক্ষ্ণতা ও ঔজ্জ্বল্যের সঞ্চার তিনি করেছিলেন, তা আমাদের চিরকালীন বৌদ্ধিক সম্পদের অঙ্গ হয়েই থেকে যাবে। অমলেশ ত্রিপাঠির মত ওজনদার মূলস্রোত-ঐতিহাসিক যখন চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে ‘ট্র্যাডিশনাল মডার্নাইজার’-এর খাপে বসাতে, তখন তিনি সোচ্চারে বলেন, বিদ্যাসাগর ‘ট্র্যাডিশনাল’ না, পুরোদস্তুর ‘মডার্নাইজার’-ই, ব্যক্তিগত জীবনযাপনে সাহেবি কেতা বর্জন করেও। বিদ্যাসাগর-চর্চায় বিনয় ঘোষের মতো যে আইকন, তিনিও নিষ্কৃতি পাননি শ্রীভট্টাচার্যের হাত থেকে। বিনয় ঘোষের গবেষণা-পদ্ধতিতে যে পরস্পর-অসম্পৃক্ত নানা তাত্ত্বিক ধারার অসংশ্লেষণী মিশ্রণ ঘটেছে, এবং তার মধ্যেই কোথাও কখনও আবার অকস্মাৎ ঘটে গেছে মার্ক্সীয় তাড়নার বিসদৃশ প্রাবল্য, সে অভিযোগ সোজাসাপ্টা ভাবে ব্যক্ত করতে তিনি মোটেই দ্বিধা করেননি। ‘বিনয় ঘোষ গরম খেয়ে লিখলেন’ জাতীয় বিদ্রূপাত্মক ও তাচ্ছিল্য-সূচক উক্তি করতে বোধহয় একমাত্র তিনিই পারতেন, যে পারঙ্গমতা উৎসারিত হত তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাসী মেধা ও নৈতিক সাহস থেকে, এবং যার ছোঁয়া কখনও বুঝি বা টের পেতে হয়েছে অন্য লেখকদেরও।

এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী মেধা ও নৈতিক সাহসই তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকার প্রতি বিরাগ ও তাচ্ছিল্যের। বছর দুই আগে একটি বড়সড় সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্য-সংস্কৃতি পত্রিকার তরফে তাঁর কাছে ‘হেগেল’ বিষয়ে লেখার প্রস্তাব এলে তিনি তা কোন ভঙ্গিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সে গল্প ঘনিষ্ঠ ওয়াকিবহালদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পড়তে এসে পৌঁছেছিল আমার মতো নিতান্ত তুচ্ছ এক অপরিচিত অঘনিষ্ঠের কাছেও। অথচ, সদাব্যস্ত এই গবেষক প্রায় কখনওই ফেরাতেন না ছোট অবাণিজ্যিক পত্রিকাদের, এমনকি শেষের দিকে অশক্ত শরীরেও। অগুন্তি প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন এইসব পত্রিকায়, আর কীই বা তাদের অসামান্য বিষয়-বৈচিত্র্য! বিদ্যাসাগরীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে খাঁটি ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতার গভীর সাযুজ্য, বঙ্গদেশে যুক্তিবাদ ও নাস্তিকতার উদ্ভব ও বিকাশ, ক্রিকেট খেলার মূল্যবোধ, ‘কথামৃত’ গ্রন্থে সম্ভাব্য অসত্যকথন, বাংলার গ্রামীণ লোকধর্মে সামাজিক প্রতিবাদ, আল বেরুনির চোখে ভারতীয়দের যুক্তিবোধ, উত্তরাধুনিক বিজ্ঞান-সমালোচনার ফাঁক ও ফাঁকি, মহেশ যোগীর জোচ্চুরি! আর, প্রাচীন ভারতে ধর্ম ও যুক্তিবোধের সঙ্ঘাতের প্রসঙ্গ তো আছেই।

যতদূর শুনেছি, শেষের দিকে তাঁর শরীর হয়ে উঠছিল বয়সজনিত নানা সমস্যায় কাহিল। বিশেষত চোখের সমস্যায় নিজে আর লেখাপড়া করতে পারতেন না, তবুও ছাত্র ও অনুগামীদের সহায়তায় তা চলছিল মোটের ওপর, থামেনি। তিনি যে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, এটা ধরা পড়েছিল একেবারে সম্প্রতি, তখন আর চিকিৎসকদের সেভাবে কিছু করার ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর মরদেহ দান করা হয় নীলরতন সরকার হাসপাতালে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে। রবিবার এবং উৎসবের দিন হওয়ায় কিছু বিড়ম্বনা থাকলেও, শেষত দেহদানকার্য সুসম্পন্ন হয়।

আজ খুব বেশি করে মনে পড়ে, একদা এক অসৎ ব্যক্তির কুৎসিত প্ররোচনার শিকার হয়ে কিছু কর্কশ কথা তাঁর উদ্দেশে বলেছিলাম, আমাদের পত্রিকায়। সে লজ্জা আর অস্বস্তি আজও ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। তিনি হয়তো-বা ক্ষমা করে দিয়েছেন, কিংবা হয়তো আদৌ মনেই রাখেননি আমার মতো এক অতিতুচ্ছকে, এই ভরসায় থেকেছি এতকাল। তাই একান্তভাবে কামনা করি, আমার আজকের এ ক্ষুদ্র স্মরণ হয়ে উঠুক, নিছক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মাধ্যম নয়, পাপস্খালনের সুযোগও।